বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুধবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
17 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে সবুজ প্রযুক্তি

সবুজ প্রযুক্তি, পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি বা পরিবেশসম্মত প্রযুক্তি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এই যুগে সবচেয়ে চর্চিত বিষয়। পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনতে অভিযোজিত ও উদ্ভাবনী সমাধান কেন্দ্রে রেখেই এই প্রযুক্তির উন্নয়ন। সবুজ প্রযুক্তি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ যেমন হ্রাস করে একইভাবে দূষণ ও ক্ষতিকর বর্জ্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখতে ভূমিকা রাখে।
এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে অর্থনীতি ও পরিবহনের একেক খাতে একেক ধরনের সবুজ প্রযুক্তির আত্তীকরণ চলছে অনেক আগে থেকেই। তবে ধরন যা-ই হোক লক্ষ্য একটাই এবং তা হলো প্রথাগত প্রযুক্তির বিকল্প হাজির করা, যাতে করে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব সমাধানের সন্ধান পাওয়া যায়।

পরিবহন খাতে বিশ্বব্যাপীই এখন সবুজ প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে জোরেশোরে। পরিবহনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনও এর বাইরে নয়। কারণ, গ্রিন শিপিং বাস্তুতান্ত্রিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে যেমন বিশেষ ফলদায়ক একইভাবে দক্ষতারও প্রবর্ধক। সবুজ প্রযুক্তির পাশাপাশি ইন্টেলিজেন্ট প্রযুক্তি প্রয়োগের তৎপরতাও শুরু হয়েছে বৈশ্বিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থায়।

গ্রিন ইন্টেলিজেন্ট অভ্যন্তরীণ নৌযানের যে প্রযুক্তি, তার রয়েছে প্রধানত পাঁচটি মৌলিক অংশ। প্রথমত ইন্টেলিজেন্ট সিস্টেম, যা গড়ে তুলতে সমান্তরাল ইন্টেলিজেন্স অত্যন্ত জরুরি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইন্টেলিজেন্ট নেভিগেশন। ইন্টেলিজেন্ট কন্ট্রোল ও রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে এটা সমাধা হয়ে থাকে। তৃতীয়টি হচ্ছে সবুজ জ্বালানি, যা পরিবেশবান্ধব নৌ চলাচল নিশ্চিত করে থাকে। চতুর্থ অনুষঙ্গটি হচ্ছে ইলেক্ট্রিক প্রোপালশন ব্যবস্থা। পঞ্চম ও সর্বশেষ অংশটি হচ্ছে পরীক্ষা ও যাচাইকরণ কৌশল।
গ্রিন শিপিংয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগণ্য হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস। জ্বালানি দক্ষতা অর্জন এর পূর্বশর্ত। জ্বালানিদক্ষ নৌযান গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণই কেবল কমায় না, জাহাজ চলাচল কোম্পানির খরচও সাশ্রয় করে। সেই সাথে বাড়িয়ে দেয় পরিচালন দক্ষতা। এ কারণে দেশে দেশে জাহাজ মালিকরাও এখন এই দিকটাতে মনোযোগ বাড়িয়েছে। নতুন নির্মিত অভ্যন্তরীণ নৌযানে তাই জ্বালানি দক্ষতার কারিগরি বিষয়গুলো প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিদ্যমান নৌযানেও ইন্টেলিজেন্ট এনার্জি এফিশিয়েন্সি কন্ট্রোল টেকনোলজি অবলম্বন করা হচ্ছে, যাতে করে নৌযানের গতি, রুট ও পাওয়ার সিস্টেমের সর্বোচ্চ ও সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায়।

ইন্টেলিজেন্ট এনার্জি-এফিশিয়েন্সি কন্ট্রোল করা হয় মোটা দাগে তিনটি প্রক্রিয়ায়। সেন্সর ব্যবহার করে নৌযানের জ্বালানি ব্যবহার যন্ত্রপাতি ও চলাচলের অবস্থা অনলাইন পদ্ধতিতে মনিটরিং করা হয়। ইন্টেলিজেন্ট এনার্জি এফিশিয়েন্সি মূল্যায়ন ও তা সর্বোচ্চ করতে এ সংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহ, হস্তান্তর ও প্রক্রিয়াকরণ করা হয়ে থাকে। ক্লাস্টারিং ও মেশিন লার্নিংয়ের মতো ডেটা মাইনিং প্রযুক্তির সাহায্যে এনার্জি এফিশিয়েন্সি উপাত্তের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয় এবং জ্বালানি দক্ষতার বিভিন্ন নির্দেশকের মাধ্যমে নৌযানের জ্বালানি দক্ষতার স্তর ও অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়। সর্বোচ্চ জ্বালানি দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি নির্ভর করে সঠিক গতি ও রুট নির্ধারণের ওপর। এরপর একটি মডেল তৈরি করা হয় এবং সর্বাধুনিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে জ্বালানি দক্ষতার সর্বোচ্চকরণের একটি পদ্ধতি গড়ে তোলা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে জাহাজের সদস্যরা জ্বালানি দক্ষতা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে পরামর্শ পেয়ে থাকেন, যাতে করে জ্বালানি সাশ্রয়ের পাশাপাশি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করা সম্ভব হয়।

সবুজ ও ইন্টেলিজেন্ট নৌযানের পরীক্ষা এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ব্যাটারিচালিত ৬৪ টিইউ ধারণক্ষতার গ্রিন ইন্টেলিজেন্ট কনটেইনার জাহাজ গুয়োচুয়াংয়ের পরীক্ষাটি চালিয়েছে চীন। ৯৯৪ টনেজের ৬৪ মিটার দীর্ঘ ও সাড়ে ১২ মিটার গভীরতার জাহাজটি ২০২১ সালের জুনে তাইঝুতে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালনা করা হয়। অভ্যন্তরীণ নৌপথে মোট ২৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় জাহাজটি। উদ্ভাবনীমূলক বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির সম্মিলন ঘটানো হয়েছে জাহাজটিতে। ডিসি ইলেক্ট্রিক প্রোপালশন সিস্টেম, কনটেইনারাইজড মোবাইল পাওয়ার সাপ্লাই, ইন্টেলিজেন্ট চার্জিং ও রিপ্লেসিং সিস্টেম এবং ইন্টেলিজেন্ট শিপ অক্সিলারি নেভিগেশন সিস্টেম এর মধ্যে অন্যতম। প্রথাগত জাহাজের তুলনায় জাহাজটি বছরে ১ লাখ ৩০ হাজার লিটারের সমতুল্য জ্বালানি সাশ্রয় করতে সক্ষম। কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ কমাতে সক্ষম বছরে ৩৪০ টনের মতো।

নৌযানে হাইব্রিড পাওয়ার টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমেও জ্বালানি সাশ্রয় ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের বড় সুযোগ রয়েছে। চ্যাংঘ্যাং কার্গো ০০১ নামে একটি কার্গো ভেসেল পরীক্ষামূলকভাবে চালানোর মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিতও হয়েছে। ১৩০ মিটার দীর্ঘ, ১৬ দশমিক ২ মিটার প্রশস্ত ও ৭ দশমিক ২ মিটার ড্রাফটের জাহাজটিতে ডিজেল-গ্যাস-ইলেক্ট্রিক হাইব্রিড পাওয়ার টেকনোলজির পাশাপাশি ইন্টেলিজেন্ট এনার্জি এফিশিয়েন্সি কন্ট্রোল টেকনোলজিও ব্যবহার করা হয়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সরবরাহ করা কার্গো জাহাজটিতে সম্মিলন ঘটানো হয়েছে হাল ও প্রোপেলার অপটিমাইজেশন, ইঞ্জিন রুমে ইন্টেলিজেন্ট মনিটরিং সিস্টেম, শিপ-শোর সমন্বিত তথ্য ব্যবস্থা, সমন্বিত নেভিগেশন সিস্টেম এবং ইন্টেলিজেন্ট স্টিয়ারিং সিস্টেমের মতো সবুজ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তি। এসব প্রযুক্তি জ্বালানি দক্ষতার পাশাপাশি নৌযানটির নিরাপত্তাও বাড়িয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here