বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুধবার, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৫
30 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

১৩ লঞ্চঘাট উন্নয়ন মেঘনার প্রবাহজুড়ে শক্তিশালী নৌ যোগাযোগের প্রয়াস

নদীবাংলা ডেস্ক,
মনপুরা লঞ্চঘাট। ছবি: ফ্লিকার

প্রাক-কথা

বহু পার্বত্য স্রোতস্বতীর সম্মিলনেই মেঘনার উৎপত্তি। মেগাস্থিনিস এই নদীর নাম দিয়েছিলেন মেগোন। বাংলাদেশের প্রধানতম নদীগুলোর অন্যতম এই মেঘনা। দেশের মধ্য দিয়ে দুটি আলাদা অংশে প্রবাহিত হচ্ছে নদীটি; আপার মেঘনা এবং লোয়ার মেঘনা। আপার মেঘনার প্রবাহ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, যা সুরমা ও কুশিয়ারার মিলিত প্রবাহ। কুলিয়ারচর থেকে ষাটনল পর্যন্ত বিস্তৃত আপার মেঘনা তুলনামূলক ছোট নদী। আপার মেঘনা সর্পিলাকার নদী এবং পানি প্রবাহের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১৬ হাজার কিউমেক।

ষাটনলের পর থেকে লোয়ার মেঘনার প্রবাহ শুরু এবং এটি বৃহৎ নদী। লোয়ার মেঘনাকে স্বতন্ত্র নদী হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। ছোট ছোট বেশ কিছু চর লোয়ার মেঘনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা প্রধান দুটি চ্যানেল সৃষ্টি করেছে। পূর্বদিকের বৃহৎ চ্যানেলটি ৫ থেকে ৮ কিলোমিটার প্রশস্ত। পশ্চিম দিকের চ্যানেলটি দুই কিলোমিটারের মতো প্রসারিত।

মেঘনা তীরবর্তী মানুষের জীবিকা প্রধানত নদীকেন্দ্রিক। তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই নৌ-অবকাঠামোর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। নদী তীরবর্তী ল্যান্ডিং স্টেশনগুলো কেবল পরিবহনের মাধ্যম নয়; ব্যবসা-বাণিজ্যেরও চালক। এগুলোর উন্নয়ন মানে স্থানীয় অর্থনীতির প্রসার; নদী তীরবর্তী জনপদের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি। মেঘনাকেন্দ্রিক নৌ-অবকাঠামো তথা ল্যান্ডিং স্টেশনগুলোর আধুনিকায়নের মাধ্যমে যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সেই সুযোগটিই করে দিচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

১৩ লঞ্চঘাট উন্নয়ন

পণ্য এবং যাত্রী পরিবহনে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ নৌপথ হচ্ছে চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ নৌ-করিডর এবং নারায়ণগঞ্জ ও বরিশালের বর্ধিতাংশ। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ নৌযান এই করিডর দিয়ে চলাচল করে। নৌপথটি দিয়ে যাত্রী চলাচল করে দৈনিক প্রায় দুই লাখ। এই চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বর্ধিত এই চাহিদার পাশাপাশি সড়কের ওপর থেকে চাপ কমিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের বাড়াতে নৌ-করিডরটির সক্ষমতা বৃদ্ধি, নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং টেকসই করার উদ্যোগ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। তারই অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন প্রকল্প-১ (বিআরডব্লিউটিপি-১) বাস্তবায়ন করছে সংস্থাটি। এই প্রকল্পের একটি অঙ্গ হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে ১৩টি লঞ্চঘাট/ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ।

প্রকল্পটির আওতায় নির্মাণাধীন লঞ্চঘাটগুলো হচ্ছে ভৈরব, আলুবাজার, হিজলা, লাহারহাট, ইলিশা, মনপুরা, ব্যাংকের হাট, দৌলতখাঁন, তজুমদ্দিন, মজু চৌধুরীর হাট, মতিরহাট, তমরুদ্দিন ও বহদ্দারহাট। মোট তিনটি প্যাকেজে লঞ্চঘাট নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিআরডব্লিউটিপি-ডব্লিউ৫এ প্যাকেজের আওতায় রয়েছে ভৈরব, আলুবাজার, হিজলা ও লাহারহাট লঞ্চঘাট। বিআরডব্লিউটিপি-ডব্লিউ৫বি প্যাকেজের আওতায় বাস্তবায়নাধীন লঞ্চঘাটগুলো হলো ইলিশা, মনপুরা, ব্যাংকের হাট, দৌলতখাঁন ও তজুমদ্দিন। আর মজু চৌধুরীর হাট, মতিরহাট, তমরুদ্দিন ও বহদ্দারহাট লঞ্চঘাট বাস্তবায়িত হচ্ছে বিআরডব্লিউটিপি-ডব্লিউ৫সি প্যাকেজের আওতায়। সবগুলো লঞ্চঘাটের নির্মাণকাজই ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

লঞ্চঘাটগুলো উন্নয়নে নারী এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কথা বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনগণ যাতে লঞ্চঘাটগুলো ব্যবহার করতে পারেন সেভাবেই এগুলোর ডিজাইন করা হয়েছে। এসব লঞ্চঘাটের অনেকগুলোর অবস্থান লোয়ার মেঘনা তীরবর্তী এমন সব এলাকায়, যেখানকার বাসিন্দাদের নদীপথ ছাড়া যোগাযোগের বিকল্প কোনো মাধ্যম নেই।

ভৈরব লঞ্চঘাট

আপার মেঘনার তীরে ভৈরব বাজার ঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বড় বাজার। ঘাটের কাছাকাছি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা দোকান রয়েছে ৭০০ এর মতো। ব্যবসা, চাকরি ও দিনমজুরির প্রয়োজনে বিপুল সংখ্যক মানুষ এই ঘাটটি দিয়ে যাতায়াত করেন। কিন্তু ঘাটে অবকাঠামো সুবিধা বলতে রয়েছে দুটি পন্টুন ও একটি গ্যাংওয়ে।

অপর্যাপ্ত এই অবকাঠামো ও ব্যবহারকারীদের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে ঘাটটি আধুনিকায়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ। বিআরডব্লিউটিপি-১ এর আওতায় ‘আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ ভৈরব, আলুবাজার, হিজলা ও লাহারহাটে ল্যান্ডং স্টেশন (লঞ্চঘাট) আধুনিকায়ন ও নির্মাণকাজ’ শীষক প্যাকেজের অধীনে লঞ্চঘাটটির উন্নয়নকাজ চলছে। ৯৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ঘাটটির নির্মাণকাজ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়েছে। ১২ মাসের মধ্যে উন্নয়নকাজ শেষ করার কথা রয়েছে এবং সে লক্ষ্যে কাজের সন্তোষজনক অগ্রগতিও হয়েছে। ঠিকাদারের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে ঘাটের জন্য পন্টুন নির্মাণের কাজ চলছে। পাশাপাশি চলমান রয়েছে ওয়েটিং শেডসহ পার্কিং ইয়ার্ডের জন্য প্রয়োজনীয় জমি নির্বাচনের কাজ।

ভৈরব লঞ্চঘাট ব্যবহার করে যাত্রীরা যাতে সহজেই যাতায়াত করতে পারেন সেজন্য লঞ্চ ও স্পিডবোটের জন্য পৃথক পন্টুনের ব্যবস্থা থাকছে। পণ্য পরিবহনের জন্য রয়েছে কার্গো পন্টুন। কার্গো ও লঞ্চ পন্টুনসম্বলিত দুটি জেটিও রয়েছে ল্যান্ডিং স্টেশনটিতে। আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুবিধার মধ্যে রয়েছে দুই তলাবিশিষ্ট একটি ওয়েটিং শেড, যেখানে লঞ্চের জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা অবস্থান করতে পারবেন। এ ছাড়াও রয়েছে একটি করে পার্কিং ইয়ার্ড, কার্গো প্ল্যাটফর্ম ও কার্গো স্টোরেজ।

আলুবাজার লঞ্চঘাট

শরীয়তপুরের আলুবাজার লঞ্চঘাট লোয়ার মেঘনায় গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কেন্দ্র। এই অঞ্চলের মানুষের প্রাত্যহিক যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহনে বড় ভূমিকা রাখছে ঘাটটি। সেই সাথে কৌশলগত অবস্থানের কারণে শরীয়তপুর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেরও অন্যতম প্রভাবক এটি।

২০১৬ সালে প্রণীত প্রকল্পের পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা কর্মকাঠামোর তথ্য অনুযায়ী, ঘাটটি দিয়ে দৈনিক ২০ টনের মতো পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যাত্রীও প্রতিদিন ব্যবহার করেন ঘাটটি। যদিও ল্যান্ডিং স্টেশনটিতে বিদ্যমান যে অবকাঠামো চাহিদার তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়। লঞ্চঘাটটিতে অবকাঠামো সুবিধাদির মধ্যে রয়েছে তীরের সাথে সংযোগকারী একটি সিঁড়ি, একটি পন্টুন, একটি স্টিল জেটি এবং পন্টুনসহ একটি ফেরিঘাট।

বর্ধিত চাহিদা ও বিদ্যমান অপর্যাপ্ততার কথা বিবেচনায় নিয়ে লোয়ার মেঘনা তীরের এই ঘাটটি উন্নয়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে লঞ্চঘাটটিতে একটি করে পন্টুন ও স্পাড, গ্যাংওয়ে এবং জেটি রয়েছে। পাশাপাশি অ্যাকসেস রোড, ড্রেজিং, নদীর তীররক্ষা বাঁধ, পার্কিং ইয়ার্ড এবং ওয়েটিং শেডও নির্মাণ করা হচ্ছে।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ এগোচ্ছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব ইয়ার্ডে পন্টুন নির্মাণের কাজ করছে। এ ছাড়া ওয়েটিং শেড ও পার্কিং ইয়াডের জন্য যে জমি প্রয়োজন, তা নির্বাচনের কাজও চলমান রয়েছে।

হিজলা লঞ্চঘাট

বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে নদীপথ। আর এই যোগাযোগের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো ল্যান্ডিং স্টেশন। এমনই একটি ল্যান্ডিং স্টেশন হলো হিজলা লঞ্চঘাট। হিজলা উপজেলা, বরিশাল নগরী, ঢাকা, ভোলাসহ দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোর মধ্যে মেঘনা নদী দিয়ে যাতায়াতের গেটওয়ে হিসেবে কাজ করে এই লঞ্চঘাটটি। বিপুল সংখ্যক যাত্রী, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের যাত্রীরা তাদের নিত্য যাতায়াতের প্রয়োজনের লঞ্চঘাটটি ব্যবহার করেন। মাছ, ধান ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের জন্য পরিচিত হিজলা। বরিশাল ও ঢাকায় এসব পণ্য পরিবাহিত হয় এই লঞ্চঘাট দিয়েই।

অর্থাৎ বরিশালের নদীনির্ভর জনগোষ্ঠীর ব্যবসা, যোগাযোগ ও প্রাত্যহিক জীবিকার প্রয়োজনে হিজলা লঞ্চঘাট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এখানকার অবকাঠামো এখনো অপর্যাপ্ত। বর্তমান সুবিধাদির মধ্যে রয়েছে স্থলের সাথে সংযোগকারী একটি সিঁড়ি ও পন্টুন। এই অবকাঠামো অপর্যাপ্ততা দূর করতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঘাটটি আধুনিকায়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ। এরই অংশ হিসেবে একটি করে পন্টুন ও স্পাড, গ্যাংওয়ে ও জেটির পাশাপাশি বিদ্যমান অ্যাকসেস রোড উন্নত ও নতুন অ্যাকসেস রোড তৈরি এবং পার্কিং ইয়ার্ড নির্মাণ করা হচ্ছে। সেই সাথে থাকছে দুই তলাবিশিষ্ট ওয়েটিং শেড কাম সাইক্লোন শেল্টার।

পরিকল্পনা অনুযায়ীই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে পন্টুন তৈরির কাজ করছে। ওয়েটিং শেডসহ পার্কিং ইয়ার্ডের জন্য প্রয়োজনীয় জমি নির্বাচনের কাজও একই সাথে চলমান রয়েছে।

 

লাহারহাট লঞ্চঘাট

লোয়ার মেঘনা নদী প্রণালীর অংশ তেঁতুলিয়া নদীর তীরে অবস্থিত বরিশালের লাহারহাট দক্ষিণাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডিং স্টেশন। তেঁতুলিয়া নদী দিয়ে ভোলার সাথে বরিশালের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ হাব এটি। ২০০১ সালে চালু হওয়া ঘাটটি যাত্রী চলাচলের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একইভাবে তাৎপর্যপূর্ণ পণ্য পরিবহনের জন্যও। এই এলাকায় উৎপাদিত মৎস্য ও কৃষিপণ্য ঘাটটি দিয়ে পরিবাহিত হয়। অর্থাৎ, বরিশাল ও ভোলার মধ্যে পণ্য পরিবহন সচল রাখে ঘাটটি।

প্রতিদিন হাজার দশেক মানুষ টার্মিনালটি ব্যবহার করেন। তবে ঈদের মতো উৎসবের সময় যাত্রী সংখ্যা দৈনিক ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ঘাটটির বিদ্যমান অবকাঠামো বাড়তি এই চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া সিগন্যালিং সিস্টেম ও ভাঙনের মতো সমস্যাও রয়েছে ব্যস্ত এই ঘাটটিতে।

গুরুত্ব ও বর্ধিত চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঘাটটি আধুনিকায়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ। এর অংশ হিসেবে একটি করে পন্টুন ও স্পাড, গ্যাংওয়ে ও জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ভাঙন সমস্যা সমাধানে নির্মাণ করা হচ্ছে ৪ হাজার ১০০ বর্গমিটার তীররক্ষা বাঁধ। এক তলাবিশিষ্ট একটি ওয়েটিং শেড, পার্কিং ইয়ার্ডের পাশাপাশি টয়লেট কমপ্লেক্স, পার্কিং ইয়ার্ড ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুবিধাদিও থাকছে দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই ল্যান্ডিং স্টেশনটিতে।

প্রকল্পের কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও হয়েছে। সাইট প্রিপারেশন ও মোবিলাইজেশন সম্পন্ন হয়েছে এবং ঠিকাদারের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে পন্টুন নির্মাণের কাজ চলছে। চলমান রয়েছে ওয়েটিং শেড এবং পার্কিং ইয়ার্ড নির্মাণের কাজও।

লঞ্চঘাটটির আধুনিকায়ন সম্পন্ন হলে বরিশাল ও ভোলার মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। কম খরচে স্থানীয়রা তাদের উৎপাদিত পণ্য শহরের বাজারগুলোতে সরবরাহ করতে পারবেন, যা সেখানকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে। সর্বোপরি এই অঞ্চলে পরিবেশবান্ধব লজিস্টিকস ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবে।

ইলিশা লঞ্চঘাট

দক্ষিণে লোয়ার মেঘনা তিনটি চ্যানেলে ভাগ হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত চ্যানেলগুলো হলো তেঁতুলিয়া, শাহবাজপুর ও বামনি। বরিশালের মূল ভূখণ্ডকে ভোলা থেকে বিচ্ছিন্নকারী এই তেঁতুলিয়া নদীর তীরেই অবস্থান ইলিশা লঞ্চঘাটের। ভোলা এবং অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে নদীপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে ঘাটটি।

নগরের কর্মসংস্থান ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোর সাথে সংযুক্তির মাধ্যমে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও বড় অবদান রাখছে ঘাটটি। তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে বিস্তর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নদীভাঙন। ২০২৩ সালে ১০০ মিটার তীররক্ষা বাঁধ মেঘনা ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং লঞ্চ টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জোয়ারের সময় টার্মিনাল পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। ২০২৪ সালেও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে পন্টুন ও গ্যাংয়ে ডুবে যায়। এতে পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রী উভয়েই বিপত্তিতে পড়েন।

ইলিশা লঞ্চঘাট দিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যাত্রীর পাশাপাশি দৈনিক ২০ টনের মতো পণ্য পরিবাহিত হয়। বিদ্যমান দুটি সংযোগ সিঁড়ি ও একটি পন্টুন দিয়ে এই চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। যদিও উন্নত অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। সে লক্ষ্যেই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিআরডব্লিউটিপি-১ প্রকল্পের আওতায় ইলিশা লঞ্চঘাট আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। এর অংশ হিসেবে তিনটি পন্টুন ও স্পাড, তিনটি গ্যাংওয়ে এবং একটি জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সেই সাথে রয়েছে অ্যাকসেস রোড উন্নত করা এবং পার্কিং ইয়ার্ড ও দ্বিতল ওয়েটিং শেডের ব্যবস্থা।

কাজের অগ্রগতি হিসেবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে পন্টুন নির্মাণের কাজ চলছে। সেই সাথে ওয়েটিং শেড ও পার্কিং ইয়ার্ডের জন্য জমি নির্বাচনের কাজও চলমান রয়েছে।

মনপুরা লঞ্চঘাট

ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলা বিছিন্ন এক দ্বীপ। নদীপথই এখানকার মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এই যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে মনপুরা লঞ্চঘাট। বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের অর্থনীতির চালক হিসেবে কাজ করছে ঘাটটি। প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার মানুষ লঞ্চঘাটটি দিয়ে যাতায়াত করেন। ঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক দোকান, যেগুলো এসব পরিবারকে জীবিকার জোগান দিচ্ছে। এ ছাড়াও রয়েছে বিপুল সংখ্যক জেলে পরিবার। আহরিত মাছ তারা এই লঞ্চঘাটের মাধ্যমে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহন করে থাকে। দৈনিক ১০ টনের মতো পণ্য এই ঘাট দিয়ে পরিবাহিত হয়।

দুইটি সংযোগ সিঁড়ি, একটি পন্টুন, ট্রানজিট শেড ও আরসিসি জেটির সাহায্যে ঘাটের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া নদীভাঙন এখানকার প্রতি বছরের সমস্যা। নদীর তীররক্ষাও তাই জরুরি। এসব বিবেচনায় ও বর্ধিত চাহিদা পূরণের তাগিদ থেকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে মনপুরা লঞ্চঘাট আধুনিকায়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ। আধুনিকায়ন কাজের অংশ হিসেবে ঘাটে একটি করে পন্টুন ও স্পাড, গ্যাংওয়ে এবং জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সেই সাথে পার্কিং ইয়ার্ড, ওয়েটিং শেড ও কার্গো স্টোরেজের সুবিধাও থাকছে।

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে পন্টুন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। পাশাপাশি পার্কিং ইয়ার্ডসহ ওয়েটিং শেডের জন্য জমি নির্বাচনের কাজ চলমান রয়েছে।

ভেদুরিয়া (ব্যাংকের হাট) লঞ্চঘাট

ঐতিহাসিককাল থেকেই দক্ষিণবঙ্গে যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম নৌপথ। কৃষি অধ্যুষিত বরিশাল অঞ্চলের শস্য পরিবহনের প্রয়োজনে স্বাধীনতার আগে থেকেই ভেদুরিয়া ঘাট হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে। বরিশাল ও ঢাকায় ধান, মাছ ও পাট পরিবহনের অন্যতম হাব হয়ে ওঠে ভোলার উত্তর-পশ্চিমে তেঁতুলিয়া নদীর তীরের এই ল্যান্ডিং স্টেশনটি। ভোলা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ার কারণে পরবর্তীতে এখানে ফেরি ও লঞ্চ সার্ভিসের সম্প্রসারণ ঘটে। ভেদুরিয়া থেকে বরিশাল, লক্ষ্মীপুর ও ঢাকার মধ্যে নিয়মিত লঞ্চ চলাচল করতে থাকে। ক্রমবর্ধমান যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য গড়ে ওঠে ঘাটে মৌলিক কিছু অবকাঠামো। ২০০১ সালে লাহারহাট-ভেদুরিয়া ফেরি সার্ভিস চালু হলে বরিশালের সাথে যোগাযোগের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সুষ্ঠু ও দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য ২০১৫ সালে ঘাটটি বিআইডব্লিউটিএর নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হয়। এরপর অবকাঠামোর আরও উন্নতি হয়।

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যাত্রীর পাশাপাশি ঘাটটি দিয়ে দৈনিক বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহনও হয়। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের এই চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে একটি গ্যাংপ্ল্যাঙ্ক ও পন্টুন দিয়ে। কিন্তু ঘাটের ব্যবহার অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় এর অবকাঠামো সুবিধা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাংকের হাট লঞ্চঘাট আধুনিকায়নের কাজটি করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে একটি করে পন্টুন ও স্পাড, গ্যাংওয়ে এবং জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি নদীর তীররক্ষা, পার্কিং ইয়ার্ড ও ওয়েটিং শেডও নির্মাণ করা হচ্ছে। লঞ্চঘাটের জন্য পন্টুন নির্মাণের কাজ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে চলমান রয়েছে। একই সাথে ওয়েটিং শেডসহ পার্কিং ইয়ার্ডের জন্য জমি নির্বাচনের কাজও চলছে।

দৌলতখাঁন লঞ্চঘাট

তেঁতুলিয়া নদীর তীরে অবস্থিত দৌলতখাঁন লঞ্চ ঘাটের গুরুত্ব অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন নেটওয়ার্কে বরাবরের। সড়কপথ সম্প্রসারণের আগে ভোলা জেলার বাসিন্দাদের অন্যান্য স্থানে যাতায়াতের যে অল্প কয়েকটি উপায় ছিল দৌলতখাঁন লঞ্চঘাট তার মধ্যে অন্যতম। কৌশলগত অবস্থানের কারণেই ভোলা জেলায় উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য পরিবহনে অবদান রেখে চলেছে ঘাটটি।

গত কয়েক দশকে ঘাটটিতে যাত্রী চাহিদাও অনেক বেড়েছে এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যাত্রী ঘাটটি ব্যবহার করছেন। পণ্য পরিবহনও হচ্ছে বিপুল পরিমাণে। দৈনিক গড়ে ৭৩০ টন পণ্য এই ঘাটটি ব্যবহার করে বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের এই কাজ পরিচালিত হয় ২২ মিটার দীর্ঘ একটি জেটি ও একটি পন্টুনের মাধ্যমে। চাহিদার তুলনায় এ অবকাঠামো পর্যাপ্ত না হওয়ায় তা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিআরডব্লিউটিপি-১ প্রকল্পের আওতায় ঘাটটিতে একটি করে পন্টুন ও স্পাড, গ্যাংওয়ে ও জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সেই সাথে থাকছে পার্কিং ইয়ার্ড, ওয়েটিং শেড কাম সাইক্লোন শেল্টার, উন্নত অ্যাকসেস রোডসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুবিধাদি।

চুক্তি স্বাক্ষরের ১২ মাসের মধ্যে প্রকল্পটি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী ভৌত কাজ চলমান আছে। ঘাটের জন্য পন্টুন নির্মাণের কাজ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে চলছে। সেই সাথে চলছে পার্কিং ইয়ার্ড ও ওয়েটিং শেড কাম সাইক্লোন শেল্টারের জন্য প্রয়োজনীয় জমি নির্বাচনের কাজও।

তজুমদ্দিন লঞ্চঘাট

তজুমদ্দিন লঞ্চঘাটের অবস্থান ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় মেঘনা নদীর তীরে। দক্ষিণাঞ্চলের যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে লঞ্চঘাটটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এই লঞ্চঘাট ব্যবহার করে লোকজন চর জহির উদ্দিন, চর মোজাম্মেল, কলাতলি, মনপুরা এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য ঘাটে যাতায়াত করেন। এমনকি ১৫ কিলোমিটার দূরের যাত্রীরাও ব্যবহার করেন ঘাটটি। কারণ, নৌপথ ছাড়া এই এলাকায় যাতায়াতের বিকল্প কোনো মাধ্যম নেই।

২০১৬ সালে প্রস্তুতকৃত প্রকল্পের পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা কর্মকাঠামো অনুযায়ী, তজুমদ্দিন লঞ্চঘাট দিয়ে প্রতিদিন যাত্রী যাতায়াত করেন গড়ে ৩০৭ জন। ঘাটটি ব্যবহার করে প্রতিদিন পণ্য পরিবহন করা হয় ২৩ টন। এই পরিমাণ যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য ঘাটটিতে বিদ্যমান অবকাঠামো সুবিধা হলো দুটি স্থল সংযোগ সিঁড়ি এবং একটি পন্টুন।

আরও বেশি যাত্রী ও পণ্য পরিবহন এবং স্বস্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে লঞ্চঘাটটি আধুনিকায়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিআরডব্লিউটিপি-১ প্রকল্পের আওতায় ঘাটটিতে একটি করে পন্টুন ও স্পাড, গ্যাংওয়ে এবং জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে পার্কিং ইয়ার্ড, কার্গো ওয়্যারহাউস, ওয়েটিং শেড ও সাইক্লোন শেল্টারসহ অন্যান্য সুবিধাদি। ঠিকাদারের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে পন্টুন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। একই সাথে চলছে পার্কিং ইয়ার্ড ও ওয়েটিং শেড কাম সাইক্লোন শেল্টারের জন্য জমি নির্বাচনের কাজও।

মজু চৌধুরীর হাট লঞ্চঘাট

মজু চৌধুরীর হাট লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়নের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় এলাকা। এক সময় রহমতখালী নামে পরিচিত স্থানটির ১৯৬৫ সালে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী মজু চৌধুরীর নামে নামকরণ করা হয়। এখানকার লঞ্চঘাটটিও তারই নামে, যা এখন পরিবহন, বাণিজ্য ও পর্যটনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।

মজু চৌধুরীর হাট লঞ্চঘাটের জন্য পন্টুন নির্মাণ করছে নারায়ণগঞ্জ শিপবিল্ডার্স। ছবি: বিআইডব্লিউটিএ

লঞ্চঘাটটির প্রতিষ্ঠা এই এলাকার নদীপথে যোগাযোগকে শক্তিশালী করেছে। পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মজু চৌধুরীর হাট লঞ্চঘাট মেঘনা নদী দিয়ে বেশ কিছু জেলায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে অবদান রাখছে।

রহমতখালী খাল ও মেঘনা মোহনার কারণে লঞ্চঘাটের আশপাশের এলাকা পর্যটন গন্তব্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতিও পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। আর ল্যান্ডিং সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এই পর্যটনকে সহায়তা করে আসছে মজু চৌধুরীর হাট লঞ্চঘাট।

২০১৬ সালে তৈরি প্রকল্পের পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা কর্মকাঠামো সংক্রান্ত প্রতিবেদনে ঘাটটির ওপর নির্ভরশীল স্থায়ী ৫০০ থেকে ৭০০ এবং অস্থায়ী ৩০০টি দোকানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আছে ইলিশের প্রাচুর্যও। এসব কারণে ঘাটটির উন্নয়ন জরুরি। একই সাথে জরুরি ড্রেজিংও।

এসব বিবেচনায় নিয়ে বিআরডব্লিউটিপি-১ প্রকল্পের আওতায় মজু চৌধুরীর হাট লঞ্চঘাটের উন্নয়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ। এর অংশ হিসেবে একটি করে পন্টুন ও স্পাড, গ্যাংওয়ে এবং জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি থাকছে পার্র্কিং ইয়ার্ড, ওয়েটিং শেডসহ অন্যান্য সুবিধাদি।

প্রকল্পের অগ্রগতি হিসেবে ঠিকাদারের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে পন্টুন নির্মাণের কাজ চলছে। নির্বাচন করা হচ্ছে পার্কিং ইয়ার্ড ও ওয়েটিং শেডের জন্য জমিও।

মতিরহাট লঞ্চঘাট

মতিরহাট লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার একটি প্রসিদ্ধ নদী তীরবর্তী এলাকা। মেঘনা নদীকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা এলাকাটি স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় গন্তব্য। মিনি কক্সবাজার নামে পরিচিত সৈকতের অবস্থান এই মতিরহাটেই।

এখানে গড়ে ওঠা লঞ্চঘাটটি এই অঞ্চলে যোগাযোগে বড় ভূমিকা রাখছে। লক্ষ্মীপুর সদর, ভোলা ও বরিশালের মতো শহরগুলোর সাথে নদী তীরবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামগুলোকে সংযুক্ত করেছে লঞ্চঘাটটি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনিক কাজে মতিরহাট লঞ্চঘাট ব্যবহার করে শহরে যেতে পারছেন স্থানীয়রা। অর্থাৎ, প্রত্যন্ত এই অঞ্চলকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষা করেছে লঞ্চঘাটটি। মাছসহ অন্যান্য পণ্য গ্রাম থেকে শহরের বাজারগুলোতে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবেও কাজ করছে মতিরহাট লঞ্চঘাট। পাশাপাশি এর মাধ্যমে হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান।

গুরুত্ব বিবেচনায় লঞ্চঘাটটি উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিআরডব্লিউটিপি-১ প্রকল্পের আওতায় ঘাটে অবকাঠামোসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে লঞ্চঘাটটিতে দুটি করে পন্টুন ও স্পাড, গ্যাংওয়ে এবং জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি থাকছে পার্কিং ইয়ার্ড, ওয়েটিং শেড কাম সাইক্লোন শেল্টার ও অন্যান্য সুবিধাদি। ঠিকাদারের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে পন্টুন নির্মাণের কাজ চলছে। নির্বাচন করা হচ্ছে পার্কিং ইয়ার্ড ও ওয়েটিং শেডের জন্য জমি নির্বাচনের কাজও।

মতিরহাট লঞ্চঘাটের জন্য তৈরি করা হচ্ছে ৩৬.৬ মিটার দীর্ঘ পন্টুন । ছবি: বিআইডব্লিউটিএ

তমরুদ্দিন লঞ্চঘাট

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হাতিয়ার জন্য তমরুদ্দিন লঞ্চঘাট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাতিয়ার অর্থনীতি মোটাদাগে এই ঘাটের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এই ঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তমরুদ্দিন বাজার। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার হাজারো মানুষের জীবিকা এই ঘাটের ওপর নির্ভরশীল। তমরুদ্দিন লঞ্চঘাট আধুনিকায়নের অর্থ হলো হাতিয়ার অর্থনীতির উন্নতি।

কিন্তু বিদ্যমান অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে স্থানীয়দের চাহিদার পুরোটা পূরণ করতে পারছে না লঞ্চঘাটটি। নাব্যতা সংকটের পাশাপাশি ঘাটের চ্যানেলে রয়েছে ডুবোচর। তাই বড় নৌযান সেখানে ভিড়তে পারে না। যাত্রীদের জন্য স্যানিটেশন সুবিধাসম্বলিত একটি অপেক্ষমাণ কক্ষ থাকলেও সেটি ঘাট থেকে দূরে। এ ছাড়া যত সংখ্যক লঞ্চ ঘাটটিতে চলাচল করে চাহিদা তার চেয়ে বেশি। কারণ, তমরুদ্দিন লঞ্চঘাট থেকে পরিচালিত লঞ্চ সার্ভিসের ওপর কেবলমাত্র হাতিয়া নয়; মনপুরা, তজুমদ্দিন, দৌলতখাঁনসহ অনেকগুলো চর ও দ্বীপের মানুষকে নির্ভর করতে হয়। তাই এই ঘাটের আধুনিকায়ন ব্যবহারকারীদের অনেকদিনের চাওয়া।

এই চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে তমরুদ্দিন লঞ্চঘাট আধুনিকায়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিআরডব্লিউটিপি-১ প্রকল্পের আওতায় একটি করে পন্টুন ও স্পাড, গ্যাংওয়ে এবং জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সেই সাথে রয়েছে প্যাসেঞ্জার প্ল্যাটফর্ম, কার্গো স্টোরেজ, দুই তলাবিশিষ্ট ওয়েটিং শেড কাম সাইক্লোন শেল্টার। প্রকল্পের আওতায় চ্যানেল খনন ও অ্যাকসেস রোডের উন্নয়নও করা হচ্ছে।

নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি হচ্ছে। ঠিকাদারের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে পন্টুন নির্মাণের কাজ চলছে। নির্বাচন করা হচ্ছে পার্কিং ইয়ার্ড ও ওয়েটিং শেডের জন্য জমি নির্বাচনের কাজও।

তমরুদ্দিন লঞ্চঘাটের জন্য পন্টুন নির্মাণের কাজ চলছে ঠিকাদারের ডকইয়ার্ডে। ছবি: বিআইডব্লিউটিএ

বহদ্দারহাট লঞ্চঘাট

বহদ্দারহাট লঞ্চঘাটের অবস্থান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলায় লোয়ার মেঘনার তীরে। কৌশলগত অবস্থানের কারণেই নদীপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য ঘাটটির গুরুত্ব অনেক বেশি। ঘাটটি নদী তীরবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোকে বড় শহর ও নগরীগুলোর সাথে সংযোগ তৈরি করেছে। ২০১৬ সালে তৈরি প্রকল্পের পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা কর্মকাঠামোতে যে তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে তাতে বহদ্দারহাট লঞ্চঘাটে রয়েছে একটি আরসিসি জেটি, ওয়েটিং শেড ও পার্কিং ইয়ার্ড। এই অবকাঠামো ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য যাত্রী চলাচলের পাশাপাশি ৩০ টনের মতো পণ্য পরিবাহিত হয়।

এই অবকাঠামো সুবিধা আরও বর্ধিত করার উদ্যোগ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। তারই অংশ হিসেবে একটি করে পন্টুন ও স্পাড, গ্যাংওয়ে এবং জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে পার্কিং ইয়ার্ড, দুই তলাবিশিষ্ট ওয়েটিং শেড কাম সাইক্লোন শেল্টার। পাশাপাশি চ্যানেলের নাব্যতা বাড়াতে ড্রেজিংও করা হবে কাজের অংশ হিসেবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করতে ঠিকাদারের নিজস্ব ডকইয়ার্ডে চলছে পন্টুন নির্মাণের কাজ। নির্বাচন করা হচ্ছে পার্কিং ইয়ার্ড ও ওয়েটিং শেডের জন্য জমিও।

সুফল পাবে সকলেই

উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত লঞ্চঘাটগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের যাতায়াতের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেরও ক্ষেত্র। এসব লঞ্চঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দোকান। লঞ্চঘাটগুলোর বিদ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন এসব ছোট ব্যবসায়ীর দীর্ঘদিনের চাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে লঞ্চঘাটগুলো আধুনিকায়নের কাজ সম্পন্ন হলে ব্যবসার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।

লক্ষীপুরের বহদ্দারহাট লঞ্চঘাটের জন্য পন্টুন নির্মাণ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান । ছবি: বিআইডব্লিউটিএ

শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষায়িত কোনো ব্যবস্থা টার্মিনালগুলোতে প্রায় অনুপস্থিত। যদিও তাদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে লঞ্চঘাটগুলোতে এ ধরনের অবকাঠামো সুবিধা থাকা জরুরি। শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরা তাই সড়কপথকেই তাদের যাতায়াতের উপযোগী মাধ্যম বলে মনে করেন। কিন্তু তাদের জন্য ঘাটগুলোতে লঞ্চে ওঠার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে তারাও নৌপথে আরামদায়ক পরিবেশে যাতায়াত করতে পারবেন। লঞ্চঘাটগুলোর উন্নয়নে সে বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

লঞ্চঘাটগুলো আধুনিকায়নের সুফল পাবেন স্থানীয় জেলেরা। এই সম্প্রদায়ের বসবাস সাধারণত নদীতীরে অথবা নদীর এক কিলোমিটারের মধ্যে। তাই আহরিত মাছ তারা সহজেই এসব লঞ্চঘাট ব্যবহার করে পরিবহন করতে পারবেন। তাছাড়া নেভিগেশনাল চ্যানেলগুলোতে সিগন্যালের ব্যবস্থা থাকবে। এমনকি নৌপথ ড্রেজিংয়ের সময়ও মাছের পোনা ছাড়ার এলাকা, চলাচলের রুট এবং মাছ ধরার বাণিজ্যিক এলাকাগুলো এড়িয়ে চলা হবে। এসব স্থানে ও রুটে কোনো ধরনের ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালও ফেলা হবে না। ফলে মাছের বিচরণক্ষেত্র অক্ষত থাকবে এবং জেলেদের মাছের প্রাপ্তিতে কোনো কমতি হবে না।

লঞ্চঘাটগুলোর উন্নয়নে যেসব বিষয়কে বিচেনায় নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নারীদের যাতায়াতকে সহজ করা। এসব এলাকার নারীদের বিশেষ করে গৃহিণীদের প্রায় সময়ই নানা প্রয়োজনে স্বামী-সন্তানদের সাথে নৌপথে ভ্রমণ করতে হয়। তাদের এই ভ্রমণ যাতে নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হয় সেজন্য টার্মিনালে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। আরও থাকছে অপেক্ষমাণ কক্ষ ও আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা।

শেষ কথা

মেঘনার প্রবাহকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা লঞ্চ ঘাটগুলো দূরবর্তী দ্বীপ ও উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনরেখা। একদিকে যাতায়াতের মাধ্যম, অন্যদিকে গন্তব্যে পণ্য পৌঁছানোর উপায়। জীবিকারও চালক। দ্বীপগুলোকে মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযোগকারী। এই সংযোগকে এবার আরও দৃঢ় করার প্রয়াস নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। তারই প্রতিফলন ১৩টি লঞ্চ ঘাট উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন। এতে নদী তীরবর্তী মানুষের যাতায়াত যেমন সহজ ও সুগম হবে, একইভাবে বাড়বে সাশ্রয়ে পণ্য পরিবহনের সুযোগ। এর প্রভাব পড়বে স্থানীয়দের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিতে।

প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে লঞ্চঘাটের চ্যানেলে ড্রেজিংকাজ। ছবি: বিআইডব্লিউটিএ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here