বন্যায় পানি ঢুকছে দ্রুত। উঠোনগুলো পানির নিচে। ঘরের ভিতরেও পানি। আতঙ্কে গ্রামবাসীরা। কিছুদিন আগেও তারা পরিবার নিয়ে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিলেন। তারাই এখন আশ্রয়ের খোঁজে উদ্ধারকারীদের অপেক্ষায়। আগস্টের বন্যায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যাদুর্গত মানুষের এই যখন অবস্থা তখন উদ্ধার সরঞ্জাম ও ত্রাণ সহায়তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে বিলম্ব করেনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। একদিকে বন্যার্তদের উদ্ধার, অন্যদিকে তাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা দুটি কাজই সমানতালে করেছে সংস্থাটি। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যেও বানভাসিরা পেয়েছেন কিছুটা স্বস্তি।

কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে এই উদ্ধার ও ক্রাণ কার্যক্রম সার্বক্ষণিক তদারকি করেছেন আইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা। এ ছাড়া বন্যার্তদের সহায়তায় কর্তৃপক্ষের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থও প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে জমা দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। পাশাপাশি সার্বক্ষণিক যাতে বন্যার্তদের পাশে থাকা যায় সেজন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর/দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়।
স্পিডবোট পাঠিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম

উদ্ভূত বন্যা পরিস্থিতিতে ২২ আগস্ট সকাল ৬টায় মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিএ ভবনের নিচতলায় অতিথি কক্ষে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জনাব মো. নাহিদ ইসলামের উপস্থিতিতে একটি মতবিনিময় সভা হয়। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফার নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন। সভায় বিআইডব্লিউটিএ বন্যাদুর্গতদের পাশে থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে ফেনী ও কুমিল্লা জেলার বন্যাদুর্গত এলাকায় উদ্ধারকাজে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্টসহ ওইদিনই ২০টি স্পিডবোট পাঠানো হয়। মাওয়া ও নারায়ণগঞ্জ থেকে স্পিডবোটগুলো পাঠানো হয়। চট্টগ্রামের নৌ-নিট্রা বিভাগ থেকে পাঠানো হয় ১০টি লাল বোট, দুটি স্পিডবোট ও ৩টি কাঠের বোট। এ ছাড়া উদ্ধার কাজে ব্যবহারের জন্য নারায়ণগঞ্জ নৌ-নিট্রা বিভাগ থেকে ১১৮টি কলারযুক্ত লাইফ জ্যাকেট, ১৯২টি সাধারণ লাইফ জ্যাকেট ও ১২০টি কলারছাড়া লাইফ জ্যাকেট পাঠানো হয়। এর বাইরে ২০টি রেইনস্যুট বিডি, ২০টি লাইফ বয়া, ১২ কেজি নাইলন রশি, ২৫ জোড়া গামবোট ও ৫টি চায়না রেইনস্যুটও বন্যাদুর্গত এলাকায় সরবরাহ করা হয়।
পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএর চাঁদপুর শাখা থেকে ডাইভিং সরঞ্জামসহ একটি ডুবুরি টিম যায় বন্যাদুর্গত এলাকায়। পরদিন অর্থাৎ ২৩ আগস্ট সকাল থেকেই তারা উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেন। উদ্ধার কার্যক্রম সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ওইদিন জোরদার কুমিল্লার বুড়িচংয়ে আরও ৫টি স্পিডবোট পাঠানো হয়। এর বাইরে ২৩ আগস্ট আশুগঞ্জ-ভৈরব বাজার নদীবন্দর থেকে ৪০০ লিটার অকটেন ও ১৬ লিটার মবিল পিকআপযোগে কুমিল্লার বুড়িচংয়ের নানুয়ার বাজার/ভুরভুরিয়া বাজারে পাঠানো হয়।

সার্বিক উদ্ধার কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রামের নৌ-সওপ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা জনাব মোঃ সবুর খান। এ কাজে তাকে সার্বিক সহায়তা করেন নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের উপ-পরিচালক জনাব ওবায়দুল করিম খান। উদ্ধার টিমের অন্য সদস্যরা হলেনঃ চট্টগ্রামের পরিবহন পরিদর্শক মোঃ আমজাদ হোসেন, ট্রাফিক সুপারভাইজার মোহাম্মদ কুদ্দুছুর রহমান, নিম্নমান সহকারী আব্দুর রহিম ও দুলাল মজুমদার। উদ্ধার কাজে যাতে কোনো ধরনের ব্যত্যয় না ঘটে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান।
ত্রাণসামগ্রী বিতরণ

উদ্ধার কার্যক্রমের পাশাপাশি ত্রাণ তৎপরতায় শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। তারই অংশ হিসেবে ২৪ আগস্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ১ হাজার ২৫ প্যাকেট শুকনো খাবার ও পানীয় জল বন্যাদুর্গত এলাকায় পাঠানো হয়। প্রতি প্যাকেটে ছিল এক কেজি করে চিড়া, টোস্ট বিস্কুট ও খেজুর, আধা কেজি চানাচুর, দুই লিটার পানি এবং ১০ কার্টন খাবার স্যালাইন।
দুটি ট্রাকে করে ২৪ আগস্ট এসব ত্রাণ সামগ্রী কুমিল্লা ও ফেনীর উদ্দেশে রওনা দেয়। বিআইডব্লিউটিএর কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটিসহ ৮ জন কর্মকর্তা সাথে যান। ত্রাণ প্রেরণ ক্রার্যক্রমে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) জনাব এ, কে, এম আরিফ উদ্দিন।
ওইদিন বিকালেই এসব শুকনো খাবার ও পানীয় জল বন্যাদুর্গতদের মাঝে বিতরণ শুরু করেন বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা। ২৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৬টায় কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার নানুয়ার বাজার থেকে এই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম আবার শুরু করেন তারা।
ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখে কর্তৃপক্ষ। ২৭ আগস্ট কুমিল্লা বুড়িচংয়ের লরিবাগ মধ্যপাড়া জামে মসজিদ, রাজাপুর হাইস্কুলে ৫০ প্যাকেট ত্রাণ বিতরণ করা হয়। দিঘলির চর, পিতাম্বর, পয়াত, রসুলপুর, যদুপুর ও খুদাতলিতে বিতরণ করা হয় ৩৫০ প্যাকেট ত্রাণ। খারাতাইয়া, ইন্দ্রবতী, মহিষমারা, শিকারপুর ও বুরবুড়িয়ায়ও ৪০০ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা।

৩০ আগস্ট ফেনীর ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী উপজেলার বন্যাদুর্গত এলাকায় ১ হাজার ১০০ প্যাকেট ত্রাণ বিতরণ করা হয়। কর্তৃপক্ষের পরিচালক (নিরীক্ষা) জনাব গোলাম ফারুক চৌধুরীর নেতৃত্বে ফেনীর ফুলগাজীর বন্যাদুর্গত এলাকায় ৬০০ প্যাকেট এবং ঢাকা নদীবন্দরের উপ-পরিচালক (বন্দর) জনাব মো. রেজাউল করিমের নেতৃত্বে ছাগলনাইয়ায় বিতরণ করা হয় আরও ৫০০ প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী। সব মিলিয়ে কুমিল্লা ও ফেনী জেলায় বিআইডব্লিউটিএ ত্রাণ বিতরণ করেছে ৩ হাজার ৬২৫ প্যাকেট। ৩১ আগস্ট তারা চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানায় ১৩ নং উত্তর সূচীপাড়া ইউনিয়নের বন্যার্তদের মাঝেও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে। এ ছাড়া বন্যার্তদের মাঝে বিতরণের জন্য মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ২১তম ব্যাচের প্রাক্তন ক্যাডেটদের (কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের ব্যাচ) পক্ষ থেকে বিআইডব্লিউটিএকে ৫০০ ব্যাগ ত্রাণসামগ্রী প্রদান করে। সেগুলোও বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করে বিআইডব্লিউটিএ।
উদ্ধার কার্যক্রম ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি বন্যার্তদের সহায়তায় সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে জমা দেয় বিআইডব্লিউটিএ। ২৮ আগস্ট কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা এই অর্থ জমা দেন। কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় তাঁর সাথে উপস্থিত ছিলেন।
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় বিআইডব্লিউটিএ অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বানভাসিদের পাশে দাঁড়ায়। উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরলসভাবে কাজ করে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন। ভয়াবহ এই দুর্যোগে আন্তরিকভাবে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোয় তাদেরকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সাধারণ মানুষ।
