বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
17 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

অভ্যন্তরীণ নৌযান জ্বালানি দক্ষতায় আধুনিক প্রযুক্তি

পশ্চিমা বিশ্বে জ্বালানি দক্ষতার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে সত্তরের দশকে। জ্বালানির উচ্চমূল্যে দিশেহারা বার্জ অপারেটররা তখন ব্যয় কমাতে হন্যে হয়ে বিকল্প জ্বালানির তালাশ করতে থাকেন। কারণ, মোট পরিবহন ব্যয়ের ৭০ শতাংশই তখন চলে যেত জ্বালানি বাবদ। পরে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, নৌযানের নকশাকারী ও নির্মাতা এবং বার্জ অপারেটরদের সম্মিলিত প্রয়াসে লক্ষণীয় মাত্রায় জ্বালানি সাশ্রয়ের একটা উপায় উদ্ভাবিত হয়। প্রথমদিকে বার্জ অপারেটরদের কাছে ব্যয় কমানোটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য, কার্বন নির্গমনের বিষয়টি ছিল গৌণ। গ্রিনহাউজ গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে উন্নত জ্ঞান ও সচেতনতার ফলে পরের দিকে কার্বন নির্গমনের বিষয়টিও জ্বালানি দক্ষতায় সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

অভ্যন্তরীণ নৌযানের জ্বালানি দক্ষতা অর্জনের প্রথাগত কিছু পদ্ধতি থাকলেও আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও তার প্রয়োগই একে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। নৌযানকে কীভাবে আরো জ্বালানি দক্ষ করা যায় সে নিয়ে নতুন নতুন গবেষণাও নিরন্তর চলছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জ্বালানি দক্ষতা অর্জনে যে অগ্রগতি তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে উচ্চ দক্ষতার প্রোপালশন সিস্টেম ও ই-নেভিগেশন। উন্নততর শিপ ডিজাইন ও নতুন ধরনের লজিস্টিকস ধারণারও ভূমিকা রয়েছে এতে।

জ্বালানি দক্ষতাকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে গেছে অল ইলেকট্রিক শিপ (এইএস), ডিজেল ইলেকট্রিক শিপ নামেও যা পরিচিত। এসব নৌযান পরিচালিত হয় ডিজেলচালিত একাধিক ইলেকট্রিক জেনারেটরের মাধ্যমে। ইলেকট্রিক শিপের ইতিহাস যদিও শত বছরের পুরনো। প্রথমবারের মতো ডিজেল ইলেকট্রিক ভেসেল নির্মিত হয়েছিল সেই ১৯০৩ সালে। সেটি ছিল ভান্দাল নামে নৌপথে চলাচলকারী একটি ট্যাংকার। নৌবাহিনীর জাহাজে অবশ্য ইলেকট্রিক্যাল প্রোপালশন যুগের সূচনা আরেকটু পরের দিকে, ১৯১২ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর ইউএসএস জুপিটারের মধ্য দিয়ে। তবে ৮০-এর দশক পর্যন্ত এর ব্যবহার ছিল কদাচিৎ। ঠিক ওই সময়ই পাওয়ার ইলেকট্রিক প্রযুক্তি উন্নয়নের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রিক মটরের গতি নিয়ন্ত্রণের দক্ষ উপায় উদ্ভাবিত হয়। এই পদ্ধতির আধুনিক যুগের শুরু হয় ১৯৮৭ সালে কুইন এলিজাবেথ টু-কে ডিজেল ইলেকট্রিক প্রোপালশন সিস্টেমে উন্নীত করার মধ্য দিয়ে।

ইলেকট্রিক প্রোপালশন ব্যবহারের মাধ্যমে জেনারেশন থেকে প্রোপালশন সিস্টেমে শক্তি পরিবাহিত হয় মেকানিক্যাল পদ্ধতির পরিবর্তে ইলেকট্রিক্যাল পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে প্রোপালশন ও থ্রাস্টার (সেকেন্ডারি প্রোপেলার) উভয়ই নিয়ন্ত্রিত হয় ভ্যারিয়েবল স্পিড ড্রাইভসের (ভিএসডিএস) মাধ্যমে। প্রাথমিকভাবে ইলেকট্রিক ড্রাইভস ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল উচ্চদক্ষতা, জ্বালানি সাশ্রয় ও পরিবেশগত সুবিধার কথা মাথায় রেখে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইলেকট্রিক সিস্টেম, পাওয়ার সিস্টেম, কন্ট্রোল স্ট্র্যাটেজি ও ইলেকট্রিক মেশিনের আধুনিকায়ন ইলেকট্রিক শিপ প্রোপালশন সিস্টেমকে টেকসই রূপদানেও ভূমিকা রাখছে।

প্রথাগত প্রোপালশন সিস্টেমের তুলনায় ডিজেল ইলেকট্রিক প্রোপালশন সিস্টেম বর্তমানে অনেক বেশি সুবিধা দিচ্ছে। ব্যবস্থাগুলোর সঠিক ব্যবহার বিশেষ পরিস্থিতিতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়, ইঞ্জিন তা উৎপাদন করে। সাধারণত জাহাজের ইঞ্জিন কমপক্ষে ৭০ শতাংশ শক্তির জোগান দিলে তাকে দক্ষ পরিচালন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কারণ, ব্যবহৃত এই পরিমাণ শক্তিকে নির্দিষ্ট পরিস্থিতি, জ্বালানি সাশ্রয় ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড হ্রাসের জন্য উপযুক্ত। এ পদ্ধতিতে যে পরিমাণ জ্বালানি সাশ্রয় হয়, নৌযানের পুরো জীবৎকালের হিসাবে তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই এর চাহিদাও বাড়ছে সমানতালে। প্রযুক্তি ও গবেষণার প্রাগ্রসরতায় এখন আর এটি কেবল ছোট নৌযানে সীমাবদ্ধ নেই। জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবস্থাটি মোটা দাগে বাড়তি যেসব সুবিধা দেয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

● প্রথাগত সিস্টেমের তুলনায় ইলেকট্রিক প্রোপালশন যন্ত্রপাতি স্থাপনে জায়গা অনেক কম লাগে।
● প্রাইম মুভারের সাথে প্রোপেলার শ্যাফটের সরাসরি কোনো সংযোগ না থাকায় ঝাঁকুনি হয় সীমিত।
● জ্বালানি ব্যবহার ও কার্বন নির্গমন কম হওয়ায় এর পরিবেশগত সুবিধা অনেক বেশি।
● লাইফ সাইকেল কস্ট ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও তুলনামূলক কম হয়।
● ঝাঁকুনি ও শব্দ কম হওয়ার কারণে যাত্রাও হয় তুলনামূলক আরামদায়ক।

তবে এ ব্যবস্থায় কিছু অসুবিধাও রয়েছে। প্রথাগত প্রোপালশনের তুলনায় ইলেকট্রিক প্রোপালশন সিস্টেম স্থাপনে খরচ হয় অনেক বেশি। মেকানিক্যাল সিস্টেমের চেয়ে একেবারে আলাদা হওয়ায় ক্রুদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। পাশাপাশি দরকার হয় নৌযানের বড় ধরনের অটোমেশনের। এসব সুবিধা ও অসুবিধা পাশাপাশি রেখে অনায়াসেই বলা যায়, ডিজেল ইলেকট্রিক প্রোপালশন সিস্টেমে অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই বেশি।

সবশেষে জ্বালানি সাশ্রয়ের পাশাপাশি পরিচালন দক্ষতা বাড়াতে পারে ই-নেভিগেশনও। নৌযানের কাক্সিক্ষত গতির ধারণা, লক ও ব্রিজ পরিকল্পনা সর্বোপরি জ্বালানির সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দেয় এটি। পরিবহনের সময় পণ্যের গতিবিধির খবর (ট্র্যাকিং অ্যান্ড ট্রেসিং) এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, কনটেইনারের বাইরে কিছুদিন আগ পর্যন্তও যা ছিল ধারণার অতীত।

অনেকগুলো বিষয় ই-নেভিগেশনের আওতার মধ্যে পড়ে। রিভার ইনফরমেশন সার্ভিসেস বা আরআইএস এর অন্যতম। এটি হলো আন্তর্জাতিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা, নৌযান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ও নৌপথ ব্যবস্থাপনা এবং জাহাজের চালক ও টার্মিনালগুলোর মধ্যে তথ্যের বিনিময়। অন্যান্য খাতেও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন যেভাবে হচ্ছে তাতে আগামীতে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতের পরিচালন দক্ষতা বৃদ্ধির অবারিত সুযোগ তৈরির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

সমুদ্রগামী জাহাজের অগ্রসর ডিজাইন নিয়ে যেসব গবেষণা চলছে তার সুফল পেতে পারে অভ্যন্তরীণ নৌযানও। কারণ সমুদ্রগামী জাহাজ খাতে উন্নয়ন ও গবেষণা বরাদ্দ অনেক বেশি থাকে। উন্নয়ন ও গবেষণার যেসব প্রকল্প রয়েছে হাল ডিজাইন তার অন্যতম। যদিও অভ্যন্তরীণ নৌযানে এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো বড় উন্নয়ন এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here