চন্দ্রবংশীয় রাজাদের আমলেই একাদশ শতকের প্রথমার্ধে প্রথম বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবারের নাম জানা যায়। তারাই হয়তো নগরটি প্রতিষ্ঠা করে থাকবেন। তবে প্রতিষ্ঠা যাদের হাতেই হোক, রামপালই মূলত নগরটির খ্যাতি ও মর্যাদার যথার্থ দাবিদার। হয়তো তিনিই একে বিস্তৃত ও সংস্কার করে নিজের নাম এর সাথে জড়িয়ে দিয়েছেন।
মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনী ও পাইকপাড়া গ্রামের অদূরেই ছিল রামপালের অবস্থান। এই রামপালেই প্রাচীনকালে গড়ে উঠেছিল প্রায় ১৫ বর্গমাইল জুড়ে প্রসিদ্ধ এক নগরী। রামপালের এই নগরী কালের গর্ভে আশ্রয় নিয়েছে বহু আগেই। এর ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্ব এখন অতীত। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বেশকিছু গ্রাম।
ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, সমগ্র স্থানটিই হয়তো এক সময় নিম্নভূমি ছিল। সে জন্যই বোধ হয় অসংখ্য ছোট-বড় দীঘি কেটে নগরভূমিকে সমতল উচ্চভূমিতে রূপ দেওয়া হয়েছিল। চতুর্দিক দিয়ে বেষ্টিত বিস্তৃত এই নগরীর মাঝখানে উঁচু স্থানে রাজপ্রাসাদের বিরাট ধ্বংস্তূপের চিহ্নও পরবর্তীতে পাওয়া যায়। স্থানীয়দের কাছে এটি বল্লাল বাড়ি নামে পরিচিত।
ইছামতীর ভূমিকা
রামপালে নগর প্রতিষ্ঠার পেছনে নদী যে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল, আরো স্পষ্ট করে বললে, রসদ জুগিয়েছিল তা অবিদিত নয়। কারণ রামপালের উত্তরেই ছিল ইছামতী নদী। নদীটির নিম্নপ্রবাহ এখন ধলেশ্বরীর প্রবাহের সাথে মিশে গেছে। পূর্বদিক দিয়ে বয়ে গেছে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের খাত। ব্রহ্মপুত্র যে একসময় এই নগরীর পূর্ব সীমা স্পর্শ করে প্রবাহিত হতো, এটা তারই প্রমাণ। রামপালের এই নগরীর পশ্চিম ও দক্ষিণে ছিল বিস্তৃত দুটি পরিখা, পরবর্তীতে যা মিরকাদিম ও মকুহাটি খাল নামে পরিচিতি পায়।
যা-ই হোক, ইছামতীর প্রাচীন খাত থেকে একটি সুপ্রশস্ত রাজপথ নগরটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে একেবারে সোজা দক্ষিণ-সীমা পর্যন্ত চলে যায়। এই প্রধান রাজপথ থেকে পূর্ব ও পশ্চিমে অনেকগুলো পথ বের হয়ে একেবারে সোজা পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
কার হাতে প্রতিষ্ঠা
বল্লাল বাড়ি নামটি তো বল্লাল সেনের স্মৃতিবিজড়িত। তাহলে নগরীর নাম রামপাল কেন? প্রতিষ্ঠাতাই বা কে? যথেষ্ট যুক্তি আছে এই বিতর্কে। তবে নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব’ গ্রন্থে এ নিয়ে যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তা খানিকটা এ রকম পালরাজ রামপাল যদি নগরীটির পত্তন নাও করে থাকেন তাহলে তিনি একে প্রতিষ্ঠা দান করেছিলেন।
আবার এই রামপালই যে চন্দ্র-বর্মণ-সেন-দেববংশের লিপিগুলোয় উল্লেখিত ‘শ্রীবিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবার’ সেটাও মনে হয়েছে নীহাররঞ্জন রায়ের। তার মতে, সমগ্র বিক্রমপুর পরগনায় এমন সুপ্রশস্ত এবং ভৌগোলিক দিক থেকে সুবিন্যস্ত ও সুরক্ষিত নগরের ধ্বংসাবশেষ আর কোথাও আবিষ্কৃত হয়নি। রামপালের (একাদশ শতকের শেষার্ধ) নাম ও স্মৃতির সাথে জড়িত বলে এই অনুমান আরো বেশি প্রণিধানযোগ্য।
নগরটির পত্তন সম্পর্কে আরেকটু অগ্রসর হয়ে এই ইতিহাসবিদ বলেছেন, চন্দ্রবংশীয় রাজাদের আমলেই প্রথম বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবারের নাম জানা যায় (একাদশ শতকের প্রথমার্ধ)। তারাই হয়তো নগরটি প্রতিষ্ঠা করে থাকবেন। তবে প্রতিষ্ঠা যাদের হাতেই হোক, রামপালই মূলত নগরটির খ্যাতি ও মর্যাদার যথার্থ দাবিদার। হয়তো তিনিই একে বিস্তৃত ও সংস্কার করে নিজের নামের সাথে জড়িত করেছেন।
রামপাল ছিলেন বাংলায় পাল বংশের অন্যতম রাজা, যিনি রামপাল দেব নামেও পরিচিত ছিলেন। রামচরিতের বর্ণনা থেকে যা জানা যায়, তা হলো দ্বিতীয় শূরপালকে কোনো উপায়ে সরিয়ে তিনি পৈত্রিক রাজ্যাধিকার প্রাপ্ত হয়েছিলেন। রামপালের অভিষেককালে পাল রাজাদের রাজত্ব সম্ভবত ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যবর্তী বদ্বীপে সীমাবদ্ধ ছিল।
রামপাল কৃতী পুরুষ ছিলেন এবং বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। নির্বাসন জীবন শুরু করে বিদ্রোহীদের হাত থেকে পিতৃভূমি বরেন্দ্রী উদ্ধার, বাংলার অধিকাংশ পুনরুদ্ধার, উড়িষ্যা ও কামরূপে আধিপত্য বিস্তার এবং একাধিক বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়েও পালরাজ্য ও রাষ্ট্রের সীমা এবং আধিপত্য আমৃত্যু অক্ষুন্ন রাখেন। এসবই তার রাষ্ট্রবুদ্ধি, দৃঢ়চরিত্র ও শৌর্যবীর্যের পরিচায়ক। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আদর্শ বা সামাজিক ব্যবস্থার সময়োপযোগী পরিবর্তন না হলে শুধু ব্যক্তিগত চরিত্রের গুণে রাজ্য বা রাষ্ট্রকে বিনষ্টের হাত থেকে বাঁচানো যায়নি। এটা মহীপালের মতো সম্রাটের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, একইভাবে সত্য রামপালের ক্ষেত্রেও। পরে পরিণত বার্ধক্যে রামপাল মাতুল মথনের মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পেরে গঙ্গায় আত্মবিসর্জন করেন।
বল্লাল সেনের বাড়ির সন্ধান
রামপাল ইউনিয়নের বল্লাল বাড়ি গ্রামে খননকাজ করে সেন রাজা বল্লাল সেনের প্রাচীন প্রাসাদের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল বল্লাল বাড়ি গ্রামের একটি পানের বরজের মাটি খুঁড়ে প্রত্ননিদর্শনটির সন্ধান পায়। প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা, সেন বংশের রাজা বল্লাল সেনের দুর্গ-প্রাসাদ ছিল এটি।
খনন করে যে দুর্গটি পাওয়া যায়, সেটি অনেকটা বর্গাকার। এর প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ২৭২ মিটার। দুর্গের চারদিকে পরিখা ছিল, যা প্রায় ৬০ মিটার প্রশস্ত। রামপাল কলেজের কাছে এখনো একটি পরিখার চিহ্ন বর্তমান। বাকিগুলো ভরাট করে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, দোকানপাট নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রত্ননিদর্শনটি সম্পর্কে সুফি মুস্তাফিজুর রহমান সে সময় বলেন, বল্লাল সেনের এই প্রাসাদ একটি দুর্গ। কিন্তু খনন না করার কারণে আগে এর সন্ধান পাওয়া যায়নি। মাটির দু-তিন ফুট নিচে প্রাচীন ইট, ইটের টুকরো, মৃৎপাত্রের টুকরো ও কাঠ-কয়লা পাওয়া গেছে। এগুলো পাওয়া যায় প্রথম খননে। পরবর্তী সময়ে বিস্তৃত আকারে খনন করলে দেয়াল বেরিয়ে আসে। খননকাজ চালিয়ে গেলে হয়তো বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ, মন্দির, রাস্তাঘাটসহ সবকিছু পাওয়া যাবে।
বল্লাল সেন ছিলেন সেন রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা ও সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেনের পুত্র। বাংলায় তার শাসনকাল ছিল ১১৬০ থেকে ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ। লক্ষ্মণ সেন ছিলেন বল্লাল সেনের ছেলে। বল্লাল সেনের নামেই মুন্সিগঞ্জের এই গ্রামটির নাম বল্লাল বাড়ি।