দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পরিবহনের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। সম্প্রতি মোংলা বন্দরের কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ায় ও পায়রা বন্দরের উন্নয়ন এ অঞ্চলের নৌপথের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ অঞ্চলের নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করতে প্রয়োজন দেখা দিয়েছে নৌপথ খনন ও ঘাট উন্নয়নের।
আঠারো শতকের ষাটের দশক পর্যন্তও বরিশালে সড়ক বলতে তেমন কিছু ছিল না। যা ছিল তাও ভাঙাচোরা, প্রায় সময়ই থাকত অব্যবহৃত ও ক্ষীয়মাণ। ১৮৭০ সালে রোড কমিটি গঠনের পরও অবস্থার তেমন একটা বদল আসেনি। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার: বাকেরগঞ্জ’র তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭৩ সালে বরিশালে (তৎকালীন বাকেরগঞ্জ) সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল সাকল্যে ২৯ মাইল। পরবর্তী তিন-চার দশকের মধ্যে সড়কের দৈর্ঘ্য ৩৮৭ মাইলে উন্নীত হলেও তা পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহার হতো কদাচিৎ। এর প্রধানতম কারণ ছিল নৌপথে সহজে ও নির্ঝঞ্ঝাটে পণ্য পরিবহনের সুবিধা।
বরিশালের নদী ব্যবস্থার ধরনই উত্তর-দক্ষিণ বরাবর অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের এ অনায়াস সুবিধা তৈরি করে দিয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণে প্রবাহিত নদীগুলোও তখন মোটামুটি আকৃতির নৌকা চলাচলের জন্য যথেষ্ট গভীর ছিল এবং পর্যাপ্ত স্রোতের ওপর ভর করে যে কেউ তার পণ্য নিয়ে সহজেই পাশর্বর্তী কোনো বাজারে বা বড় নদীতে পৌঁছে যেতে পারত।
বরিশালে পূর্ব ও পশ্চিমে প্রবাহিত গভীর প্রবাহ ও খালেরও এক সময় অভাব ছিল না। বিশাখালী থেকে বলেশ্বর পর্যন্ত ছিল আমুয়াদন এবং পশ্চিম দিকে বিশখালী নদী ও পূর্ব দিকে বাকেরগঞ্জ নদীকে সংযোগকারী বিশখালী খাল। দক্ষিণে ছিল ভান্ডারিয়দন, খাগদন ও কুকুয়ার মতো বেশকিছু প্রবাহ, যা বড় নদীগুলোর মধ্যকার যোগাযোগকে সহজ করেছিল।
উন্নত ও সুগম্য অভ্যন্তরীণ নৌপথের কারণে ১৮৮০ সালের কিছু আগেই বরিশালের নদীগুলোতে স্টিমার চলাচল শুরু করে। ১৮৮৪ সালে খুলনা ও বরিশালের মধ্য দিয়ে নতুন রুট চালুর পর বরিশাল হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ স্টিমার সেন্টার। বরিশালের অভ্যন্তরে চলাচলকারী স্টিমারগুলোর পাশাপাশি পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জেলা থেকে কলকাতাগামী স্টিমারের স্টেশনে পরিণত হয় বরিশাল। অর্থাৎ সমগ্র বরিশালই স্টিমার যোগাযোগের আওতায় চলে আসে এবং বাধাহীনভাবে নৌপথে পূর্ববঙ্গের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ও বরিশালের এক অংশ থেকে আরেক অংশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে এখানকার নৌপথগুলো।
পরবর্তীকালে সড়ক যোগাযোগ উন্নত হলেও নৌপথের গুরুত্ব একটুও কমেনি। এখনো দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পরিবহনের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। সম্প্রতি মোংলা বন্দরের কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ায় ও পায়রা বন্দরের উন্নয়ন এ অঞ্চলের নৌপথের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
বরিশাল বিভাগের নৌপথগুলোর বর্তমান অবস্থা
নদী ব্যবস্থার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে নৌ-যোগাযোগের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠা বরিশাল বিভাগের এই নৌপথগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় বহু আগেই। ২০১৪ সালে প্রকাশিত বাকেরগঞ্জকে নিয়ে প্রকাশিত জেলা গেজেটিয়ারে বলা হয়, ‘এখানকার সব নদীই জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত হওয়ায় নৌযান চলাচলে বিলম্ব ঘটা স্বাভাবিক। গভীরতা হ্রাসের কারণে পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত প্রশস্ত নদীগুলো দিয়েও বেশি পণ্য নিয়ে সারা বছর নৌকা চলাচল সম্ভব হয় না। সত্যি বলতে, পণ্য পরিবহনের জন্য পূর্ব ও পশ্চিমের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা বরিশালের জন্য প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপুল ব্যয়ে নৌপথের গভীরতা বাড়ানো ছাড়া এটা সম্ভব নয় বলেই মনে হয়।’
এরই ধারাবাহিকতায় বরিশালের অধিকাংশ নৌপথেই নাব্যতা কমেছে। সম্প্রতি বিভাগের ৩১টি নৌপথের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, পর্যাপ্ত গভীরতা আছে চারটি নৌপথে। বাকি ২৭টি নৌপথের গভীরতা কাক্সিক্ষত মাত্রায় আনতে এসব নৌপথে কম-বেশি ক্যাপিটাল ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়বে।
সমীক্ষা, পদ্ধতি, রুট ও ঘাট
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের, বিশেষ করে বরিশাল বিভাগের নদীগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কারিগরি, পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক আঙ্গিক বিবেচনায় রেখে সরকারের নির্দেশনায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) গৃহীত ‘বরিশাল বিভাগের নদীসমূহের নাব্যতা উন্নয়ন, পানি নিষ্কাশনসহ জলাবদ্ধতা রোধ, সেচ ব্যবস্থা ও ল্যান্ডিং সুবিধাদি প্রদানকল্পে ক্যাপিটাল ও মেইনটেনেন্স ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী ব্যবস্থাপনার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনায় পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেছে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। ২০১৯ সালের ৫ মার্চ অনুমোদিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষার উদ্দেশ্য নৌপথ সচল করা, খালের উন্নয়ন ও বিআইডব্লিউটিএ’র অধীনে রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে খনন করা। সেই সাথে নদী-ভাঙন রোধে চর খনন ও লঞ্চঘাটের সাথে সংযোগ স্থাপন। সর্বোপরি এই অঞ্চলের নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধি ও ক্ষেত্রবিশেষে পুনরুদ্ধার; বিদ্যমান ঘাট বা ল্যান্ডিং স্টেশনগুলার সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন ও নতুন ঘাট বা ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণের মাধ্যমে নৌপথের নিরাপদ ও সুষ্ঠ ব্যবহার নিশ্চিত করা। পাশাপাশি পর্যটন, জলজ পরিবেশ, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণও সমীক্ষা প্রকল্পটির উদ্দেশ্য।
এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকল্পটির আওতায় মোট ৩১টি রুটের ওপর সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে, যার মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৭৫ কিলোমিটার। রুটগুলো হলো শোওলা-মুলাদী-সাত হাজার বিঘা, বাকেরগঞ্জ-মির্জাগঞ্জ, দপদপিয়া (বরিশাল)-চরাদি-বাকেরগঞ্জ-বগা-পটুয়াখালী-গলাচিপা-পায়রা পোর্ট-সাগর মোহনা, বরিশাল-ঝালকাঠি-বরগুনা-পাথরঘাটা, চাঁদপুর-মতলবগঞ্জ-নন্দলালপুর-কালির বাজার-কালিপুর, হিজলা-সাত হাজার বিঘা-বরিশাল, হুলারহাট-কলাখালী-শ্রীরামকাঠি-বাঁশবাড়িয়া বাজার (চাঁদপুর-গোপালগঞ্জ), ভান্ডারিয়া-পশারিবুনিয়া-ইকরি-তুষখালি, ইলিশা-দৌলতখান-তজুমদ্দিন-চরফ্যাশন, গাবখান-ধানসিড়ি-রাজাপুর-নিয়ামতি বাজার, আঙ্গারিয়া-মির্জাগঞ্জ, পাটকাঠি-ঝিলনা, ধুলিয়া-কালিসুরি-নারায়ণপুর-বাউপাল-কালাইয়া-নিমদি ও ভাটশালা-বাহেরচরা বাজার, হোসনাবাদ-টরকি-ফাসিয়াতলা, হুলারহাট-পিরোজপুর, ইন্দুরকানি-মাটিভাঙ্গা বাজার, লেবুখালি-পাঙ্গাসিয়া-পায়রাকুঞ্জ, চরমোনাই-দুর্গাপাশা-ধুলিয়া-বোরহানুদ্দিন-লালমোহন-গোসাইরহাট-চর মন্তাজ, আলিমাবাদ-মুলাদি-মিরগঞ্জ, কাউখালি-বানারীপাড়া-উজিরপুর-বাবুগঞ্জ-শায়েস্তাবাদ হাট, পায়রা বন্দর-খেপুপাড়া-মহীপুর হাট-কুয়াকাটা, খেপুপাড়া-তেগাসিয়া-হালদাবাড়িয়া, গাবখান-আমরাজুরি-কাউখালি-ভান্ডারিয়া-চরখালি, লাহারহাট-শ্রীপুর-ভেদুরিয়া, লাহারহাট-গেরুরিয়া, হিজলা-শোওলা, মেহেন্দিগঞ্জ-চর হাড়িয়া-চর মহিষা-চর ভোলানাথ, পয়সার হাট-চৌমোহনা হাট-বৈঠাকাটা-শ্রীরামকাঠি, পটুয়াখালী-পায়রাকুঞ্জ-মির্জাগঞ্জ-আমতলী-তালতলী, বরিশাল-সাহেবের হাট-লাহারহাট এবং ভেদুরিয়া-ভোলা-গঙ্গাপুর।
সমীক্ষা পরিচালনার ক্ষেত্রে এ-সংক্রান্ত পূর্ববর্তী কাজগুলো পর্যালোচনার পাশাপাশি হাইড্রো-মরফোলজিক্যাল উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই সাথে ট্রাফিক জরিপ, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট মূল্যায়ন ও পরিবেশগত অবস্থাও নিরূপণ করা হয়েছে। বন্দর ও ঘাটসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য বরিশাল নদীবন্দর কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মতামত নেওয়া হয়েছে স্থানীয় জনগণের।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষে খসড়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি বরিশাল সার্কিট হাউজে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার ড. অমিতাভ সরকারের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন বরিশাল বিভাগের সংসদ সদস্যবৃন্দ, বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবত সাদিক আবদুল্লাহ ও বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদিক। কর্মশালায় উন্মুক্ত আলোচনায় অতিথিরা কীর্তনখোলাসহ অন্যান্য নদী দখলমুক্ত করা, নদীদূষণ রোধ করা, নদীতীর ও সীমানা চিহ্নিতকরণ, খননকৃত মাটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, ব্রিজ নির্মাণের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ক্লিয়ারেন্স নিশ্চিত করা, ঝালকাঠির বাসন্ডা খালের নাব্যতা রক্ষা করা এবং বরিশাল শহরের খালগুলো পুনরুদ্ধারের সুপারিশ করেন।
খনন প্রয়োজন ৪৩০ কিলোমিটার নৌপথ
বরিশাল বিভাগের জরিপকৃত ৩১টি নৌপথের মধ্যে চারটিতে পর্যাপ্ত গভীরতা থাকায় সেগুলো খননের প্রয়োজন নেই। এর মধ্যে বুড়িশ্বর-পায়রা নদীর আঙ্গারিয়া-মির্জাগঞ্জ নৌপথটি প্রথম শ্রেণির এবং সব স্থানেই প্রায় ১০ মিটার গভীরতা রয়েছে। লেবুখালি-পাঙ্গাসিয়া-পায়রাকুঞ্জ এবং খেপুপাড়া-তেগাসিয়া-হালদাবাড়িয়া নৌরুটেও পর্যাপ্ত গভীরতা থাকায় খননের প্রয়োজন নেই। তবে অবশিষ্ট নৌপথগুলোতে কম-বেশি খননের প্রস্তাব করা হয়েছে সমীক্ষা প্রতিবেদনে। সব মিলিয়ে খননের প্রয়োজন এ অঞ্চলের ৪৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংও। এর মধ্যে প্রথম তিন বছরে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে হবে ৫ কোটি ২০ লাখ ঘনমিটার। পরবর্তী সাত বছর ২১ কোটি ৩০ লাখ ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে পটুয়াখালী-পায়রাকুঞ্জ-মির্জাগঞ্জ-আমতলী-তালতলী নৌপথটির পটুয়াখালী ঘাটের সামনের অংশে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং চলমান রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের আওতায় রয়েছে লাহারহাট-শ্রীপুর-ভেদুরিয়া নৌপথটিও।
যেসব নৌপথে খনন
পরিমাণের হিসাবে বরিশাল বিভাগের নৌপথগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে দপদপিয়া (বরিশাল)-চরাদি-বাকেরগঞ্জ-বগা- পটুয়াখালী-গলাচিপা-পায়রা বন্দর-সাগর মোহনা নৌপথের। এই নৌপথটিতে মোট ১ কোটি ১০ লাখ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে হবে। এছাড়া হিজলা-সাত হাজার বিঘা-বরিশাল নৌপথে ৫৫ লাখ, ইন্দুরকানি-মাটিভাঙ্গা বাজারে ৬৫ লাখ এবং পায়রা বন্দর-খেপুপাড়া-মহীপুর হাট-কুয়াকাটা নৌপথে ৩৫ লাখ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে।
ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পর নাব্যতা ধরে রাখতে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংও সবচেয়ে বেশি করতে হবে এসব নৌপথেই। প্রস্তাব অনুযায়ী, ইন্দুরকানি-মাটিভাঙ্গা বাজার নৌপথটিতে সাত বছরে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়বে ২ কোটি ৬৬ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার। হিজলা-সাত হাজার বিঘা-বরিশাল নৌপথে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করতে হবে ২ কোটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার। এছাড়া পায়রা বন্দর-খেপুপাড়া-মহীপুর হাট-কুয়াকাটা নৌপথেও ক্যাপিটাল ড্রেজিং-পরবর্তী সাত বছরে ১ কোটি ৭১ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়বে।
রুট ১ : শোওলা-মুলাদী-সাত হাজার বিঘা
রুটটি বরিশাল জেলার নয়াভাঙ্গনি নদীর ওপর দিয়ে প্রবহমান। এটি হিজলা উপজেলার মেঘনা নদী থেকে যাত্রা করে মুলাদী উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় আড়িয়াল খাঁ নদীতে পতিত হয়েছে। গড়ে প্রায় ২১০ মিটার প্রশস্ত নৌরুটটি দিয়ে সারা বছরই নৌকা চলাচল করে।
ভাঙন ও পরিবৃদ্ধি সব নদীরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য। নয়াভাঙ্গনিও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে ১৯৮০-২০০৩ সালের মধ্যে নয়াভাঙ্গনি নদীর চর পরিবৃদ্ধির হার বেশি হওয়ায় নতুন ১০৮ হেক্টর এলাকার সংযোজন হয়। এ সময় নদীর গড় প্রশস্ততা কমে দাঁড়ায় প্রায় ৫০ মিটারে। যদিও ২০০৩-২০২০ সালের মধ্যে নদীটির পরিবৃদ্ধি ও ভাঙনের হার প্রায় সমান লক্ষ করা যায়।
শোওলা-মুলাদী-সাত হাজার বিঘা নৌপথের স্বাভাবিক নাব্যতা ফেরাতে নয়াভাঙ্গনিতে ২২ লাখ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে সমীক্ষা প্রতিবেদনে। গড়ে ১ দশমিক ৯৭ মিটার গভীরতায় নৌপথটির মোট ৩৩ দশমিক ৯৭ মিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়বে। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পর রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করতে হবে ৯০ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার।
রুট ২ : বাকেরগঞ্জ-মির্জাগঞ্জ
বাকেরগঞ্জ-মির্জাগঞ্জ বরিশাল জেলার ওপর দিয়ে প্রবহমান সীমান্ত নালা নদীর একটি নৌপথ। বাকেরগঞ্জ উপজেলায় খায়রাবাদ নদী থেকে যাত্রা আরম্ভ করে পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলায় বুড়িশ্বর-পায়রা নদীতে পতিত হয়েছে নদীটি। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও গড়ে ৭৫ মিটার প্রস্থের নৌপথটি দিয়ে মোটামুটি সারা বছরই ছোট-বড় নৌকা চলাচল করে।
বাকেরগঞ্জ-মির্জাগঞ্জ নৌপথের নাব্যতা বাড়াতে গড়ে ১ দশমিক ৫ মিটার গভীরতায় ৩৩ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার খননের কথা বলা হয়েছে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায়। এর মধ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে হবে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ঘনমিটার এবং রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ৬১ লাখ ৫০ ঘনমিটার। সমীক্ষা অনুযায়ী ১০ মিটার ও ২০ মিটার প্রস্থে খনন করতে হবে নদীটি পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনে। আর ৩৭ প্রস্থে খনন করা হবে নৌপথ সচল করার লক্ষ্যে।
রুট ৪ : বরিশাল-ঝালকাঠি-বরগুনা-পাথরঘাটা
বরিশাল-ঝালকাঠি-বরগুনা-পাথরঘাটা নৌরুটটি কীর্তনখোলা, সুগন্ধা, বিশখালী এবং খাগদুন নদীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নৌপথটি বরিশাল সদর উপজেলার কীর্তনখোলা নদী থেকে যাত্রা করে নলছিটি, রাজাপুর, কাঁঠালিয়া, বেতাগী ও বামনা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলায় এসে শেষ হয়েছে। প্রায় ১১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌপথটির কীর্তনখোলা নদীর অংশে প্রস্থ গড়ে ৩৪৫ মিটার। তবে খাগদুন নদীতে প্রশস্ততা ৪৫ মিটারে নেমে এসেছে। নদী দুটিতে কোনো ভাঙন না দেখা গেলেও সুগন্ধা ও বিশখালী নদী প্রশস্ত করার কারণে গত ২০ বছরে ভাঙন পরিলক্ষিত হয়েছে।
নৌপথটির সুগন্ধা ও বিশখালী নদীর অংশে লঞ্চঘাটের সামনে ৩ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার খননের কথা বলা হয়েছে। আর নৌপথটির খাগদুন অংশ সচল রাখার জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র অধীনে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের পরিমাণ ২৭ লাখ ঘনমিটার।
রুট ১০ : গাবখান-ধানসিড়ি-রাজাপুর-নিয়ামতি বাজার
গাবখান-ধানসিড়ি-রাজাপুর-নিয়ামতি বাজার নৌপথটি ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর খাল ও ধানসিড়ি নদীর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। ঝালকাঠি সদর উপজেলায় বিশখালী নদী থেকে নৌপথটির যাত্রা আরম্ভ হয়েছে। এরপর রাজাপুর উপজেলা হয়ে এটি কাঁঠালিয়া উপজেলায় বিশখালী নদীতে পতিত হয়েছে। প্রায় ২৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌপথটির প্রথম ১১ কিলোমিটার পড়েছে রাজাপুর খালে। এ অংশে নদীর প্রস্থ গড়ে ২০-২৫ মিটার। পরবর্তী সময়ে সাড়ে ১৫ কিলোমিটারের মতো ধানসিড়ি নদীর অন্তর্গত, যার প্রশস্ততা প্রায় ৬৫ মিটার।
সাড়ে ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌপথটির ১৬ দশমিক ২ কিলোমিটার গড়ে ২ দশমিক ২৭ মিটার গভীরতায় খননের পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে ৮ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার এবং রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ৩৪ লাখ ৯০ হাজার ঘনমিটার। নৌপথটির রাজাপুর খাল অংশের ১০ কিলোমিটার পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে খননের কথা বলা হয়েছে। খননের উদ্দেশ্যের মধ্যে আছে ১০ ও ২০ মিটার প্রস্থে জলাবদ্ধতা রোধ এবং ৩৭ মিটার প্রস্থে নদী পুনরুদ্ধার।
রুট ১২ : পাটকাঠি-ঝিলনা
পাটকাঠি-ঝিলনা লোহালিয়া নদীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত নৌপথ, যা বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলায় তেঁতুলিয়া নদী থেকে যাত্রা করে পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দুমকী উপজেলায় গিয়ে শেষ হয়েছে। নৌপথটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ কিলোমিটার এবং অংশবিশেষে ৪০০ থেকে ৭০০ মিটার প্রস্থ নদীটি। ঢাকা-আমতলী, ঢাকা-পটুয়াখালী নৌরুট এ নদীর ওপর দিয়েই চলে গেছে।
নৌপথটির লক্ষ্মীপাশা বাজার থেকে ঝিলনা পর্যন্ত অংশ সচল রাখতে ৭৪ মিটার প্রস্থে গড়ে ২ দশমিক ৩৮ মিটার গভীরতায় প্রায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটার খননের প্রস্তাব করা হয়েছে। নৌপথটিতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়বে ৩৩ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার এবং রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ১ কোটি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার। লোহালিয়া নদীতে কিছু চর থাকায় নদীর বাঁকে ভাঙন দেখা গেছে। তাই কিছু অংশে চর ড্রেজিংয়ের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে।
এর বাইরে বরিশাল বিভাগের দপদপিয়া (বরিশাল)-চরাদি-বাকেরগঞ্জ-বগা-পটুয়াখালী-গলাচিপা-পায়রা বন্দর-সাগর মোহনা নৌপথটির ১১৮ দশমিক ৬২ কিলোমিটার ১ দশমিক ২৪ মিটার গভীরতায় খননের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নৌপথটিতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে ১ কোটি ১০ লাখ ঘনমিটার ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ৪ কোটি ৫১ লাখ ঘনমিটার। চাঁদপুর-মতলবগঞ্জ-নন্দলালপুর-কালির বাজার-কালিপুর নৌপথের ৩৮ কিলোমিটার ২ দশমিক ৮ মিটার গভীরতায় খননের প্রস্তাব করা হয়েছে। নৌপথটিতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে হবে ১০ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ৪৩ দশমিক ১০ হাজার ঘনমিটার। ১ দশমিক ৫৬ মিটার গভীরতায় ২৯ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার খননের প্রস্তাব করা হয়েছে চাঁদপুর-মতলবগঞ্জ-নন্দলালপুর-কালির বাজার-কালিপুর নৌপথটি। এর মধ্যে ১০ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার করতে হবে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং পরবর্তী সাত বছর ৪৩ লাখ ১০ হাজার ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং। ভান্ডারিয়া-পশারিবুনিয়া-ইকরি-তুষখালি নৌপথটিরও ২৯ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার ১ দশমিক ৫৬ মিটার গভীরতায় খননের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে ৮০ হাজার ঘনমিটার ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ৩২ লাখ ৮০ হাজার ঘনমিটার। ঘাটের সম্মুখে ৪ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ১৮ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে ইলিশা-দৌলতখান-তজুমদ্দিন-চরফ্যাশন নৌপথটি খননের প্রস্তাব করা হয়েছে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায়। ২ দশমিক ৪৩ মিটার গভীরতায় ২৯ কিলোমিটার খননের পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে ধুলিয়া-কালিসুরি-নারায়ণপুর-বাইপাল-কালাইয়া-নিমদি নৌপথটির। ১৮ লাখ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং পরবর্তী সাত বছরের জন্য ৭৩ লাখ ৮০ হাজার ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করতে হবে। ভাটশালা থেকে বাহেরচরা বাজার নৌপথটির সাড়ে ৭ কিলোমিটার খননের পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে ২ দশমিক ২১ মিটার গভীরতায়। নৌপথটি নাব্য রাখতে ৪ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ১৮ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে। স্বল্প পরিসরে খননের কথা বলা হয়েছে হুলারহাট-পিরোজপুর নৌপথটির। ১ দশমিক ৯৫ মিটার গভীরতায় নৌপথটির ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার খননের প্রয়োজন পড়বে। এর মধ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে হবে ১ লাখ ৩০ হাজার ঘনমিটার ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ৫ লাখ ১০ হাজার ঘনমিটার। ৫৬ লাখ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ২ কোটি ৬৬ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে ইন্দুরকান্দি-মাটিভাঙ্গা বাজার নৌপথটির। ২ দশমিক ১২ মিটার গভীরতায় নৌপথটির ৮১ দশমিক ৭ কিলোমিটার খনন করতে হবে। চরমোনাই-দুর্গাপাশা-ধুলিয়া-বোরহানুদ্দিন-লালমোহন- গোসাইরহাট-চর মন্তাজ নৌপথটির খনন করতে হবে ঘাটের সামনে। নৌপথটির ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে ১৮ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ৭৪ লাখ ঘনমিটার। আলিমাবাদ-মুলাদি-মিরগঞ্জ নৌপথটিরও ২ দশমিক ৬৪ কিলোমিটার দশমিক ৮১ মিটার গভীরতায় খননের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নৌপথটির ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়বে ৩ লাখ ঘনমিটার ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ১২ লাখ ঘনমিটার। এছাড়া কাউখালি-বানারীপাড়া-উজিরপুর-বাবুগঞ্জ-শায়েস্তাবাদ হাট নৌপথটির ঘাটের সামনের অংশ খননের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায়। ১ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ৭ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে এই নৌপথটির। ৩৫ লাখ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ১ কোটি ৭১ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে পায়রা বন্দর-খেপুপাড়া-মহীপুর হাট-কুয়াকাটা নৌপথটির। ১ দশমিক ৫৬ মিটার গভীরতায় ২১ দশমিক ৫ কিলোমিটার খনন করতে হবে। গাবখান-আমরাজুরি-কাউখালি-ভান্ডারিয়া-চরখালি নৌপথটিরও ৯ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার খননের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ১ দশমিক শূন্য ৪ মিটার গভীরতায় নৌপথটিতে ৬ লাখ ৩০ হাজার ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ২৫ লাখ ৬০ হাজার ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করতে হবে। এ অঞ্চলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ লাহারহাট-শ্রীপুর-ভেদুরিয়া রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের আওতায় রয়েছে। দশমিক ৮১ মিটার গভীরতায় ৮ দশমিক ১২ কিলোমিটার খননের প্রস্তাব রয়েছে লাহারহাট-গেরুরিয়া নৌপথটির। এজন্য ৭ লাখ ৩০ হাজার ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ২৪ লাখ ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে। হিজলা-শোওলা নৌপথটির ২৫ দশমিক ৬ কিলোমিটার খননের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ দশমিক ১৯ মিটার গভীরতায়। এজন্য ১৮ লাখ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ৭৩ লাখ ৮০ হাজার ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করতে হবে।
এর বাইরে মেহেন্দিগঞ্জ-চর হাড়িয়া-চর মহিষা-চর ভোলানাথ নৌপথটির ১২ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার ১ দশমিক ৮ মিটার গভীরতায় খননের সুপারিশ করা হয়েছে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায়। নৌপথটিতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে ১২ লাখ ঘনমিটার ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ৪৮ লাখ ঘনমিটার। ১ দশমিক ১৪ মিটার গভীরতায় ১৪ কিলোমিটার খনন করতে হবে পয়সার হাট-চৌমোহনা হাট-বৈঠাকাটা-শ্রীরামকাঠি নৌপথটির। এজন্য ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন ১১ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং ৪৭ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার। এছাড়া পটুয়াখালী-পায়রাকুঞ্জ-মির্জাগঞ্জ-আমতলী-তালতলী নৌপথটির পটুয়াখালী ঘাটের সামনের অংশে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের কাজ চলমান রয়েছে। আড়াই মিটার গভীরতায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার খননের প্রস্তাব এসেছে বরিশাল-সাহেবের হাট-লাহারহাট নৌপথটির। ৮ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ৩৪ লাখ ৯০ হাজার ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করতে হবে। এছাড়া ১৫ লাখ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ৬০ লাখ ঘনমিটার রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে ভেদুরিয়া-ভোলা-গঙ্গাপুর নৌপথটির।
খননকৃত মাটি ব্যবস্থাপনা
খননের পর খননকৃত মাটি ব্যবস্থাপনা একটা বড় ইস্যু। মাঠ জরিপের মাধ্যমে মাটি রাখার স্থানও প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। খনন কার্যক্রম শুরুর আগে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের মতামতের ভিত্তিতে তা চূড়ান্ত করতে হবে। মাটি রাখার স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে জনসম্পত্তি (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা) অথবা খাসজমি। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিও স্থানীয় চাহিদা মোতাবেক নির্বাচন করা হয়েছে। কোনো সরকারি/ব্যক্তিগত চাহিদা না থাকলে ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে। আর ভাঙনপ্রবণ এলাকায় খননকৃত মাটি ভাঙন রোধে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ঘাট উন্নয়ন
দক্ষিণাঞ্চলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য ২৪৪টি ঘাটের মধ্যে লঞ্চঘাট রয়েছে ১৪৩টি এবং খেয়া/ট্রলার ঘাট ১০১টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাট রয়েছে পটুয়াখালী জেলায় ৭৫টি ও বরিশাল জেলায় ৬২টি। এছাড়া বরগুনায় ৩৪টি, ভোলায় ২৪টি, ঝালকাঠিতে ১৬টি এবং পিরোজপুর ও চাঁদপুরে ১৪টি করে ঘাট রয়েছে। তবে এসব ঘাটের সবগুলো ভালো অবস্থায় নেই। যেমন পাতারহাট ও পশ্চিম কাছিপাড়া লঞ্চঘাটটির কোনো জেটি নেই। আবার শ্রীপুরের লঞ্চঘাটটি পড়েছে নদীভাঙনের কবলে। গঙ্গাপুর লঞ্চঘাটটির পন্টুন ক্ষতিগ্রস্ত, কচুয়াখালী লঞ্চঘাটে কোনো সিঁড়ি বা জেটি তৈরি হয়নি। লেঙ্গুটিয়া লঞ্চঘাটের সংযোগ সড়ক থাকলেও সেটি বেহাল এবং একই অবস্থা গুলবুনিয়া খেয়াঘাটের সংযোগ সড়কেরও। এছাড়া বালিয়াতলী লঞ্চঘাটের জেটিটি জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে গেছে।
এসব ঘাট উন্নয়নের পাশাপাশি বর্ধিত চাহিদা ও যাত্রী সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে নতুন ঘাট নির্মাণ প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষায়ও সেই প্রস্তাবই দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বিদ্যমান ঘাট উন্নয়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ৪৩টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭টি বিদ্যমান ঘাট উন্নয়ন করতে হবে ভোলা জেলায়। এছাড়া পটুয়াখালীতে ১২টি, বরিশালে ছয়টি, চাঁদপুরে ছয়টি, পিরোজপুরে চারটি ও বরগুনায় একটি ঘাট উন্নয়ন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তবে ঝালকাঠির সবগুলো ঘাটই ভালো অবস্থায় আছে।
এছাড়া নতুন করে ৯টি লঞ্চঘাট ও ৩৯টি কার্গোঘাট উন্নয়নের কথাও বলা হয়েছে। নতুন লঞ্চঘাটগুলোর মধ্যে তিনটি করে হবে পটুয়াখালী ও ভোলা জেলায়, দুটি বরগুনায় ও একটি বরিশালে। প্রস্তাবিত নতুন কার্গোঘাটগুলোর মধ্যে ২১টি হবে পটুয়াখালী জেলায়। বাকিগুলোর মধ্যে ছয়টি হবে ভোলায়, পাঁচটি বরিশালে, তিনটি বরগুনায় এবং চাঁদপুরে ও ঝালকাঠিতে দুটি করে।
পর্যটনকে উৎসাহিত করতে পর্যটনের জন্য পাঁচটি ঘাটের পাশাপাশি নতুন ৩৮টি খেয়াঘাটের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে দুটি হবে ঝালকাঠিতে এবং বরিশাল, পিরোজপুর ও ভোলায় একটি করে। আর প্রস্তাবিত নতুন খেয়াঘাটগুলোর মধ্যে ১৪টি হবে পটুয়াখালী জেলায়। বাকিগুলোর মধ্যে ৯টি হবে বরগুনায়, আটটি বরিশালে, পাঁচটি ঝালকাঠিতে ও দুটি পিরোজপুরে।
প্রস্তাবিত ঘাটগুলো হবে আধুনিক মানের এবং ব্যবহারকারীদের জন্য সব ধরনের সুবিধাই থাকবে সেখানে। লঞ্চঘাটগুলোয় গ্যাংওয়ে, পন্টুন, সিঁড়ি ও র্যাম্প, পার্কিং, বিশ্রামাগার, টয়লেট, পানির ব্যবস্থাসহ আনুষঙ্গিক সব সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হবে।
কার্গোঘাটেও গ্যাংওয়ে, পন্টুন, সিঁড়ি ও র্যাম্প, পার্কিং, অফিস ভবন, টয়লেট, পণ্য মজুদের স্থানসহ অন্যান্য সুবিধা থাকবে। খেয়াঘাটের সুবিধাদির মধ্যে থাকবে সিঁড়ি ও র্যাম্প, যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা, কাউন্টার, টয়লেট, পানির ব্যবস্থা ও সৌরবিদ্যুতে চালিত বাতি।
পর্যটনের জন্য ঘাটগুলোতেও আধুনিক সব সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে। নৌকা ঘাঁটি, সৌরবিদ্যুতে চালিত বাতি, সিঁড়ি ও র্যাম্প, পার্কিং, খাবারের দোকান, টয়লেট এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুবিধা থাকবে এখানে।
এছাড়া বামনা, ভাসানচর, গলাচিপার মতো অধিক ভাঙনপ্রবণ অঞ্চলে বিশেষ ধরনের ঘাট নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। ভাসমান পন্টুন, যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা, টয়লেট, সৌর বিদ্যুচ্চালিত বাতিসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুবিধা থাকবে ভাঙনপ্রবণ অঞ্চলের এসব ঘাটে।
পরিবেশগত প্রভাব
ভৌত অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক কিছু প্রভাব থাকে। অন্য সব প্রকল্পের মতো বরিশাল বিভাগের নৌপথ ও ঘাট উন্নয়ন কার্যক্রমেরও পরিবেশগত কিছু প্রভাব থাকবে। এসব কার্যক্রম সম্পাদনকালে শব্দদূষণের পাশাপাশি পানি ও মাটির গুণগত মানের সাময়িক অবনতি ঘটতে পারে। অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে মাছের আবাসস্থলের। মৎস্য উৎপাদন সাময়িক হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বেড়ে যেতে পারে সামদ্রিক মাছের মৃত্যুহার। সেই সাথে শস্য উৎপাদন হ্রাস, জলজ ও স্থলজ উদ্ভিদের ক্ষতি এবং বন্য প্রাণীর সাময়িক স্থানান্তর ক্ষতি হতে পারে। সবশেষে পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ বিশেষ করে নারীদের জীবনযাত্রায় সাময়িক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে প্রাক-পুনঃখনন/প্রাক-নির্মাণকালীন এবং পুনঃখনন/নির্মাণকালীন নেতিবাচক এসব প্রভাবের অধিকাংশই সাময়িক এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এসব বিরূপ প্রভাব সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব। পরিবেশগত এসব প্রভাব মূল্যায়নের মাধ্যমেই এ প্রকল্পের যথার্থতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবগুলো প্রশমনের জন্য পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার সুপারিশও করা হয়েছে।
পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের নীতিমালা বিশ্লেষণে বলা যায়, খনন ও নির্মাণ-পরবর্তীকালে সামগ্রিকভাবে বরিশাল অঞ্চলের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক অনেক প্রভাব পড়বে, যার গুরুত্ব ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। ফলে নদীবহুল দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তৃত নৌপথগুলোর নাব্যতা যেমন বাড়বে, একইভাবে নিশ্চিত হবে নৌপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের সহজ, সুগম ও নির্বিঘ্ন ব্যবস্থা। ভূমিকা রাখবে উচ্চপ্রবৃদ্ধির সিঁড়ি বেয়ে অতি দারিদ্র্যমুক্ত উচ্চ মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আকাঙ্খিত ঠিকানায় পৌঁছে যেতে।