নদ-নদী এই অঞ্চলের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের প্রাণশক্তি নিহিত এই নদ-নদীতেই। ঐতিহাসিককাল থেকেই এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা, সমৃদ্ধির সাথে জড়িয়ে আছে এই নদী। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষায়, বাংলার ইতিহাস রচনা করেছে এখানকার ছোট বড় অসংখ্য নদী। এরাই যুগে যুগে বাংলাকে গড়েছে, আকৃতি-প্রকৃতি, মেজাজ তৈরি করেছে বাঙালির। এই নদীই বাংলার আশীর্বাদ ও অভিশাপ। বাংলার কোমল, নরম ও নমনীয় ভূমি নিয়ে বাংলাদেশের নদ-নদী ঐতিহাসিকভাবে কত খেলাই না খেলেছে; উদ্দাম প্রাণলীলায় কতবার যে পুরাতন খাত ছেড়ে নতুন খাতে প্রবাহিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সহসা এই খাত পরিবর্তনে কত সুরম্য নগর, কত বাজার-বন্দর, কত বৃক্ষ-শ্যামল গ্রাম, শস্য-শ্যামল প্রান্তর, কত মঠ ও মন্দির, মানুষের কীর্তি ধ্বংস করেছে, কত দেশখণ্ডের চেহারা ও সুখ-সমৃদ্ধি একেবারে বদলে দিয়েছে তার হিসাবও ইতিহাস সব সময় রাখতে পারেনি।
কালের পরিক্রমায় নদীর অনেক পুরাতন পথ মরে গেছে, দীর্ঘ, প্রশস্ত ও খরস্রোতা নদীও সংকীর্ণা, ক্ষীণ¯স্রোতা হয়েছে। অনেক নদী হারিয়েও গেছে। নদীর এই মরে যাওয়া, বদলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রাকৃতিক কারণ যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে মনুষ্য কারণ, যা আরও ব্যাপক, আরও বীভৎস।
নদীর প্রতি দায় ও দায়িত্ব তাই সর্বজনীন, সর্বকালীন। ‘বিশ্ব নদী দিবস’ সেই দায়বদ্ধতারই প্রতীক; একটি বৈশ্বিক উদ্যাপন। এটা কেবল একটি দিবস নয়, নদীর বহুমাত্রিক অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে এর প্রতি দায়বদ্ধ হওয়ার শিখন। সারা বিশ্বের সব নদীর প্রতিটি নৌপথ সুগম-নিরাপদ-বাধাহীন রাখার অঙ্গীকার। মার্ক অ্যাঞ্জেলোর ভাষায় ’ নদী হচ্ছে পৃথিবীর ধমনি; সত্যিকারের জীবনরেখা।’
দিবসের শুরু যেভাবে
নদীর ইতিহাস বহুকালের পুরোনো হলেও শুধু নদীকে নিয়ে আলাদা দিবস উদ্যাপনের রেওয়াজ খুব বেশি দিনের নয়। শৈশবেই নদীর ডাক যিনি শুনতে পেয়েছিলেন, বুঝতে শিখেছিলেন নদীদের ভাষা, সেই মার্ক অ্যাঞ্জেলোর ব্যক্তিগত উদ্যোগে সীমিত পরিসরে, স্বল্প আয়োজনে ১৯৮০ সালে শুরু হয় বিশ্ব নদী দিবস উদ্যাপন। নদীবিষয়ক বরেণ্য এই আইনজীবীর উদ্যোগে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া (বিসি) ইনস্টিউট অব টেকনোলজি ওই বছর থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার দিবসটির উদ্যাপন শুরু করে। প্রথম দিকে এটি পালিত হতো বিসি রিভারস ডে নামে।
এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ নদী রক্ষায় জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ২০০৫ সালে ‘জীবনের জন্য জল দশক’ ঘোষণা করে। একই সময়ে জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থনও করে। সেই থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি উদ্যাপন করে আসছে।
বাংলাদেশ অবশ্য দিবসটির চল শুরু হয়েছে আরও পরে ২০১০ সালে। ওই বছর থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও নদী রক্ষার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদ্যাপিত হচ্ছে। তবে সরকারি-বেসরকারিভাবে দিবসটি প্রথম পালিত হয় ২০১৬ সালে। সেই থেকে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর নানা আয়োজন ও অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে নদী দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রোববার হিসেবে এ বছর বিশ্ব নদী দিবস ছিল ২৫ সেপ্টেম্বর।
প্রতিপাদ্য
অন্য সব দিবসের মতো বিশ্ব নদী দিবসেরও একটি প্রতিপাদ্য থাকে। তবে প্রতিপাদ্য নির্বাচনে আন্তর্জাতিক অন্যান্য দিবসের থেকে বিশ্ব নদী দিবসের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কেন্দ্রীয় একটি প্রতিপাদ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চল বা দেশ তাদের প্রেক্ষাপটের সাথে সাজুয্যপূর্ণ একটা প্রতিপাদ্য ঠিক করে নেয়। যেমন এ বছর দিবসটির কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য ‘ওয়াটারওয়েজ অব লাইফ’ বা ‘জীবনের জলপথ’ হলেও বাংলাদেশে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আন্তঃসীমান্ত নদীতে বাংলাদেশের অধিকার’। আবার মালয়েশিয়ায় এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘রিভারস অ্যান্ড স্ট্রিমস ইন আওয়ার কমিউনিটিজ’। দেশভেদে দিবসটির প্রতিপাদ্য ভিন্ন ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন; নদীকে রক্ষা করা, নদীকে অবাধে বইতে দেওয়া।
বাড়ছে আয়োজনের পরিসর
এক দশক আগে দেশে স্বল্প পরিসরে সীমিত উদ্যোগে বিশ্ব নদী দিবস উদ্যাপনের শুরু হলেও এখন পালিত হচ্ছে বড় পরিসরে। উদ্যাপনের মিছিলে যোগ দিচ্ছে নতুন নতুন সংগঠন ও সংস্থা। এর মধ্যে বেসরকারি সংগঠন ও সংস্থা যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থাও। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, বিআইডব্লিউটিএ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পর্যটন কর্পোরেশনের মতো রাষ্ট্রীয় সংস্থা দিবসটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বেসরকারি সংগঠন ও সংস্থাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), রিভারাইন পিপল, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশ, ধরা, এনার্জি প্যাক অন্যতম।
নানা আয়োজনে নদীর প্রতি অঙ্গীকার
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নানা আয়োজনে এ বছর বিশ্ব নদী দিবস পালন করেছে। আয়োজনের অংশ হিসেবে কেউ সেমিনার আয়োজন করেছে, কেউ করেছে মানববন্ধন ও র্যালি। কেউ আবার পরিচ্ছন্নতা অভিযানও পরিচালনা করেছে। আয়োজনের ধরন ভিন্ন ভিন্ন হলেও অঙ্গীকার ছিল প্রায় অভিন্ন; নদীর প্রতি দায়বদ্ধতা। সব ধরনের দখল দূষণ থেকে রক্ষা করে নদীকে বাধাহীনভাবে প্রবাহিত হতে দেওয়া। ভবিষ্যতের জন্য টেকসই জলপথ নিশ্চিত করা। আরেকটি বিষয় এ বছরের বিশ্ব নদী দিবসের আলোচনাগুলোতে বড় করে উঠে এসেছে। তা হলো আন্তঃসীমান্ত নদীতে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা।
আন্তঃসীমান্ত নদীতে ন্যায্য হিস্যায় জোর:
বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষ্যে ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রিন রোডের পানি ভবনে দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘অভিন্ন নদীতে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার’ শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করে বিশ্ব নদী দিবস ২০২৪ উদ্যাপন পরিষদ। সেমিনারে অভিন্ন নদীতে পানির হিস্যার বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপনের ওপর গুরুত্ব দেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তবে এক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও তুলে ধরে তিনি। বলেন, আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশনে স্বাক্ষর না করার কারণে উজানের যেসব দেশ পানি দিচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে অভিযোগ করা যাচ্ছে না।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ১৯৯৭ সালে এই কনভেনশন হলেও ২০১৪ সালে ৩৬টি রাষ্ট্রের স্বাক্ষরের মাধ্যমে তা আইনে পরিণত হয়। কিন্তু এরপর উজানের কোনো দেশ এতে স্বাক্ষর করেনি। এ কনভেনশনে ন্যায্যতা ও সমতার কথা বলা আছে। এ কারণে উজানের দেশ আগ্রহী নয়।
১৯৯৭ সালের কনভেনশন হলেও ২৭ বছরেও বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেনি। কেন করেনি, তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এতদিনে যেহেতু বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি, তার নিশ্চয়ই লিখিত কিছু কারণ আছে। কেন আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে সেগুলো আসছে। সেটি আমরা পর্যালোচনা করে দেখব।
তিনি বলেন, আমাদের উজানে শুধু ভারত নয়, নেপাল এবং চীনও এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। চীন মেকং রিভার কমিশনেও স্বাক্ষর করেনি। ফলে ভাটির দেশ হিসেবে আমরা যখন এতে স্বাক্ষর করব, তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের পক্ষের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরব এবং তার ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের অধিকারের কথাগুলো বলতে পারব। যেহেতু এটা একটি জাতিসংঘের কনভেনশন, আমরা যদি অনুস্বাক্ষর করি তাহলে জাতিসংঘকে আমাদের কথাগুলো বলতে পারব।
প্রায় সময়ই একটি প্রশ্ন তোলা হয় এবং তা হলো আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে যায় না কেন? এর উত্তরে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতে কোনো একটা রাষ্ট্র এককভাবে যেতে পারে না। দুটি রাষ্ট্রকে পক্ষ হতে হয়। ইউরোপের দেশ যেতে পারে। কারণ, তাদের দেশে একটি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আছে। আমাদের দেশে নদীর প্রবাহ একটি প্রাণসত্তা শুধু নয়, নদী রাজনৈতিক, নদী অর্থনৈতিক বিষয়। নদী শুধু একটি নদী নয়। নদীকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে দেখতে হবে। কিন্তু নদী নিয়ে দর-কষাকষি উপমহাদেশে সেভাবে করা হয়নি।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বলা হয়ে থাকে পাকিস্তান ও ভারতে মধ্যে পানি ভাগাভাগি রাজনৈতিক কারণে আটকে গেছে। ফলে নদীকে আমরা একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে এগিয়ে নেব, সেই বাস্তবতা নেই। এ জন্য নদী নিয়ে আলোচনা করব। নদী রক্ষা নিয়ে আমাকে যতটা প্রশ্ন করা হয়, তার চেয়ে বেশি প্রশ্ন করা হয় ভারতের সাথে সম্পর্কের কী হবে তা নিয়ে।
দর-কষাকষির দুর্বলতা উজানের দেশগুলোর কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা বলে মন্তব্য করেন এই পরিবেশবিদ। তিনি বলেন, প্রথমত, যৌথ নদী কমিশনের সবাই প্রকৌশলী। সেখানে অন্য পেশাজীবীদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। কিন্তু নদী তো শুধু প্রকৌশলের বিষয় নয়। দ্বিতীয়ত. আমরা নিজেরা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলোচনা করি, আমরা নদীপাড়ের কথা শুনি না।
নদীর পানি ভাগাভাগি অনেক বেশি রাজনৈতিকভাবে করা হয় বলেও মন্তব্য করেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এক্ষেত্রে অতীতের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পানি ভাগাভাগির চুক্তি প্রায় হয়ে গেছে, চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাওয়া হয়েছে, এ সময় বলা হলো স্বাক্ষর করা হবে না। পানি ভাগাভাগিতে দুই দেশের স্বার্থে সূক্ষ্মভাবে ভারসাম্য আনতে হবে।
কিছু ক্ষেত্রে রাজনীতি টেনের আনার প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বন্যার পানি বাংলাদেশে কখন প্রবেশ করবে, কী মাত্রায় প্রবেশ করবে, বৃষ্টিপাতের মাত্রা কী, বাংলাদেশে কতটুকু প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, এসব তথ্য নিতান্তই মানবিক কারণে বিনিময় করতে হবে। সেখান থেকে আমরা ভারতের সাথে আলোচনা শুরু করতে চাই। সকল অভিন্ন জলরাশির ওপর বিভিন্ন কাঠামো করা হলে সেটা আমাদের জানতে হবে। না জানালে আমাদের পানি ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ব নদী দিবস উদ্যাপন পরিষদের আহবায়ক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস।
নদী রক্ষায় আইনের কঠোর প্রয়োগের ঘোষণা:
নদীগুলোকে রক্ষার পাশাপাশি দখল হয়ে যাওয়া নদী পুনরুদ্ধারে জোর দিয়েছেন পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এ লক্ষ্যে আইনের কঠোর প্রয়োগ শুরু করার কথা জানান তিনি।
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন আয়োজিত বিশ্ব নদী দিবস ও রিভার অ্যাওয়ার্ড ২০২৪ প্রদান উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ভবনে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, নদী শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, আমাদের সংস্কৃতি ও জীবিকার সাথেও নিবিড়ভাবে জড়িত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিতের অংশ হিসেবে নদীকে দূষণমুক্ত করতে হবে। আর এ জন্য সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। নদীকে দূষণমুক্ত করতে ব্যয়সাশ্রয়ী পরিকল্পনা প্রণয়নের কথা বলেন তিনি।
নদী রক্ষায় শিক্ষার্থীদের অঙ্গীকার:

নেত্রকোণায় বিশ্ব নদী দিবস উদ্যাপন করেছে ‘শিক্ষা সংস্কৃতি পরিবেশ ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি’। পরিবেশ ও ধান গবেষণা সংস্থা নেত্রকোণার বারসিক ও বেলার সহযোগিতায় দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষ্যে ৭০টি নদীর নাম লেখা প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে শিক্ষার্থীরা। টিফিনের ফাঁকে জেলা শহরের মোক্তারপাড়া ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে এই প্রদর্শন অনুষ্ঠিত হয়।
এ ছাড়াও নদী নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কুইজ প্রতিযোগিতা শেষে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নদীর নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্কুল মাঠে মানবপ্রাচীর করে। প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে স্কুলের কয়েকটি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে নিজেরা সচেতন হওয়া ও অন্যদের সচেতন করার অঙ্গীকার করে।
নদী বাঁচলে বাঁচবে সুন্দরবন:
সুন্দরবনের নদীতে বিষ প্রয়োগে মাছ ধরা একটি বড় সমস্যা। এ ছাড়া এখানকার নদীগুলোতে শিল্প ও প্লাস্টিক দূষণও কম নয়। এগুলো বন্ধে বিশ্ব নদী দিবসে ধরিত্রী রায় আমরা (ধরা), ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ নদী পাড়ে মানববন্ধন পালন করে। মানববন্ধনে আয়োজকরা বলেন, নদী বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে। আর সুন্দরবন বাঁচলে নদীর মাছ ও জীববৈচিত্র্য ভালোভাবে টিকে থাকবে। বেঁচে থাকবে বাংলাদেশ। তাই বনের খালে বিষ প্রয়োগে মাছ নিধন বন্ধ এবং শিল্প ও প্লাস্টিক দূষণ বন্ধের দাবি জানান তারা।
মোংলা বন্দরের পশুর নদীতে অনেক সময় কয়লা ও জ্বালানি তেলসহ রাসায়নিক পণ্যবোঝাই জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে। এর ফলে হুমকির মুখে পড়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। কারণ, সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের অনেকটাই নির্ভর করে পশুর নদের স্বাস্থ্য কতটা ভালো তার ওপর। এ ছাড়া জাহাজের বর্জ্য, কয়লা, তেল ও প্লাস্টিক দূষণেও সুন্দরবনের প্রাণ পশুর নদের জলজপ্রাণীর প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব বিবেচনায় পশুর নদী রক্ষায় সব রকমের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয় মানববন্ধনে।
পাশাপাশি নদী দখল ও দূষণকারীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানান আয়োজকরা। তারা বলেন, উপজেলা ও জেলা নদী রক্ষা কমিটিকে সচল করে নদীর অভিভাবক হিসেবে নদী রক্ষা কমিশনকে সক্রিয় ও ক্ষমতায়ন করা এখনই জরুরি। নদী দখল ও দূষণকারীদের তালিকা প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বন ও নদী রক্ষা করা সম্ভব হবে। মানববন্ধন শেষে পশুর নদের প্লাস্টিক বর্জ্যরে প্রতীকী পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি পালন করা হয়।
নদ-নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির আহ্বান:
সিলেট বিভাগে ৩৫টি নদ-নদী বেশি সংকটাপন্ন বলে তথ্য তুলে ধরা হয় সিলেটে আয়োজিত বিশ্ব নদী দিবসের আলোচনায়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আয়োজিত ‘সিলেটের নদ-নদী রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ও জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের তথ্যে গরমিল আছে। নদীরক্ষা কমিশনের তথ্যমতে, বিভাগে নদ-নদী ১৬৮টি। অন্যদিকে পাউবোর হিসাবে মাত্র ৩৬টি। এসব নদীর অনেকগুলো অবৈধ দখলে চলে গেছে। এগুলো দখলমুক্ত করে খনন প্রয়োজন।
অবৈধ দখল ও বালুমহাল থেকে নদীকে রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বক্তারা আরও বলেন, সিলেটের ধলাই নদের সাদা পাথর ও সুনামগঞ্জের জাদুকাটা নদীতে সৌন্দর্য উপভোগে যান পর্যটকরা। কিন্তু সেখানে বালু ও পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। অবৈধ দখলদার ও বালুমহালের কারণে পর্যটকরা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অবৈধ এই দখলদার ও বালুমহাল থেকে নদীকে রক্ষা করা প্রয়োজন।
সভায় সিলেটের নদ-নদী রক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এগুলো হলোঃ ছোট-বড় সব নদ-নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা; নদ-নদীর সীমানা নির্ধারণ করা; অবৈধ দখলদারদের তালিকা করে অবিলম্বে উচ্ছেদ করা; সিএস (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এসএ) ম্যাপ অনুযায়ী নদীগুলো পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করা; নদী খনন ও দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম সমন্বিতভাবে করা; নদীতীর সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের ব্যবস্থা করা; পায়ে হাঁটার পথ নির্মাণ করা এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বিঘ্ন ঘটায় এমন সব অবকাঠামো অপসারণ করা।
সংকটাপন্ন নদী দ্রুত সংরক্ষণের আহ্বান:

বিভাগীয় শহর হিসেবে সিলেটের পাশাপাশি রাজশাহীতেও এদিন বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। নগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে বেলা আয়োজিত ওই আলোচনা সভায় জানানো হয়, রাজশাহী বিভাগের ৪৫টি নদীর মধ্যে ২১টি সংকটাপন্ন।
আলোচনা সভায় উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে নদীগুলোকে বাঁচাতে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। প্রবন্ধ উপস্থাপন শেষে উন্মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
বক্তারা বলেন, রাজশাহী বিভাগে ৪৫টি নদী রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২১টি বেশি সংকটাপন্ন। এই নদীগুলো দ্রুত সংরক্ষণ না করা হলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এসব নদীপাড়ে শিল্পবর্জ্য ফেলা হচ্ছে। অনেকে নদী দখল করে বসতিসহ নানা স্থাপনা করেছে।
মার্চ টু ময়ূর রিভার:
বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষ্যে ‘মার্চ টু ময়ূর রিভার’ পালন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) খুলনা শাখা। ময়ূর নদ খনন ও সংরক্ষণের দাবিতে নগরীর গল্লামারীস্থ লায়নস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে পদযাত্রা শুরু হয়। ময়ূর নদের পাড়ে এক সমাবেশের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর পলিমাটি দিয়ে এ দেশের জন্ম। নদী মায়ের মতোই দেশের ভূমি, প্রকৃতি, গাছপালা, পশুপাখি সবকিছুই প্রতিপালন করছে। অথচ দখল-দূষণসহ মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে আমাদের নদীগুলো আজ নানামুখী সংকটে পড়েছে। খুলনা মহানগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ময়ূর নদটিও এর বাইরে নয়।
ময়ূর নদ রক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয় সমাবেশে। এর মধ্যে রয়েছে, এই নদীসংযুক্ত হাতিয়া ও ক্ষেত্রখালীসহ প্রায় ২২ কিলোমিটার নদী খনন, সংযুক্ত খালসমূহ পুনরুদ্ধার, এ নদীর উৎসস্থল বিল ডাকাতিয়াকে অবমুক্ত ও জলাবদ্ধতা নিরসন, ময়ূর নদের মিলিতস্থলে নির্মিত স্লুইস গেট নিয়মিত পরিচালনা বা সম্ভাব্যতা যাচাইপূর্বক গেটগুলো স্থায়ীভাবে অবমুক্ত করা এবং সর্বোপরি খননকৃত মাটি-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ।
‘নদী আমার মা’:
নদ-নদীকে দূষণ থেকে বাঁচাতে ‘নদী আমার মা’ শীর্ষক ব্যতিক্রমী একটি কর্মসূচি পালন করছে এনার্জিপ্যাক বাংলাদেশ। কর্মসূচির আওতায় নদী থেকে বর্জ্য উত্তোলন ও উত্তোলিত বর্জ্য স্থানীয় পৌরসভার সাথে সমন্বয় করে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাজারো মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসূচিতে সংযুক্ত আছেন। পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনকে সচেতন করতে নিয়মিত প্রচারণাও চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষ্যে ‘নদী আমার মা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে খুলনার দাকোপে পশুর নদ ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ কমাতে বর্জ্য অপসারণ করা হয়। এনার্জিপ্যাক বাংলাদেশের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এতে অংশ নেন।
এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী হুমায়ুন রশিদ বলেন, নদী রক্ষায় আমরা সবসময়ই সচেষ্ট। শুধু দিবসকেন্দ্রিক নয়, বছরজুড়েই এমন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ভবিষ্যতে ‘নদী আমার মা’ কর্মসূচি আরও বেশিসংখ্যক নদী ও এলাকায় বিস্তৃত করা হবে। নদী থেকে বর্জ্য সংগ্রহে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু করা হবে।
‘নদী আমার মা’ কর্মসূচির সূচনা হয়েছিল খুলনার দাকোপে অবস্থিত জি-গ্যাস এলপিজি প্ল্যান্ট এলাকা থেকে। নদী তীরবর্তী ৫ হাজার মিটার এলাকায় ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩০ টনেরও বেশি বর্জ্য উত্তোলন ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া রূপগঞ্জে জি-গ্যাস স্যাটেলাইট প্ল্যান্টে প্রতি মাসের প্রথম শনিবার নদী পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এখান থেকে এ পর্যন্ত ৫ টন বর্জ্য উত্তোলন ও নিষ্কাশন করা হয়েছে।
নদী শপথ:
বিশ্ব নদী দিবস উদ্যাপন করেছে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও। এ উপলক্ষ্যে ২২ সেপ্টেম্বর রিভারাইন পিপলের সাথে যৌথভাবে ‘ওয়াটারওয়েস অব লাইফ’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে তারা। সেমিনারে দখল ও দূষণ থেকে নদীকে রক্ষার বিভিন্ন দিক, বিশেষ করে নদীকে প্লাস্টিক ও শিল্প কারখানার বর্জ্য থেকে মুক্ত করার ওপর জোর দেওয়া হয়। সেমিনার শেষে উপস্থিত সবাইকে ‘নদী শপথ’ পাঠ করানো হয়, যার প্রতিপাদ্য ছিল নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে ব্যক্তি প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দেওয়া।
এ ছাড়া ‘আন্তঃসীমান্ত নদীতে বাংলাদেশের অধিকার’ প্রতিপাদ্যে পাবনায়ও বিশ্ব নদী দিবস পালিত হয়েছে। দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বলা হয়, পাবনা ইছামতী নদীর জন্য বরাদ্দকৃত মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সুতরাং সঠিক এবং যথাসময়ে কাজটি সুসম্পন্ন হবে বলে আশা করা যায়। ইছামতী নদী ছাড়াও পাবনার অনেক নদী এখন মরা নদী। এই সকল নদী ও নদীর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
নদী দূষণ একটি বড় সমস্যা। নদীর এই দূষণ বিষময় করে তুলছে চারপাশের পরিবেশ। স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কোটি কোটি মানুষের। এই অবস্থা যে কেবল আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের, তা নয়। বিশ্বব্যাপীই নদীর একই অবস্থা। এর সাথে রয়েছে নদীকে রুদ্ধ করার প্রয়াস। অনেক সময় অপরিকল্পিত বাঁধ দিয়ে বা তীর দখল করে নদীকে আমরা অন্তরীণ করে ফেলছি। কারারুদ্ধ এইসব নদীকে মুক্ত করা তাই সময়ের দাবি, যাতে নিষ্প্রাণের বুকের ভেতর থেকে আবার প্রাণের ধারাস্রোত নিত্য উৎসারিত হতে পারে। এই বার্তা দেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই প্রতি বছর নদী দিবসের এই উদযাপন। তাই আমাদের যে নদ-নদী সেগুলোকে রক্ষা ও সতত প্রবহমান রক্ষার অঙ্গীকারকে স্মরণ করার এক অভূতপূর্ব এই আয়োজন এই বিশ্ব নদী দিবস। তবে দিবসটি শুধু পালনের মধ্যে বেঁধে রাখলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হবে না। সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে দিবসটির দর্শন, প্রতিপাদ্য ও মর্ম। কারণ, নদী মানে শুধু প্রবহমান জলধারা নয়, জীববৈচিত্র্যের এক বহমান ধারাও। তার চারপাশের অসংখ্য মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির ধারক।