এগারসিন্দুর ষোড়শ শতকে নির্মিত একটি জলদুর্গ। দুর্গটি তিন দিকেই নদী পরিবেষ্টিত ছিল। মাটির দেয়ালে ঘেরা দুর্গের ভিত প্রায় ৬০ ফুট চওড়া। প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে দুর্গের পশ্চিম দিকে ছিল একটি পরিখা। মুঘল সুবেদার ইসলাম খান অহোমদের পরাজিত করে দুর্গটিকে ধ্বংস করে দেন।
১১টি নদীর মোহনায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে উঁচু-শক্ত-লাল মাটির অঞ্চল। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যেমন উপযোগী, বসবাসের জন্যও তা-ই। পরিচিতি তাই গঞ্জের হাট নামে। প্রসিদ্ধিও কম নয়। যে ১১টি নদীর সঙ্গমস্থলে এলাকাটির অবস্থান সেই নদীগুলোকে তখনকার লোকজন আখ্যায়িত করেন সিন্ধু নদ নামে। এর সাথে ১১ মিলে স্থানটির নাম হয়ে যায় এগারসিন্দুর। কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার এই এগারসিন্দুর গ্রামেই ষোড়শ শতকে গড়ে উঠেছিল প্রসিদ্ধ এক জলদুর্গ, যা এগারসিন্দুর নামে খ্যাত।
জনশ্রুতি আছে, বেবুধ নামে এক কোচ রাজা ষোড়শ শতকে দুর্গটি নির্মাণ করে এটিকে তাঁর রাজধানী ঘোষণা করেন। ‘বেবুধ রাজার দিঘি’ নামে পরিচিত এখানকার যে দিঘি, ধারণা করা হয় রাজপ্রাসাদটির অবস্থান ছিল ওই দিঘির পাড়েই। পরবর্তীতে বারোভুঁইয়াদের প্রধান ঈশা খাঁ দুর্গটি দখল করে নেন এবং এটিকে সংস্কার করে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেন। ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে রাজা মানসিংহ দুর্গটি আক্রমণ করেন। সতের শতকের শুরুর দিকে অহোমদের দখলে চলে যায় এটি। পরে মুঘল সুবেদার ইসলাম খান অহোমদের পরাজিত করে দুর্গটিকে ধ্বংস করে দেন। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য
এগারসিন্দুর দুর্গ তিন দিকেই নদী পরিবেষ্টিত ছিল। মাটির দেয়ালে ঘেরা দুর্গটির ভিত প্রায় ৬০ ফুট চওড়া। প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে এর পশ্চিম দিকে ছিল একটি পরিখা। দুর্গটি সম্ভবত পাথর দিয়ে নির্মিত ছিল এবং ধারণা করা হয়, ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি শাহ মুহম্মদ মসজিদটির পাথর দুর্গের ধ্বংসাবশেষ থেকেই সংগ্রহ করা। ৭”ঢ৭”ঢ১.৫” আকৃতির অসংখ্য ইট, ইটের টুকরা, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, কিছু পাথর এবং কয়েকটি মাটির ঢিবি এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে দুর্গের কোনো অবকাঠামোই এখর আর বর্তমান নেই।
ঐতিহাসিক মূল্য
এগারসিন্দুর ইশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত মধ্যযুগীয় জলদুর্গ। স্বাভাবিকভাবেই এর ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। রাজা মানসিংহের সাথে তাঁর দ্বৈরথ হয়েছিল এখানেই। ইতিহাস বলছে, ঈশা খাঁর অবর্তমানে রাজা মানসিংহ এগারসিন্দুর দুর্গ আক্রমণ করেন। খবর পেয়ে দুর্গ রক্ষায় ছুটে আসেন ঈশা খাঁ। কিন্তু মানসিংহের সৈন্যরা এতোটাই ক্লান্ত ছিলেন যে, যুদ্ধে জড়াতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে রাজা মানসিংহকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানান ঈশা খাঁ। শর্ত থাকে, দ্বন্দ্বযুদ্ধে যে জিতবে রাজ্য তাঁরই অধিকারে যাবে। মানসিংহ কিছুটা কূটকৌশল অবলম্বন করেন। প্রথমে তিনি তাঁর জামাতাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান। মানসিংহ ভেবে ঈশা খাঁ তাঁর সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং মানসিংহের জামাতা নিহত হন। এরপর মানসিংহ নিজের পরিচয় প্রকাশ করে ঈশা খাঁকে যুদ্ধে আহ্বান জানান।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে মানসিংহের তরবারি ভেঙে গেলে ঈশা খাঁ তাঁর নিজ তরবারি তাঁকে দিতে চান। কিন্তু মানসিংহ তা নিতে রাজি হননি। এরপর ঈশা খাঁ ঘোড়া থেকে নেমে নিরস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধের প্রস্তাব দেন। মানসিংহ তাতেও সাড়া না দিয়ে ঈশা খাঁকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন এবং বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন।
রাজা মানসিংহের সাথে যুদ্ধের সময় বাংলার বারোভুঁইয়াদের প্রধান ঈশা খাঁ দুর্গ থেকে দুর্গে ছুটে বেড়িয়েছেন। সর্বশেষ যে দুর্গে তিনি আশ্রয় নেন সেটি এই এগারসিন্দুর। এই দুর্গ ও ইশা খাঁকে নিয়ে প্রচলিত বয়ান দীনেশ চন্দ্র সেন তুলে ধরেছেন তাঁর ‘ব্যালাডস অব ইস্টার্ন বেঙ্গল’ গ্রন্থের দ্বিতীয় ভলিউমে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন, এগারসিন্দুর দুর্গে অবস্থানকালে ইশা খাঁ জানতে পারেন যে, রাজা মানসিংহ দিল্লি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই সংবাদে ইশা খাঁ তার জেনারেলদের সাথে এগারসিন্দুর দুর্গে রাত অতিবাহিত করেন আনন্দ করে উৎফুল্ল চিত্তে। কিন্তু মানসিংহ লোহার শক্ত কিছু খাচা তৈরি করে সেগুলো দুর্গের বিভিন্ন ফটকে রেখে দেন, যাতে করে দুর্গ থেকে কেউ বেরোনোর চেষ্টা করলেই খাঁচায় আটকে যান। ঘটেও তা-ই। রাজা মানসিংহ দুর্গে আগুন ধরিয়ে দিলে ভেতরের লোকজন উত্তাপে থাকতে না পেরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন এবং খাঁচায় আটকা পড়েন। ইশা খাঁর ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটে। এরপর একটি হাতির পিঠে চাপিয়ে খাঁচাটি দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
একদিন, দুইদিন পেরিয়ে সপ্তাহ চলে যায়, কিন্তু বন্দির দিকে কারও নজর নেই। ইশা খাঁর অবস্থা হয় খাঁচায় বন্দি আহত সিংহের মতো। এরপর সম্রাট আকবর একদিন রাজা মানসিংহকে দরবারে ডেকে তাঁর কাছে যুদ্ধের বিষয়ে জানতে চান। মানসিংহ বলেন, ‘ইশা খাঁ তাঁর দেখা সবচেয়ে সাহসী ও শক্তিশালী যোদ্ধা, যা এই রাজ্যে দ্বিতীয়টি নেই। সম্রাট তাঁকে ক্ষমা করে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করলে তাঁর আনুগত্য পেতে পারেন। তাছাড়া ইশা খাঁ যদি কোনোমতে পালাতে পারেন তাহলে ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবেন।’ সব শুনে সম্রাট আকবর তাঁকে মুক্তি দিয়ে দরবারে তাঁর পাশের আসনে বসান এবং মসনদালি উপাধি দেন। সেই সাথে ২২টি পরগনার মালিকানাও দেন।