ভাওয়াল গড়ের পাহাড়ি বংশী এলাকা থেকে উৎপত্তি হয়ে তুরাগ নদী গাজীপুরের কালিয়াকৈরে প্রবেশ করেছে। এরপর প্রথমে কিছুটা পূর্বদিকে অগ্রসর ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে মিলিত হয়েছে।
তুরাগ ঢাকার চারপাশে প্রবাহিত চারটি নদীর একটি। এটি আসলে বংশী নদের একটি শাখা। ভাওয়াল গড়ের পাহাড়ি বংশী এলাকা থেকে উৎপত্তি হয়ে সর্পিলভাবে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে প্রবেশ করে প্রথমে কিছুটা পূর্বদিকে অগ্রসর হয়েছে। তারপর ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে মিলিত হয়েছে।
কালিয়াকৈর উপজেলার বংশী নদ থেকে উৎপত্তি লাভ করে তুরাগ ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নে এসে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়েছে। এর একটি শাখা সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়নে বংশী নদে পড়েছে। আর মূল শাখাটি আমিনবাজার ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর সাথে মিশেছে। অর্থাৎ এটি মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় বুড়িগঙ্গায় মিলিত হওয়ার আগে কালিয়াকৈর, জয়দেবপুর, মির্জাপুর, গাজীপুর, সাভার ও মিরপুর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
তুরাগ নদের উৎপত্তি ও প্রবাহ সম্পর্কে আমরা বর্ণনা পাই ১৯১২ সালে প্রকাশিত যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে। তার বয়ানে-
‘এই নদী ময়মনসিংহ জেলা হইতে আসিয়া দরিয়াপুরের নিকটে ঢাকা জেলায় প্রবেশ লাভ করিয়াছে। তথা হইতে পূর্ব্বাভিমুখে কিয়দ্দুর আসিয়া রাজাবাড়ী, বোয়ালিয়া প্রভৃতি স্থানের পার্শ্বদেশ ভেদ করিয়া পূর্ব্ববাহিনী হইয়াছে। শেনাতুল্লার সন্নিকটে মোড় ঘুরিয়া প্রায় সরলভাবে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হইয়াছে; এবং মৃজপুর, কাশিমপুর, ধীতপুর, বিরলিয়া, উয়ালিয়া, বনগাঁও প্রভৃতি স্থান তীরে রাখিয়া মীরপুরের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার সহিত মিলিত হইয়াছে।’
এই তুরাগেরই ছোট একটি শাখা কালিয়াকৈরের কাছ থেকে উৎপন্ন হয়ে কড্ডা এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে টঙ্গী খালে পড়েছে। স্থানীয়ভাবে এই শাখাকেও তুরাগ নদ বলে। আবার মধুপুরজঙ্গল থেকে উৎপন্ন তিনটি নদী সালদহ, লবণদহ ও গোয়ালিয়ার খাল তুরাগ নদে পড়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ নদের দৈর্ঘ্য ৭১ কিলোমিটার ও মিরপুর অংশে প্রস্থ ২১৮ মিটার। একই স্থানে নদীর গভীরতা সাড়ে ১৩ মিটার। নদী অববাহিকার আয়তন ১ হাজার ২১ বর্গকিলোমিটার। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তুরাগের পানিপ্রবাহ সবচেয়ে বেশি হ্রাস পায়। সে সময় এর মিরপুর অংশে পানিপ্রবাহ থাকে ১২৪ কিউমেকের মতো এবং একই স্থানে গভীরতা থাকে সাড়ে ৪ মিটার। তবে বর্ষা মৌসুমে আগস্টে এই প্রবাহ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৬ কিউমেকে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য
অধিকাংশ নদীর মতো তুরাগও বারোমাসী একটি নদ। অর্থাৎ সবসময়ই পানিপ্রবাহ থাকে। একেবারে শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা কোনো মাসেই ঘটে না। নদটিতে সবচেয়ে বেশি পানি প্রবাহিত হয় আগস্ট মাসে। আর সবচেয়ে কম প্রবাহ থাকে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে। এই সময় পানিপ্রবাহ হ্রাস পেয়ে ক্ষীণকায় হলেও নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে। তুরাগে পলিপ্রবাহ নেই। এর পানিও লবণাক্ত না। অন্যান্য নদীর মতো তুরাগেও জোয়ার-ভাটার প্রভাব রয়েছে। তবে সাধারণ বন্যায় নদের পাড় উপচিয়ে পানি প্রবাহিত হতে দেখা যায় না। তারপরও বন্যা ব্যবস্থাপনায় নদের ডানতীরে ১২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। নদের বামতীরে রয়েছে ১২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্যাংক রিভারমেন্ট।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
এই তুরাগপাড়েই গড়ে উঠেছে কাশিমপুর, আমিনবাজার ও টঙ্গী পৌরসভা। টঙ্গীবাসীর জন্য তুরাগকে ধরা হয় আশীর্বাদ হিসেবে। কারণ, এই নদকে কেন্দ্র করেই টঙ্গীতে বিস্তৃত হয়েছে শিল্প। আবার এই শিল্পের আগ্রাসনেই তুরাগ হয়ে ওঠে টঙ্গীবাসীর অভিশাপ। তবে সব শিল্প-কারখানা নয়, এজন্য দায়ী গুটিকয়েক শিল্প-কারখানা। তীরবর্তী কিছু শিল্প-কারখানা বেপরোয়াভাবে রাসায়নিক বর্জ্য তুরাগে ফেলায় এর পানি ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে গভীর কালো রং ধারণ করেছে। বর্ষা মৌসুমে এই দূষিত পানির রং তেমন কালো না দেখালেও শুষ্ক মৌসুমে তা স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। দূষণের ফলে জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি হুমকিতে পড়েছে জলজ প্রাণীও।
অবকাঠামো
যোগাযোগ সহজ তুরাগ নদের ওপর বেশকিছু অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে সড়ক সেতু যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে রেল সেতুও। এগুলো হলো টঙ্গী সড়ক ও রেল সেতু, আবদুল্লাহপুর সড়ক সেতু, আশুলিয়া সড়ক সেতু ও গাবতলী সড়ক সেতু।