বাংলার অর্থ-প্রাচুর্যের সুখ্যাতি সুলতানি আমল থেকেই। মুঘল আমলে তা আরও সমৃদ্ধি পায়। স্বাভাবিকভাবেই রাজধানী ঢাকায় দস্যু ও অনুপ্রবেশকারীদের আগ্রাসন বেড়ে যায়। সেই সময় শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে পর্তুগিজ এবং মগ জলদস্যুরা প্রায়ই ঢাকায় প্রবেশ করত। একই নৌপথ দিয়ে ঢাকায় প্রবেশের সময় সোনারগাঁ ও বিক্রমপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতেও দস্যুরা লুটতরাজ চালাত। কৌশলগতভাবে এসব দস্যুতা প্রতিরোধে শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা ও ইছামতী নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে জলদুর্গ। শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রের প্রাচীন সংযোগস্থলে সোনাকান্দা দুর্গটি এর মধ্যে অন্যতম।
অবস্থান
সোনাকন্দা জলদুর্গটির অবস্থান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলায় শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে। ঢাকা থেকে ১৬.৮৩ কিলোমিটার দূরে বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের এনায়েত নগর গ্রামে এর অবস্থান। দুর্গটি বর্তমানে যেখানে রয়েছে সেটা একসময় শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থল ছিল। শীতলক্ষ্যার যেখান থেকে ত্রিবেণী খাল বেরিয়েছে তার ঠিক দক্ষিণে এটি নির্মিত হয়।
সোনাকান্দা দুর্গের নির্মাণকাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। হাসান (১৯০৪), তায়েশ (১৯৮৫), আহমেদ (১৯৯১) ও হুসেইনের (১৯৯৭) মতে, সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি মুঘল শাসনামলে সোনাকান্দা জলদুর্গটি নির্মিত হয়। তাদের মতে, মুঘল সুবেদার মীর জুমলা (১৬৬০-১৬৬৩) এই জলদুর্গটি নির্মাণ করেন। অন্যদিকে তাইফুরের (১৯৫৬) মতে, সোনাকান্দা দুর্গটি মুঘল যুগের আগে নির্মিত। তিনি মনে করেন, আরকানদের ওপর নজর রাখতেই তুর্কি বা পাঠান শাসকেরা দুর্গটি গড়ে তোলেন। তবে এই বিষয়ে খোদাইকৃত কোনো তথ্য না থাকায় সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল সোনাকান্দা দুর্গের নির্মাণকাল ঠিক কবে।
গঠন কাঠামো
সোনাকান্দা দুর্গটি দুটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত। চতুর্ভুজ আকৃতির সুরক্ষা প্রচীর নিয়ে একটি অংশ গঠিত। পূর্ব দিকে একটি কেন্দ্রীয় চত্বর এবং চত্বরটিকে ঘিরে থাকা চারটি অংশ নিয়ে সুরক্ষা প্রাচীরটি তৈরি। পশ্চিম দিকের কামান রাখার উঁচু মঞ্চ নিয়ে দুর্গের দ্বিতীয় অংশটি গঠিত। গোলাকার বিশাল সেই মঞ্চটি থেকে নদীপথে আগত শত্রুদের উদ্দেশে কামান দাগা হতো।
চতুর্ভুজাকৃতির দুর্গটির অভ্যন্তরীণ আয়তন ৮৬.৫*৫৭.০ মিটার। দুর্গের চারপাশের প্রাচীর ৩.৩৯ মিটার উঁচু এবং ১.০৬ মিটার পুরু। পুরু এই প্রাচীর ইট ও পলেস্তারা দিয়ে তৈরি। প্রাচীর তৈরিতে ব্যবহৃত ইটের আকার ১৯.০৫*৮.৮৯*৩.৮১ সেন্টিমিটার। শত্রুর ওপর হামলা চালানোর জন্য সুউচ্চ প্রতিরক্ষা প্রাচীরে প্রশস্ত-অপ্রশস্ত অসংখ্য ছিদ্র তৈরি করা হয়েছিল। এসব ছিদ্র দিয়ে শত্রুর ওপর বন্দুক এবং হালকা কামানের শেল নিক্ষেপ করা হতো। দুর্গে প্রবেশের একমাত্র প্রবেশদ্বারটি উত্তর দিকে অবস্থিত। গোলাপের নকশা করা প্রবেশ তোরণটি আয়তাকার একটি কাঠামোবিশিষ্ট। প্রতিপক্ষের ওপর গোলাবর্ষণের জন্য তোরণটির ওপরে কুলুঙ্গি তৈরি করা হয়েছিল। তোরণটি আটকে রাখতে ভারী হুড়কো ব্যবহার করা হতো।
দুর্গের পশ্চিম দিকে সুরক্ষা প্রাচীরের কাছে বিশাল আকারের কামান মঞ্চ রয়েছে। বড় বড় কামান দিয়ে সেই মঞ্চ থেকে শত্রুর ওপর আক্রমণ চালানো হতো। উঁচু সেই বেদিতে ওঠার জন্য সিঁড়ি রয়েছে। শত্রুকে প্রতিহত করতে কামানের পাশাপাশি বন্দুকও ব্যবহার করা হতো। দুর্গের প্রাচীর এবং প্রাচীরের ওপরে থাকা কুলুঙ্গিতে অসংখ্য ছোট-বড় ফোকর রয়েছে। সেসব ফোকর দিয়ে বন্দুক এবং হালকা কামানের গুলি ছোড়া হতো। কুলুঙ্গিগুলোর চূড়া থেকে ০.৯১ মিটার পর্যন্ত এসব ফোকর রয়েছে।
সোনাকান্দা দুর্গের আয়তাকার অংশের চারদিকে চারটি বুরুজ সংযুক্ত রয়েছে। গোলাকার এই বুরুজগুলোর মাথায় রয়েছে কুলুঙ্গি। প্রাচীরের ওপরে থাকা কুলুঙ্গির মতো এগুলোতেও অসংখ্য ফোকর রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের বুরুজ দুটি একই সমান। উভয়ের ব্যাস ৬.৮৫ মিটার এবং উচ্চতা ৩.৩৯ মিটার। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকের বুরুজ দুটি একই আকারের। এ দুটির উচ্চতা ৩.৩৯ মিটার এবং ব্যাস ৪.২৬ মিটার। ভেতরের দিকের একটি সংকীর্ণ হাঁটাপথ সংযুক্ত চারটি বুরুজের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। ২.৫ মিটার চওড়া এই হাঁটাপথটি দিয়ে বুরুজগুলো একটা আরেকটার সাথে যুক্ত।
এছাড়া দুর্গের চারদিকে যে চারটি বুরুজ রয়েছে সেগুলো সবই একই আকারের। অষ্টভুজাকৃতির এই বুরুজগুলোর ভেতরটা ফাঁপা। প্রতিটি বুরুজের চূড়ায় একই রকম দেখতে দুটি কুলুঙ্গি রয়েছে। গোলাবর্ষণের জন্য বুরুজগুলোর দেয়ালজুড়ে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির ফোকর রাখা হয়েছে। ফোকরগুলো বন্দুক ও কামান দাগার কাজে ব্যবহৃত হতো। বিভিন্ন ধরনের বন্দুক ও কামান ব্যবহার করা হতো বলে এসব ছিদ্রও একেকটা একেক আকৃতির। ফোকরের পাশাপাশি বুরুজগুলোতে একাধিক খিলানও রয়েছে।
মুঘল আমলে নির্মিত অন্যান্য জলদুর্গের মতো সোনাকান্দা দুর্গেরও অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর কামান মঞ্চ। কামান মঞ্চটি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুটি বেষ্টনী নিয়ে গঠিত। অভ্যন্তরীণ বেষ্টনীটির ব্যাস ১৫.২৪ মিটার এবং বাহ্যিক বেষ্টনীর ব্যাস ২১.৭৫ মিটার। কামান মঞ্চটিকে ঘিরে থাকা দেওয়ালের পুরুত্ব ০.৯১ মিটার। পুরু এই দেয়ালটির উপরে মোট ৩২টি কুলুঙ্গি রয়েছে। ফোকরযুক্ত এসব কুলুঙ্গি গড়ে ০.৯৭ মিটার চওড়া এবং ১.৯১ মিটার উঁচু। মাটি থেকে ৬.০৯ মিটার উঁচু গোলাকার মঞ্চটিতে ওঠার জন্য বেশ বড় একটি সিঁড়ি রয়েছে। ১৬.১৫ মিটার লম্বা তিন স্তরবিশিষ্ট সেই সিঁড়িতে ধাপ রয়েছে মোট ২৫টি। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ গড়ে ১৫ সেন্টিমিটার প্রশস্ত। এ ছাড়া সিঁড়িপথের শুরুতে পঞ্চমুখী একটি তোরণও আছে। বিশাল কামান মঞ্চটি ছাড়া গোটা দুর্গে আর কোনো স্থায়ী স্থাপনার সন্ধান পাওয়া যায়নি।