কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা, (জি), এনইউপি, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসির ৩২ বছরের কর্মজীবন। দক্ষতার সাথে পালন করেছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দায়িত্ব। দীর্ঘ এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০২৩ সালের মার্চে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান হিসেবে। সংস্থা প্রধান হিসেবে তাঁর লক্ষ্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিআইডব্লিউটিএকে একটি প্রযুক্তিদক্ষ প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া। সেই সাথে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল গড়ে তুলে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। নদীবাংলার সাথে তাঁর দীর্ঘ আলাপচারিতায় সেসব লক্ষ্য ও আকাক্সক্ষার কথাই উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কী?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে অভ্যন্তরীণ নৌপথ। সড়ক ও রেলপথের তুলনায় অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে খরচ অনেক কম। স্বাভাবিকভাবেই বাল্ক পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে পছন্দের মাধ্যম এটি। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌপথ হচ্ছে সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব পরিবহন মাধ্যম। সড়কের ওপর চাপ কমাতেও অভ্যন্তরীণ নৌপথের ভূমিকা অনেক। এর আরেকটি সুবিধার জায়গা হচ্ছে পর্যটন। বাংলাদেশে বিপুল বিস্তৃত নৌপথের সুবিধার কারণে নদী পর্যটনের বড় সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। নদী তীরবর্তী মানুষের কর্মসংস্থান তথা দারিদ্র্য হ্রাসেও ভূমিকা রাখছে অভ্যন্তরীণ নৌপথ। সব মিলিয়ে বলা যায়, পরিবহন ব্যবস্থা তথা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিপুল এবং ব্যাপক।
পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় অভ্যন্তরীণ নৌপথকে কোথায় এগিয়ে রাখবেন?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনকে এগিয়ে রাখার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত. এটি তুলনামূলক নিরাপদ। বিগত কয়েক বছরের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আরেকটি কারণ হলো অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যয়সাশ্রয়ী। পণ্য পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ট্যারিফ হার অন্য সব মাধ্যমের তুলনায় কম। একই সাথে জ্বালানিদক্ষও। ইউএনএসকাপের হিসাবে, প্রতি লিটার জ্বালানিতে নৌপথে যেখানে ১০৫ টন-কিলোমিটার পণ্য পরিবহন করা যায় সেখানে রেলপথে পরিবাহিত হয় ৮৫ টন-কিলোমিটার এবং সড়কপথে বড় ডিজেল ট্রাকে ২৫ টন-কিলোমিটার। জ্বালানি দক্ষতার অর্থ হলো কার্বন নিঃসরণ সীমিত রাখা। সেই সাথে পরিচালন ব্যয়ও কম হওয়া। বিশ্বব্যাংকের ২০০৭ সালের হিসাবে, সড়কের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করলে বছরে ৫ কোটি ৮৫ লাখ লিটার ডিজেল সাশ্রয় করা সম্ভব। এর ফলে বছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন কম কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হবে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে পরিবেশের ওপর। জ্বালানি দক্ষতার পাশাপাশি মূলধনি বিনিয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
অভ্যন্তরীণ নৌপথে যোগাযোগ সুবিধা বাড়াতে বিআইডব্লিউটিএ তার ভূমিকা কতটা সফলভাবে রাখতে পারছে?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: দুটি বিষয় এক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে ফেয়ারওয়ে বা নৌপথ তৈরি। দ্বিতীয়টি টার্মিনাল সুবিধা বাড়ানো। সরকারের ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বন্ধ নৌপথ চালু ও বিদ্যমান নৌপথের নাব্যতা বাড়ানোর কাজ বিআইডব্লিউটিএ নিরন্তর করে যাচ্ছে। ১০ হাজার কিলোমিটার নাব্য নৌপথ চালুর লক্ষ্য নিয়ে কর্তৃপক্ষ এগোচ্ছে এবং এরই মধ্যে দৃশ্যমান সাফল্যও এসেছে। পাশাপাশি পণ্য হ্যান্ডলিং সুবিধা বাড়াতে নতুন নতুন নদীবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। বিদ্যমান নদীবন্দরগুলোর অবকাঠামোও আধুুনিকায়ন করা হচ্ছে। একটা বিষয় এখানে লক্ষণীয় এবং তা হচ্ছে শুধু বাল্ক কার্গো নয়, কনটেইনার কার্গোও যাতে হ্যান্ডলিং করা যায় সেই অবকাঠামো নির্মাণের দিকেও এখন জোর দেওয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগের ফলে পরিবহন বাবদ লজিস্টিকস যে ব্যয় তা কমে আসবে। তবে শুধু নৌপথ সৃষ্টি ও টার্মিনাল সুবিধা বাড়ালেই হবে না; সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। এজন্য ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে।
কনটেইনার হ্যান্ডলিং উপযোগী নদীবন্দর নির্মাণের ক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএ এখন পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: কনটেইনার পরিবহনের লক্ষ্য থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে পানগাঁওয়ে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করেছে এবং ২০১৩ সাল থেকে এখানে কনটেইনার পরিবহন হচ্ছে। এ ছাড়া আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নদীবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার কাজ শিগগিরই শুরু হবে। নারায়ণগঞ্জের খানপুরেও বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে কনটেইনার টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। ভবিষ্যতের চাহিদা বিবেচনায় শিমুলিয়ায় একটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর ফলে চট্টগ্রাম, মোংলা এবং অন্যান্য বন্দর থেকে নদীপথে সহজেই কনটেইনার পরিবহন করা সম্ভব হবে।
শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনাতেই নয়, বেসরকারি উদ্যোগেও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এ ছাড়া রাজশাহী, ঢালার চর, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কুড়িগ্রামের মতো দেশের অন্যান্য স্থানেও অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের সুযোগ রয়েছে। দেশের সব অর্থনৈতিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা গেলে কনটেইনার পরিবহনে সড়কপথের ওপর চাপ বহুলাংশে কমে আসবে এবং তুলনামূলক কম খরচে ও নিরাপদে কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ তৈরি হবে। নিশ্চয় সরকারের নীতিনির্ধারকের সেটি বিবেচনায় রয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে আমরা তার বাস্তবায়নও দেখতে পাব।
অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনের বড় উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। এগুলো সম্পন্ন হলে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় কী পরিবর্তন আসবে?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা : পণ্য পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথের সর্বোচ্চ ব্যবহারে সরকার বড় উদ্যোগ নিয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। এসব প্রকল্পের মধ্যে পানগাঁও কার্গো টার্মিনাল, আশুগঞ্জ কার্গো টার্মিনাল ও খানপুরে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ও বাল্ক টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর উদ্বোধন করা হয়েছে। জুন, ২০২৩ সালে শুরু হওয়া সবগুলো প্রকল্পই মে, ২০২৫ সালে সমাপ্ত হওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ নৌপথে কম খরচে খোলা পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হবে। সড়কের ওপর থেকে চাপ কমবে। সেই সাথে অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে। এ ছাড়া খানপুরে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ও বাল্ক টার্মিনালটি নির্মিত হলে অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
দক্ষতার সাথে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আত্তীকরণের বিকল্প নেই। এখন চলে এসেছে ৪আইআর প্রযুক্তি। এগুলো গ্রহণের ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ কতটা প্রস্তুত?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: ৪আইআর প্রযুক্তি যেমন ইন্টারনেট অব থিংস, বিগ ডেটা, মেশিন লার্নিং, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও রোবোটিকসের কথা এখন জোরোশোরে আলোচিত হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগুলোর ব্যবহারও হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ দক্ষতার সাথে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে সর্বাধুনিক এসব প্রযুক্তি কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
ই-ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এবং অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের (এটুআই) সহযোগিতায় এটি উন্নয়ন করেছে বিআইডব্লিউটিএ। যাত্রীসেবা থেকে শুরু করে জাহাজমালিক, কর্মচারী, তদন্তকারী ও নিয়ন্ত্রণকারীর কার্যক্রম, এমনকি জাহাজ চলাচলের বিভিন্ন তথ্যও এই সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সফটওয়্যার প্রস্তুত হওয়ার পর এর ইউজার অ্যাকসেপটেন্স টেস্ট (ইউএটি) হয়ে গেছে। এখন এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। ই-ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের আওতায় অনেক কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পাদন হওয়ার কারণে সেবাসমূহ পক্ষপাতমুক্ত থাকবে।
এছাড়া ই-নথির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কাজে লক্ষণীয় অগ্রগতিও হয়েছে। সংস্থার আরও অনেক কাজকেই অটোমেটেড করা হয়েছে। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএতে একটি কমান্ড সেন্টার প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা হচ্ছে। এসব উদ্যোগ বিআইডব্লিউটিএকে প্রযুক্তিদক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলারই অংশ।
বিআইডব্লিউটিএকে নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। স্বাধীনতার আগেই ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে ডেক কর্মী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (ডিইপিটিসি) নামে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট বলতে এটিই ছিল। সরকার প্রশিক্ষণের বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করে ২০১২ সালে বরিশালে একটি ডেক অ্যান্ড ইঞ্জিন পারসোনেল ট্রেইনিং সেন্টার (ডিইপিটিসি) প্রতিষ্ঠা করে। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে মাদারীপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় শিপ পার্সোনেল ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট (এসপিটিআই)। তিনটি প্রতিষ্ঠানই বিআইডব্লিউটিএর অধীনে পরিচালিত হচ্ছে এবং অভ্যন্তরীণ নৌপথের জন্য আমরা বছরে ৩ হাজার ৫০০ নাবিক তৈরি করছি। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। তবে এই প্রশিক্ষণটা পাচ্ছেন কেবল জাহাজ চালনার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা। আমাদের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এখনো গড়ে ওঠেনি এবং অভ্যন্তরীণভাবে প্রশিক্ষণের কোনো সুবিধা তৈরি হয়নি। জনগণের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের প্রশাসনিক দক্ষতা আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। কীভাবে সেটাকে বাড়ানো যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
সারা বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়ন এবং এ সংক্রান্ত নানা কার্যক্রম পরিচালনায় বিআইডব্লিউটিএর অধীনে আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন অফিস রয়েছে। এর মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ যেমন আছে, একইভাবে আছে প্রকৌশল ও অর্থ। কিন্তু তারা সবাই স্বাধীন ও এককভাবে কাজ করে এবং প্রধান কার্যালয়ের সাথে সমন্বয়ও করে এককভাবে। যেমন ধরুন, কোথাও একটা পন্টুন মেরামত করতে হবে। এজন্য প্রথমে নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালনের (সিঅ্যান্ডপি) স্থানীয় পর্যায় থেকে পরিচালকের (সিঅ্যান্ডপি) কাছে চাহিদা পাঠানো হয়। পরিচালক জানান চেয়ারম্যানকে। একই ঘটনা ঘটে পূর্তকাজের ক্ষেত্রেও। যেমন, কোথাও পন্টুনের জন্য গ্যাংওয়ে নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দিল কিংবা বিদ্যুতিক কোনো কাজের দরকার হলো। সেক্ষেত্রে যেটা হয় তা হলো সেখানকার সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সরাসরি চাহিদাপত্র দিচ্ছেন। কাজটা হচ্ছে তবে মনিটরিংয়ের জন্য মধ্যবর্তী কোনো টায়ার নেই। মধ্যবর্তী একটা টায়ারের দরকার আছে। এজন্য আমাদের কিছু আঞ্চলিক কার্যালয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। তারা বিভিন্ন কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করে সেগুলো বাস্তবায়নের সুপারিশ করবে। সেই সাথে ওই আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতায় যত উন্নয়ন কার্যক্রম আছে সেগুলো তারা তদারকি করবে। পাশাপাশি তাদেরকে কিছু আর্থিক ক্ষমতাও আমরা দিয়ে দিতে পারি। এর ফলে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজগুলো দ্রুত সম্পাদন করা সম্ভব হবে এবং তদারকিটাও ভালো হবে। অর্থাৎ, এক ধরনের জবাবদিহিতা তৈরি হবে এবং সুশাসন নিশ্চিত হবে। প্রযুক্তিদক্ষ বাংলাদেশের জন্যই এটা দরকার।
ড্রেজ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার একটা পরিকল্পনার কথা শোনা গিয়েছিল। সে ব্যাপারে অগ্রগতি কী?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: শুধু ড্রেজ প্রশিক্ষণের জন্য একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা শুরুতে ছিল। কিন্তু এখন আমরা এটাকে আরও একটু বড় পরিসরে চিন্তা করছি। কেবলমাত্র ড্রেজ প্রশিক্ষণ না হয়ে সেটা হবে বিআইডব্লিউটিএর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, যেখানে সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণগুলো হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের মধ্যেও এটা আছে। এজন্য নারায়ণগঞ্জে একটা জায়গাও নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানেই বিআইডব্লিউটিএর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটটি হবে।
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার ভিশন কী?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: সংস্থার প্রধান হিসেবে আমার ভিশন হচ্ছে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে তাদের দক্ষতা ও জবাবদিহিতা কীভাবে আরও বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা করা। সেই সাথে শুদ্ধাচারকে আরও এগিয়ে নেওয়া। শুদ্ধাচারের ক্ষেত্রে পুরস্কার ও তিরস্কার দুটোই থাকতে হবে। যারা ভালো কাজ করবেন তাদেরকে পুরস্কৃত করতে হবে। আবার কেউ কাজে শৈথিল্য দেখালে বা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এটা নিশ্চিত করা গেলেই শুদ্ধাচারকে আমরা আরও বেগবান করতে পারব। এর ফলে বিআইডব্লিউটিএ প্রশাসনিকভাবে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে এই দিকটাতে আমি বিশেষ জোর দিচ্ছি।
প্রতিষ্ঠানকে যাতে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারি সেটাই আমার লক্ষ্য। আমি চাই কর্তৃপক্ষও প্রযুক্তিদক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হোক। সে কারণেই ডিসিশন সাপোর্ট সিস্টেম (ডিএসএস) ও কন্ট্রোল সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। ই-ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ ম্যানেজমেন্টের লক্ষ্যও তা-ই। অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী সব নৌযানকে আমরা সফটওয়্যারের মাধ্যমে মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে চাই।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী পরিবহন কমে গেছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে এটাই সকলের চাওয়া। আধুনিক বিশ্বে সকলেই চায় দ্রুততম সময়ে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে, তার সময় বাঁচাতে। পদ্মা সেতু সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এখন দ্রুত যাতায়াত করতে পারছে। কিন্তু আরামের জায়গায় বা স্বস্তির জায়গায় মানুষ আবার নদীর কাছেই ফিরে আসে। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে যদি প্রশ্ন করেন তাহলে বলব, নদীপথ সবসময়ই আমার কাছে অগ্রাধিকারের।
উচ্চ আয়ের বা সামর্থ্যবান মানুষের আরামদায়কভাবে যাতায়াতের জন্য বিলাসবহুল লঞ্চ যেমন রয়েছে, একইভাবে স্বল্প আয়ের মানুষজন যাতে কম খরচে নদীপথে আসা-যাওয়া করতে পারেন সে ব্যবস্থাও রয়েছে। এ ছাড়া নৌপথে যাতায়াত স্বাস্থ্যকরও। তাই বলব, অভ্যন্তরীণ নৌপথের চাহিদা সব সময়ই থাকবে। এই কারণেই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ভোলায় পাঁচটি আধুনিক বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে নদীভিত্তিক পর্যটনের সম্ভাবনা বিপুল। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর একটা বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে। লঞ্চমালিকরা যদি তাদের বিলাসবহুল লঞ্চগুলোকে পর্যটনের উদ্দেশে বিনোদনমূলক ভ্রমণের কাজে ব্যবহার করতে চান এবং নৌযানের ব্যাপারে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে তারা সেটা করতে পারেন। নতুন করেও এ ধরনের সেবা যদি কেউ চালু করতে চায় সেক্ষেত্রে আমরা রুট পারমিট দিয়ে দেব। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে যাত্রী কমে যাওয়ায় লঞ্চগুলো যদি একদম নতুন কোনো রুটে যেতে চায় সেক্ষেত্রে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, বরং উৎসাহিত করব।
পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নৌপথে আমরা পণ্য পরিবহন বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ সৃষ্টির যে পরিকল্পনা তা এসব বিষয় মাথায় রেখেই।
বাংলাদেশের নদী পর্যটনে গঙ্গা বিলাস কী বার্তা দিল?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: গঙ্গা বিলাস রিভার ক্রুজ নদী পর্যটনের বৈশি^ক মানচিত্রে বাংলাদেশকে জায়গা করে দিয়েছে। পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তুলে ধরারও একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। বিলাসবহুল এই রিভার ক্রুজটি যেভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে খবর হয়ে উঠেছে তাতে করে পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশ নতুন করে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
‘গঙ্গা বিলাস’ প্রটোকল রুট ব্যবহার করে নদী পর্যটনের এই সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া গঙ্গা বিলাস যতবারই চলাচল করবে ততবারই বাংলাদেশের অনেকগুলো নদীবন্দরে থামবে। সেখানে বিদ্যুৎ, পানীয় জলসহ সব ধরনের লজিস্টিক সহায়তা দেবে এ দেশের সরকার। এজন্য তারা নির্দিষ্ট হারে মাশুল পাবে। বিদেশি পর্যটকদের ‘ফুটফল’ হলে স্থানীয় অর্থনীতিও লাভবান হবে। ফলে পর্যটনের মাধ্যম হিসেবে ‘রিভার ক্রুজ’ নদীমাতৃক এই অঞ্চলে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
তাছাড়া রুটটা পরিচিতি পেলে বাংলাদেশও এই পথে রিভার ক্রুজ পরিচালনায় উৎসাহিত হবে। বাংলাদেশের সেই সক্ষমতা রয়েছে এবং আমাদের এখানেও নদী পর্যটনের উপযোগী জাহাজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা রিভারক্রুজও তো শুরু হয়েছে। সেবাটির কী ধরনের সম্ভাবনা দেখছেন?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: দুই দেশের মধ্যে পর্যটক যাতায়াত চালু হওয়ার পর ভারত থেকে সাতটি পর্যটকবাহী রিভার ক্রুজ বাংলাদেশ ঘুরে গেলেও আমরা এক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে ছিলাম। তবে এমকে শিপিং লাইনের এমভি রাজারহাট-সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা রুটে রিভার ক্রুজ চালু হয়েছে। ঢাকার হাসনাবাদ ফেরি ঘাট থেকে যাত্রা করে চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, কাউখালী, মোরেলগঞ্জ, মোংলা, চালনা হয়ে আংটিহারায় ইমিগ্রেশন পার হয় রিভার ক্রুজটি। এরপর হেমনগর, বালি, কুমিরমারি, ভগবতপুর, নামখানা, ডায়মন্ড হারবার হয়ে কলকাতা পুলিশ জেটি ঘাটে পৌঁছে। জাহাজটি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচল করায় রিভারক্রুজে থাকা পর্যটকরা সুন্দরবনের গহিনের অনেক অদেখা অঞ্চল দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। তাই বাংলাদেশ, ভারতের নাগরিক ছাড়াও অন্য দেশের আন্তর্জাতিক পর্যটকদেরও এই সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ রয়েছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, ক্রুজ সেবাটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ নদী পর্যটন নিয়ে কী ভাবছেন?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা: নদী পর্যটনকে উৎসাহিত করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। নানাভাবে তা করাও হচ্ছে। এজন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। তারা যদি সমীক্ষা করে সম্ভাব্য স্পটগুলো আমাদেরকে দেন তাহলে আমরা সেখানে ল্যান্ডিং স্টেশন ও আনুষাঙ্গিক সুবিধাদি করে দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে পারি। ল্যান্ডিং স্টেশন করে দিলে সেগুলোর পর্যাপ্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় সম্পদের অপচয় হবে।
এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে নদী পর্যটনকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সে ব্যাপারে সচিব মহোদয়েরও নির্দেশনা আছে। সেভাবেই আমরা কাজ করছি। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, সম্ভাবনাগুলো খুঁজে খুঁজে কাজ করলে আশা করি, সাফল্য আসবেই। সেই চেষ্টাই আমরা করছি।
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়নে অন্যতম অংশীজন বিআইডব্লিউটিএ। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি কী?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা : ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ মোটা দাগে পানিসম্পদকে কেন্দ্র করে হলেও তা বাস্তবায়নে অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার ভূমিকাও কম নয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ, মরফোলজিক্যাল ও জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে খাতটির ওপর। অনিয়মিত প্রবাহের কারণে নদীবক্ষে অত্যধিক পলি জমে নৌ-চলাচলে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিতে পড়ছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের নানা অবকাঠামোও। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় টেকসই, দক্ষ ও আধুনিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে মহাপরিকল্পনার অধীনে বাস্তবায়নের জন্য ৮০টি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে বিআইডব্লিউটিএ। তিনটি পর্যায়ে অর্থাৎ ১০, ২০ ও ৩০ বছর মেয়াদে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে জ্ঞানভিত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্পও।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় অংকের বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। তবে আশার কথা হলো এসব বিনিয়োগ করতে হবে ধাপে ধাপে, যা সংস্থানযোগ্য।
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ছয়টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে। প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব কী?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা : অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন যাতে আরও বেশি সহজ হয় সেজন্যই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে দুটি জেনারেল কার্গো টার্মিনাল নির্মাণ এবং তিনটি প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ও একটি ডেক অ্যান্ড ইঞ্জিন পার্সোনেল ট্রেইনিং সেন্টারের (ডিইপিটিসি) উন্নয়ন। জেনারেল কার্গো টার্মিনাল দুটি হচ্ছে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ। প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল তিনটি হলো চাঁদপুর, বরিশাল ও ঢাকার শ্মশানঘাট। এর মধ্যে শ্মশানঘাট টার্মিনালটি নতুনভাবে নির্মিত হচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনে চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ অঞ্চলের নৌ-করিডোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই করিডোরের সক্ষমতা বাড়ানো তাই জরুরি। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পগুলোর আওতায় চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ ও সংযুক্ত নৌপথ খনন এবং টার্মিনালসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই অভ্যন্তরীণ নৌপথের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। সেই সাথে নদীপথে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীরা আরও আগ্রহী হবেন।
বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ডকইয়ার্ড সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা : বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ডকইয়ার্ড নিয়ে কী করা যায় সে ব্যাপারে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংকে (আইডব্লিউএম) পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে আমরা সমীক্ষা সম্পন্ন করেছি। সমীক্ষার আলোকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছে, যা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এসব ডকইয়ার্ড স্থানান্তরের জন্য মুন্সিগঞ্জে শীতলক্ষ্যা ও মেঘনার মোহনায় স্থানও নির্বাচন করা হয়েছে। সেখানে ডকইয়ার্ড জোন করে দেওয়া হবে। প্রত্যেকটি ডকইয়ার্ডের জন্য থাকবে আলাদা আলাদা প্লট। জোনে ডকইয়ার্ডের কর্মীদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। নৌযানের যন্ত্রাংশের জন্য মার্কেটও করে দেওয়া হবে। ট্রাকে করে যাতে পণ্য সহজেই ডকইয়ার্কে আসতে পারে সেজন্য সংযোগ সড়ক করে দেওয়া হবে।
এ ছাড়া ওই স্থানের নৌপথটিও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে আরও চওড়া করা হবে, যাতে করে ডকইয়ার্ডের কোনো জাহাজ নদীতে নামানোর সময় চলমান জাহাজ বাধাগ্রস্ত না হয়। এভাবেই বুড়িগঙ্গা তীরের ডকইয়ার্ড সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আর এটা করা হচ্ছে ডকইয়ার্ডগুলোকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে। এ নিয়ে আমরা জাতীয় কর্মশালারও আয়োজন করেছি।
অভ্যন্তরীণ নৌপথে বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ আছে কিনা? বেসরকারি বিনিয়োগের প্রস্তাব পেলে কীভাবে নেবেন?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা : আমাদের অভ্যন্তরীণ নৌপথে বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জেটি ও টার্মিনাল রয়েছে। মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরে বেসরকারি উদ্যোগে অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনালও গড়ে উঠেছে। আরও বেশ কিছু টার্মিনালের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
যদি বেসরকারি উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসার প্রয়োজনে ফেয়ারওয়ে উন্নয়নের প্রস্তাব দেন তাহলে আমরা তাকে স্বাগত জানাবো। কুমিল্লায় গোমতী, বাঘাবাড়ী, গোদাগাড়ীর দিকে এটা হতে পারে।
আঞ্চলিক যোগাযোগে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা : এই অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের চল বহু দিনের। ১৯৫০ এর দশকের শেষ দিকেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য এবং এক দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য অন্য দেশের নৌপথ ব্যবহারের সুযোগ ছিল। কিন্তু ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড (পিআইডব্লিউটিটি) স্বাক্ষরিত হয়। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নৌপথে দ্বিপক্ষীয় পণ্য বাণিজ্য আরও গতিশীল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে প্রটোকল রুট এবং পোর্ট অব কলের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। প্রটোকল রুট দিয়ে এক সময় ভারত থেকে কেবল আমদানি হলেও এখন বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিও শুরু হয়েছে। ভুটানও এখন ভারতের মধ্য দিয়ে আসাম থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে বাংলাদেশে পাথর রপ্তানি করছে। নৌপথ ব্যবহারের আগ্রহ দেখিয়েছে নেপালও। অর্থাৎ, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেই অভ্যন্তরীণ নৌ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। এসব রুট দিয়ে জাহাজ চলাচল যাতে নির্বিঘœ হয় সেজন্য নৌপথগুলো সারা বছর নাব্য রাখার চেষ্টা করছি আমরা। প্রটোকল রুটের ভারতীয় অংশও সংরক্ষণ ও উন্নয়নে কাজ করছে সে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ।
সুলতানগঞ্জ-মায়া প্রটোকল রুট সম্প্রতি চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে এর প্রভাব কী হবে?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা : প্রটোকল রুটটিতে ট্রায়াল রান সম্পন্ন হয়েছে। এতে করে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ট্রায়াল রান সম্পন্নের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমের অনুমোদন পাওয়া গেলে বিআইডব্লিউটিএ তার কাজ শুরু করবে।
রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ থেকে দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়কপথে সরাসরি সংযোগ থাকায় মায়া পোর্ট অব কলের মাধ্যমে ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্য দেশের বৃহত্তর অংশে পৌঁছানো সহজ হবে। প্রাথমিকভাবে এই পথে ভারত থেকে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল, পাথর, মার্বেল, খনিজ বালুর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী বাংলাদেশে আসবে। আর বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাবে বস্ত্র, মাছ, পাট ও পাটজাত পণ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য। সুলতানগঞ্জ-মায়া প্রটোকল রুট দিয়ে এসব পণ্য পরিবহনে সময় যেমন কম লাগবে, খরচও সাশ্রয় হবে।
এ ছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ দেশের অন্যান্য মেগা প্রকল্পে ব্যবহৃত পাথরের বড় অংশ আমদানি করা হয় ভারত থেকে। সড়কপথে এসব পাথর আমদানিতে টনপ্রতি খরচ হয় ১৩ মার্কিন ডলার। মায়া-সুলতানগঞ্জ নৌরুট ব্যবহার করে একই পাথর আমদানিতে খরচ নেমে আসবে টনপ্রতি ৯-১০ মার্কিন ডলারে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর এডিপিভুক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের হার কতটা সন্তোষজনক?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা : নদীভিত্তিক প্রকল্পগুলো সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখলমুক্ত করার কথাই ধরুন। দেখা গেল, কোথাও আমরা নদীর জমি দখলমুক্ত করলাম এবং সেটাকে স্থায়ী রূপ দিতে দিতে আরেকজন আবার দখল করে নিচ্ছে। আবার দেখা গেল, কোথাও আমরা স্লোপ বাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি কিন্তু পরে দেখা গেল ভার্টিক্যাল বাঁধ দিলে ভালো হয়। ব্যয় সাশ্রয়ের জন্যও অনেক সময় প্রকল্পে পরিবর্তন আনতে হয়। নদীভিত্তিক প্রকল্পের কাজের ধরনই এটা, যার ফলে প্রকল্প সম্পাদনে অনেক সময় কিছুটা বেশি সময় লেগে যায়।
ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রেও অনেকটা তা-ই। ড্রেজিং চলাকালেই অনেক সময় অধিকতর সমীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। প্রকল্প টেকসই রূপ দিতে ও সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিত করতে ক্ষেত্রবিশেষে কলেবরও বেড়ে যায়। ব্যয় ও সময় দুটোই এর সাথে জড়িত। এসব চ্যালেঞ্জের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ করা সম্ভব হয় না। তা সত্তে¡ও আমি বলব, বিআইডব্লিউটিএ তথা নৌপারিবহন মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার যথেষ্ট সন্তোষজনক।
কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী?
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা : যেকোনো কাজেই কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। বিআইডব্লিউটিএর ক্ষেত্রেও আছে। উন্নয়ন বাজেটের কথা যদি বলেন তাহলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংস্থাগুলোর মধ্যে বিআইডব্লিউটিএর বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে উন্নয়ন বাজেটভুক্ত আমাদের মোট ১৪টি প্রকল্প আছে। এর মধ্যে তিনটি ড্রেজিং প্রকল্প। বাকিগুলো হয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প অথবা অ্যাকুইজিশন অব প্ল্যাটফরম। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় লোকবল যদি না থাকে এবং বাজেটে যদি তার প্রতিফলন না থাকে তাহলে সেটা একটা চ্যালেঞ্জ।
ড্রেজারের কথা যদি বলেন, তাহলে আরও ৩৫টি ড্রেজার আমাদের বহরে যুক্ত হচ্ছে। সেগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ জনবল প্রয়োজন। সেই সাথে আমাদের ব্যয়ও কমিয়ে আনতে হবে। এগুলো নিশ্চিত করা আমার জন্য চ্যালেঞ্জ।
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা : বিআইডব্লিউটিএ আমার জন্য কাজের নতুন একটা ক্ষেত্র এবং কাজ করে আমি আনন্দ পাচ্ছি। এখানকার কর্মীদের মধ্যে স্বতঃস্ফ‚র্ততার কোনো কমতি নেই এবং তারা যথেষ্ট সহযোগিতার মনোভাবাপন্ন। তৎক্ষণাৎ দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তাঁরা সবসময়ই প্রস্তুত। এখানকার কাজের ধরনটাই এমন। কোনো ঘাট ভেঙে গেলে বা লঞ্চের কোনো টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হলে তখনই সেখানে মেরামত করতে হয়। সেটা না করলে যাত্রীসাধারণ অসুবিধায় পড়বেন এবং একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ, এখানে সব কাজই খুব দ্রুততার সাথে হয় এবং বিআইডব্লিউটিএর কর্মীরা সেটাই করছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে সবখানেই বিআইডব্লিউটিএর কর্মীরা নিরলসভাবে তাঁদের কাজগুলো করে যাচ্ছেন।
সারা দেশে আমাদের ৬০০ এর মতো পন্টুন আছে। একেকজন পন্টুন লস্করকে দুই-তিনটি পন্টুন দেখভাল করতে হয়। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাঁরা এই কাজগুলো নিষ্ঠার সাথে করে যাচ্ছেন। উদ্ধার জাহাজগুলোকে ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত থাকতে হয়। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত তাদেরকে উদ্ধারকাজ শুরু করতে হয়। এক কথায় বললে, কর্তৃপক্ষের কর্মীদের মধ্যে আগ্রহের কোনো ঘাটতি নেই; কাজ করার ব্যাপারে তাঁরা প্রতিশ্রæতিবদ্ধ এবং তার প্রমাণও তাঁরা প্রতিনিয়ত রেখে চলেছেন। চেয়ারম্যান হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে সবাইকে উদ্বুদ্ধ রেখে প্রতিষ্ঠানকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া।
মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য নদীবাংলার পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা : নদীবাংলাকেও ধন্যবাদ।