বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
16 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুড়িগঙ্গা : ঢাকার প্রাণসঞ্চারক

বুড়িগঙ্গা শুধু একটি নদীর নাম নয়, সমৃদ্ধ ইতিহাসও। মুঘলরা ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন মূলত বুড়িগঙ্গার আকর্ষণেই। সেই সময় থেকেই উচ্চবিত্তরা বুড়িগঙ্গার তীরে ভিড় করতে থাকেন। নদীর পাড়ে গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক দালানকোঠা। বাংলার সুবেদার মুকাররম খান তার শাসনকাজ চালাতেন এখান থেকেই। প্রতি রাতেই আলোকসজ্জায় রঙিন হতো বুড়িগঙ্গার পানি।

বুড়িগঙ্গা জোয়ারভাটা প্রভাবিত একটি নদী, যার উৎপত্তি সাভারের দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী থেকে। বুড়িগঙ্গা বয়ে গেছে ঢাকা শহরের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক দিয়ে। নদীটি কিভাবে বুড়িগঙ্গা নাম পেল? এ নিয়ে আছে একটি সনাতনী বয়ান। বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি ও নামকরণ নিয়ে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব) বইয়ে।

বুড়িগঙ্গা নিয়ে নীহাররঞ্জনের বয়ানটা এ রকম পদ্মার প্রাচীনতম প্রবাহপথের নিশানা সম্বন্ধে নি:শংসয়ে কিছু বলা যায় না। ফান ডেন ব্রোকের (১৯৬০) নকশাঁয় দেখা যায়, পদ্মার প্রশস্ততর প্রবাহের গতি ফরিদপুর-বাখরগঞ্জের (বরিশাল) ভিতর দিয়ে দক্ষিণ শাহবাজপুরের দিকে। কিন্তু এই নকশায় প্রাচীনতম পথটিরও কিছুটা ইঙ্গিত বোধ হয় আছে। এই পথটি রাজশাহীর রামপুর-বোয়ালিয়ার পাশ দিয়ে চলনবিলের ভিতর দিয়ে ধলেশ্বরীর খাত হয়ে ঢাকার পাশ ঘেঁষে মেঘনা খাড়িতে গিয়ে সমুদ্রে মিশত। ঢাকার পাশের নদীটিকে যে বুড়িগঙ্গা বলা হয়, তা এই কারণেই। এই বুড়িগঙ্গাই প্রাচীন পদ্মা-গঙ্গার খাত।

বুড়িগঙ্গার উদ্ভব ধলেশ্বরী থেকে হলেও এর প্রধান প্রবাহটি আসে তুরাগ নদ থেকে। কামরাঙ্গীর চরের কাছে তুরাগ নদ বুড়িগঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছে। ধলেশ্বরীর সাথে মিশেছে মুন্সিগঞ্জে। তবে ছাগলাকান্দির কাছে বুড়িগঙ্গার উজান অঞ্চল পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুধুমাত্র বন্যার সময় পানিপ্রবাহ দেখা যায়। যদিও ভাটি অঞ্চল সারা বছরই নাব্য থাকে। ধলেশ্বরী নদীর গতি-প্রকৃতির উপর নির্ভর করে ভাটি অঞ্চলে বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর মিলনস্থলের পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে এই মিলনস্থল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে ৩ দশমিক ২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।

বুড়িগঙ্গা শুধুই একটি নদীর নাম নয়, সমৃদ্ধ এক ইতিহাসও। মুঘলরা ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন মূলত বুড়িগঙ্গার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই। ঢাকা অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা হওয়ার পরও সারা বছর বুড়িগঙ্গার পানিপ্রবাহ তাদের চমৎকৃত করেছিল। বুড়িগঙ্গার সম্মুখভাগ মুঘলদের মধ্যে যারপরনায় আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। এটি ছিল পানির উৎস ও  যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম। এসব সুবিধার কারণে সেই সময়কার উচ্চবিত্তরা বুড়িগঙ্গার তীরে ভিড় জমাতে শুরু করেন। নদীর পাড়ে গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক দালান কোঠা। বাংলার সুবেদার মুকাররম খান তার শাসনকাজ চালাতেন এখান থেকেই। প্রতি রাতেই আলোকসজ্জায় রঙিন হতো বুড়িগঙ্গার পানি। নদীর বুকে নৌকায় জ¦লত ফানুস বাতি। বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ব্রিটিশ বণিক হেনরি টেইলর ১৮ শতকে লিখেছিলেন, বর্ষা মৌসুমে বুড়িগঙ্গা যখন পানিতে ভরে ওঠে, ঢাকাকে তখন ভেনিসের মতোই দেখায়।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব

যোগাযোগ সহজ করতে বুড়িগঙ্গার উপর সেতু ও ঘাট গড়ে ওঠে সেই মুঘল আমলেই। বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী শহরটি ক্রমেই ব্যবসা-বাণিজ্যের জনপ্রিয় কেন্দ্র হয়ে উঠতে থাকে। ১৭ শতকেই ইউরোপীয় বণিকরা ঢাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প গড়ে তোলেন। অর্থাৎ আজকের ঢাকার যে অর্থনৈতিক জৌলুস তার প্রভাবক এই বুড়িগঙ্গাই। ঢাকার জন্য বুড়িগঙ্গার অর্থনৈতিক গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। বলতে গেলে লাইফ লাইন। কিন্তু শিল্প ও পয়োবর্জ্যে বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহার উপযোগিতা হারাতে থাকে। দখলকারীদের দৌরাত্মে ছোট হয়ে আসতে থাকে নদীর পরিসর।

তবে দখলদারদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বুড়িগঙ্গা তার হারানো তীর আবার ফিরে পাচ্ছে। হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরের ফলে বুড়িগঙ্গার পানির স্বচ্ছতা ফিরে আসছে।

বাংলায় তমলিটিস নামে একটি বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায় গ্রিক পÐিত টলেমির মানচিত্রে। প্রাচীন বাংলায় তা¤্রলিপ্তি বা তা¤্রলিপ্ত নামে যে বন্দর, মনে করা হয় এটি তারই অন্য পরিচয়। বন্দরটির অবস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনিপুর জেলায় বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী রূপনারান নদীর মোহনায় অবস্থিত তমলুকই যে প্রাচীন তা¤্রলিপ্তি, সেটা মোটামুটিভাবে স্বীকৃত।

বলা যায় আবহমানকাল থেকেই বাংলার পরিবহন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে নদীবন্দর। কারণ পণ্য পরিবহনের জন্য শুধু নৌপথ থাকলেই তো চলে না। এজন্য চাই নদীবন্দর। তাছাড়া এই নদীবন্দরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে সব বড় শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্র।

ঢাকা নদী বন্দরও তেমনি একটি বন্দর, যেটি সদরঘাট নামেও পরিচিত। ঠিক কবে এ ঘাটের পত্তন হয়েছিল সে ইতিহাস এখনও অজানা। মতান্তরে এ ঘাটের বয়স হাজার বছরের কম হবে না। ঢাকা শহরের পত্তনের পর্বে যখন রেল ও সড়ক যোগাযোগ অনুপস্থিত তখন এই সদরঘাট দিয়েই নদীপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের চল শুরু হয়। এরপর অনেক সময় গড়িয়েছে; সড়ক, রেল ও আকাশপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বলে ঢাকা নদীবন্দরের গুরুত্বে কমতি আসেনি।

গুরুত্বের কথা বিবেচনায় নিয়ে ১৯৬৭ সালে বিআইডবিøউটিএ সদরঘাটে নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ করে আধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ব্যস্ততা বাড়ে সদরঘাটে। এখন সারাদেশ, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে রাজধানীর নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে এই নদীবন্দর। প্রতিদিন শত শত নৌযান সদরঘাটে নোঙর করে কিংবা ছেড়ে যায়। বার্জগুলোও সদরঘাটকে পণ্য ওঠানো-নামানোর কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। লঞ্চের ভেপুর শব্দ, যাত্রীদের ছোটাছুটি আর নৌশ্রমিকদের হাকডাকে ২৪ ঘণ্টাই মুখর থাকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দরটি।

যাত্রী নিরাপত্তা

ঢাকা নদীবন্দরে যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যাত্রীদের নিরাপত্তায় সদরঘাট টার্মিনালে স্থাপন করা হয়েছে ডিএমপি পুলিশ ফাঁড়ি ও নৌ পুলিশ ফাঁড়ি। মোতায়েন করা হয়েছে আনসারও। লঞ্চঘাটের বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে ৩২টি সিসি ক্যামেরা ও ২২টি মাইক। অবৈধ কুলিদের দৌরাত্ম্য বন্ধে চালু করা হয়েছে ‘শ্রম যার মজুরি তার’ নীতি। এর আওতায় পোর্টার বা কুলি নিয়োগ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। চুক্তিভিত্তিতে যাত্রীদের লাগেজ ও মালপত্র পরিবহন করেন তারা।

এছাড়া নদীবন্দরের কার্যক্রম যাতে নির্বিঘেœ চলতে পারে সেজন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ করেছে বিআইডবিøউটিএ। শুধু ২০১৯-২০ অর্থবছরেই ঢাকা নদীবন্দরের আশপাশের ২ হাজার ৬৩৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তীরভূমি উদ্ধার করা হয়েছে ৬৪ দশমিক ৭৫ একর। পাশাপাশি জরিমান আদায় করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। আর নিলামে তোলা হয়েছে ৮ কোটি ২৬ লাখ ১৫ হাজার টাকার সম্পদ।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড

কয়েকশ বছর আগে থেকেই প্রশাসনিক, বসতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে সদরঘাট। ১৮২০ সালের দিকে সদরঘাটের কাছে পূর্বদিকে ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের অফিসসহ অন্যান্য বহু অফিস পর্যায়ক্রমে স্থানান্তরিত হয় এবং এর উত্তর দিকের এলাকা নগরকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। এখন বন্দরের ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় সদরঘাটে গড়ে উঠেছে বিবিধ সামগ্রীর একটি বড় বাজার। বিভিন্ন নদীপরিবাহিত পণ্য, বিশেষ করে মাছ ও ফলের সুবিশাল সব আড়ত তৈরি হয়েছে সদরঘাটকে ঘিরে। সদরঘাটের সন্নিকটেই গড়ে উঠেছে পুস্তক প্রকাশনার প্রধানতম কেন্দ্র বাংলাবাজার।

ঢাকা নদীবন্দর থেকেই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, হুলারহাট, মাদারীপুর, চাঁদপুর, খুলনা, হাতিয়া, বাগেরহাটসহ মোট ৪৫টি রুটে লঞ্চ ও স্টিমার চলাচল করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here