বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
16 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বড় কাটরা: বুড়িগঙ্গা তীরে অনন্য মুঘল কীর্তি

বড় কাটরা নির্মিত হয়েছিল সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজার আদেশে। তার আদেশে মীর-ই-ইমারত বা প্রধান স্থপতি মীর মুহাম্মদ আবুল কাশেম এর নির্মাণ সম্পন্ন করেন। বড় কাটরা মুঘল আমলের অন্যতম নান্দনিক স্থাপত্যকীর্তি হলেও এর নির্মাণকাজ সম্রাট-তনয়ের মনমতো না হওয়ায় তা আবুল কাশেমকে দান করেন বলে কথিত আছে।

কাটরা শব্দটি এসেছে আরবি ‘কাতার’ বা ‘কাতারা’ থেকে, যার অর্থ খিলানযুক্ত ভবন। আরবি ও ফারসি সাহিত্যে এর উল্লেখ পাওয়া যায় ‘ক্যারাভান সরাই’ বা ‘সরাইখানা’ হিসেবে। সংস্কৃতিও এ ধরনের শব্দের অস্তিত্ব রয়েছে, যার অর্থ ছাতা। অর্থাৎ কাটরা হলো পথচারী, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের জন্য নির্মিত সরাইখানা, যা সাধারণত একটি অঙ্গনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। অঙ্গনের চারদিকে নির্মিত হয় বারান্দা এবং এরপরে একাধিক কক্ষ। কক্ষে পথচারী ও ব্যবসায়ীরা রাত যাপন করতেন এবং তাদের যানবাহনের পশু ও ভ্রমণের অন্যান্য সরঞ্জাম রাখা হতো অঙ্গনে। এগুলো গড়ে উঠত বাণিজ্যপথ ধরে। অর্থাৎ বাণিজ্য যত প্রসারিত হয়েছে এর পথ ধরে গড়ে উঠেছে কাটরা। বাংলাও এর বাইরে ছিল না। বাণিজ্যের সুবিধার্থে বাংলাদেশেও কাটরা নির্মিত হয়। মুঘল শাসনামলে ঢাকায় নির্মিত দুটি কাটরার নাম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এর একটি নির্মিত হয় ঢাকার চকবাজারের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে, যা বড় কাটরা নামে পরিচিত।

নির্মাতা ও নির্মাণ

বড় কাটরার নির্মাতা ও নির্মাণ সময় নিয়ে একাধিক মত আছে। লিস্ট অব অ্যানশন্ট ডকুমেন্টসে এটি কুমার আজিম উশ্বানের নির্দেশে নির্মিত হয় বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু তথ্যটি সঠিক নয়। কারণ আজিম উশ্বান ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের পৌত্র এবং যেই সময় বড় কাটরা নির্মিত হয় সেই সময় তার জন্ম হয়নি। সুতরাং তার আদেশক্রমে যে এই নান্দনিক কীর্তি গড়ে ওঠেনি জোর দিয়েই তা বলা যায়।

প্রকৃত ইতিহাস হলো বড় কাটরা নির্মিত হয়েছিল সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজার আদেশে। তার আদেশে মীর-ই-ইমারত বা প্রধান স্থপতি মীর মুহাম্মদ আবুল কাশেম এর নির্মাণ সম্পন্ন করেন। বড় কাটরা মুঘল আমলের অন্যতম নান্দনিক স্থাপত্যকীর্তি হলেও এর নির্মাণকাজ সম্রাট-তনয়ের মনমতো হয়নি বলে কথিত আছে। এ কারণে স্থাপত্যটি কাটরা হিসেবে ব্যবহারের জন্য আবুল কাশেমকে দান করেছিলেন। তবে এজন্য কিছু শর্ত তিনি আরোপ করেছিলেন। তা হলো এ ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা কাটরায় অবস্থান করার যোগ্য কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো ধরনের ভাড়া নেবেন না। এ কারণেই কাটরার ব্যয় নির্বাহের জন্য ২২টি দোকান ওয়াকফ করে দেওয়া হয়।

কাটরাটির নির্মাণকাল নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন তথ্য রয়েছে। যতীন্দ্রমোহন রায় তার ঢাকার ইতিহাস গ্রন্থে বড় কাটরার নির্মাণকাল হিসেবে ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে হান্টারের দাবি বিবেচনায় নিলে বড় কাটরার নির্মাণকাল ধরতে হয় ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ। আবার বড় কাটরায় ফারসি ভাষায় যে দুটি শিলালিপি আছে তার একটিতে এর নির্মাণকাল হিসেবে ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ (১০৫৩ হিজরি) উল্লেখ আছে। অন্যটিতে ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে (১০৫৫ হিজরি) যুবরাজ শাহ সুজা স্থাপত্যটি কাটরা হিসেবে ব্যবহারের জন্য মীর আবুল কাশেমকে দান করেন বলে উল্লেখ আছে।

নির্মাণশৈলী

অট্টালিকাটির নির্মাণশৈলী ছিল অত্যন্ত সুন্দর। সেই সাথে সুদৃঢ়। ঢাকার ইতিহাস গ্রন্থে বড় কাটরার নির্মাণশৈলীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘বুড়িগঙ্গার সম্মুখস্থিত প্রকাণ্ড তোরদ্বার এবং তৎপাশর্বর্তী অপেক্ষাকৃত অল্পায়তনবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারগুলি অষ্টকোণসমন্বিত উচ্চ চূড়াদ্বয় আজিও অতীতের স্মৃতি বক্ষে ধারণ করিয়া ঢাকার প্রাচীন সমৃদ্ধি গৌরব ঘোষণা করিতেছে।’ এর সৌন্দর্য বর্ণিত হয়েছে এভাবে ‘বুড়িগঙ্গার গর্ভ হইতে ইহার প্রশস্ত তোরণদ্বয় এবং উন্নত ও সুদৃঢ় প্রাচীরের সুবিশাল দৃশ্য একখানা চিত্রপটের ন্যায় প্রতীয়মান হয়।’

বাংলাপিডিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, বড় কাটরা চতুর্ভুজাকৃতির একটি অঙ্গনকে বেষ্টন করে নির্মিত হয়েছিল। এর প্রতি পাশ্বে ২২টি কক্ষ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি অত্যুচ্চ প্রবেশপথ ছিল। বড় কাটরার সম্মুখভাগ ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে। এ কারণে এর দক্ষিণাংশ জমকালো করে পরিকল্পনা এবং মুঘল রীতিতে শিল্পবিন্যাস করা হয়েছিল। বড় কাটরার উত্তরাংশ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও দক্ষিণাংশের কাঠামো এখনো বিদ্যমান। পূর্ব ও পশ্চিমাংশেরও সামান্য কিছু অবশেষ আছে। দক্ষিণাংশের দৈর্ঘ্য ৬৭ দশমিক ৯৭ মিটার। এ অংশের মাঝখানে রয়েছে সুউচ্চ ও ও সুগঠিত ত্রিতল প্রবেশপথ। এ প্রবেশপথ ছিল অতি মনোমুগ্ধকর এবং এটি দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার দিকে প্রায় ৭ দশমিক ৬২ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১২ দশমিক ১৯ মিটার প্রসারিত ছিল। এই প্রবেশপথের দুই পাশে ছিল দুটি প্রহরী কক্ষ, যার আয়তন ছিল পূর্ব-পশ্চিমে ৫ দশমিক ৫ মিটার/২ দশমিক ৯ মিটার। এর পরেই ছিল অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আয়তনের তিনটি প্রবেশপথ।

চারটি প্রবেশপথের পরেই ছিল অষ্টকোণাকৃতির একটি হল কামরা। এর ওপরের ছাদ ছিল গম্বুজাকৃতির এবং তাতে পলেস্তারার ওপর নানা রকম লতাপাতা ইত্যাদির সুন্দর অলংকরণ ছিল। এ হল কামরার মাঝামাঝি অংশের সোজা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ছিল পর পর দুটি করে কামরা। কাটরার ভেতর দিকে দোতলা ও তিনতলায় ওঠার সিঁড়ি আছে। ওপরে দোতলায় ও তিনতলায় নির্মিত ছিল বসবাসের কক্ষ। শুধু প্রবেশপথের ওপরের অংশই ছিল তিনতলাবিশিষ্ট। তিনতলার কক্ষসমূহ চতুষ্কোণাকার এবং অশ্বক্ষুরাকৃতি ফ্ল্যাট আর্চ সংবলিত ছিল। কাটরার বাকি অংশ ছিল দ্বিতল।

উদ্দেশ্য ও ব্যবহার

যুবরাজ শাহ সুজার বাসভবন হিসেবে বড় কাটরা নির্মাণ করা হয়েছিল। স্থান হিসেবে বুড়িগঙ্গার তীরকে বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ হলো নদীপথে ঢাকার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা। মুঘল শাসনামলে শত শত যাত্রী সরাইখানা হিসেবে ব্যবহৃত এই অট্টালিকায় আশ্রয় নিতেন এবং খাবার ও পানীয় গ্রহণ করতেন। সুবাদার মীর জুমলা বড় কাটরাকে নিজের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করেন। এর তোরণদ্বারে প্রকাণ্ড দুটি কামানও স্থাপন করেছিলেন তিনি।

নির্মাণের উদ্দেশ্য ও ব্যবহার যাই হোক বড় কাটরা এখনো মুঘল স্থপতি আবুল কাশেমের অসাধারণ শিল্পচাতুর্যের সাক্ষী হয়ে আছে। এটি বাংলাদেশে মুঘল আমলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here