নিরাপদ গভীরতার নিষ্কণ্টক নৌরুট, স্রোতের তীব্রতা ও সামনে চরজাতীয় কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে অর্থাৎ নৌযান বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে পাইলটকে সে ব্যাপারে সতর্ক করে নাইট নেভিগেশন মোবাইল অ্যাপ। ভারতের প্রথম রাজ্য হিসেবে আসাম ব্রহ্মপুত্র নদে চলাচলকারী নৌযানের জন্য পদ্ধতিটি চালু করে।
দুর্ঘটনা এড়িয়ে নিরাপদে নৌযান চালানোর ক্ষেত্রে কিছুদিন আগ পর্যন্তও পাইলটদের ভরসা ছিল জিপিএস ব্যবস্থার (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) ওপর। যদিও তা কেবল স্বল্পদৈর্ঘ্যরে রুট নির্ধারণে কাজে আসত পাইলটদের। নিরাপদ গভীরতার নিষ্কণ্টক নৌরুট, স্রোতের তীব্রতা ও চলার পথে চর জাতীয় কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা, সে বিষয়ে আগাম সতর্কতা পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা এ ব্যবস্থায় নেই। এসব বিষয়ে চালককে আগাম বার্তা দিয়ে নিরাপদ নৌযান চালনায় সহায়তা করে যে ব্যবস্থা, তা হলো নাইট নেভিগেশন মোবাইল অ্যাপ। অর্থাৎ, নৌযান যদি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তাহলে পাইলটকে সে ব্যাপারে সতর্ক করে এই অ্যাপ। জেগে ওঠা চরই কেবল নয়, চলার পথে বড় কোনো জাহাজ থাকলে সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা পাঠায় নাইট নেভিগেশন অ্যাপ।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতও নাইট নেভিগেশন মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে। দেশটির প্রথম রাজ্য হিসেবে আসাম ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রহ্মপুত্র নদে চলাচলকারী নৌযানের জন্য পদ্ধতিটি চালু করে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা দিনের বেলা অ্যাপটি উদ্বোধন করেন। অ্যাপটি চালুর উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদে চলাচলকারী ফেরি প্রয়োজনীয় মৌলিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত করা, যাতে কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলে পাইলট সে ব্যাপারে তথ্য পান।
যেভাবে কাজ করে
নাইট নেভিগেশন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি তৈরি করেছে ভারতের পরিবহন বিভাগ। এটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আইআইটি মাদ্রাজের প্রধান বিজ্ঞানী কে রাজু। গুয়াহাটি প্লাসের সাথে আলাপকালে নতুন এই মোবাইল অ্যাপের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দিয়েছেন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট (আইডাব্লিউটি) ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ শর্মা। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অ্যাপ্লিকেশনটিতে রয়েছে উচ্চ রেজল্যুশনের পানির গভীরতাসংক্রান্ত একটা চার্ট, যা ১৫ থেকে ৩০ দিন অন্তর হালনাগাদ হয়। এটি ১০০ মিটার পর্যন্ত নিরাপদ নেভিগেশন জোন ও ভার্চুয়াল মার্কা চিহ্নিত করে তা প্রদর্শন করে। সেই সাথে একটি ডিজিটাল কম্পাস, গতি, দূরত্ব, পৌঁছানোর সম্ভাব্য সময় ইত্যাদিরও ব্যবস্থা থাকে অ্যাপে।
একটা নিরাপদ দূরত্বের মধ্যে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকলে সে ব্যাপারে ভার্চুয়াল সতর্ক সংকেতের মাধ্যমে নিরাপদ নৌচলাচল পথের দিশা দিয়ে থাকে অ্যাপ্লিকেশনটি। চলার পথে কোনো বিপদ সমাসন্ন হলে সে ব্যাপারে সতর্কীকরণের নির্দেশিকা-সংবলিত একটি প্রটোকলও পাওয়া যায় এতে।
প্রাথমিকভাবে ব্রহ্মপুত্রের নৌপথে চলাচলকারী চারটি নৌযানে নাইট নেভিগেশন মোবাইল অ্যাপটি স্থাপন করা হয়। একই ব্যবস্থা আরও ছয়টি নৌযানে স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে রাজ্যের। তবে ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে গুয়াহাটি ও উত্তর গুয়াহাটির মধ্যে চলাচলকারী তিনটি নৌযানে অ্যাপটি কার্যকর রয়েছে।
সুফল
জিপিএস ব্যবস্থায় অনুপস্থিত অনেক সুবিধাই নাইট নেভিগেশন মোবাইল অ্যাপে পাওয়া যায়। নিরাপদ নৌ যোগাযোগে জিপিএসের ভূমিকা থাকলেও তা সীমিত। এর সপক্ষে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটি অব ইন্ডিয়ার (আইডাব্লিউআই) নৌযান এমভি জেএফআর জ্যাকবের পাইলট সফদার হোসেনের কথায়। জিপিএস প্রযুক্তিসংবলিত নৌযানটির এই পাইলটের কথায়, এখন পর্যন্ত হাতের কাছে যে প্রযুক্তি আমাদের রয়েছে তা কেবল রুট, নৌযানের গতি, পানির গভীরতা, পানির স্রোত এবং নিকটবর্তী নৌযানের সাথে যোগাযোগের সুবিধাই দেয়।
এমভি জেএফআর জ্যাকবে রাডার না থাকায় নৌযানটি সামনে ছোট কোনো নৌযান এবং অন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়। কারণ, রাডার কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার মধ্যেও গন্তব্য চিনতে সহায়তা করে। এমভি জেএফআর জ্যাকবে শুধু জিপিএস ব্যবস্থা থাকায় কুয়াশার মধ্যে নৌযানটির চলাচল বন্ধ রাখতে হয়।
কিন্তু নাইট নেভিগেশন অ্যাপের ডিজাইন করা হয়েছে এক্সটার্নাল সেন্সরের ব্যবস্থা রেখে। স্বাভাবিকভাবেই নৌযান তার চলার পথে ছোট কোনো নৌযান বা অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়লে সতর্কসংকেত বেজে ওঠে। এছাড়া এই প্রযুক্তি ফেরি পরিচালনার সময়ও বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ, নাইট নেভিগেশন মোবাইল অ্যাপের ফলে আরও বেশি রাত পর্যন্ত নৌপথে চলতে পারছে ফেরিগুলো। গুয়াহাটিতে সর্বশেষ ফেরিটি ছেড়ে যাচ্ছে রাত ৯টায় এবং ফিরে আসছে রাত ১০টার দিকে, যা উত্তর গুয়াহাটির অনেকের মধ্যেই স্বস্তি বয়ে এনেছে। কারণ, রাত ৯টার পর গুয়াহাটি থেকে বাড়ি ফিরতে গণপরিবহনের জন্য গলদঘর্ম হতে হতো তাদের।
মোবাইল নাইট নেভিগেশন অ্যাপটি বর্তমানে ব্রহ্মপুত্রের অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী নৌযানেই ব্যবহৃত হচ্ছে। সে হিসেবে কেবল রাতের বেলার সুবিধাই পাওয়া যাচ্ছে এখন পর্যন্ত। কিন্তু দিনের বেলায় নৌযান পরিচালনার ক্ষেত্রেও অ্যাপটি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। দিনে ও রাতে দুই সময়ই অ্যাপটি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে কতটা কাজ করে তাও। তাই বলা যায়, দুর্ঘটনামুক্তভাবে নির্বিঘ্নে, নিরাপদে ও স্বচ্ছন্দে নৌ চলাচলে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে মোবাইল নাইট নেভিগেশন অ্যাপ।