বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
16 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

জাহাজঘাট: পঞ্চদশ শতকের বিলুপ্ত এক নদীবন্দর

যশোর শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার উত্তরে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় ভৈরব নদের উত্তর তীরে বারোবাজার ইউনিয়নের হাসিলবাগ গ্রামে সন্ধান মিলেছে পঞ্চদশ শতকের বিলুপ্ত এক ঘাটের। জাহাজঘাট নামে পরিচিত ঘাটটি সেই সময় নদীবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

বারোবাজার নাকি বড়বাজার তা নিয়ে বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি। অনেকের মতে, প্রসিদ্ধ বারোটি বাজার ছিল, তাই নাম বারোবাজার। কারও মতে, বড়বাজার। কেউ কেউ আবার বলেন, খানজাহান আলী ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বারোজন আউলিয়া নিয়ে এখানে এসেছিলেন। সেই কারণেই জায়গাটির নাম বারোবাজার। এটিই এখন পর্যন্ত বহুল প্রচলিত মত।

ঐতিহাসিকদের মতে, পাল ও সেন আমলে এই অঞ্চল তাদেরই অধীনে ছিল। স্থানটি প্রথমবারের মতো মুসলিমদের অধিকারে আসে সুলতান জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ শাহর আমলে। তার সময়ই খানজাহান আলী (১৪২৮—১৪৩২) বারোবাজার এলাকায় এসে অবস্থান নেন এবং অনেক মসজিদ নির্মাণ করেন। যদিও সেসব মসজিদের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। যেসব মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে সেগুলোর স্থাপত্য শৈলীর সাথে খানজাহান আলী নির্মিত মসজিদের কোনো মিল নেই। তবে, খানজাহান আলীর বারোবাজারে অবস্থানকালে এটি নামকরা বন্দর ছিল। সেই সাথে বড় বড় অনেক দিঘিও খনন করেন তিনি। স্থানীয় অধিবাসীদের মতে, এর সংখ্যা ছয় কুড়ি।

সতীশচন্দ্র মিত্রও তার গ্রন্থে অনেকগুলো দিঘির উল্লেখ করেছেন। রাজমাতার দিঘি, সওদাগর দিঘি, পীরপুকুর, মীরের পুকুর, ঘোমারি পুকুর, চেরাগদানী দিঘি, গলাকাটার দিঘি, ভাইবোন পুকুর, মিঠাপুকুর, পাঁচ পীরের দিঘি, হাঁসপুকুর, শ্রীরাম রাজার দিঘি, বেড় দিঘি, ফেনঢালা, চাউল ধোওয়া, কোদাল ধোওয়া এর মধ্যে অন্যতম। যদিও এসব দিঘি ও পুকুরের অধিকাংশেরই এখন আর অস্তিত্ব নেই। সতীশ চন্দ্র মিত্র তার ‘যশোর—খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে এই বারোবাজারকে প্রাচীন সমতটের রাজধানী উল্লেখ করেছেন।

ঐতিহাসিক হোসেনউদ্দীন হোসেন তার ‘যশোরাদ্য দেশ’ গ্রন্থে বারোবাজারকে উল্লেখ করেছেন গঙ্গারিডি রাজ্যের রাজধানী হিসেবে। তার বয়ানে, পিরোজপুর, বাদুড়গাছা, খোসালপুর, সাদেকপুর, এনায়েতপুর, মুরাদগড়, রহমতপুর, মোল্লাডাঙ্গা, বাদেডিহি, বারোবাজার, দৌলতপুর ও সাদগাছি—এই ১২টি বাজার নিয়ে প্রসিদ্ধ ছিল বারোবাজার, যার আয়তন ১০ বর্গমাইল।

এই বারোবাজারের অবস্থান যশোর শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার উত্তরে যশোর—ঝিনাইদহ মহাসড়কের উপরে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়। এর পাশ দিয়েই এক সময় প্রবহমান ছিল বিশাল ভয়ঙ্করী ভৈরব নদ। এই নদেরই উত্তর তীরে বারোবাজার ইউনিয়নের হাসিলবাগ গ্রামে সন্ধান মিলেছে পঞ্চদশ শতাব্দীতে নির্মিত বিলুপ্ত এক ঘাটের। জাহাজঘাট নামে পরিচিত এই ঘাটটি সে সময় নদীবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

জাহাজঘাটের সন্ধান যেভাবে

এক সময় স্থানটিতে মাটির বড় বড় ঢিবি ছিল। স্বাভাবিকভাবেই এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন থাকতে পারে, এই ধারণা থেকে ১৯৬১ সালে জরিপ পরিচালনা করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এবং আশির দশকে খননকাজ চালায়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননে একটি চতুভুর্জাকৃতির কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়, ১৯৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি যা গেজেটভুক্ত হয়।

নদী—তীরবর্তী এই কাঠামোর অস্তিত্ব, কাঠামোর প্রকৃতি ও জনশ্রুতি থেকে ধারণা করা হয় যে, বারোবাজারে সুলতানি আমলে অর্থাৎ ১৫ শতকে নির্মিত একটি বন্দর ছিল। ঢিবি খননের পর প্রত্নত্ত্ববিদরা বারোবাজারের নাম দেন শহর মুহাম্মদাবাদ।

অবস্থান ও বর্ণনা

আয়তাকৃতির এই ঢিবিটি পূর্ব—পশ্চিমে ২৯ মিটার দীর্ঘ এবং উত্তর—দক্ষিণে ২০ মিটার প্রশস্ত। নদীর তল থেকে এর উচ্চতা আনুমানিক ৩ মিটার। ঢিবির পূর্ব—দক্ষিণে, পূর্ব—পশ্চিমে ও উত্তর—দক্ষিণে বিস্তৃত দুটি দেওয়া লের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আগে হাসিলবাগ গড় বলা হলেও লোকজন এখন এটিকে জাহাজঘাট নামেই চেনে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জাহাজঘাট সংরক্ষণ করছে।

ইতিহাস খুঁড়ে দেখা যায়, একসময় ভয়ঙ্কর ভৈরব নদ এখান দিয়েই প্রবহমান ছিল এবং তার তীরেই গড়ে উঠেছিল জাহাজঘাট বন্দর। এই বন্দর দিয়ে এক সময় উৎকৃষ্টমানের মসলিনও রপ্তানি হয়েছে। কথিত আছে, বণিক চাঁদ সওদাগর এই বন্দর ব্যবহার করেই বাণিজ্যে বসতি গড়েন। সুবিদপুর গ্রামে নাকি চাঁদ সওদাগরের দুইটি জাহাজ নিমজ্জিত হয়েছিল।

ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় যখন বলেন—‘এই কোমল, নরম ও নমনীয় ভূমি লইয়া বাঙলার নদ—নদীগুলি ঐতিহাসিক কালে কত খেলাই না খেলিয়াছে; উদ্দাম প্রাণলীলায় কতবার যে পুরাতন খাত ছাড়িয়া নূতন খাতে, নূতন খাত ছাড়িয়া আবার নূতনতর খাতে বর্ষা ও বন্যার বিপুল জলধারাকে দুরন্ত অশ্বের মতো, মত্ত ঐরাবতের মতো ছুটাইয়া লইয়া গিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। এই সহসা খাত পরিবর্তনে কত সুরম্য নগর, কত বাজার—বন্দর, কত বৃক্ষশ্যামল গ্রাম, শস্যশ্যামল প্রান্তর, কত মঠ ও মন্দির, মানুষের কত কীর্তি ধ্বংস করিয়াছে, আবার নূতন করিয়া সৃষ্টি করিয়াছে, কত দেশখণ্ডের চেহারা ও সুখ—সমৃদ্ধি একেবারে বদলাইয়া দিয়াছে তাহার হিসাবও ইতিহাস সর্বত্র রাখিতে পারে নাই। প্রকৃতির এই দুরন্ত লীলার সঙ্গে মানুষ সর্বদা আঁটিয়া উঠিতে পারে নাই, অনেক সময়ই হার মানিয়াছে।’’—তখন আর বলতে দ্বিধা থাকে না যে, বারোবাজারও উন্মত্ত ভৈরবের দুরন্ত লীলার সাথে পেরে ওঠেনি; হার মেনেছে। হারিয়ে গেছে এক সময়ের সমৃদ্ধ বন্দর জাহাজঘাট। টিকে আছে কেবল ইতিহাসটুকুই একদা এই ভৈরবের তীরে এই বারোবাজারকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ নগর।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here