বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অসংখ্য নদ-নদীর আশীর্বাদে পুষ্ট। এসব নদ-নদী এই অঞ্চলে যোগাযোগকে সহজ করছে, সেচের পানির জোগান দিচ্ছে, শিল্পকেও বড় করছে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এসব নদ-নদীতে পানির প্রবাহে ক্রমে ভাটা পড়েছে। নাব্যতা হারিয়ে নৌপথগুলো দৈর্ঘ্য হারিয়েছে, সংকীর্ণ ও কৃশ হয়েছে। কিন্তু আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে এ অঞ্চলের নদীগুলোর নাব্যতা উন্নয়ন আশু প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে।
কারণটা খুবই স্বাভাবিক। পণ্য পরিবহনে মোংলা বন্দরের ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নৌপথের চাহিদাও বাড়ছে। সেই সাথে যাত্রী পরিবহনের চাহিদা তো আছেই। প্রাক্কলন বলছে, খুলনা নদীবন্দর হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নৌপথ দিয়ে যাত্রী পরিবহন ২০৩০ সালেই ১৯ লাখ ২২ হাজারে উন্নীত হবে। সে নাগাদ এই নৌপথগুলো দিয়ে কার্গো পরিবহন করতে হবে ৩ লাখ ৮৭ হাজার টন। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ যখন উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাবে তখন যাত্রী ও কার্গো পরিবহন আরও বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১৯ লাখ ৭২ হাজার ও ৪ লাখ ৯ হাজার টনে। আর ২০৫০ সালে এ অঞ্চলের নৌপথগুলো দিয়ে বছরে ২০ লাখ ২ হাজার মানুষ যাতায়াত করবে। সেই সাথে ৪ লাখ ২২ হাজার টন কার্গোও পরিবহন করতে হবে। নৌপথগুলোর বিদ্যমান যে অবস্থা তা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণ করা একেবারেই অসম্ভব। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নৌপথগুলোর ওপর সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) পরিচালিত এক সমীক্ষায়ও তারই প্রতিফলন দেখা গেছে। গড়াই, মধুমতী, চিত্রা, আফ্রা, নবগঙ্গা, কপোতাক্ষ, পশুর, শিবসা, খোলপেটুয়া, রূপসা, মালঞ্চ ও রায়মঙ্গলের মতো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীগুলো ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা উন্নয়নের কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে সমীক্ষা প্রতিবেদনে। একই সাথে ল্যান্ডিংসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। এতে নৌচলাচল যেমন নির্বিঘ্নে হবে, একই সাথে শক্তি পাবে পর্যটনও। রক্ষিত হবে জলজ বাস্তুতন্ত্র, উন্নত হবে সেচ ব্যবস্থা আর হ্রাস পাবে জলাবদ্ধতা। দীর্ঘমেয়াদে এর আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবও হবে ইতিবাচক। এসবই স্থান পেয়েছে এ সংখ্যার বক্ষ্যমাণ প্রধান রচনায়।
নদীই গ্রামবাংলার প্রাণ। বাংলাকে আকৃতি-প্রকৃতি দেওয়া এই নদীকে আশ্রয় করেই কালের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেড়ে ওঠা ও মানস গঠন। বঙ্গবন্ধু তাই শাশ্বত বাংলারই প্রতিরূপ। এই মহামানবের জীবনে নদীর ভূমিকা ব্যাপক। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২৬ ডিসেম্বর আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধু : শাশ্বত বাংলার প্রতিরূপ’ শীর্ষক সেমিনারে জাতির পিতাকে নিয়ে আলোচকদের মূল্যায়ন ছিল এমনই। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আয়োজিত তিনটি সেমিনারের এটি ছিল তৃতীয়। নারায়ণগঞ্জ ড্রেজার বেইজ থেকে ছেড়ে যাওয়া বিআইডব্লিউটিএর পরিদর্শী জাহাজে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের আলোচনা সচিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবারের বিশেষ প্রতিবেদনে।
নদীমাতৃক দেশ হিসেবে আমাদের অভ্যন্তরীণ নৌপথের যে গৌরব তা ফিরিয়ে আনতে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তত্ত¡াবধানে এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এ কাজের অগ্রগতিসহ বিআইডব্লিউটিএর সার্বিক কর্মকান্ড, পরিকল্পনা ও লক্ষ্য নিয়ে কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক এনজিপি, এনডিসি, এনসিসি, পিএসসির আলাপচারিতা ছাপা হয়েছে এ সংখ্যার সাক্ষাৎকার বিভাগে।
নিয়মিত আয়োজন হিসেবে এ সংখ্যায়ও থাকছে ‘প্রযুক্তি’ বিভাগ। সংক্ষিপ্ত কলেবরে এবারও তুলে এনেছি আমাদের নদী ও আমাদের বন্দরের কথা। পরিভ্রমণ করেছি দূর অতীতে, আমাদের ঐতিহ্যে। সেই সাথে থাকছে দেশ-বিদেশের নদী ও নৌখাত নিয়ে সবশেষ ঘটনাপ্রবাহের কথা ও ছবি।
প্রিয় পাঠক, আশা করি আমাদের এই প্রয়াস নদী ও নৌপথ নিয়ে আপনার জিজ্ঞাসার উত্তর দেবে। কিছুটা হলেও নতুন ভাবনার খোরাক জোগাবে। আপনার মূল্যবান মতামত, মন্তব্য ‘নদীবাংলা’র পথচলা এগিয়ে নেবে।