উত্তর প্রদেশের বারাণসী থেকে যাত্রা। গন্তব্য আসামের ডিব্রুগড়। মাঝে ২৭টি নদীর ৩,২০০ কিলোমিটার পথ ৫১ দিনে ভ্রমণ। বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল রুট ধরে এই যাত্রাপথে পৃৃথিবীর দীর্ঘতম রিভার ক্রুজ ‘গঙ্গা বিলাস’ ছুঁয়ে গেছে দুই দেশের ৫০টি পর্যটন স্পট। পর্যটকরা পেয়েছেন সেখানকার শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সাক্ষাতের এক বিরল উপলক্ষ্য। উন্মেষ ঘটেছে ভারত-বাংলাদেশ নদী পর্যটনের এক নতুন যুগের।
যা আছে গঙ্গা বিলাসে
‘এমভি গঙ্গা বিলাস’ ৬২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের বিলাসবহুল ক্রুজ। এর ড্রাফট ১ দশমিক ৪ মিটার। তিন ডেকবিশিষ্ট জাহাজটিতে স্যুট আছে ১৮টি, যাতে ৮০ জন পর্যটক ভ্রমণ করতে পারবেন। জাহাজে পর্যটকদের জন্য যে সেবার বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে তা বিলাসবহুল এবং মনে রাখার মতো। জাহাজটিতে দূষণমুক্ত সরঞ্জামের পাশাপাশি শব্দ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ভ্রমণকালে পর্যটকরা যাতে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন সেজন্য জাহাজে রয়েছে আলাদা জায়গার ব্যবস্থা।
উদ্বোধন
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৩ জানুয়ারি পৃথিবীর দীর্ঘতম রিভার ক্রুজ ‘এমভি গঙ্গা বিলাস’ উদ্বোধন করেন। রিভার ক্রুজের অভিজ্ঞতার ওপর আলোকপাত করে তিনি বলেন, প্রত্যেকের জন্যই এতে বিশেষ কিছু রয়েছে। যারা আধ্যাত্ববাদের সন্ধান করছেন তাদের জন্য রয়েছে কাশি, বোধগয়া, বিক্রমশীলা, পাটনা সাহিব ও মাজুলির মতো স্থান। কেউ বহুজাতিক ক্রুজের অভিজ্ঞতা পেতে চাইলে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় তারা সেই অভিজ্ঞতা পাবেন। আর যারা প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ করতে চান, তাদের জন্য রয়েছে সুন্দরবন ও আসামের বনভূমির মতো স্থান।
উদ্বোধনের পর ৩২ জন বিদেশি পর্যটক নিয়ে ওই দিনই বারাণসী ত্যাগ করে ‘গঙ্গা বিলাস’।
ভ্রমণপথ
বারাণসীর গঙ্গা আরতি বরাবরই পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। সেই আরতি দর্শন দিয়েই শুরু হয় ‘গঙ্গা বিলাস’-এর ভ্রমণ। ১৩ জানুয়ারি বারাণসী থেকে যাত্রা করে ‘গঙ্গা বিলাস’ বিহারের গাজীপুর-বক্সার-ছাপরা-পাটনা-মুঙ্গের-বোধগয়া-নালন্দা, ঝাড়খণ্ডের সাহিবগঞ্জ, পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা-মুর্শীদাবাদ হয়ে কলকাতায় পৌঁছায়। এক দিন বিরতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অংশের নামখানা-সজনেখালী হয়ে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে।
এই যাত্রায় মোংলা বন্দর-বাগেরহাট-মোরেলগঞ্জ-বরিশাল-সোনারগাঁ হয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় পৌঁছায়। এর পর আরিচা-টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ-চিলমারী-আসামের ধুবরি-গোয়ালপাড়া হয়ে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে গুয়াহাটিতে পৌঁছায় ‘গঙ্গা বিলাস’। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে পৌঁছায় মাজুলি আইল্যান্ডে এবং ৫১ দিনের ভ্রমণশেষে ১ মার্চ আসামের ডিব্রুগড় গিয়ে সমাপ্ত হয় বিশ্বের দীর্ঘতম পথ পাড়ি দেওয়া গঙ্গা বিলাসের যাত্রা।
বাংলাদেশে ১৫ দিন
‘গঙ্গা বিলাস’ তার ৫১ দিনের ভ্রমণকালে বাংলাদেশে অবস্থান করে ১৫ দিন। এই ১৫ দিনে এখানকার নদীগুলোর ওপর দিয়ে পাড়ি দেয় ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার পথ। পর্যটকরা প্রত্যক্ষ করেন এখানকার নদীর চিরন্তন সত্য রূপ। ঘুরে দেখেন ঐতিহাসিক স্থান। সাথে করে নিয়ে যান এখানকার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও উষ্ণ আতিথেয়তার স্মৃতি।
খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার আংটিহারায় অনবোর্ড ইমিগ্রেশন শেষে ৩ ফেব্রুয়ারি ‘গঙ্গা বিলাস’ সুন্দরবনে প্রবেশ করে। পরদিন ৪ ফেব্রুয়ারি মোংলা বন্দরে পর্যটকদের স্বাগত জানানো হয়। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এমপি তাদেরকে স্বাগত জানান। অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ভাতৃত্ব-বন্ধুত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্যের যে অনন্য সম্পর্ক গঙ্গা বিলাসের মাধ্যমে তা বিশ্ব পরিমণ্ডলে পৌঁছে গেছে। তাদের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে চলে গেছে। সর্বক্ষেত্রে অন্যরকম উচ্চতায় পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। জাহাজটি যখন বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে যাবে তখন এই বন্ধুত্বকেও আরও রঙিন করে দিয়ে যাবে।
গঙ্গা বিলাস রিভার ক্রুজ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ইকোট্যুরিজমের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মা। তাঁর ভাষায়, ‘বাংলাদেশের কিছু ঐতিহাসিক স্থানের মধ্য দিয়ে প্রমোদতরিটি যাবে। এই স্থানগুলোকে বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে নিয়ে আসবে এবং পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় অর্থনীতিতে গতি আনবে। তবে এটা শুধু দুই দেশের পর্যটনের সম্ভাবনা উন্মোচন করার উপায় নয়, মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপনেরও একটি নতুন উপায়। এ ছাড়া যে নদীগুলো ঐতিহ্যগতভাবে ভারত ও বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে গঙ্গা বিলাস সেই সংযোগকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হবে।’
সুন্দরবন, ষাটগম্বুজ মসজিদ পরিদর্শনশেষে ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালে আসেন পর্যটকরা। এদিন বিকাল পৌণে ৩টায় কীর্তনখোলা নদী ও বরিশাল নগরের মুক্তিযোদ্ধা পার্কের বিআইডব্লিউটিএর পন্টুনে নোঙর করে গঙ্গা বিলাস। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ সময় পর্যটকদের শুভেচ্ছা জানানো হয়। বরিশালে তাঁরা শতাব্দি প্রাচীন অক্সফোর্ড গির্জা পরিদর্শন করেন। ১৯০৩ সালে গ্রিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত গির্জাটি বরিশালের অন্যতম নান্দনিক পর্যটন আকর্ষণ। ৯ ফেব্রুয়ারি তারা ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের ভাসমান বাজার ঘুরে দেখেন।
বরিশালে একদিন অবস্থানের পর ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কাছে মেঘনাঘাটে নোঙর করে গঙ্গা বিলাস। সেখানে জাহাজেই রাত্রিযাপন করেন পর্যটকরা এবং পরদিন পনের শতকের সমৃদ্ধ নগরীর সাক্ষি হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা পানাম সিটি ঘুরে দেখেন। সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘরেও যান পর্যটকরা। কয়েক শতকের প্রাচীন ভাস্কর্য, কাঠের ভাস্কর্য এবং অন্যান্য প্রত্নত্বিক সামগ্রী তাঁদেরকে এই অঞ্চলের বহু পুরোনো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই অঞ্চলের মসজিদ স্থাপত্যের অনন্য শৈলী সম্পর্কে ইউরোপীয় পর্যটকরা ধারণা পান ১৬ শতকে সোনারগাঁয়ে নির্মিত গোলদি মসজিদ দেখে।
পর্যটকরা তাদের এই ভ্রমণে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সব খাবারের স্বাদ নিতেও ভোলেননি। সেই সাথে প্রত্যক্ষ করেন হাইকোর্ট ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, শহীদ মিনার ও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মতো ঢাকার ঐতিহাসিক সব স্থাপনা। জাতীয় সংসদ ভবনও ঘুরে দেখেন তাঁরা। ঐতিহাসিক এসব স্থাপনা ঘুরে দেখে নারায়ণগঞ্জের বৈদ্যরবাজারে রাত্রিযাপন করেন পর্যটকরা। পরদিন তাদেরকে নিয়ে গঙ্গা বিলাস পাল তোলে আরিচার উদ্দেশ্যে। সেখানে একদিন অবস্থান করে ১৩ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে যান পর্যটকরা। সেখানে তাঁরা ঐতিহাসিক আতিয়া মসজিদ পরিদর্শন করেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি সিরাজগঞ্জ যমুনা নদীর জেলখানা ঘাটে নোঙর করে। পর্যটকরা পরে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির ও পাঁচলিয়া এলাকায় তাঁতশিল্প পরিদর্শন করেন। তাঁরা সেখানকার তাঁতিদের সাথেও কথা বলেন। জেলার ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এবং আতিথেয়তা মুগ্ধ করে পর্যটকদের। ওই দিন সন্ধ্যায় পর্যটকদের নিয়ে সিরাজগঞ্জ ত্যাগ করে চিলমারীর উদ্দেশে যাত্রা করে জাহাজটি।
ব্রহ্মপুত্র নদে নাব্যতা সংকট থাকায় স্পিডবোটে করে চিলমারী বন্দরের রমনা ঘাটের বিআইডব্লিউটিএর পন্টুনে পৌঁছান গঙ্গা বিলাসের পর্যটকরা। সেখানে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা তাদেরকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যটকরা চিলমারী থেকে রংপুরে যান ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরে দেখতে। রংপুরে তাঁরা ২০ শতকের গোড়ার দিকে নির্মিত ঐতিহাসিক তাজহাট জমিদার বাড়ি পরিদর্শন করেন। এ ছাড়া তাঁরা ডিমলা কালিমন্দির ও শতাব্দি প্রাচীন কারমাইকেল কলেজ ঘুরে দেখেন। রংপুরে পর্যটকরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ও শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় তাদের ১৫ দিনের বাংলাদেশ ভ্রমণ।
পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি গঙ্গা বিলাস পৌঁছায় আসামের ধুবরিতে। এরপর আসামের গোয়ালপাড়া, সুয়ালকুচি, পান্ডু বন্দর, কোলং, সিঙ্গড়ি, সিলঘাট, ধানসিঁড়িমুখ, সুবানসিঁড়িমুখ, মাজুলি আইল্যান্ড-নিমাতিঘাট এবং শিবসাগর-বগিবিল হয়ে ১ মার্চ পৌঁছায় ডিব্রুগড়। এর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় নদীপথে পৃথিবীর দীর্ঘতম ভ্রমণের।
ডিব্রুগড় সমাপনী অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এমপি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে করা প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেডের (পিআইডব্লিউটিটি) অধীনে বাংলাদেশ-ভারত নৌপথে বাণিজ্য শুরু হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়েও তা কার্যকর আছে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘এমভি গঙ্গা বিলাস’ ভারত থেকে যাত্রা শুরু করে প্রটোকল রুট ধরে বাংলাদেশ হয়ে আসামে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রক্ত দিয়ে গড়া। ৫০ বছর ধরে এ সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে এ সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে।
‘এমভি গঙ্গা বিলাস’ যাতে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে সেজন্য জলসীমায় সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে বিআইডব্লিউটিএ। স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুযায়ী প্রটোকল রুটের নাব্যতা রক্ষা, বার্থিং সুবিধা নিশ্চিতকরণ ও নৌপথ ব্যবহারের জন্য ভয়েজ পারমিশন প্রদান এবং ভয়েজ পারমিশনের সার্বিক মনিটরিংয়ের দায়িত্বে ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাটি।
বাংলাদেশে নদী পর্যটনের নতুন যুগ
বাংলাদেশ নদীর দেশ। স্বাভাবিকভাবেই এখানে নদী পর্যটনের সম্ভাবনা অফুরন্ত। ভারত-বাংলাদেশ প্রটোকল রুট ব্যবহার করে দুই দেশের মধ্যে নদী পর্যটনের সম্ভাবনা আরও ব্যাপক। তাছাড়া ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল হয়ে কলকাতা রুটে যাত্রীবাহি স্টিমার চলত নিয়মিতই। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে যাত্রী পরিবহন সেবাটি বন্ধ হয়ে যায়। নৌ পর্যটন ও মানুষে মানুষে সংযোগের কথা বিবেচনা করে মাঝখানে বেশ কয়েকবার এটি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের এপ্রিলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের মধ্যে উপকূলীয় এবং প্রটোকল রুটে যাত্রী ও ক্রুজ সেবা সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয় স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি)।
সব প্রক্রিয়া শেষ করে ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ ভারতীয় জাহাজ আরভি বেঙ্গল গঙ্গা কলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা করে। একই দিনে ঢাকা থেকে কলকাতার উদ্দেশে ছেড়ে যায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) জাহাজ এমভি মধুমতী। ওই বছরের ৫ মে ভারতীয় জাহাজ এমভি মহাবাহু ৯ জন পর্যটক নিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। আর ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে বাংলাদেশ হয়ে গুয়াহাটির উদ্দেশে যাত্রা করে এমভি মহাবাহু। এরপর তিন বছর দুই দেশের মধ্যে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। আবারও অপেক্ষা। এবার এমভি গঙ্গা বিলাসের মাধ্যমে সেই অপেক্ষার অবসান হলো।
‘গঙ্গা বিলাস’ প্রটোকল রুট ব্যবহার করে নদী পর্যটনের এই সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, প্রটোকল রুটের এই ক্রুজ সেবা কেবল ভারত বা বাংলাদেশের নয়। এটা আন্তর্জাতিক। এতে লাভবান হবে দুই দেশই। শুষ্ক মৌসুমে নদীর যেসব জায়গায় চর পড়ে নাব্যতা সমস্যা দেখা দেয় বাংলাদেশ সরকার ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সেসব জায়গায় নাব্যতা বাড়িয়ে ক্রুজ চলার উপযোগী করে তুলছে। একইভাবে বাংলাদেশের কোনো জাহাজ ভারতে গেলে তারাও সেই কাজটিই করবে। এতে করে প্রটোকল রুটের নাব্যতা বাড়ানোর একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এ ছাড়া দুই দেশের নদীবন্দরেই পর্যটকবাহী জাহাজ থামবে। সেখানে বিদ্যুৎ, পানীয় জলসহ সব ধরনের লজিস্টিক সহায়তা দেবে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার। এজন্য তারা নির্দিষ্ট হারে মাশুল পাবে। বিদেশি পর্যটকদের ‘ফুটফল’ হলে স্থানীয় অর্থনীতিও লাভবান হবে। ফলে পর্যটনের মাধ্যম হিসেবে ‘রিভার ক্রুজ’ নদীমাতৃক এই অঞ্চলে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। তাতে নদী পর্যটনে ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশই সমানভাবে লাভবান হবে।
তাছাড়া রুটটা পরিচিতি পেলে বাংলাদেশি অপারেটররাও এই পথে রিভার ক্রুজ পরিচালনায় উৎসাহিত হবেন। বাংলাদেশের সেই সক্ষমতাও রয়েছে। এই সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশি ক্রুজ অপারেটররা এর সুফল কতটা ঘরে তুলতে পারে সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।
নদী পর্যটনের বৈশ্বিক মানচিত্রে বাংলাদেশ
গঙ্গা বিলাস রিভার ক্রুজ ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও বৈশ্বিক রিভার ক্রুজ মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছে। ৫১ দিনের যাত্রার সমাপনী দিনে ভারতের কেন্দ্রীয় বন্দর, জাহাজ চলাচল ও নৌপথমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল বলেন, এটা অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের ঐতিহাসিক ঘটনা। এমভি গঙ্গা বিলাস ভারত ও বাংলাদেশকে নদী পর্যটনের বৈশ্বিক মানচিত্রে জায়গা করে দিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে পর্যটন ও পণ্য পরিবহনের নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে গঙ্গা বিলাস।
পর্যটন গন্তব্য হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরারও একটা সুযোগ এনে দিয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম এই রিভার ক্রুজ। বিলাসবহুল এই রিভার ক্রুজটি যেভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে খবর হয়ে উঠেছে তাতে করে পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশ নতুন করে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বস লিখেছে, ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশেই রয়েছে বহু প্রাচীন মন্দির, ব্যস্ত শহর এবং অফুরান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। সবগুলো যদি এক যাত্রায় উপভোগ করতে চান তাহলে নৌযানই সর্বোত্তম মাধ্যম। বিশ্ববিখ্যাত গঙ্গা থেকে শুরু করে প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণ এশিয়ার আইকনিক এই নদী ঘিরে গড়ে ওঠা ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে গঙ্গা বিলাস সর্বোৎকৃষ্ট অবস্থানে রয়েছে। এসব উপভোগে বিলাস-ব্যসনেরও খামতি রাখা হয়নি।
সিএনএন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ইউরোপে রিভার ক্রুজিংয়ের ইতিহাস বেশ পুরোনো। বিভিন্ন কোম্পানি দানিয়ুব, রাইন ও সিয়েন নদীতে নিয়মিতই ক্রুজ সেবা পরিচালনা করছে। এর চল আছে উত্তর আমেরিকায়ও। কিন্তু ভারতে বলতে গেলে এটা নতুন। যদিও রিভার ক্রুজ অনেক বেশি গ্রামীণ ও প্রান্তিক গন্তব্যে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। সেই সাথে ওইসব গন্তব্যের কমিউনিটির জন্য রাজস্বেরও সুযোগ তৈরি করে। আকাশ বা সড়কপথে এইসব গন্তব্যে পৌঁছানোর সুযোগ সেভাবে থাকে না।
ভ্রমণ বিষয়ক বিখ্যাত প্রকাশনা কন্ডে নাস্ত ট্রাভেলার লিখেছে, বসা বা দাঁড়ানোর জন্য গঙ্গা বিলাসে রয়েছে উন্মুক্ত সানডেক। সেই সাথে রয়েছে স্পা। পুরো ভ্রমণকালে একেক অঞ্চলের খাবারের স্বাদ নেওয়া যাবে। আপনি যখন বিহারের মধ্য দিয়ে যাবেন, তখন উপভোগ করতে পারবেন লিটি চোখার স্বাদ। মুর্শিদাবাদে পাবেন সেহেরওয়ালি ও পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি মিষ্টি। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে যখন জাহাজটি অতিক্রম করবে তখন আপনার সামনে আসবে বাংলাদেশের ইলিশ, কাকড়া, খাসির মাংস ও টাইগার চিংড়ির নানা পদ। গঙ্গা বিলাসে ভ্রমণের এই আয়োজনটি এমনভাবে করা হয়েছে যাতে যাত্রাপথের প্রতিটি স্থানের অনন্য সংস্কৃতির মধ্যে আপনি ডুব দিতে পারেন।
স্থানীয় কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব
পর্যটন সব সময়ই স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের একটা সুযোগ তৈরি করে। সেই সাথে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যও গতি পায়। গঙ্গা বিলাসের মতো নদী পর্যটনেও সেই সুযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের ঘিরে স্থানীয় মাঝি, হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে। স্থানীয় বাজার ও হস্তশিল্পের বিক্রি বৃদ্ধিরও সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকটি নদীবন্দরে ভিড়বে ‘গঙ্গা বিলাস’। সুন্দরবন, মোংলা, বরিশাল কিংবা সোনারগাঁওয়ে যাত্রীরা নামবেন, নানা দর্শনীয় বস্তু দেখবেন, নানা জায়গায় কেনাকাটাও করবেন। এতে করে পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের প্রোফাইল নিশ্চিতভাবেই সমৃদ্ধ হবে। সেই সাথে কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ বাড়িয়ে হিন্টারল্যান্ডের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ভূমিকা পালন করবে গঙ্গা বিলাসের মতো নদী পর্যটন।
নদী পর্যটনের সম্ভাবনা বিপুল। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক নদী পর্যটনের বাজার ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০২৭ সালে পর্যটন বাজারে নদী পর্যটনের হিস্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩৭ শতাংশ। বৈশ্বিক নদী পর্যটনের বাজারের নেতৃত্ব দিচ্ছে ইউরোপ। এই বাজারের ৬০ শতাংশের বেশি তাদের দখলে। অসংখ্য, সক্রিয় ও প্রমত্তা নদীর উপস্থিতির কারণে বাংলাদেশেরও এ বাজারে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। গঙ্গা বিলাস সে সম্ভাবনাকে নিশ্চিতভাবেই বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে নদী পর্যটনের সাফল্যের জন্য বেসরকারি খাতের বড় পরিসরে অংশগ্রহণ জরুরি। কারণ, নৌরুটে পলি জমে নৌ চলাচলে বিঘ্নের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। নৌপথগুলোকে সারাবছর প্রয়োজনীয় মাত্রায় নাব্য রাখতে পারে বেসরকারি অংশগ্রহণ। সেই সাথে আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনার জন্য উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ কর্মকাঠামোও দরকার। মনোযোগ দিতে হবে নদী পর্যটন ও কার্গো পরিবহনের কারণে মৎস্যজীবী ও মাঝিদের জীবিকার ওপর কোনো ধরনের প্রভাব পড়ে কিনা সেদিকেও।
সবশেষে, গঙ্গা বিলাস কেবল পর্যটনকেই এগিয়ে নেবে না, বন্ধুপ্রতীম দুই দেশের জনগণকে আরও কাছ্কাাছি নিয়ে আসবে। বন্ধুত্বকে আরও বাড়িয়ে দেবে। শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশও একই ধরনের রিভার ক্রুজ পরিচালনা করবে এবং সে সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। সেই সাথে বাড়বে রিভার ক্রুজের সংখ্যা। নদীর প্রতি আকৃষ্ট হবে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা। সেই প্রত্যাশা করাই যায়।