বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুধবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
17 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

নদীকে ধরে রাখতে হলে তাকে বুঝতে হবে

নদীবাংলা ডেস্ক,

আমাদের নদীগুলোকে দেখতে হবে অঞ্চলভিত্তিক দৃষ্টিতে। একই নদীর একটা অংশের স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে, দূষিত হতে পারে। আবার আরেক অংশ হয়তো ভালোই আছে। মনে রাখতে হবে, নদী শুধু পানি বহন করে না, সেডিমেন্টও বহন করে। পাহাড় যেখানে সমতলে মিশেছে সেখানে নদীর তলদেশে নুড়ি পাথর, বড় পাথর ইত্যাদি থাকে। সেগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে নদীগুলোকে এলোপাতাড়ি খনন করা হচ্ছে। এতে করে নদীর যে একটা স্বাভাবিক অবয়ব সেটা আর থাকছে না। কিছু কিছু জায়গায় যেমন তামাবিল এবং পঞ্চগড়ে নদী ও এর প্লাবন ভূমিতে মেশিন বসিয়ে পাথর তোলা হচ্ছে। এতে নদীগুলোর আকৃতি নষ্ট হয়েছে; স্বাভাবিক ¯্রােত নেই, দিক পরিবর্তন করেছে।

নদী যখন সমতলে আসে, তখন আবারও এলোপাতাড়িভাবে ছোট ছোট যান্ত্রিক ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করা হয়। কিন্তু এই বালু গর্ত করে এক জায়গা থেকে তোলা হয় না। ফলশ্রæতিতে নদীর যে ভারসাম্য সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এবং নদীর প্রবাহ বহু জায়গায় একদিকে সরে গিয়ে পাড়ভাঙা শুরু হয়েছে। এটাও নদীর ক্ষতি করছে। অনেক জায়গায় সেতুর মতো অবকাঠামো আছে। তার পাশ থেকে যদি বালু উত্তোলন করা হয় তাহলে সেতুও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বর্ষার পরে যখন পরিবহন ক্ষমতার অতিরিক্ত বালু নদীর তলদেশে জমা হয়, তখন অনেক সময় নদীর পাড়ের পাশে চর পড়ে। অনেক সময় নদীর মাঝেও চর পড়ে। বিশেষ করে নদীর কিনারে যে চর পড়ে সেখান থেকে যখন বালু উত্তোলন করা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সেখানে পানি প্রবাহের চাপ সৃষ্টি হয় এবং নদীভাঙন দেখা দেয়।

আরও যদি ভাটিতে আসি, সেখানেও নদী থেকে প্রচুর পরিমাণে বালু উত্তোলন করা হয়। এক্ষেত্রে স্থান নির্বাচনটা নদীর স্থায়িত্বকে চিন্তা করে করা হয় না। যে কারণে ধলেশরী কিংবা কালিগঙ্গা বা সুরমা-কুশিয়ারার মতো মাঝারি ও ছোট আকারের নদী তাদের অবয়ব হারাচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নদী পানির সাথে সাথে একটা জীবনও ধারণ করে। মাছ, কচ্ছপ, পোকামাকড়Ñএ সবকিছু মিলে একটা অ্যাকুয়াটিক ইকোসিস্টেম। যখন এলোপাতাড়ি ড্রেজিং করা হয় তখন নদীর তলদেশটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু জায়গায় কালভার্ট বানানোর নামে আমরা নদীকে ছোট করে ফেলছি। এতে নদীর প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্রমান্বয়ে মরে যাচ্ছে। ইছামতিসহ অনেক নদীর মধ্যখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নদী মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে বাধ্য। আর দূষণের কথা যদি ধরি, তাহলে দেখা যাবে শিল্প-কারখানা অধ্যুষিত নগরগুলো থেকে যে দূষিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তাতে নদীগুলোর মৃত্যু ঘটছে।

আমি নদীর জীবনকে তিনভাবে দেখি। প্রথম জীবন হচ্ছে ফিজিক্যাল বা ভৌত অবয়ব। সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে নদীগুলোকে চেপে ধরা হচ্ছে। সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে প্রচুর পিলার গেড়ে। এতো পিলারের হয়তো প্রয়োজন নেই কিন্তু এগুলো নদীর প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে নদীর রাসায়নিক জীবন। এক সময় নদীর পানি মানুষ সরাসরি পান করত। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূর্বপুরুষদের জন্য নদীর পানিতে সূর্য তর্পণ করত। কিন্তু আজকাল শহরের কাছাকাছি নদীগুলো এতটাই দূষিত যে এর পানি পান করা তো দূরের কথা, গোসল করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর তৃতীয় জীবন হচ্ছে জৈব জীবন। নদীর পানিতে মাছ, কচ্ছপ, কাঁকড়া, বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় মিলে যে একটা খাদ্যচক্র সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে। এর কারণ রাসায়নিক দূষণের ফলে পানিতে দ্রবীভ‚ত অক্সিজেন (ডিও) কমে যাওয়া। ডিওর পরিমাণ ৪ ইউনিটের নিচে নেমে গেলে তাতে জীবন ধারণ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু বুড়িগঙ্গার পানিতে শীতকালে ডিও-এর পরিমাণ শূন্যে নেমে আসে। এতে এমন কিছু পোকামাকড় বাঁচতে পারে, যা ক্ষতিকর। বর্ষার সময় যখন নতুন পানি আসে তখন জৈব জীবনটা আবার ফেরত আসে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে নদীকে কিভাবে তার প্রাণ ফিরিয়ে দেব? বাংলাদেশের সংবিধানেই এর উপায় বলে দেওয়া আছে। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সংবিধানে ১৮ক ধারা সংযোজন করা হয়েছে। ২০১১ সালে সংযোজিত ধারাটিতে পরিষ্কার করে বলা আছে-‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ রাষ্ট্রকে এই অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে। পরিবেশ আদালত আইন নামে আমাদের আরেকটা আইন আছে। তবে আইনটির একটা দুর্বলতা হলোÑপরিবেশ অধিদপ্তরই কেবলমাত্র মামলা করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো অধিদপ্তর অনেক সময় জবরদখলকারী ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না। ২০১২ সালে সংশোধিত পরিবেশ সংরক্ষণ আইন আছে। নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টেরও দুই দফা রুলিং আছে। অর্থাৎ সরকারের হাত শক্তিশালী করার মতো যথেষ্ট উপাদান আছে।

৪০-৫০ বছর আগে আমি বিদেশে ছাত্র থাকাকালে দেখেছি, লন্ডনের টেমস নদী বা গাসগোর ক্লাইড নদীও আমাদের নদীগুলোর মতোই দূষিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আইন প্রয়োগ করে সেগুলোকে দূষণমুক্ত করা হয়েছে। আমাদেরও আইন প্রয়োগ করতে হবে। যেখানে আদালত আমাদের সহায়ক, সংবিধান আমাদের সহায়ক সেখানে আইন প্রয়োগ করে নদীকে দূষণমুক্ত না করতে পারার তো কোনো কারণ নেই।
অনেক সময় যেটা হয়, পরিদর্শনের উদ্দেশে হয়তো কর্মকর্তারা রওয়ানা হলেন, তার আগেই কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে খবর পৌঁছে গেল। এরপর কারখানা কর্তৃপক্ষ হয় কারখানা বন্ধ করে দেয়, না হয় ইটিপি চালু করে দেয়। তাই কত ঘণ্টা ইটিপি চালু ছিল সেই হিসাবে না গিয়ে আমাদের দেখতে হবে যেখানে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সেখানকার পানির মান কেমন। মোদ্দাকথা, সমাধানের জন্য যে অস্ত্রগুলো প্রয়োজন তার সবই আমাদের আছে। কিন্তু অস্ত্র থাকলেই তো হবে না। সেগুলো দক্ষভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার জলাধার রক্ষার কথা বলছেন। কয়েকদিন আগেও হাওড়ের মধ্য দিয়ে সওজের রাস্তা তৈরির একটি পরিকল্পনা তিনি আটকে দিয়েছেন। তাহলে অন্য সংস্থাগুলো কি করছে? তাদেরকেও একইভাবে উদ্যোগ নিয়ে আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে।

আমাদের নৌপথগুলো ড্রেজিং করা হচ্ছে। কিন্তু পরের বছরই আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ড্রেজিংকে স্থায়ী করতে নদী শাসনও এর সাথে যোগ করতে হবে। শুধুমাত্র ড্রেজিং করা মানে অর্থ ব্যয়। তাতে কেউ কেউ উপকৃত হলেও জাতি কোনো উপকার পাবে না।

ড্রেজিংয়ের জন্য অনেক ধরনের তথ্য প্রয়োজন। পলি ও সেডিমেন্টের পরিমাণ ও কোন দিকে আসছে সে তথ্য দরকার। কারণ নদীর ¯রাত যখন একদিকে ধাবিত হয় তখন তার পলি ও সেডিমেন্ট লাগে পানির সাথে সেডিমেন্টের ভারসাম্য রক্ষার জন্য। আবার কোনো চর যখন ভাঙে এবং তার যে সেডিমেন্ট সেটা অন্য কোথাও জমা হয়। এসব তথ্য জানতে হবে।

নদী তার মতো করে ভাঙবে-গড়বে। নদীকে ধরে রাখতে হবে। তাকে বুঝতে হবে। তাকে বলতে হবে এই তোমার পথ ঠিক করে দিলাম, তোমার কোনো কষ্ট হবে না, তোমাকে এই পথ দিয়ে চলতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here