ঐতিহাসিক কাল থেকে নদীমাতৃক এই বঙ্গদেশে যাতায়াত ও বাণিজ্য নদীপথেই প্রশস্ততর ছিল। এ পথ প্রাগৈতিহাসিক। এমনকি রেলপথে দ্রুত বাণিজ্য-সম্ভার যাতায়াতের যখন সূত্রপাত হয় তার আগ পর্যন্তও বাণিজ্যলক্ষ্মীর যাতায়াত অভ্যন্তরীণ নদীপথেই বেশি ছিল। ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ ভারতে রেল যোগাযোগ চালু হওয়ার পর ধারাক্রমে যাতায়াত ও বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠতে থাকে এটি। তারও প্রাক-পর্বে সড়ক যোগাযোগের উত্থান। তার পরও ব্রিটিশ ভারত কিংবা পাকিস্তান আমলে আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্বে টান পড়েনি। নাব্য নৌপথের ওপর ভর করে যাত্রী ও কার্গো পরিবহন অভ্যন্তরীণ নৌপথ তাৎপর্যপূর্ণ হিস্যা ধরে রেখেছিল। ১৯৭৫ সালের দিকেও মোট যাত্রী পরিবহনের ১৫ শতাংশ হতো অভ্যন্তরীণ নৌপথে। তবে পরবর্তীতে আর নৌপথ তার স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় ধরে রাখতে পারেনি। পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপথ অন্য মাধ্যমগুলোর তুলনায় কেবল পিছিয়েছে। মোট দেশীয় উৎপাদনে পরিবহন খাতটির হিস্যা যেমন কমেছে, একইভাবে কমেছে নিজের প্রবৃদ্ধিও। এসবই ঘটেছে পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোর অভ্যন্তরীণ নৌপথকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রান্তে রাখার ফলাফল হিসেবে।
আশার কথা হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের আমলে প্রান্তিকতা থেকে উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রে স্থান পেয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাত। সরকারের এই মেয়াদেই ২৭৮টি নদী খননের এক মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, যার লক্ষ্য অভ্যন্তরীণ নৌপথের দৈর্ঘ্য ১০ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করা। সেই সাথে নৌ যোগাযোগের সর্বাধুনিক অবকাঠামো ও সুবিধাদি নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ। এর সুফলও মিলছে। তবে এই সুফলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে দরকার এ খাতে কাঙ্ক্ষিত অর্থ বরাদ্দ। কারণ, পরিবহনের অপরাপর মাধ্যমের তুলনায় নৌপথই সর্বাধিক সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব। সেদিকেই আলোকপাত করা হয়েছে এ সংখ্যার বক্ষ্যমাণ প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে।
২৮ সেপ্টেম্বর ছিল স্রোতোস্বিনী নদীর বেগে ছুটে চলা নতুন বাংলাদেশের কাণ্ডারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিন। দিবসটি উদযাপনে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা সেজেছিল বর্ণিল সাজে। আবহমান বাংলার জলক্রীড়া নৌকাবাইচ মুগ্ধ করে বুড়িগঙ্গা পাড়ের লাখো মানুষকে। সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দেয় নদীর প্রতি তাদের দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতাকে। বর্ণাঢ্য এ প্রতিযোগিতার আয়োজনে ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। প্রতিযোগিতার মুহূর্তগুলোর সচিত্র উপস্থাপন স্থান পেয়েছে এ সংখ্যায় বিশেষভাবে।
পার্বত্য অঞ্চলের নদীপ্রণালিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে কর্ণফুলী নদী। হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এই নদীরই গুরুত্বপূর্ণ একটি নৌরুট চট্টগ্রাম-কাপ্তাই বাঁধ নৌপথ। নৌরুটটির পরিচিতি ও সম্ভাবনার খতিয়ান তুলে আনা হয়েছে বিশেষ রচনায়।
নিয়মিত আয়োজন হিসেবে এ সংখ্যায়ও থাকছে ‘প্রযুক্তি’ বিভাগ। আছে নদী ও নৌপথ নিয়ে সরকারের আরও পরিকল্পনার সারকথা। নিয়মিত আয়োজন হিসেবে সংক্ষিপ্ত কলেবরে এবারও তুলে এনেছি আমাদের নদী ও আমাদের বন্দরের কথা। পরিভ্রণ করেছি দূর অতীতে, আমাদের ঐতিহ্যে। সেই সাথে থাকছে দেশ-বিদেশের নদী ও নৌখাত নিয়ে সবশেষ ঘটনাপ্রবাহের কথা ও ছবি।
প্রিয় পাঠক, আশা করি আমাদের এই প্রয়াস নদী ও নৌপথ নিয়ে আপনার জিজ্ঞাসার উত্তর দেবে। কিছুটা হলেও নতুন ভাবনার খোরাক জোগাবে। আপনার মূল্যবান মতামত, মন্তব্য ‘নদীবাংলা’র পথচলা এগিয়ে নেবে।