ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে। পুরো শিল্প খাতেই নতুন এই প্রযুক্তি বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসছে। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনেও নতুন এসব প্রযুক্তির বিকল্প নেই। কারণ, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনকে ট্রাক ও ট্রেনের মতো অন্যান্য অভ্যন্তরীণ পরিবহন মাধ্যমের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতা করতে হয়। আন্তর্জাতিক শিপিংয়ের যেটার দরকার পড়ে না।
দ্রুত পরিবর্তনশীল এই প্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহারে বর্তমান অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্রেই মৌলিক পরিবর্তন আসতে পারে। বাষ্প ইঞ্জিন, ইন্টারনাল কম্বাসশন ইঞ্জিন ও কনটেইনার প্রযুক্তির কথা এখানে উল্লেখ করা যায়, যা পরিবহন ব্যবস্থাকে এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছে। তাই অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থার প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নতুন আরও যেসব প্রযুক্তি আসছে সেগুলোর আত্তীকরণ অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে জরুরি বিষয় হচ্ছে খাতটির প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে পারে এমন কার্যকর সব প্রযুক্তি চিহ্নিত করে সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
শিপিং খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের চালক বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির এরই মধ্যে উন্নয়ন হয়েছে। এর মধ্যে কার্গো হ্যান্ডলিং অটোমেশন প্রযুক্তি যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে অটোনোমাস নেভিগেশন প্রযুক্তি, বিকল্প জ্বালানি প্রযুক্তি এবং তথ্য একত্রীকরণ ও তার বিশ্লেষণ প্রযুক্তি। এখন জানা দরকার এসব প্রযুক্তি কী এবং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় তার প্রভাবই বা কেমন।
কার্গো হ্যান্ডলিং অটোমেশন প্রযুক্তি
সেন্সর, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এবং রোবোটিকস প্রযুক্তি বন্দরগুলোর দক্ষতা বাড়াতে কার্গো হ্যান্ডলিং স্বয়ংক্রিয় করেছে। বিশ্বের অধিকাংশ বড় সমুদ্রবন্দর এই প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে গেলেও অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরের মতো অপেক্ষাকৃত ছোট বন্দরগুলোতে এর প্রয়োগ এখনো শুরু হয়নি। এর একটি বড় কারণ প্রারম্ভিক বিনিয়োগ ব্যয়। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে এইজিসের মতো প্রকল্পের মাধ্যমে ছোট বন্দরগুলোর উপযোগী প্রযুক্তি উন্নয়ন করা হচ্ছে।
এই প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রধান যে সুবিধা তা হচ্ছে, ডাবল হ্যান্ডলিংয়ের বোঝা কমে যাওয়া। কারণ, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাই হচ্ছে ডাবল-হ্যান্ডলিং। এ ছাড়া এর সাহায্যে কার্গো পরিবহন বাড়িয়ে নেওয়াও সম্ভব। অটোনোমাস প্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে সড়কের তুলনায় বড় পরিসরে কার্গো হ্যান্ডলিং করা যেতে পারে। সুতরাং, অটোনোমাস প্রযুক্তি যে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের তুলনামূলক প্রতিযোগিতা সক্ষম বাড়াবে সেটা নিশ্চিত।
অটোনোমাস নেভিগেশন প্রযুক্তি
অটোনোমাস নেভিগেশনের ভিত্তি মূলত সেন্সিং, উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ এবং নেভিগেশন প্রযুক্তি। কারিগরি দিক মূল্যায়নে এখনই এটির বাণিজ্যিকায়ন সম্ভব। আন্তর্জাতিক শিপিংয়ের জন্য মাস কোড এরই মধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো অভ্যন্তরীণ বা উপকূলীয় নৌপথে অটোনোমাস শিপ পরিচালনা শুরুও করেছে।
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে অটোনোমাস প্রযুক্তি ব্যবহার করা গেলে পরিচালন ব্যয় হ্রাস পাবে। পাশাপাশি বৃদ্ধি পাবে পরিচালন দক্ষতা। কারণ, শ্রমের ব্যয় অত্যধিক বেশি হওয়ায় সড়ক পরিবহনে আরও বেশি সক্রিয়ভাবে প্রযুক্তিটি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই অটোনোমাস নেভিগেশন প্রযুক্তির উন্নয়ন অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে মনে হতে পারে। যদিও দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন এই প্রযুক্তিটি অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধিই করবে।
বিকল্প জ্বালানি প্রযুক্তি
পরিবেশগত যেসব নীতিমালা রয়েছে সেগুলো পরিপালনের উদ্দেশ্যেই মূলত বিকল্প জ্বালানি প্রযুক্তির উদ্ভাবন। বিকল্প জ্বালানির মধ্যে রয়েছে ইলেক্ট্রিক ব্যাটারি, অ্যামোনিয়া, মিথানল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। বিকল্প এসব জ্বালানির বাণিজ্যিক ব্যবহারও শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক শিপিংয়ে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে অ্যামোনিয়া বা মিথানলের ব্যবহার হচ্ছে। স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের কারণে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনেরও বৈদ্যুতিক জ্বালানি কাজে লাগানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে বিকল্প জ্বালানি প্রযুক্তি ব্যবহারে নিশ্চিতভাবেই প্রারম্ভিক বিনিয়োগ ও পরিচালন খরচ বাবদ ব্যয়ের বোঝা বাড়বে। তবে তুলনামূলক কম জ্বালানি ব্যবহার ও পরিবেশের ওপর প্রভাব বিবেচনায় নিলে সড়ক পরিবহনের চেয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে প্রযুক্তিটি ব্যবহারের সুযোগ বেশি। তাই সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে প্রযুক্তিটি, চূড়ান্তভাবে যা পরিবহন মাধ্যমটির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে।
তথ্য একত্রীকরণ ও বিশ্লেষণ প্রযুক্তি
এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কার্গোর অবস্থান ও ট্রাফিকের অবস্থা সম্পর্কে ব্যাপকভিত্তিক রিয়েল-টাইম তথ্য সংগ্রহ এবং তা বিশ্লেষণ সম্ভব। পরিবহন মাধ্যম হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখার সব সম্ভাবনাই রয়েছে প্রযুক্তিটির। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনকে ট্রাকের মতো অন্যান্য পরিবহন মাধ্যমের সাথে সংযুক্তির মধ্য দিয়ে মাধ্যমগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনা সম্ভব। একটি সমন্বিত ও দক্ষ লজিস্টিকস সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা গেলে বিভিন্ন মাধ্যমে কার্গো প্রবাহে যে ভারসাম্যহীনতা, নিশ্চিতভাবেই তা নিরসন করা সম্ভব।
তবে এসব প্রযুক্তির ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি দরকার এগুলোর উন্নয়ন, ইলেক্ট্রিক প্রোপালশন শিপ চার্জিং স্টেশন স্থাপন ও বেসরকারি খাতে সিনকোমোডালিটি সার্ভিস চালুর ভিত্তি তৈরির মতো নীতি সহায়তা প্রদান। আর্থিক প্রণোদনাও এক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (এসক্যাপ) এ লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রকল্প নিয়েছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উদ্ভাবনী স্বয়ংক্রিয় শিপিং প্রযুক্তি চালুর লক্ষ্যে ২০২২ সালে গৃহীত একটি প্রকল্প এর মধ্যে অন্যতম। এর আওতায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোরস্বয়ংক্রিয় শিপিং প্রযুক্তি বাস্তবায়নে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নের কথা। সেই সাথে দেশগুলো যাতে নতুন এই প্রযুক্তি সঠিকভাবে চালু করতে পারে সেজন্য তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে।