১৯৬০ সালে পাঁচটি নদীবন্দরের গেজেট প্রকাশিত হয়। টঙ্গী নদীবন্দর তার মধ্যে একটি। সর্বশেষ সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে নদীবন্দরটির গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালের ১৯ অক্টোবর।
বাংলার পরিবহন ব্যবস্থায় নদী ও নৌপথের ভূমিকা বহু পুরনো। আর নৌপথে চলাচলকারী যাত্রী ও পণ্য ওঠানামার জন্য যেহেতু নদীতীরেই যুতসই স্থান ও স্থাপনার প্রয়োজন পড়ে, তাই এ অঞ্চলে নদীবন্দরের ইতিহাসও নতুন নয়। বাংলায় প্রথম নদীবন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায় গ্রিক পণ্ডিত টলেমির মানচিত্রে, যেটাকে তিনি তমলিটিস নামে চিত্রিত করেছেন। অনেকের মতে, বাংলার তাম্রলিপ্তি বা তাম্রলিপ্ত বন্দরেরই আরেক নাম এটি। বন্দরটির অবস্থান নিয়ে বিস্তর বিতর্ক থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মেদিনিপুর জেলায় বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী রূপনারান নদীর মোহনায় অবস্থিত তমলুকই যে সেই প্রাচীন তা¤্র্রলিপ্তি সে ব্যাপারে মোটামুটি মতৈক্য রয়েছে। এছাড়া সরস্বতী নদীর মোহনায় অবস্থিত সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও ও কর্ণফুলী নদীর মোহনায় চট্টগ্রাম বন্দরও বেশ প্রাচীন এবং মধ্যযুগেই এগুলোর সুনাম বহির্বিশে^ ছড়িয়ে পড়ে। বন্দরগুলো নদীর মোহনায় গড়ে উঠলেও এগুলো ছিল মূলত সামদ্রিক যোগাযোগের কেন্দ্র, যা সমুদ্রবন্দর হিসেবে বেশি পরিচিতি পায়।
মধ্যযুগে সোনারগাঁ নামে সমৃদ্ধ একটি নদীবন্দরের বর্ণনা পাওয়া যায় মরক্কোর পণ্ডিত ও পরিব্রাজক ইবনে বতুতার বয়ানে। সুলতানি আমলে বাংলা ভ্রমণকালে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে নদীপথে এই বন্দরেই উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। অষ্টাদশ শতকে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রশাসনিকভাবে কলকাতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং কলকাতা ও হুগলিতে গড়ে ওঠা বন্দরগুলোর সাথে পূর্ব বাংলার বাণিজ্যের প্রয়োজনে নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, মাদারীপুর, খুলনা ও গোয়ালন্দ নদীবন্দরেরও গুরুত্ব বেড়ে যায়। তবে আসামের সাথে যোগাযোগে সিরাজগঞ্জ ও চিলমারি বন্দরের গুরুত্বও কম ছিল না। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বাষ্পচালিত নৌযানের পরিসর বাড়লে যাত্রী ও পণ্য ওঠানামার প্রয়োজনেই নদীবন্দরের চাহিদা বাড়তে থাকে। এখনো এই ধারা অব্যাহত।
বর্তমানে সরকারের গেজেটভুক্ত নদীবন্দরগুলোর অন্যতম হলো টঙ্গী নদীবন্দর, যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। নদীবন্দরটির প্রথম গেজেট প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পোর্টস অ্যাক্ট, ১৯০৮ এর সেকশন ৩ এর ক্লজ ৯ এর সাব-সেকশন ৭ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ইস্ট পাকিস্তান ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অর্ডিন্যান্স, ১৯৫৮ এর সেকশন ৩ এর আওতায় টঙ্গী নদীবন্দরের কর্তৃত্ব পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (ইপিডব্লিউটিএ) কাছে ন্যস্ত করেন। ১৯৬০ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ আদেশ কার্যকর বলে গেজেট নোটিফিকেশনে উল্লেখ করা হয়।
সেই সাথে পোর্টস অ্যাক্ট, ১৯০৮ এর সেকশন ৪ এর সাব-সেকশন ২ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নদীবন্দরের সীমানাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সেই সময় পূর্বদিকে বন্দরের সীমানা ধরা হয় টঙ্গী গ্রামের ময়মনসিংহ রোড সেতুর পূর্ব প্রান্তের প্রাচীরের পূর্বদিক থেকে টঙ্গী নালার দক্ষিণ তীরের ২ মাইল পর্যন্ত। পশ্চিম দিকে সীমানা ধরা হয় সেতৃর পশ্চিম দিকের প্রাচীরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে টঙ্গী নালার দক্ষিণ তীর বরাবর ২ মাইল পশ্চিমে। এছাড়া শুরুতে উত্তর দিকের সীমানা ছিল স্বাভাবিক স্রোতের সময় টঙ্গী নালার উত্তর তীর বরাবর হাই ওয়াটার মার্ক থেকে ৫০ গজ পর্যন্ত। আর দক্ষিণ দিকের সীমানা ছিল টঙ্গী নালার দক্ষিণ তীর বরাবর হাই ওয়াটার মার্ক থেকে ৫০ গজ পর্যন্ত। এর প্রায় সাড়ে চার দশক পরে টঙ্গী বন্দরের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে ২০০৪ সালের ১৯ অক্টোবর গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকার।
কয়েক বছর ধরেই অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরটি দিয়ে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে টঙ্গী নদীবন্দর দিয়ে ২০ লাখ ৯ হাজার যাত্রী পরিবহন হলেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৩ লাখে। তবে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে একটা লম্বা সময় পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নৌপথে নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে যাত্রী পরিবহন ১৭ লাখ ২৪ হাজারে নেমে আসে।
একইভাবে ২০১০-১১ অর্থবছরে টঙ্গী নদীবন্দর দিয়ে ৬ লাখ ১৪ হাজার টন কার্গো পরিবহন হলেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ৯ লাখ টনের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে নদীবন্দরটি দিয়ে কার্গো পরিবাহিত হয় সাকল্যে ৯ লাখ ৪১ হাজার টন।