ডিজিটালাইজেশনের প্রভাব পড়েছে কম-বেশি সব খাতেই। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিবহন ও লজিস্টিক খাতেও ডিজিটাল প্রযুক্তি আত্তীকরণের বিকল্প নেই। এর মধ্য দিয়ে শিপার ও লজিস্টিক সেবাদাতাদের মধ্যকার ব্যবসায় প্রক্রিয়া যেমন গতিশীল হয়, একইভাবে প্রক্রিয়াটি সহজীকরণের মাধ্যমে অনেক বেশি দক্ষ ও কার্যকরও হয়ে ওঠে। পরিবহনের অনেক মাধ্যম এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের ব্যবহার শুরু করেছে। অটোনমাস যানের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে এ খাতেও বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এ ধরনের ব্যবস্থা কার্যকরের ক্ষেত্রে বেশকিছ প্রতিবন্ধক রয়েছে। এর মধ্যেও আশার কথা হলো প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তাতে করে সেই প্রতিবন্ধকতাও অনেকটাই লাঘব হয়েছে। সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর জোগান দিচ্ছে। ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল সিঙ্গেল মার্কেট উদ্যোগ ও ডিজিটাল ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড লজিস্টিকস ফোরামের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
তবে ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতার কথা মাথায় রেখে অন্যদেরও এই পথে যাওয়ার বিকল্প নেই। কারণ, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতকে একদিকে পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যমের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে, অন্যদিকে মাল্টিমোডাল পরিবহন ইকোসিস্টেমেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটি।
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের তিনটি ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের কথা জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে নৌযান চলাচল ও ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন, যাতে নৌযানের জ্বালানি সাশ্রয়ের পাশাপাশি নৌ-অবকাঠামোর সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যমের সাথে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের সমন্বয়ও প্রয়োজন। তৃতীয়টি হচ্ছে প্রশাসনিক বোঝা কমানো। ইউরোপিয়ান কমিশনের ‘ডিজিটাল ইনল্যান্ড ওয়ারটারওয়ে এরিয়া’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনেও এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
‘ডিজিটাল ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়ে এরিয়া (ডিনা)’ এমন একটি ধারণা, যা অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের অবকাঠামো, ব্যক্তি, পরিচালন, নৌযান ও কার্গো সম্পর্কিত তথ্যকে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত করে। পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যমের সাথেও এই তথ্যের বিনিময় হয়। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন একটি প্ল্যাটফরম, যার মাধ্যমে এসব তথ্যের নিয়ন্ত্রিত বিনিময় নিশ্চিত হবে।
ডিজিটাল ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়ে এরিয়া বিভিন্ন শ্রেণির অংশীজনের প্ল্যাটফরম, যারা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। মোটা দাগে এদের তিনটি স্তরে বিভক্ত। প্রথম স্তরে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহারকারী, যেমন শিপার ও লজিস্টিক সেবাদাতা। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে খোদ পরিবহন খাত, যেমন বার্জ অপারেটর, টার্মিনাল অপারেটর এবং অন্য পরিবহন মাধ্যমের সাথে তাদের সংযোগ। আর তৃতীয় স্তরে রয়েছে কর্তৃপক্ষ অথবা তাদের হয়ে কাজ করা অন্য পক্ষ। কর্তৃপক্ষের কাজ মূলত বিপর্যয় হ্রাসে উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রকাশ এবং চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা।
ব্যবস্থাটিতে প্রত্যেক অংশীজনেরই ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে এবং সেগুলো অর্জনে কিছু বিষয়ের জোগান থাকতে হয়। শিপারের উদ্দেশ্য কম খরচে লজিস্টিক সেবার তালাশ, বুকিং ও তার বাস্তবায়ন এবং শিপমেন্টের সময় কার্গোর উন্নত দৃশ্যমানতা। এজন্য দরকার পড়ে অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রদানকারী লজিস্টিক সেবায় প্রবেশগম্যতা, ডিজিটালি লজিস্টিক সেবা বুকিং দেওয়ার সুবিধা ও কার্গোর অবস্থানগত তথ্য জানা।
লজিস্টিক সেবাদাতাদের উদ্দেশ্যও প্রায় একই রকম। উদ্দেশ্য পূরণে তাদেরও বার্জ অপারেটরদের দেওয়া সেবাসমূহ ও সহজে বুকিং সুবিধার প্রয়োজন পড়ে। বার্জ অপারেটরদের লক্ষ্য থাকে ব্যয়সাশ্রয়ে আরও দক্ষ নেভিগেশন এবং নির্ভরযোগ্যতা বাড়ানো বা ধরে রাখা। বিদ্যমান বা নতুন গ্রাহকদের আরও বেশি পণ্য পরিবহনও করাও লক্ষ্য থাকে তাদের। সেই সাথে লক্ষ্য থাকে কম পরিশ্রমে কীভাবে সব নিয়ম-কানুন পরিপালন করা যায়। এজন্য প্রয়োজন যতটা দক্ষভাবে সম্ভব যাত্রার পরিকল্পনা করা, যার জন্য চাই ট্রাফিক-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য। বন্দর বা টার্মিনালে অপেক্ষমাণ সময় কমিয়ে আনার স্বার্থে টার্মিনাল অপারেটরদের সমন্বয়ের সক্ষমতাও থাকতে হবে।
টার্মিনাল অপারেটরদের লক্ষ্য মূলত টার্মিনাল পরিচালনায় দক্ষতা বাড়ানো ও বন্দরে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা। এজন্য বার্জ অপারেটরের সাথে সমন্বয় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আর কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য অভ্যন্তরীণ নৌপথের নিরাপদ ও দক্ষ ব্যবহারে সহায়তা দেওয়া। অন্য মাধ্যমের তুলনায় নৌপথের ব্যবহার বাড়ানোর দিকেও নজর থাকে কর্তৃপক্ষের। এজন্য সবার আগে যেটা দরকার, তা হলো কোনো নির্দিষ্ট করিডোরে বার্জ অপারেটরদের জাহাজ পরিচালনার পরিকল্পনা-সংক্রান্ত অতিরিক্ত উপাত্ত কর্তৃপক্ষের হাতে থাকা।
বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে নানা উপাত্তের ডিজিটাল বিনিময়ের জন্য বেশি ব্যবস্থা ও সেবা চালু আছে। শিপারদের জন্য রয়েছে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সলিউশন (এসসিএম)। লজিস্টিক সেবার চুক্তি করতে বৃহৎ শিপার ও লজিস্টিক সেবাদাতারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক বুকিং প্ল্যাটফরম তৈরি করেছে। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও শিপমেন্ট ব্যবস্থাপনায় অপারেটরদের জন্য রয়েছে ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস (টিএমএস)। বার্জ কল, কার্গো বোঝায় ও খালাস এবং টার্মিনাল পরিচালন-সংক্রান্ত অন্যান্য কাজ সম্পাদনে টার্মিনাল অপারেটরদের জন্য রয়েছে টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেমস (টস)। অনেক নৌযানে ভেসেল ট্র্যাকিং অ্যান্ড ট্রেসিং (ভিটিটি) সিস্টেমও স্থাপন করা হয়েছে। সেই সাথে চ্যানেল পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে আবহাওয়া-সংক্রান্ত উপাত্তও প্রকাশ করছে।
এসব ডিজিটাল সেবার মধ্যে সমন্বয়ে ডিজিটাল ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়ে এরিয়ার জন্য প্রয়োজন একটি স্বতন্ত্র ফ্রেমওয়ার্ক, যার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য বিভিন্ন সলিউশন, অংশীজন ও তাদের ডিজিটাল সিস্টেমের মধ্যে আন্তঃনির্ভরশীলতা তৈরি করা।
তবে ডিজিটাল ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়ে এরিয়ার রূপরেখা বাস্তবায়নে দুটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছেন গবেষকরা। সুশাসন ও মান ধরে রাখা তার একটি। অর্থাৎ এটি উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুশাসন থাকতে হবে। সেই সাথে ধরে রাখতে হবে মানদণ্ড। এছাড়া পরিবহনের অন্য মাধ্যমগুলোর সাথে এটিকে সাজুয্যপূর্ণও করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ডিজিটাল ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়ে এরিয়ার বিভিন্ন উপাদান উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা থাকতে হবে। এই সহযোগিতা অর্থায়নের ক্ষেত্রেও হতে পারে।