বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
16 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াসে নৌখাতের উজ্জীবন নদী ফিরছে আপন বাঁকে

প্রাক-কথা

মধুমতির অসংখ্য শাখা নদীর একটি বাইগার নদী। নদীর দু’পাশে তাল, তমাল, হিজল গাছের সবুজ সমারোহ। ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে আসে হালধরা মাঝির কণ্ঠ থেকে, পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলে। (শেখ মুজিব আমার পিতা-শেখ হাসিনা)

এই বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেন বঙ্গবন্ধু। এই টুঙ্গিপাড়াতেই তার শৈশব কেটেছে, নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে।

বঙ্গবন্ধু তাই নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘পানির দেশের মানুষ’ হিসেবে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন-‘পানির দেশের মানুষ আমরা। পানিকে বড় ভালবাসি। আর মরুভূমির ভিতর এই পানির জায়গাটুকু ছাড়তে কত যে কষ্ট হয় তা কি করে বোঝাব!’ এই ভালোবাসা থেকেই নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার কথা ভেবেছিলেন সেই ১৯৫৬ সালেই। আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘বন্যা পূর্ব পাকিস্তানিদের জীবনে নূতন নয়। কিন্তু বিজ্ঞানসমৃদ্ধ ও সম্পদ বলিষ্ঠ মানুষ অসহায়ের মত আজও প্রকৃতির রুদ্র পীড়ন সহ্য করিবে কিনা ইহাই হইল সবচেয়ে বড় সওয়াল। হোয়াংহো নদীর প্লাবন, ট্যানিসিভ্যালির তা-ব ও দানিয়ুবের দুর্দমতাকে বশে আনিয়া যদি মানুষ জীবনের সুখ-সমৃদ্ধির পথ রচনা করিতে পারে, তবে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মত শান্ত নদীকে আয়ত্ত করিয়া আমরা কেন বন্যার অভিশাপ হইতে মুক্ত হইব না?’

নদীর প্রতি ভালোবাসা ও দায় কোনোদিনই বিস্মৃত হননি জাতির পিতা। স্বাধীনতার পর তাই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে কিছুদিন রাখেন নিজের হাতে। নৌপথ নাব্য রাখতে উদ্যোগী হন নদী খননে। এর অংশ হিসেবে সংগ্রহ করেন সাতটি ড্রেজার। নদী ব্যবস্থাপনা ও এর প্রাণ-প্রকৃতি নিয়েও ভাবতেন তিনি। জাতির পিতার কালোত্তীর্ণ ভাবনা বাস্তবে রূপ দেওয়ার, সামনে এগিয়ে নেওয়ার ব্রত এবার তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

রাজনৈতিক অঙ্গীকার

রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া জাতীয় উন্নয়ন, পরিবর্তন ও সংস্কার অসম্ভব। আর এ অঙ্গীকার আসতে হয় রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। সদ্য স্বাধীন দেশে নদী ও নৌপথের উন্নয়নের যে অঙ্গীকার, সেটাও এসেছিল জাতির পিতার কাছ থেকে। এ অঙ্গীকার নদীর মতোই প্রবহমান রেখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, যা প্রতিবিম্বিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে।

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে নদী ও নৌপথের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে আওয়ামী লীগ। অঙ্গীকার করা হয় নদী খনন, পানি সংরক্ষণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদীভাঙন রোধের। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় প্রতিটি

ছোট-বড় নদী খনন করার; সেই সাথে সারা বছর তা যেন নাব্য থাকে সেই ব্যবস্থা গ্রহণের। ইশতেহারে নিরাপদে স্বল্প খরচে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য নৌপথের উন্নয়ন ও নৌপরিবহন ব্যবস্থা আধুনিকায়নের ওপর জোরারোপ করে আওয়ামী লীগ।

পরের ইশতেহারে অর্থাৎ ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ নদীপথ খনন ও পুনর্খননের বিশাল কর্মযজ্ঞ আরো জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ক্রমশ ভরাট হয়ে যাওয়া নৌপথগুলো পুনরুদ্ধার ও খননের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি ও নৌ চলাচলের উপযোগী করে তোলার কথা বলা হয়। প্রধান নদী ও নৌপথগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধি ছাড়াও ভরাট ও পরিত্যক্ত নৌপথগুলো ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী পুনরুজ্জীবনের প্রকল্পগুলোর কাজ অব্যাহত রাখার ঘোষণাও দেওয়া হয় ওই ইশতেহারে।

দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নদী ও নৌপথের গুরুত্ব কতখানি সেটি উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ অর্থাৎ ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকেই ঐতিহ্যগতভাবে নৌপথ একটি নিরাপদ ও সাশ্রয়ী এবং পরিবেশ ও দরিদ্রবান্ধব যোগাযোগ মাধ্যম। একসময় যোগাযোগের ৮৫ শতাংশ হতো নৌপথে। দেশে সর্বমোট প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে। যার মাত্র ছয় হাজার কিলোমিটার পরিবহনকাজে ব্যবহার হয় এবং শুষ্ক মৌসুমে তা অর্ধেকে নেমে আসে।’

অভ্যন্তরীণ নৌপথের পুনরুদ্ধার ও এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হয় এই ইশতেহারে। বলা হয়, ব্যাপক খননের পরিকল্পনা হিসেবে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে। আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরের সাথে অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলোর সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি সুগম করা হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্যকে সহজ করার লক্ষ্যে ভারতের সাথে নৌপথে বাণিজ্য আরো বাড়িয়ে একে নেপাল-ভুটান পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে। ঢাকার চারপাশের চারটি নদী ও খালগুলো দূষণ ও দখলমুক্ত করার পাশাপাশি খননের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে এনে নদীতীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকারও করা হয়েছে।

অঙ্গীকার নিছক কথার কথা নয়, জাঁ-পল সাত্রের মতে, তা আদতে কাজ। বর্তমান সরকারও তাদের অঙ্গীকার ও পরিকল্পনাকে কেবল কথার গণ্ডিতে আটকে রাখেনি, তা বাস্তবায়নের পথে হেঁটেছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০০৯ সালে গঠিত সরকারের মেয়াদেই ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে মধুমতি, গড়াই, যমুনা, বুড়িগঙ্গা, কুশিয়ারা প্রভৃতি নদীর দীর্ঘ নৌপথগুলোর নাব্যতা পুনরুদ্ধার করা হয়। মধুমতি ও গড়াই খননের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানিপ্রবাহ বেড়েছে। যার ফলে এই অঞ্চলের লবণাক্ততা হ্রাস পেয়েছে এবং সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০০৯-১৫ সময়ে সরকার ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার নৌপথ খনন করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ১ হাজার ২৭০ কিলোমিটার নৌপথ এবং প্রায় তিন হাজার একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষায় মোংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথ খনন করে নৌ-সংযোগ চালু করা হয়েছে।

দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার সাতটি ড্রেজার সংগ্রহ করেছিল। এরপর দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে ২০০৯-১৩ সময়কালে আওয়ামী লীগ সরকার ১৪টি ড্রেজার সংগ্রহ করে। নদীপথে দেশে বাণিজ্য গতিশীল করতে নৌযানের সংখ্যা বাড়ানোরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০১৯ সালে দেশে রেজিস্ট্রিকৃত নৌযানের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৩ হাজারে। ২০০৯ সালে যেখানে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় হাজার।

নদী বাঁচিয়ে তাকে সঞ্চারণশীল রাখতে ইশতেহারের বাইরেও নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসবই সম্ভব হয়েছে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও আন্তরিক প্রচেষ্টায়।

গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি

গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যার সূত্রপাত হয় ১৯৫২ সালে, যখন ভারত কলকাতা বন্দর (বর্তমানে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দর) রক্ষার যুক্তি দেখিয়ে সীমান্তের ঠিক উজানে একটি ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বুঝতে বাকি ছিল না যে, বাংলাদেশের অভিন্ন প্রায় সব নদীর উজান যেহেতু ভারত, সেখান থেকে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। তাই স্বাধীনতার মাত্র দুই মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করেন। তখনই ভারতের সাথে গঙ্গার পানিবণ্টনের ফর্মুলা নির্ধারণে জোরালো উদ্যোগ নেন।

এ অঞ্চলের পানিসম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যৌথ নদী কমিশন বা জেআরসি গঠনের আলোচনা এবং একটি স্থায়ী যৌথ নদী কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে যৌথ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের নভেম্বরে যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি যৌথ ঘোষণাপত্রে একমত পোষণ করেন যে, বাংলাদেশ ও কলকাতা বন্দরের পূর্ণ চাহিদা মেটানোর জন্য শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কার কাছে গঙ্গা নদীতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এছাড়া কোনো চুক্তিতে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত ফারাক্কা চালু হবে না। এ নিয়ে ১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির আওতায় ভাটির দেশ হিসেবে গঙ্গার পানির ৪৪ হাজার কিউসেক হিস্যা পাওয়ার সম্মতি আদায় করে নেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা–পরবর্তী সময়ে নানা সাময়িক চুক্তি হলেও গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে গঙ্গার পানির ঘূর্ণি ঘুরতেই থাকে। ঘূর্ণনের পাকে জড়িয়ে যেতে থাকে অববাহিকার মানুষের বেঁচে থাকার উপাদানগুলোও। রাজনৈতিক টানাপড়েনের এই পরিণতি কী হতে পারে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার তা ভালোমতোই উপলব্ধি করে। অকৃত্রিম সদিচ্ছায় সমস্যা সমাধানের পথে পা বাড়ায় সরকার। দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে ফারাক্কার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও ভারত। বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের পক্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেব গৌড়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী, ফারাক্কায় পানির প্রাপ্যতা ৭০ হাজার কিউসেক বা তার কম হলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই ৫০ শতাংশ করে পানির হিস্যা পাবে। পানির প্রাপ্যতা ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক হলে বাংলাদেশ পাবে ৩৫ শতাংশ। অবশিষ্টাংশ পাবে ভারত। আর ৭৫ হাজার কিউসেক বা তার বেশি প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে ভারতের হিস্যা হবে ৪০ হাজার কিউসেক। অবশিষ্ট পানি পাবে বাংলাদেশ।

নদীর সাংবিধানিক ও আইনি স্বীকৃতি

‘এনভায়রনমেন্টাল পারসনহুড’ ধারণাটি প্রথমবারের মতো সামনে আনেন সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ডি. স্টোন ১৯৭৪ সালে। ক্রিস্টোফার ডি. স্টোন যুক্তি দেখান, পরিবেশগত কোনো সত্তা জীবন্ত সত্তার স্বীকৃতি পেলে সে মুক্ত থাকতে পারে। সেই সাথে আদালতের শরণ নেওয়ার অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়।

এরপর থেকেই প্রকৃতির অধিকারের বিষয়টি নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয় এবং আদালতের মাধ্যমে আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি উঠতে থাকে। এরই পথক্রমে ২০০৮ সালে প্রথম দেশ হিসেবে একুয়েডর তাদের সংবিধানে প্রকৃতির আইনি অধিকারের স্বীকৃতি দেয়। ২০১১ সালে একই ধরনের আইন পাস করে বলিভিয়াও। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে

প্রথম দেশ হিসেবে নিউজিল্যান্ড সুনির্দিষ্ট একটি নদীকে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে ঘোষণা দেয়। ওয়াঙ্গানুই নদীর আইনি অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে রায় দেন দেশটির আদালত। একই বছর ভারতের উত্তরা খ- হাইকোর্ট গঙ্গা ও যমুনা নদীকে ব্যক্তিসত্তা ঘোষণা করে রায় দেন। অর্থাৎ একজন মানুষের যে ধরনের অধিকার, কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা রয়েছে, এগুলোর ক্ষেত্রেও তার সবই স্বীকার করে নেওয়া হয়। রাজ্য সরকারকে নদী দুটির অভিভাবক ঘোষণা করা হয়।

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টও নদীর আইনগত অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে ২০১৯ সালে রায় ঘোষণা দেন। বাংলাদেশই বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে সব নদীকে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে নদীর ক্ষতি সাধনের অভিযোগে যে কাউকে আদালতে তুলতে পারবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।

এছাড়া প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ২০১১ সালে সংবিধানে যুগান্তকারী একটি সংযোজনী আনা হয়েছে। ১৮ক ধারা সংযুক্ত করে পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া হয়েছে-‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন

ফরাসি দার্শনিক ও গণিতবিদ ব্লেইজ প্যাস্কাল নদীকে দেখতেন চলমান রাজপথ হিসেবে। তার ভাষায়, আমরা কোথায় যেতে চাই তার দিকনির্দেশনা দেয় নদী। এ দিকনির্দেশনা পেতে হলে নদীকে তার আপন গতিতে চলতে দিতে হয়। দেশের সব নদী যাতে তার মতো করে, তার গতিতে চলতে পারে সেজন্য ২০১৩ সালেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় নদী রক্ষা আইন প্রণয়ন করে সরকার। আরো সবিস্তারে বললে নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্প-কারখানা কর্তৃক সৃষ্ট নদীদূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌপরিবহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে একটি কমিশন গঠনের উদ্দেশে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩-এর ৫ ধারা অনুযায়ী নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে ২০১৮ সালে গঠন করা হয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। আইনে কমিশনকে স্থাবর ও অস্থাবর উভয় ধরনের সম্পত্তি অর্জন করার ও অধিকারে রাখার এবং হস্তান্তরের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিজ নামে মামলা দায়ের করার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।

কমিশনের বিশদ কার্যাবলির মধ্যে আছে:

ক. নদীর সাথে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে সরকারকে সুপারিশ করা;

খ. নদী অবৈধ দখলমুক্ত ও পুনর্দখল রোধ করার বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ প্রদান করা;

গ. নদী ও নদীর তীরে স্থাপিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ-সংক্রান্ত সরকারকে সুপারিশ প্রদান করা;

ঘ. নদীর পানি দূষণমুক্ত রাখার বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করা;

ঙ. বিলুপ্ত বা মৃতপ্রায় নদী খননের বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ করা;

চ. নদী-সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডার উন্নয়নকরণে সরকারের কাছে সুপারিশ করা;

ছ. নদী উন্নয়ন-সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের কাছে যেকোনো সুপারিশ করা;

জ. নদীর পরিবেশগত ভারসাম্য ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে সরকারকে সুপারিশ প্রদান করা;

ঝ. নদী রক্ষায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের লক্ষ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ প্রদান করা;

ঞ. নদী রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণে সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া;

ট. নিয়মিত পরিদর্শন ও নদী রক্ষা-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিবীক্ষণক্রমে সুপারিশ প্রদান করা;

ঠ. নদী রক্ষাসংশ্লিষ্ট বিদ্যমান বিভিন্ন আইন ও নীতিমালার ব্যবহারিক প্রয়োগ পর্যালোচনাক্রমে ও প্রয়োজনবোধে উক্ত আইন ও নীতিমালা সংশোধনের জন্য সরকারকে সুপারিশ করা; এবং

ড. দেশের খাল, জলাশয় এবং সমুদ্র-উপকূল দখল ও দূষণমুক্ত রাখার বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ করা।

কমিশনকে পূর্ববর্তী বছরের সব কার্যাবলি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রতি বছরের ১ মার্চের মধ্যে সরকারের কাছে পেশ করতে হয়। সারা দেশে নদী

দখলের তথ্য তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। ২০১৯ সালের দখলচিত্র-সংবলিত বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি প্রকাশ করেছে কমিশন। তাতে ৬৪ জেলায় নদী দখলদারের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৫৭ হাজার ৩৯০। কমিশনের তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে এসব দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী উচ্ছেদ কার্যক্রমও চলছে।

পরিবেশ আইন যুগোপযোগীকরণ

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নদ-নদী ও জীববৈচিত্র্য একে অপরের পরিপূরক। গতিময়তা ও অবিরাম ভাঙাগড়ার বৈশিষ্ট্যের কারণে নদ-নদী অজৈব কঠিন পদার্থের নমুনা তার কূলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে পারে না হয়তো। কিন্তু নদীর সাথে যুক্ত মানবজীবন, উদ্ভিদ-প্রাণী ধুয়ে-মুছে যায় না। আর জীববৈচিত্র্য স্বাভাবিক, সতেজ রাখতে নদীকে স্বাস্থ্যকর রাখাটা খুব জরুরি।

বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ আইনকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ২০১০ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সংশোধনীও আনা হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ১ নং আইনের ধারা ৯-এ সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পরিমাণের অতিরিক্ত পরিবেশ দূষক নির্গত হয় বা নির্গত হওয়ার ঝুঁকি থাকে, এমন ক্ষেত্রে এ ধরনের নির্গমনের জন্য দায়ী ব্যক্তি ও নির্গমন স্থানটির দখলকার ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বা প্রশমন করিতে বাধ্য থাকবে। এছাড়া এই ধারার অধীন কোনো ঘটনার তথ্য পেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা তার কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যথাশিগগির সম্ভব পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বা প্রশমন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা অন্য যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেবেন এবং নির্দেশিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বা প্রতিষ্ঠান মহাপরিচালক প্রদত্ত নির্দেশ পরিপালনে বাধ্য থাকবেন। এছাড়া মহাপরিচালকের কাছ থেকে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, পরিবেশগত ছাড়পত্র ব্যতিরেকে কোনো এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন বা প্রকল্প গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিল্পবর্জ্যে ব্যাপকভিত্তিতে নদী দূষণের যে ঘটনা তা প্রতিকারে নিশ্চিতভাবেই এটি পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যুগান্তকারী সংশোধনী। একই সাথে পরিবেশ দূষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তিতে প্রত্যেক জেলায় পরিবেশ আদালত স্থাপনের লক্ষ্যে ২০২০ সালে পরিবেশ আদালত আইন ২০১০ পাস করেছে সরকার।

নৌ-প্রটোকলের আওতা বৃদ্ধি

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে বাকি অংশের পণ্য পরিবহন ও বাণিজ্য হতো বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করে। এমনকি পাকিস্তান সৃষ্টির পরও নদী ও রেলপথে এটা অব্যাহত ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর এটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দুই দেশের মধ্যে নৌ-প্রটোকল চুক্তি প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেডের (পিআইডব্লিউটিটি) স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে নৌপথে ট্রানজিট পুনরায় চালু করেন জাতির পিতা। শুরুর দিকে চুক্তিটি প্রতি দুই বছরের জন্য নবায়নযোগ্য ছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১৫ সালের ৬ জুন পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়নের সুযোগ রেখে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিটি নবায়ন করে।

নৌ-প্রটোকলের প্রথম সংযোজনী স্বাক্ষর হয় ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর। সেখানে বাংলাদেশের পানগাঁও ও ভারতের ধুবরীকে ‘পোর্টস অব কল’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর প্রটোকলটি কীভাবে আরো বেশি কার্যকর করা যায় তা নিয়ে প্রটোকল-সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটি ও নৌপরিবহন সচিব পর্যায়ে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে নয়াদিল্লিতে। দ্বিতীয় বৈঠকটি হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায়। বৈঠকে নদীপথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহজ করতে প্রটোকল রুটের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন পোর্টস অব কল ঘোষণার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। ২০২০ সালের ২০ মে প্রটোকলের দ্বিতীয় সংযোজনী স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তা কার্যকর হয়।

চুক্তির ফলে বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল রুটের সাথে নতুন দুটি রুট দাউদকান্দি-সোনামুড়া ও সোনামুড়া-দাউদকান্দি যুক্ত হয়। রুটের সংখ্যা আটটি থেকে উন্নীত হয় ১০টিতে। রুটগুলো হলো:

১. কলকাতা-হলদিয়া-মোংলা-চাঁদপুর-সিরাজগঞ্জ-ধুবরী- শিলঘাট

২. শিলঘাট-ধুবরী-সিরাজগঞ্জ-চাঁদপুর-মোংলা-হলদিয়া- কলকাতা

৩. কলকাতা-হলদিয়া-চাঁদপুর-আশুগঞ্জ-করিমগঞ্জ

৪. করিমগঞ্জ-আশুগঞ্জ-চাঁদপুর-হলদিয়া-কলকাতা

৫. করিমগঞ্জ-আশুগঞ্জ-চাঁদপুর-সিরাজগঞ্জ-ধুবরী- শিলঘাট

৬. শিলঘাট-ধুবরী-সিরাজগঞ্জ-চাঁদপুর-আশুগঞ্জ- করিমগঞ্জ

৭. রাজশাহী-গোদাগাড়ী-ধুলিয়ান

৮. ধুলিয়ান-গোদাগাড়ী-রাজশাহী

৯. দাউদকান্দি-সোনামুড়া

১০. সোনামুড়া-দাউদকান্দি

দ্বিতীয় সংযোজনীর আগে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছয়টি করে ১২টি ‘পোর্টস অব কল’ ছিল। এগুলো হলো বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, মোংলা, সিরাজগঞ্জ, আশুগঞ্জ ও পানগাঁও এবং ভারতের কলকাতা, হলদিয়া, করিমগঞ্জ, পাণ্ডু শিলঘাট ও ধুবরী। দ্বিতীয় সংযোজনীর মাধ্যমে পাঁচটি করে ১০টি ‘পোর্টস অব কল’ও যুক্ত হয়েছে। সংযোজিত নতুন ‘পোর্টস অব কল’ হলো বাংলাদেশের রাজশাহী, সুলতানগঞ্জ, চিলমারী, দাউদকান্দি ও বাহাদুরাবাদ এবং ভারতের ধুলিয়ান, ময়া, কোলাঘাট, সোনামুড়া ও জগিগোপা।

এছাড়া দুটি করে ‘এক্সটেন্ডেড পোর্টস অব কল’ হলো বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ ‘পোর্ট অব কল’র আওতায় ঘোড়াশাল ও পানগাঁও ‘পোর্ট অব কল’র আওতায় মুক্তারপুর এবং ভারতের কলকাতা ‘পোর্ট অব কল’র আওতায় ত্রিবেণী (বেন্ডেল) ও করিমগঞ্জ ‘পোর্ট অব কল’র আওতায় বদরপুর।

নৌ-প্রটোকলে যুক্ত হওয়া কুমিল্লার দাউদকান্দি ও ত্রিপুরার সিপাহিজলা জেলার সোনামুড়া রুটে পরীক্ষামূলক পণ্য পরিবহন এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ৫০ টন সিমেন্টবাহী একটি নৌযান ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সোনামুড়া নৌবন্দরে পৌঁছে। প্রস্তুতি চলছে রাজশাহী-গোদাগাড়ী-ধুলিয়ান রুট দিয়ে পণ্য পরিবহনের। রুটটি চালু করে আরিচা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা গেলে দেশের উত্তরাঞ্চলে পাথর পরিবহনের খরচ অনেক কমে যাবে। সেই সাথে অবকাঠামোও উন্নত হবে।

বিদ্যমান প্রটোকলের আওতায় আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশ ও ভারতীয় নৌযানের অনুপাত ৯৫.২১:৪.৭৯। ২০১৯-২০ অর্থবছরে (মার্চ ২০২০ পর্যন্ত) বাংলাদেশি নৌযানের মাধ্যমে ২ হাজার ৫৯১টি ট্রিপের মাধ্যমে ২২ লাখ ২৩ হাজার ৪৬১ মেট্রিক টন পণ্য পরিবাহিত হয়েছে। একই সময়ে ভারতীয় ৫৪টি নৌযানের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়েছে ৮৩ হাজার ২৫৪ মেট্রিক টন পণ্য। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নৌ-প্রটোকল রুটে বাংলাদেশি জাহাজের মাধ্যমে ২ হাজার ৬৮৫টি ট্রিপে ২২ লাখ ৮৬ হাজার ৮৫২ মেট্রিক টন এবং ভারতীয় জাহাজের মাধ্যমে ৫৯টি ট্রিপে ৭৮ হাজার ৭৯৪ মেট্রিক টন পণ্য পরিবাহিত হয়েছিল।

নাব্যতা ফেরানোর উদ্যোগ

নদ-নদীই বাংলার প্রাণ। এরাই বাংলাকে গড়েছে। যুগে যুগে বাংলার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় করেছে, এখনো করছে। প্রয়াত ভূগোলবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যেমন বলেছেন-‘এসব নদ-নদীর ইতিহাসই বাংলার ইতিহাস। এদের তীরে তীরে মানুষ সৃষ্ট সভ্যতার জয়যাত্রা; মানুষের বসতি, কৃষির পত্তন, গ্রাম, নগর, বন্দর, সম্পদ, সমৃদ্ধি, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-কর্ম সবকিছুর বিকাশ।’

বাংলাদেশের অস্তিত্বের অংশ এসব নদ-নদী যে অদূর ভবিষ্যতে অনাদর-অবহেলায় হুমকির মুখে পড়তে পারে, বঙ্গবন্ধু তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের মতো কঠিন কাজের মধ্যেও নদী খননকে তাই বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। নদীর নাব্যতা সৃষ্টি ও উন্নয়নে গ্রহণ করেছিলেন বহুমাত্রিক কর্মপরিকল্পনা। নদী খননের কাজ শুরু করেন ১৯৭৩ সালেই। রাজবাড়ীর পাংশায় চন্দনা-বারাসিয়া নদী খননের মধ্য দিয়ে এই কাজের উদ্বোধন করেন।

বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী সময়ে নদীকে স্রোতস্বিনী রেখে নৌপথকে সচল রাখার চেষ্টা সেভাবে আর দেখা যায়নি।

সতত সঞ্চরণশীল নদী ধীরে ধীরে শীর্ণকায় ধারণ করেছে। নৌপথের পরিমাণ কমতে কমতে তলানি স্পর্শ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমনটা বলেছেন-‘বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের মোট আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ পানিসম্পদ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি, নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড় ও অন্যান্য জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল। দেশের অভ্যন্তরে ৪০৫টি নদী ও ৫৭টি আন্তঃদেশীয় সংযোগ নদী রয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক ও মনুষ্য বিভিন্ন কারণে আমাদের নদ-নদী ও জলাশয় ক্রমশ দূষণের কবলে নিপতিত হচ্ছে। নাব্যতাহীনতা এবং নদীসম্পদের অপব্যবহারের কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এজন্য নদ-নদী ও জলাশয় রক্ষা করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।’

এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই নৌপথ পুনরুদ্ধারে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে সরকার। মহাপরিকল্পনায় সরকারের এই মেয়াদেই ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। এজন্য ড্রেজিং করা হবে ১৭৮টি নদী। নাব্যতা ফেরাতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ড্রেজিংয়ের মূল দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ৩১৩টি নদী খননের লক্ষ্য রয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের।

বিআইডব্লিউটিএ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ৩০০ কিলোমিটারের মতো নৌপথ পুনরুদ্ধার করেছে ১৯টি নদীর ২১টি এলাকা খনন করে। এর মধ্যে আড়িয়াল খাঁর মাদারীপুর-কবিরাজপুর-চৌধুরীহাট নৌপথের জাজিরা-মাদারীপুর অংশ খননের মাধ্যমে ২০ কিলোমিটারে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। একই নৌপথের ময়নাকাটায় মাদারীপুর-কবিরাজপুর-পিয়াজখালী এলাকা খনন করে নাব্যতা ফেরানো হয়েছে ১১ কিলোমিটারে। নারায়ণগঞ্জ-দাউদকান্দি এলাকায় মেঘনা ও গোমতী নদীর সাত কিলোমিটার খনন করেছে

বিআইডব্লিউটিএ। খনন করা হয়েছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ডেমরা-ঘোড়াশাল-পলাশ টোক-কটিয়াদি নৌপথের ৩ কিলোমিটার এবং আনোয়ারপুর-তাহেরপুর-বিশম্বপুর নৌপথের বাউলাই, রক্তি ও রকশা নদীর ৮ কিলোমিটারও। এছাড়া কুমার নদের সিনধিয়া ঘাট-ভাঙ্গা নৌপথের ৭ কিলোমিটার; তিতাস নদীর নরসিংদী-সলিমগঞ্জ-বাঞ্ছারামপুর

নৌরুটের ৫ কিলোমিটার; একই নদীর দাউদকান্দি-হোমনা-রামকৃষ্ণ রুটে ৪ কিলোমিটার; পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের কটিয়াদি-ভৈরব নৌপথের ৫ কিলোমিটার; কংস নদীর পাগলাজোড়-মোহনগঞ্জ নৌপথের ১০ কিলোমিটার; বাউলাই ও মগরা নদীর দিলালপুর-চামড়াঘাট-নিকলি-নেত্রকোনা রুটের ১৪ কিলোমিটার; মেঘনা, পাগলা ও বুড়ি নদীর চিত্রি-নবীনগর-গোকর্নঘাট-কুটিবাড়ি রুটের ৬ কিলোমিটার; নতুন নদীর ছাতক-ভোলাগঞ্জ রুটের ৭ কিলোমিটার ও ভৈরব নদীর খুলনা-নওয়াপাড়া নৌপথের ১১ কিলোমিটার ২০১৯-২০ অর্থবছরে খনন করা হয়েছে। এর বাইরে পালরদি নদীর টরকী-হোসনাবাদ-ফাঁসিয়াতলা নৌপথের ৭ কিলোমিটার; বোগাই, কংস নদীর মোহনগঞ্জ থেকে নালিতাবাড়ি নৌপথের ৭০ কিলোমিটার; পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ৫৮ কিলোমিটার; ব্রহ্মপুত্রের মেঘনা-লাঙ্গলবন্দ নৌপথের ১১ কিলোমিটার; ঝালুখালি নদীর ডলুরা-সুনামগঞ্জ নৌপথের ৬ কিলোমিটার; ধলেশ্বরী নদীর হাজরাপুর-জাবরা নৌপথের ৮ কিলোমিটার; আত্রাই নদীর পাবনা-নাটোর-দিনাজপুর নৌপথের ১৮ কিলোমিটার এবং দুধকুমার নদীর ৪ কিলোমিটার নৌপথ খননের পর গত অর্থবছর উদ্ধার করা হয়েছে।

এছাড়া ২০০৯-১৫ সময়ে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার নৌপথ খনন করেছে সরকার। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ১ হাজার ২৭০ কিলোমিটার নৌপথ চালু করা হয়েছে।

ক. ড্রেজারের সংখ্যা বৃদ্ধি

পাকিস্তানের রেখে যাওয়া ‘খনক’ নামের একটি মাত্র ড্রেজার দিয়ে যে বিশাল আয়তনের অভ্যন্তরীণ নৌপথের নিয়মিত পলি অপসারণ ও খনন সম্ভব নয় বঙ্গবন্ধু তা প্রথমেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এজন্য স্বাধীনতার পর বিআইডব্লিউটিএ’র জন্য দু’দফায় বিদেশ থেকে সাতটি ড্রেজার সংগ্রহ করেন। দীর্ঘদিন এই সাতটি ড্রেজার দিয়েই নৌপথের খননকাজ চলছিল। ড্রেজার ক্রয়ের আর কোনো উদ্যোগ সেভাবে নেওয়া হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০১৩ সালে ১৪টি ড্রেজার সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে আরো কিছু ড্রেজার বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে যুক্ত হয়। এই নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে ড্রেজার আছে বর্তমানে ৪৫টি, যা দিয়ে বছরে প্রায় ৩৪৬ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করা সম্ভব।

বিআইডব্লিউটিএ’র দ্বিগুণের বেশি ড্রেজার রয়েছে বেসরকারি মালিকানায়। ব্যক্তিমালিকানায় এই মুহূর্তে ১০০টির বেশি ড্রেজার রয়েছে, যা দিয়ে বছরে প্রায় সাড়ে ৪০০ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করা যায়। যদিও বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং চাহিদা আরো অনেক বেশি, বছরে প্রায় ১ হাজার ৬০০ লাখ ঘনমিটার। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ড্রেজিং করতে তাই ড্রেজারের বহর শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি আরো ৩৫টি ড্রেজার ক্রয়ের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ১০টি ড্রেজার ২০২২ সালের মধ্যেই বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে যুক্ত হওয়ার কথা। তখন সংস্থাটির নিজস্ব ড্রেজারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৫৫টিতে। আর প্রকল্পটির আওতায় সবগুলো ড্রেজার কেনা হলে বিআইডব্লিউটিএ’র নিজস্ব ড্রেজারের সংখ্যা ৮০-তে উন্নীত হবে। সেই সঙ্গে দ্বিগুণের বেশি হবে

সংস্থাটির নিজস্ব ড্রেজিং সক্ষমতা। বহরে ৮০টি ড্রেজার নিয়ে বার্ষিক ৬৭২ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং সক্ষমতা তৈরি হবে। সরকারি-বেসরকারি মিলে তখন বার্ষিক ড্রেজিং চাহিদার ৭০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হবে।

খ. চলমান খনন প্রকল্প

মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপথের নাব্যতা ফেরাতে অনেকগুলো খনন প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলো হলো:

১. ঢাকা-চট্টগ্রাম-আশুগঞ্জ নৌ-করিডোর: যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-আশুগঞ্জ নৌ-করিডোর এবং নারায়ণগঞ্জ ও বরিশালের বর্ধিতাংশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ নৌযান এই পথেই চলাচল করে এবং করিডোরটি দিয়ে গন্তব্যে আসা-যাওয়া করেন দৈনিক দুই লাখের বেশি যাত্রী। দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যই শুধু নয়, ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের জন্যও সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত নৌ-করিডোর এটি।

গুরুত্ব বিবেচনায় নৌ-করিডোরটির উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন প্রকল্প-১ (চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ ও সংযুক্ত নৌপথ খনন এবং টার্মিনালসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে ড্রেজিং বা খনন অন্যতম। প্রকল্পটির আওতায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম করিডোরের আশুগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও বরিশালে মূল নদী পারফরম্যান্স বেজড কন্ট্রাক্ট (পিবিসি) ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ৭৯১ কিলোমিটার নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও নাব্য করা হবে। চাঁদপুর-শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুর-ভোলা এবং ভেদুরিয়া-লাহারহাট নৌরুটের তিনটি ফেরি ক্রসিং এলাকার সংরক্ষণ ড্রেজিংও এর অন্তর্ভুক্ত। বিআইডব্লিউটিএ’র চলমান প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর।

২. ৫৩টি নৌরুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং (প্রথম পর্যায়): নাব্যতা ফেরাতে ৫৩টি নৌরুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের একটি প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালের জুলাইয়ে। এর আওতায় প্রথম পর্যায়ে ২৪টি নদীর নৌপথ ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার কথা। প্রথম পর্যায়ে নির্বাচিত নদীগুলো হলো মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল, খোগদন, লাউকাঠি, ভোলা নালা, কীর্তনখোলা, তিতাস, সুরমা, বাউলাই, নতুন নদী, রক্তি, রক্ষা নালা, মোগরা, কংস, ভোগাই-কংস, বুড়ি, ইছামতি, কর্ণতলী, পালরদি, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা, মধুমতি, ভৈরব, আত্রাই, দুধকুমার, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও আড়িয়াল খাঁ। প্রকল্পের আওতায় খননের মাধ্যমে ৫৭০ লাখ ঘনমিটারের বেশি পলি এরই মধ্যে অপসারণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এর মধ্যে ৭০ লাখ ঘনমিটারের বেশি পলি অপসারণ করা হয়েছে সংস্থার নিজস্ব ড্রেজারের মাধ্যমে। অবশিষ্ট খননকাজ সম্পন্ন হয়েছে বেসরকারি ড্রেজারের সাহায্যে। কিছু পরিমাণ খননে এক্সক্যাভেটরের সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে গত আট বছরে শুধু এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার নৌপথের নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারিত রয়েছে।

৩. মোংলা-পাকশী নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন: মোংলা থেকে পাকশী ভায়া চাঁদপুর-মাওয়া-গোয়ালন্দ নৌপথ খননের আরেকটি প্রকল্প ২০১৭ সালে হাতে নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে ভারী যন্ত্রাংশ অভ্যন্তরীণ নৌপথ দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। এজন্য ৪৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌরুটটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি সম্পন্নের দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

৪. পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবার নাব্যতা ফেরানো: পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবার নাব্য পুনরুদ্ধারে ৪ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলনে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ। এর আওতায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ২২৭ কিলোমিটার খনন করে কমপক্ষে তিন মিটার গভীর ও ১০০ মিটার প্রশস্ত করা হচ্ছে, যাতে করে এটি দ্বিতীয় শ্রেণির নৌরুটে উন্নীত হয়। সেই সাথে কম খরচে ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন নিশ্চিত হয়।

এছাড়া ধরলার ৬০ কিলোমিটার খননের মাধ্যমে দুই মিটার গভীর ও ৩৮ মিটার প্রশস্ত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে তৃতীয় শ্রেণির নৌরুটের কাতারে উঠে আসবে এটি। একই প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনীয় খননের মাধ্যমে পুনর্ভবাকে তৃতীয় ও তুলাই নদীকে চতুর্থ শ্রেণির নৌরুটে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পুরো প্রকল্পটির আওতায় রয়েছে রংপুর বিভাগেরলালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও দিনাজপুর জেলা; ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর, শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলা।

গ. ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

দেশের নৌযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে বিআইডব্লিউটিএ’র যেসব উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের জন্যে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চিলমারী এলাকায় (রমনা, জোড়গাছ, রা

জিবপুর, রৌমারী, নয়ারহাট) নদীবন্দর নির্মাণ; বাঘাবাড়ি নদীবন্দর আধুনিকায়ন; গোমতী নদীর নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার; ফরিদপুর, ছাতক এবং কক্সবাজার নদীবন্দর এলাকায় টার্মিনালসহ বন্দর সুবিধাদি নির্মাণ, আরিচা-নরাদহ ও কক্সবাজার-মহেশখালী ফেরিঘাটসহ অন্যান্য স্থাপনা এবং বরগোপ, সাত্তার উদ্দিন, ছনুয়া এবং সেন্ট মার্টিনে জেটি নির্মাণ; হাওড় অঞ্চলে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি, নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি, পর্যটন, জলাভূমি ইকোসিস্টেম, সেচ এবং ল্যান্ডিং সুবিধাদি সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা; সাংগু, মাতামুহুরী নদী ও রাঙ্গামাটি থেগামুখ নৌপথ খননের মাধ্যমে নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার; চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া ও টেকনাফ (সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপ) অংশে জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ; ঢাকা শহরের চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমিতে তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (৩য় পর্যায়); উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি উদ্ধারকারী ও সহায়ক জলযানসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ; দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নদীর পানি আবর্জনামুক্ত করার লক্ষ্যে সহায়ক জলযানসহ রিভার ক্লিনিং ভেসেল সংগ্রহ (১ম পর্যায়); চট্টগ্রাম-হাতিয়া থেকে ভাসানচরের সাথে নৌযোগাযোগ উন্নয়ন; পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার নদীগুলো খননের মাধ্যমে নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার; নারায়ণগঞ্জের খানপুরে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ও বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণ এবং বিভিন্ন ধরনের ১০৪টি সার্ভিস জাহাজ সংগ্রহের পরিকল্পনাও করছে সংস্থাটি।

দখলমুক্ত নদীতে বাধাহীন ধারা

বুড়িগঙ্গা থেকে তুরাগ বা ধলেশ্বরী, ইছামতি থেকে শীতলক্ষ্যা বা করতোয়া সবখানেই যেন দখলদারদের ক্ষতচিহ্ন। তীর দখল করে গড়ে তোলা শিল্পের চিমনি বেয়ে কোথাও কালো ধোঁয়ার উদ্গিরণ তো কোথাও ইট-সিমেন্টের সুরম্য দালান। এসব দালানের কোনোটি আবাসিক, কোনোটা আবার বাণিজ্যিক। দখলের এই আগ্রাসনে জীবনদায়ী নদী তাই বিশীর্ণ-কৃষকায়।

শীর্ণশরীরী মৃতপ্রায় এসব নদীকে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার ব্রত নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব নদ-নদীর নাব্যতা রক্ষা ও দখলমুক্ত করতে ২০১৪ সালে ৩৭ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। নৌপরিবহন মন্ত্রীর সভাপতিত্বে টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে রাখা হয় শিল্প, স্থানীয় সরকার, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, পানিসম্পদ, পরিবেশ ও বন, আইন ও ভূমিমন্ত্রীকে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সচিব, বিআইডব্লিউটিএ ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও টাস্কফোর্সে সদস্য করা হয়। ঢাকার আশপাশের চার নদীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদী রক্ষায় প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও পরামর্শ প্রদান এবং তা বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রদানে ৩৮টি সভা করে এ টাস্কফোর্স।

আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্‌মুদ চৌধুরী এমপির নেতৃত্বে আরো একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে টাস্কফোর্সের সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয় ৬ সেপ্টেম্বর। নদীগুলোর প্রবাহ নিশ্চিত করতে দখলদারদের বিরুদ্ধে টাস্কফোর্স সোচ্চার থাকবে বলে ঘোষণা দেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী।

পাশাপাশি উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে নদীকে মুক্ত করতে এক দশক ধরে অভিযান পরিচালনা করছে বিআইডব্লিউটিএ। তবে এসব অভিযান ছিল অনিয়মিত। মাঝে মধ্যেই অভিযান বন্ধ রাখতে হয়েছে। দখলদারদের বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিএ’র সবচেয়ে জোরালো অভিযানটি শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ। অভিযানে অবৈধ বহু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে সংস্থাটি।

২০১০ সাল থেকে শুরু করে গত ১০ বছরে দেশের বিভিন্ন নদীবন্দরে অভিযান চালিয়ে দখলদারদের কব্জা থেকে প্রায় ৭০০ একর তীরভূমি অবমুক্ত করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এ সময় তারা উচ্ছেদ করেছে প্রায় ২১,০০০ অবৈধ স্থাপনা। এর মধ্যে পাকা, আধা-পাকা ও অন্যান্য স্থাপনা রয়েছে।

উদ্বারকৃত নদীর জমি আবার যাতে বেদখল না হয়ে যায় সে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। সীমানা পিলার স্থাপনের পাশাপাশি নদীর জমি যাতে আবার বেদখল না হয় সেজন্য নদীতীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করছে বিআইডব্লিউটিএ। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নদীর তীরবর্তী এলাকায় ২০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণকাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আরো ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে ও সীমানা পিলার স্থাপনের জন্য ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমির পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের ৬ জুলাই নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্‌মুদ চৌধুরী প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন। ৮৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়সংবলিত প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ২৫ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নদীর তীর রক্ষা যেমন হবে, নগরবাসীর বিনোদনেরও সুযোগ তৈরি হবে।

মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল চালু

প্রকৃতিগত কারণেই সুন্দরবন অত্যন্ত সংবেদনশীল। মোংলা সমুদ্রবন্দরের সাথে শিল্প ও বন্দরনগরী খুলনাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের নৌ-যোগাযোগের প্রয়োজনে শুরু থেকেই শ্যালা নদী দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করত। কিন্তু এটা অব্যাহত থাকলে নিকট-ভবিষ্যতে সুন্দরবন যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, জাতির পিতা তা আগেই ভেবেছিলেন। এই ভাবনা থেকেই লুপ কাটিং ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার ঘষিয়াখালী থেকে রামপাল উপজেলার বেতিবুনিয়া পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার সংযোগ খাল খনন করা হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে চালু হয় মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল; যার মূল লক্ষ্য ছিল সুন্দরবনকে অক্ষত রেখে মোংলা সমুদ্রবন্দরের পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বল্প দূরত্বের বিকল্প পথ তৈরি করা। অল্পদিনের মধ্যেই নতুন নৌপথটি সার্বিক বিবেচনায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য স্থানের নৌ-যোগাযোগের ক্ষেত্রেও নতুন এ নৌপথটি জনপ্রিয়তা পায়।

পরবর্তী সময়ে আর কোনো সরকারের আমলে চ্যানেলটির নাব্যতা বজায় রেখে চালু রাখার উদ্যোগ দেখা যায়নি। ১৯৮০-এর দশকে মোংলা-ঘষিয়াখালী সংযুক্ত খালগুলোর মুখ বন্ধ করে চিংড়ি চাষ ও পোল্ডার নির্মাণ করায় চ্যানেলটি ভরাট হতে শুরু করে। ২০১০ সালে এসে চ্যানেলটি পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শ্যালা নদী দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় ২০১৪ সালের জুলাই থেকে নৌপথটির খনন শুরু হয়। ২০১৫ সালের মে মাসে পরীক্ষামূলকভাবে চ্যানেলটি খুলে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে চ্যানেলটি উদ্বোধন করেন। সুন্দরবনের জন্য শ্যালা নদীর গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় বলেন, ‘শ্যালা নদী ডলফিনের একটা জায়গা। ওখানে ডলফিন আসে। ওই নদীর পানি আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার খায়। ওই জায়গাটা বন্যপ্রাণীর একটা অভয়ারণ্য ছিল।’

নতুন নদীবন্দর নির্মাণ ও পুরনো বন্দরের আধুনিকায়ন

কোনো একটি দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে দিতে নদীর যেমন ভূমিকা আছে, একইভাবে ভূমিকা আছে নদীবন্দরেরও। দেশের নদীবন্দরগুলো ঘিরেই একসময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বড় অংশ পরিচালিত হতো। যদিও কালের বিবর্তনে অনেক নদীবন্দরই আজ ইতিহাস। কিছু নদীবন্দর হয়ে পড়ে একেবারে শ্রীহীন মলিন। কয়েক বছর ধরেই সরকার বিদ্যমান নদীবন্দরগুলো আধুনিকায়নের কাজ করে যাচ্ছে। সেই সাথে সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় নতুন নতুন নদীবন্দর নির্মাণও করছে। ২০১০ সাল থেকে সরকার নতুন ৯টি অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরের গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪টি। ২০১০ সাল থেকে গেজেটভুক্ত নদীবন্দরগুলো হলো কক্সবাজার (কস্তুরহাট), ফরিদপুর, ঘোড়াশাল, শিমুলিয়া, টেকনাফ, টেকেরঘাট, চিলমারী, মজুচৌধুরীরহাট ও সুনামগঞ্জ।

বাড়ছে নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন

বাংলাদেশ নামক ভূখ-টি ভৌতিক ও প্রাকৃতিকভাবে নদীরই দান। প্রাচীনকালে থেকেই তাই এ ভূখ-ের মানুষের যোগাযোগেরও প্রধানতম মাধ্যম জলপথ। প্রথম দিককার চৈনিক বিবরণীতে মাহুয়ানের লেখায় পাওয়া যায়, সু-মেন-তা-লা’ (সুমাত্রা) রাজ্য থেকে জলজাহাজে ‘পাংগ-কোলা’ (বাঙ্গালা) রাজ্যে যেতে হয়। জাহাজ প্রথমে ‘চেহ-তি-গাঁ’ (চাটগাঁ) বন্দরে পৌঁছে নোঙর করে। এখান থেকে সোনারগাঁ পৌঁছানো যায়। কালের পরিক্রমায় রেল ও সড়কপথ হয়ে উঠতে থাকে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সবচেয়ে সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব হওয়ার পরও যাত্রী ও পরিবহনে পিছিয়ে পড়তে থাকে নৌপথ। বিগত কয়েক বছরে সরকারের চেষ্টায় আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে মাধ্যমটি। ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন।

বিআইডব্লিউটিএ’র পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছর বাদ দিলে গত ১০ বছরে অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে

। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে যাত্রী পরিবহন প্রায় প্রায় ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যাত্রী কমলেও কার্গো জাহাজসহ মালবাহী নৌযান চলাচল স্বাভাবিক থাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ নৌপথে কার্গো পরিবহন ৭ শতাংশ বেড়েছে।

নৌ-নিরাপত্তায় জোর

নদীর বুকে পাল তোলা নৌকা বাংলার শাশ্বত রূপ। তবে ৪৭ এর আগেই স্টিমারে সওয়ার হওয়ার অভিজ্ঞতাও পায় এ অঞ্চলের মানুষ। কলকাতার খিদিরপুর থেকে গোয়ালন্দ হয়ে পদ্মা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের পানি কেটে স্টিমার সোজা চলে যেতে নওগাঁ-জোড়হাট হয়ে আসামের গুয়াহাটি পর্যন্ত। সে সময় স্টিমারের হাল ছিল অ্যাংলো সারেংদের হাতে। ৪৭-এ ভারত ভাগ হলো। স্টিমারের হালও চলে এল বাঙালিদের হাতে। তাদের নির্দেশনাতেই দু’পাশে বিশাল বিশাল পাখা নাড়িয়ে স্টিমার এগিয়ে চলতে থাকল বুড়িগঙ্গা, মেঘনা, কীর্তনখোলা, কালিজিরা, পশুর, শিবসা, মোংলা আর রূপসা নদীর উজানভাটির ওপর দিয়ে। এরপর সময় এগোতে থাকল। বাংলাদেশ স্বাধীন ভূখ- পেল। নৌপথে আধুনিক জলযান ভাসতে শুরু করল। আস্তে আস্তে সংখ্যাটাও বাড়তে থাকল। সেই সাথে অযান্ত্রিক নৌযানগুলোতেও লাগল যান্ত্রিকতার ছোঁয়া।

সময়ের পালে চেপে নৌপথে দুর্ঘটনা, মৃত্যুর খবরগুলোও বেশি করে আসতে থাকল। সবচেয়ে নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যমটিও যেন অনিরাপদ হয়ে উঠতে থাকে। দেশে নৌ-দুর্ঘটনার বেশির ভাগই হয় দুটি লঞ্চে সংঘর্ষের কারণে। চালকের অদক্ষতা, অসতর্কতা, বেপরোয়া মনোভাব ও বৈরী আবহাওয়ার কারণেই মূলত নৌযানের মধ্যে সংঘর্ষের এ ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি অতিরিক্ত যাত্রী বা পণ্যবোঝাই, অগ্নিকা- ও নৌযানের তলদেশ ফেটে যাওয়াও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

নৌপথ নিরাপদ করতে দক্ষ চালক তৈরির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে বর্তমান সরকার। এ লক্ষ্যে সরকার ২০১২ সালেই দুটি ডেক ইঞ্জিনিয়ারিং পার্সোনেল ট্রেনিং সেন্টার (ডিইপিটিসি) প্রতিষ্ঠা করেছে। আনফিট নৌযান যাতে নৌপথে চলাচল করতে না পারে সে ব্যাপারেও কঠোরতা এসেছে। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে বিআইডব্লিউটিএ। এছাড়া আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ হয়ে উঠলে লঞ্চগুলো যাতে তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারে সেজন্য বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল ইত্যাদি নদীবেষ্টিত জেলার দুর্যোগপ্রবণ এলাকার ১০টি স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র্র নির্মাণের পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে সংস্থাটি। এসবের ফলে নৌ-দুর্ঘটনা এখন আগের চেয়ে কমে এসেছে।

নৌপরিহন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে ৬০২টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ৩ হাজার ৭৩৫ জন। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১৮২টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলেও ২০১১ থেকে ২০১৫ সালে তা নেমে আসে ৮৯টিতে। পরবর্তীতে দুর্ঘটনা আরো কমে আসে এবং ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে ৫৪টিতে দাঁড়ায়।

এছাড়া নৌপথের নিরাপত্তায় ২০১৩ সালে নৌ পুলিশও গঠন করে সরকার। নদীপথে চোরাচালান, দস্যুতা ও চাঁদাবাজিসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নদীর সম্পদ রক্ষায় কাজ করছে পুলিশের এই ইউনিটটি। এসবের মধ্য দিয়ে নিরাপদ নৌপথে নির্বিঘেœ যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here