বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুধবার, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৫
30 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

ই-বার্জের যুগে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন

নদীবাংলা ডেস্ক,
ডাচ কোম্পানি পোর্ট লাইনার নির্মিত বিশ্বের প্রথম ই-বার্জ ‘টেসলা শিপ’। ছবি: লোডস্টার

২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যে পৌঁছতে বিশ্বব্যাপী চলছে নানা উদ্যোগ ও তার বাস্তবায়ন। দেশে দেশে সরকারগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও এখন দৃশ্যমান। বড় বিনিয়োগ হচ্ছে অবকাঠামো এবং প্রযুক্তিতে। সবুজ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নৌযানের বহর।

দেশে দেশে ই-বার্জ

পরিবেশবান্ধব অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে বড় বিনিয়োগ করছে ফরাসি শিপিং জায়ান্ট সিএমএ সিজিএম। এর আওতায় ভিয়েতনামের অভ্যন্তরীণ নৌপথে তারা ইলেক্ট্রিক বার্জ (ই-বার্জ) নামাচ্ছে। আর পরিবেশবান্ধব এই বার্জে পণ্য পরিবহনের জন্য সিএমএ সিজিএমের সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে নাইকি।

সিএমএ সিজিএম শূন্য কার্বন নিঃসরণকারী এই ই-বার্জ নির্মাণ করছে ভিয়েতনামের অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলের জন্য। শতভাগ ইলেক্ট্রিক বার্জটি চলবে ব্যাটারিতে। এই ব্যাটারি চার্জের জন্য জেমালিঙ্কের গভীর-সমুদ্র টার্মিনালে তারা নির্মাণ করছে সৌর বিদ্যুৎচালিত চার্জিং অবকাঠামো। ১৮০ কিলোমিটার রাউন্ড ট্রিপের এই ই-বার্জটি চলবে বিন ডুয়োং ও কাই মেপের মধ্যে। ব্যাটারিচালিত হওয়ায় ই-বার্জটি থেকে কোনো ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হবে না এবং কার্বন নিঃসরণ এড়ানো যাবে বছরে ৭৭৮ টন।

সিএমএ সিজিএমের উপস্থিতি বিশ্বব্যাপী। মেরিটাইম, স্থল এবং আকাশপথে পরিবহন ও লজিস্টিকস সমাধান দিয়ে থাকে কোম্পানিটি। ভিয়েতনামে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে ১৯৮৯ সাল থেকে এবং বর্তমানে দেশটিতে তাদের অফিস রয়েছে পাঁচটি। ভিয়েতনামজুড়ে সাতটি বন্দরে ২৯টি সাপ্তাহিক মেইনলাইন সার্ভিস পরিচালনা করছে কোম্পানিটি।

২০৫০ সালের মধ্যে ভিয়েতনামের নেট-জিরো আকাক্সক্ষা পূরণে অংশীদার হতেই দেশটির অভ্যন্তরীণ নৌপথে ই-বার্জ পরিচালনা করতে যাচ্ছে সিএমএ সিজিএম। উদ্ভাবনীমূলক এই ই-বার্জের ডিজাইন করেছে সিএমএ সিজিএমের নিউ বিল্ড এবং গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) টিম। ব্যাটারি প্রযুক্তির জন্য তারা অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে সিএটিএলের সাথে। জেমালিঙ্ক প্রাঙ্গণে তারা নতুন যে সোলার প্ল্যান্ট নির্মাণ করছে সেখান থেকে আসবে বছরে ১ গিগাওয়াটআওয়ার সবুজ বিদ্যুৎ। পরিচ্ছন্ন এই বিদ্যুতেই রিচার্জড হবে ই-বার্জের ইলেক্ট্রিক ব্যাটারি। ই-বার্জটি কনটেইনার পরিবহন করতে পারবে বছরে ৫০ হাজার টিইইউ এর বেশি।

সিএমএ সিজিএমের এই ই-বার্জ সর্বোচ্চ ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নাইকি। বিন ডুয়োং প্রদেশ ও জেমালিঙ্কের মধ্যে তারা নিজেদের পণ্য পরিবহন করবে এই বার্জের মাধ্যমে। তবে এখনই কার্যক্রমে আসছে না শতভাগ পরিবেশবান্ধব ই-বার্জটি। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত।

নেদারল্যান্ডসের আমস্টার্ডাম বন্দর থেকে জানদামে কোকোয়া বিন পরিবহনের জন্য কোটাগ ইন্টারন্যাশনালের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পুরোপুরি ইলেক্ট্রিক পুশার টাগ ও বার্জ ব্যবস্থা আগেই চালু করেছে কারগিল। তাদের এই উদ্যোগের ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বছরে ১ লাখ ৯০ হাজার টন কমবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এই ই-বার্জের জ্বালানির উৎস পার্শ্ববর্তী বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র।

এ ছাড়া ‘টেসলা অব দ্য ক্যানেলস’ নামে পরিচিত ছয়টি ইলেক্ট্রিক বার্জ নির্মাণ করেছে ডাচ কোম্পানি পোর্টলাইনার। বার্জগুলো এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যাতে সেগুলো সেতুর নিচ দিয়েও বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচল করতে পারে। ৫২ মিটার দীর্ঘ প্রতিটি ই-বার্জ ২৮০টির মতো কনটেইনার পরিবহনে সক্ষম। এতে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রিক মোটরগুলো চালনার জন্য রয়েছে ২০ ফুট ব্যাটারি। ব্যবহৃত পাওয়ার বক্স ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত শক্তি দিতে সক্ষম। বার্জগুলো নির্মাণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভর্তুকি দিয়েছে ৭০ লাখ ইউরো। সংশ্লিষ্ট বন্দরগুলো থেকেও অতিরিক্ত তহবিল মিলেছে।

ব্যবহৃত প্রযুক্তি

আধুনিক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি প্রযুক্তি-এই দুইয়ের সফল প্রয়োগের ফল হচ্ছে ইলেক্ট্রিক বার্জ। মূল প্রযুক্তি হিসেবে প্রপেলার চালানোর জন্য প্রথাগত ডিজেল ইঞ্জিনের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে ইলেক্ট্রিক মোটর। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় তুলনামূলক সাশ্রয়ী এসি ইনডাকশন মোটর। তবে উচ্চ দক্ষতার পারমানেন্ট ম্যাগনেট সিনক্রোনাস মোটর (পিএমএসএম) এবং ছোট বার্জের জন্য ব্রাশলেস ডিসি মোটরও (বিএলডিসি) ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

ব্যাটারির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। পাশাপাশি লিথিয়াম আয়রন ফসফেট (এলএফপি), সলিড-স্টেট ব্যাটারিও ব্যবহার করা হয়। ইলেক্ট্রিক বার্জের প্রধান শর্ত হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের সাথে এর সংযুক্তি। সেটা হতে পারে সোলার প্যানেল কিংবা বায়ুবিদ্যুৎ বা হাইব্রিড সিস্টেম।

দক্ষতা ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে আধুনিক ই-বার্জে থাকে উন্নত ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা। লোড ব্যবস্থাপনা, রুট পরিকল্পনা ও চার্জিং সাইকেলের জন্য থাকে অ্যানার্জি অপটিমাইজেশন সফটওয়্যার। সর্বোত্তম রুট নেভিগেশন এবং দুর্ঘটনা এড়াতে আছে অটোনোমাস অথবা সেমি-অটোনোমাস সিস্টেম। সর্বোপরি পারফরম্যান্স যাচাই, বিদ্যুৎ ব্যবহার ও পরিবেশগত অবস্থা জানতে রিয়েল-টাইম মনিটরিং সিস্টেম।

সম্ভাবনা অবারিত

কার্বন নিঃসরণ হ্রাস ও দক্ষ পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ এগোচ্ছে তাতে করে এখানকার অভ্যন্তরীণ নৌপথেও অগ্রসর এই প্রযুক্তির সফল রূপান্তরের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভিন্ন গবেষণাতেও দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে পরিচ্ছন্ন ও কার্বন নিঃসরণমুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইলেক্ট্রিক প্রোপালশন ও সৌর শক্তির সমন্বয়। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন থেকে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের জন্য এটা খুবই জরুরি।

সিএমএ সিজিএমের সম্পদ ও পরিচালন বিভাগের নির্বাহী ভাইস-প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন কাবো-ওরেলের ভাষায়, অন্যান্য দেশেও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ই-বার্জ পরিচালনা করা সম্ভব। অধিক টেকসই পরিবহন মাধ্যমের তালাশে থাকা কার্গো মালিকদের উদ্ভাবনী সমাধান দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here