বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৫
26 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

ভিতরগড়: তালমা ও সালমারার প্রবাহপুষ্ট দুর্গনগরী

নদীবাংলা ডেস্ক,
পঞ্চগড়ের ভিতরগড় দুর্গনগরীতে উৎখনন। ছবি: সংগৃহীত

পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সদর থানার অন্তর্গত অমরখানা ইউনিয়নে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে ভিতরগড় অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দুর্গনগরী।

দুর্গ বললেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা স্বাভাবিকভাবেই সামনে চলে আসে। তবে বাংলায় দুর্গ গড়ে উঠেছিল কেবল প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে নয়, বসবাসের তাগিদেও। কখনো কখনো বাণিজ্যের প্রয়োজনেও। তবে উদ্দেশ্য যাই হোক সব দুর্গই গড়ে উঠেছিল নদীকে আশ্রয় করে। নদীবহুল বাংলায় এসব দুর্গের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হতো সাধারণত নদীর সংযোগস্থল অথবা নদীর তীরকে। ভিতরগড়ও এমন একটি দুর্গনগরী, যা গড়ে উঠেছিল তালমা ও সালমারা নদীর প্রবাহকে আশ্রয় করে।

পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সদর থানার অন্তর্গত অমরখানা ইউনিয়নে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে দুর্গটি অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দুর্গনগরী। ভিতরগড়ের বাইরের আবেষ্টনীর উত্তর দেয়াল এবং পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালের উত্তরাংশ বর্তমানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত।

কথিত আছে, পাল রাজা পৃথ্বীরাজের শাসনামলে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে দুর্গটি গড়ে ওঠে। ১৮০৯ সালে ফ্রান্সিস বুকানন ভিতরগড় জরিপ করেন। তাঁর মতে, পৃথ্বীরাজের রাজত্ব তৎকালীন বৈকণ্ঠপুর পরগনার অর্ধেক ও বোদা চাকলার অর্ধেক অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। ছয় শতকের শেষদিকে এক পৃথ্বী রাজা কামরূপে পরাজিত হয়ে ভিতরগড়ে রাজ্য স্থাপন করেন।

উৎখননের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শনসমূহের আলোকে অনুমান করা যায় যে, ছয় শতকের শেষে কিংবা সাত শতকের শুরুতে ভিতরগড় একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্থানীয়ভাবে দুর্গ নগর বা ফোর্ট সিটি নামে পরিচিত ভিতরগড় ছিল প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্র ও রুটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সিকিম, তিব্বত, ভুটান, চীন, নেপাল, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও পুণ্ড্রবর্ধনের সাথে দুর্গ নগরীটির ছিল শক্তিশালী বাণিজ্য। আর এই বাণিজ্য সম্পাদিত হতো স্বাভাবিকভাবেই নৌপথের মাধ্যমে।

ভিতরগড় দুর্গনগরী মূলত চারটি আবেষ্টনীর সমন্বয়ে গঠিত। এই আবেষ্টনীগুলো একটি আরেকটির ভেতরে অবস্থিত। অভ্যন্তরীণ আবেষ্টনী বা প্রথম আবেষ্টনীর উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দেয়ালগুলোর পরিমাপ যথাক্রমে ৩৪০ মিটার, ৬৫০ মিটার, ৬১০ মিটার ও ৪৫০ মিটার। এই দেয়ালগুলো সম্পূর্ণরূপে ইটের তৈরি এবং ২ দশমিক ৫৫ মিটার উঁচু ও উপরিভাগে ২ মিটার প্রশস্ত। বাইরের দিকে দেয়ালের সাথে রয়েছে আয়তাকৃতির বুরুজ।

অভ্যন্তরীণ আবেষ্টনীর উত্তর পূর্বাংশে সম্ভবত রাজবাড়ি ছিল। এই আবেষ্টনীর ভেতরে দুটি প্রাচীন দিঘি রয়েছে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে এই আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে একটি ক্রুশাকৃতির মন্দির এবং উভয় দিকে (পূর্ব ও পশ্চিম) স্তম্ভ বিশিষ্ট বারান্দা সম্বলিত পিরামিডাকৃতির একটি স্তূপ/মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। উৎখননকালে মন্দির স্থাপত্যে ব্যবহৃত বিভিন্ন নকশাখচিত ইট ও ত্রিকোনাকৃতির পাথরের খণ্ড পাওয়া গেছে।

প্রথম আবেষ্টনী এবং মহারাজার দিঘিসহ পাচঁটি প্রাচীন দিঘিকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে দ্বিতীয় আবেষ্টনী। ইট নির্মিত এই দ্বিতীয় আবেষ্টনীর দেয়ালগুলো উত্তর ও দক্ষিণে ১ দশমিক ৪, পূর্বে ২ দশমিক ৮৬ এবং পশ্চিমে ৩ কিলোমিটার লম্বা। ইট নির্মিত দেয়ালগুলো ৩ দশমিক ৫ মিটার উঁচু ও উপরিভাগে ২ দশমিক ৫ মিটার প্রশস্ত। পশ্চিম দেয়ালটি সালমারা নদীর প্রবাহ অনুসরণ করে নদীর পূর্ব তীরে নির্মিত হওয়ায় বেশ আঁকাবাঁকা। প্রথম আবেষ্টনীর মতো দ্বিতীয় আবেষ্টনীর দেয়ালসমূহের বাইরেও আয়তাকৃতির বুরুজ সংযোজিত রয়েছে। স্থানীয় জনশ্রুতিমতে, দ্বিতীয় আবেষ্টনীর উত্তরে কালদুয়ার এবং দক্ষিণে যমদুয়ার নামে দুটি প্রবেশদ্বার ছিল।

দ্বিতীয় আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে পাঁচটি প্রাচীন দিঘি হলো মহারাজার দিঘি, ফুলপুকুরী, কোদালধোয়া, মলানী দিঘি এবং সিঙ্গারী দিঘি। এর মধ্যে মহারাজার দিঘি সবচেয়ে বড়।

দ্বিতীয় আবেষ্টনীর চতুর্দিকে বাইরে নির্মিত হয়েছিল তৃতীয় আবেষ্টনী। তৃতীয় আবেষ্টনীর দেয়ালগুলো উত্তরে ২ দশমিক ৪৪, পূর্বে ৫ দশমিক ২৭, পশ্চিমে ৫ দশমিক ৩৭ এবং দক্ষিণে ৩ দশমিক ৭১ মিটার লম্বা। তৃতীয় আবেষ্টনীর দেয়ালগুলো মাটির তৈরি তবে উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের মধ্যবর্তী অংশ ইট নির্মিত।

তৃতীয় আবেষ্টনীর উত্তর দেয়ালের পশ্চিমাংশে তালমা নদীতে একটি বাঁধ দিয়ে নদীর প্রবাহকে পশ্চিম দেয়ালের বাইরে দিয়ে পরিচালনা করা হয়। আর তালমা নদীর প্রাচীন প্রবাহটি, যা বর্তমানে সালমারা নদী নামে পরিচিত, তৃতীয় আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে পশ্চিমাংশ দিয়ে এবং দ্বিতীয় আবেষ্টনীর পশ্চিম দেয়ালের বাইরে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তৃতীয় আবেষ্টনীর দক্ষিণ দেয়ালের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে দোমনী নামক স্থানে পুনরায় তালমা নদীর সাথে মিলিত হয়। ব এই সালমারা নদীতে আরও দুটি পাথরের বাঁধ যথাক্রমে পাথর ঘাটা ও দোমনী নামক স্থানে নির্মাণ করে ভিতরগড় দুর্গনগরীর মধ্যে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

তৃতীয় আবেষ্টনীর অভ্যন্তরে উত্তরাংশে এবং দ্বিতীয় আবেষ্টনীর উত্তর দেয়াল থেকে ২৫০ মিটার উত্তরে আরও একটি ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১.৪ মিটার উঁচু দেয়াল দেখা যায়। এই দেয়ালের উত্তরের পরিখা পশ্চিমে সালমারা নদীতে মিলিত হয়।

তৃতীয় আবেষ্টনী থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরত্বে চতুর্থ আবেষ্টনী নির্মিত হয়েছিল। চতুর্থ আবেষ্টনীর দেয়ালগুলো পুরোপুরি মাটির তৈরি। চতুর্থ আবেষ্টনী দেয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে নির্মিত একটি ছোট দুর্গ ধুমগড় নামে পরিচিত।

তথ্যসূত্র:

  • বাংলাপিডিয়া
  • Riverine Fortress city of ‘MAHASTHAN’ in Deltaic Bengal: In search for the traditional settlement pattern of ancient cities

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here