সদরঘাটের পত্তন কবে সে ইতিহাস এখনও অজানা। মতান্তরে এ ঘাটের বয়স হাজার বছরের কম হবে না। ঢাকা শহরের পত্তনের পর্বে যখন রেল ও সড়ক যোগাযোগ অনুপস্থিত তখন এই সদরঘাট দিয়েই নদীপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের চল শুরু হয়। এরপর অনেক সময় গড়িয়েছে, সড়ক-রেল-আকাশপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; তবে ঢাকা নদীবন্দরের গুরুত্ব কমেনি।
বাংলায় তমলিটিস নামে একটি বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায় গ্রিক পণ্ডিত টলেমির মানচিত্রে। প্রাচীন বাংলায় তাম্রলিপ্তি বা তাম্রলিপ্ত নামে যে বন্দর, মনে করা হয় এটি তারই অন্য পরিচয়। বন্দরটির অবস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনিপুর জেলায় বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী রূপনারান নদীর মোহনায় অবস্থিত তমলুকই যে প্রাচীন তাম্রলিপ্তি, সেটা মোটামুটিভাবে স্বীকৃত।
বলা যায় আবহমানকাল থেকেই বাংলার পরিবহন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে নদীবন্দর। কারণ পণ্য পরিবহনের জন্য শুধু নৌপথ থাকলেই তো চলে না। এজন্য চাই নদীবন্দর। তাছাড়া এই নদীবন্দরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে সব বড় শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্র।
ঢাকা নদী বন্দরও তেমনি একটি বন্দর, যেটি সদরঘাট নামেও পরিচিত। ঠিক কবে এ ঘাটের পত্তন হয়েছিল সে ইতিহাস এখনও অজানা। মতান্তরে এ ঘাটের বয়স হাজার বছরের কম হবে না। ঢাকা শহরের পত্তনের পর্বে যখন রেল ও সড়ক যোগাযোগ অনুপস্থিত তখন এই সদরঘাট দিয়েই নদীপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের চল শুরু হয়। এরপর অনেক সময় গড়িয়েছে; সড়ক, রেল ও আকাশপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বলে ঢাকা নদীবন্দরের গুরুত্বে কমতি আসেনি।
গুরুত্বের কথা বিবেচনায় নিয়ে ১৯৬৭ সালে বিআইডবিøউটিএ সদরঘাটে নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ করে আধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ব্যস্ততা বাড়ে সদরঘাটে। এখন সারাদেশ, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে রাজধানীর নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে এই নদীবন্দর। প্রতিদিন শত শত নৌযান সদরঘাটে নোঙর করে কিংবা ছেড়ে যায়। বার্জগুলোও সদরঘাটকে পণ্য ওঠানো-নামানোর কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। লঞ্চের ভেপুর শব্দ, যাত্রীদের ছোটাছুটি আর নৌশ্রমিকদের হাকডাকে ২৪ ঘণ্টাই মুখর থাকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দরটি।
যাত্রী নিরাপত্তা
ঢাকা নদীবন্দরে যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যাত্রীদের নিরাপত্তায় সদরঘাট টার্মিনালে স্থাপন করা হয়েছে ডিএমপি পুলিশ ফাঁড়ি ও নৌ পুলিশ ফাঁড়ি। মোতায়েন করা হয়েছে আনসারও। লঞ্চঘাটের বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে ৩২টি সিসি ক্যামেরা ও ২২টি মাইক। অবৈধ কুলিদের দৌরাত্ম্য বন্ধে চালু করা হয়েছে ‘শ্রম যার মজুরি তার’ নীতি। এর আওতায় পোর্টার বা কুলি নিয়োগ করেছে বিআইডবিøউটিএ। চুক্তিভিত্তিতে যাত্রীদের লাগেজ ও মালপত্র পরিবহন করেন তারা।
এছাড়া নদীবন্দরের কার্যক্রম যাতে নির্বিঘেœ চলতে পারে সেজন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ করেছে বিআইডবিøউটিএ। শুধু ২০১৯-২০ অর্থবছরেই ঢাকা নদীবন্দরের আশপাশের ২ হাজার ৬৩৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তীরভূমি উদ্ধার করা হয়েছে ৬৪ দশমিক ৭৫ একর। পাশাপাশি জরিমান আদায় করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। আর নিলামে তোলা হয়েছে ৮ কোটি ২৬ লাখ ১৫ হাজার টাকার সম্পদ।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ড
কয়েকশ বছর আগে থেকেই প্রশাসনিক, বসতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক কর্মকাÐের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে সদরঘাট। ১৮২০ সালের দিকে সদরঘাটের কাছে পূর্বদিকে ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের অফিসসহ অন্যান্য বহু অফিস পর্যায়ক্রমে স্থানান্তরিত হয় এবং এর উত্তর দিকের এলাকা নগরকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। এখন বন্দরের ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় সদরঘাটে গড়ে উঠেছে বিবিধ সামগ্রীর একটি বড় বাজার। বিভিন্ন নদীপরিবাহিত পণ্য, বিশেষ করে মাছ ও ফলের সুবিশাল সব আড়ত তৈরি হয়েছে সদরঘাটকে ঘিরে। সদরঘাটের সন্নিকটেই গড়ে উঠেছে পুস্তক প্রকাশনার প্রধানতম কেন্দ্র বাংলাবাজার।
ঢাকা নদীবন্দর থেকেই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, হুলারহাট, মাদারীপুর, চাঁদপুর, খুলনা, হাতিয়া, বাগেরহাটসহ মোট ৪৫টি রুটে লঞ্চ ও স্টিমার চলাচল করে।