মুঘল বাংলা ছিল ইউরোপীয় বণিকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে। আর রাজধানী ঢাকা ছিল সুবাহ বাংলার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। নদীবেষ্টিত হওয়ায় ঢাকার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনও ছিল বেশ সুবিধাজনক। এসব কারণে পর্তুগিজ ও ইংরেজ বণিকদের পাশাপাশি ডাচ, ফরাসি, আর্মেনিয়ান এবং গ্রিক বণিকেরাও ঢাকার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এসব দেশের বণিকেরা তখন ঢাকায় নিজ নিজ বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলেন। শিল্প বাণিজ্যের এ প্রসার সে সময় বণিকদের পাশাপাশি দস্যুদেরও ঢাকা তথা বাংলাকে সমানভাবে আকৃষ্ট করে তোলে।
পর্তুগিজ, মগ ও আরকানিজ দস্যুদের কাছ থেকে ঢাকাকে রক্ষার জন্য মুঘলরা তখন নদীকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। দস্যু ও অনুপ্রবেশকারীদের আগ্রাসন ঠেকাতে চার স্তরের নিরাপত্তা কৌশল অবলম্বন করেন মুঘল সুবেদার মীর জুমলা (১৬৬০-১৬৬৩)। তার এই চার স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা কৌশলের প্রথম ধাপটিকে বলা হতো ত্রিভুজ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ত্রিভুজাকৃতির এই নিরাপত্তাব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুর দুর্গ।
সুবেদার মীর জুমলার ত্রিভুজাকৃতির নিরাপত্তাব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছিল মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুর দুর্গটিকে কেন্দ্র করে। মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, ইছামতী ও ধলেশ্বরীর সংযোগস্থলে দুর্গটি অবস্থিত। ঢাকা থেকে ২৩.৪৮ কিলোমিটার দক্ষিণে ইছামতীর উত্তর তীরে ছিল দুর্গটির অবস্থান। পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বর্তমানে দুর্গ থেকে নদী ১.৬ কিলোমিটার উত্তরে সরে গেছে। মধ্যযুগে মুঘল শাসকেরা ইছামতী নদী দিয়েই ঢাকায় প্রবেশ করতেন। ঢাকায় প্রবেশের জন্য জলদস্যুরাও সেই একই পথ ব্যবহার করত। যার ফলে মগ জলদস্যু ও পর্তুগিজদের আক্রমণ থেকে ঢাকাকে রক্ষা করতে মুন্সিগঞ্জের প্রাণকেন্দ্রে ইদ্রাকপুর জল দুর্গটি তৈরি করা হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত হওয়ায় তিনটি দুর্গের মধ্যে সবচেয়ে নবীন হওয়া সত্ত্বেও ঢাকার নৌ-নিরাপত্তাব্যবস্থায় এই দুর্গটির কৌশলগত গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি।
দুর্গটির নির্মাণকাল সম্পর্কে লিখিত কোনো দলিল পাওয়া যায়নি। তবে এর নির্মাণশৈলীর প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন, সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে দুর্গটি নির্মাণ করা হয়। তাইফুর (১৯৫৬), দানি (১৯৬১) এবং আহমেদের (১৯৮৪) মতে, ১৬৬০ সালে মীর জুমলা ইদ্রাকপুর দুর্গটি নির্মাণ করেন। বেঙ্গল সরকারের গণপূর্ত বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘প্রাচীন বাংলার স্মৃতিস্তম্ভসমূহ’-এর তালিকা অনুযায়ী মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে (১৬৫৯-১৭০৭) এই দুর্গটি নির্মাণ করা হয়।
ইট ও চুনাপাথরের পলেস্তারা দিয়ে তৈরি ইদ্রাকপুর দুর্গটি পূর্ব ও পশ্চিম দুটি অংশ নিয়ে গঠিত। অংশ দুটি একটি বিভাজন প্রাচীর দ্বারা বিভক্ত। দুর্গের পশ্চিম অংশটি ৯৭ মিটার × ৫১.৮০ মিটার এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে। সুউচ্চ প্রাচীরে ঘেরা এ অংশের চার কোনায় চারটি গোলাকৃতি বুরুজ রয়েছে। প্রতিটি বুরুজের ব্যাস ৬.০৯ মিটার এবং উচ্চতা ৪.৬০ মিটার। শত্রুপক্ষের ওপর গোলা নিক্ষেপ করার জন্য বুরুজগুলোতে অসংখ্য চতুষ্কোনাকৃতির ফোকর রয়েছে।
অন্যদিকে দুর্গের পূর্ব অংশ এর পশ্চিমাংশের চেয়ে আকারে অনেকটাই ছোট। প্রাচীরসহ এ অংশের অভ্যন্তরীণ আয়তন ৭৭ মিটার × ৪৪ মিটার। এই অংশের মাঝে একটি গোলাকার উঁচু মঞ্চ এবং উত্তর-পূর্ব কোনায় একটি ছোট বুরুজ রয়েছে। গোলাকার এই মঞ্চটিই ইদ্রাকপুর দুর্গকে কৌশলগতভাবে এক অনন্য অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিল। ৩২.৯১ মিটার ব্যাসের গোলাকার মঞ্চটির উচ্চতা ২৪ মিটার। গোলাকার এই মঞ্চটিতে ভারী কামান রাখা হতো। নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করার জন্য মঞ্চের পাশাপাশি দুর্গ প্রাচীরে গোলা নিক্ষেপের জন্য অসংখ্য ফোকর রাখা হয়েছিল। মঞ্চে ওঠার জন্য দুর্গের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের পূর্বদিকে একটি সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়িটি ১.৯ মিটার প্রশস্ত এবং ১৮.২৬ মিটার দীর্ঘ।
এছাড়া আরও একটা সিঁড়ি আছে যা মঞ্চের নিচে থাকা ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। কক্ষটিকে দুর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে নয় ধাপবিশিষ্ট সিঁড়ির শেষ মাথায় লোহার গ্রিল লাগানো ছিল। ভূগর্ভস্থ কক্ষটি ঠিক কী কাজে ব্যবহৃত হতো সে সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। আয়েশার (১৯৯১) মতে, অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ রাখতে অস্ত্রাগার হিসেবে কক্ষটি ব্যবহার করা হতো। তবে বন্দুক, তলোয়ার রাখা গেলেও ভূগর্ভস্থ কক্ষটি বারুদের মতো দাহ্য পদার্থ মজুদের জন্য আদর্শ স্থান ছিল না। এ কারণে অস্ত্রাগারের ধারণাটা অনেকাংশই অসম্ভব বলে বিবেচিত হয়। তবে অস্ত্রাগার না হলেও একসময় এটি হয়তো আড়ত হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
অন্যদিকে মঞ্চের ওপরের অংশের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ কক্ষটির কোনো যোগাযোগ না থাকায় কক্ষটিকে অনায়াসে দুর্গের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। দুর্গের সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান হবার কারণে অনেকের মতে, কক্ষটি সম্ভবত কারাগার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এমনকি অনেকে ধারণা করেন যে এটি একটি গণশৌচাগার ছিল। উল্লেখিত ধারণাগুলোর সপক্ষে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ না থাকায় এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যায় না। তবে মুঘল আমলে বারুদের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং দুর্গটিতে বড় বড় কামানের উপস্থিতি থাকায় এটা ধারণা করা যেতেই পারে যে কক্ষটি মূলত অস্ত্রাগার হিসেবেই ব্যবহৃত হতো।
দুর্গের উত্তর দিকে এর একমাত্র প্রবেশদ্বারটির অবস্থান। ২.১০ মিটার চওড়া প্রবেশদ্বারটি আয়তাকার কাঠামোর ভেতর বসানো হয়েছে। প্রবেশদ্বারের খিলানে কুলুঙ্গিও রয়েছে। প্রবেশদ্বারের বাইরের দিকটা সজ্জিত থাকলেও ভেতরের দিকে কেবল পলেস্তারার আস্তরণ।