বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৫
28 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

সুনীল অর্থনীতির পরিসরে ছাপ রাখছে বিআইডব্লিউটিএ

নদীবাংলা ডেস্ক,

প্রাক-কথন

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) কাজ করে মূলত অভ্যন্তরীণ নৌপথ নিয়ে। নৌপথ সংরক্ষণ, নদীবন্দর ও ঘাটের টার্মিনাল সুবিধাদির উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও পরিচালন কর্তৃপক্ষের অন্যতম কাজ। নৌপথের প্রতিবন্ধকতা এবং নৌ দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনাও সংস্থাটির বড় কাজ। তবে এখন নৌ যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধির ফলে আগামী দিনের সম্ভাবনাময় খাত ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতিতেও সংস্থাটির ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সে লক্ষ্যে উপকূলীয়  অঞ্চলকে ঘিরে বড় পদক্ষেপ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। ব্লু ইকোনমির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত কোস্টাল ট্যুরিজমকে উৎসাহিত করতে ইকো-ট্যুরিজম পার্কগুলোতে ল্যান্ডিং সুবিধাদি তৈরি করছে তারা। অর্থনৈতিক অঞ্চলে জেটিসহ আনুষঙ্গিক সুবিধাদি তৈরির মাধ্যমে ভূমিকা রাখছে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনেও।

ব্লু ইকোনমির ধারণা

ব্লু ইকোনমি একটি অর্থনৈতিক দর্শন; একটি ধারণা, ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলির মাধ্যমে যার পরিচয় ঘটে। তবে এটি অবয়ব পায় ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় আর্থ সামিট রিও+২০ কনফারেন্সে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্নভাবে ব্লু ইকোনমিকে সংজ্ঞায়িত করেছে। বিশ্বব্যাংক ব্লু ইকোনমি বলতে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র অটুট রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, উন্নত জীবন-জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারকে বুঝিয়েছে। সমুদ্র ও উপকূল-সংশ্লিষ্ট সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্তকেই ব্লু ইকোনমি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে ইউরোপিয়ান কমিশন (ইসি)। কমনওয়েলথ একে নতুন ধারণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, যার লক্ষ্য আমাদের সমুদ্র ও সমুদ্রসম্পদের সর্বোত্তম পরিচর্যা। সেন্টার ফর দ্য ব্লু ইকোনমির ভাষায়, বিশ্বব্যাপীই ব্লু ইকোনমি এখন সর্বাধিক চর্চিত বিষয়, যা পরস্পরসম্পর্কিত পৃথক তিনটি অর্থ বহন করে-সামগ্রিক অর্থনীতিতে সমুদ্রসম্পদের অবদান, সমুদ্রের পরিবেশগত ও বাস্তুতান্ত্রিক স্থায়িত্ব এবং উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের প্রবৃদ্ধিতে সমুদ্রসম্পদের ব্যবহার। তবে ব্লু ইকোনমির সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য সংজ্ঞাটি দিয়েছে বোধ করি জাতিসংঘ। সংস্থাটির মতে, বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতের সমন্বয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সমুদ্রসম্পদের টেকসই ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট নীতিই হচ্ছে ব্লু ইকোনমি। এ ছাড়া জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) যে ১৭টি অভীষ্ট, তার অন্যতম হচ্ছে ‘লাইফ বিলো ওয়াটার’। সে হিসেবে ব্লু ইকোনমিতে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই।

আফ্রিকার পরিপ্রেক্ষিতে এখন ‘ইনল্যান্ড ব্লু ইকোনমি’ নামে একটি ধারণার কথাও শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে মেরিটাইমের সেই খাতগুলো, যেগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অভ্যন্তরীণ নদী, লেক ও জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে আছে নদী ও লেকে মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট, মেরিটাইম নিরাপত্তার ইস্যু এবং মেরিন ইকোসিস্টেমের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্লু ইকোনমির সুফল ঘরে তোলার জন্য সমন্বিত আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাঠামো। আফ্রিকান ইউনিয়নও বলেছে, মেরিটাইম নিরাপত্তা কেবল সামুদ্রিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অভ্যন্তরীণ নৌপথও মেরিটাইম ডোমেইনেরই অংশ।

ব্লু ইকোনমিকে ঘিরে বিশ্বব্যাপীই আবর্তিত হচ্ছে নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। তবে বাংলাদেশে এ নিয়ে চর্চার শুরু ২০১৪ সালের পর থেকে। এরই মধ্যে এখানে ব্লু ইকোনমির বেশ কিছু খাত চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্র বাণিজ্য ও জাহাজ চলাচল, পর্যটন ও ফিশারিজ এর মধ্যে অন্যতম।

বিআইডব্লিউটিএর ব্লু ইকোনমিভিত্তিক উদ্যোগ

নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ছাড়া পরিবহনের অন্যান্য সব মাধ্যমের তুলনায় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও অধিক পরিবেশবান্ধব।বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়শীল অধিকাংশ দেশই তাদের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনকে কার্যকর ও দক্ষ পরিবহন মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এই সুবিধা কাজে লাগাচ্ছে। একই সুযোগ উপস্থিত বাংলাদেশের সামনেও এবং তা কাজেও লাগানো হচ্ছে। কিন্তু ব্লু ইকোনমিতে উপকূলকেন্দ্রিক সম্ভাবনা অবারিত, যেগুলো কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন উপকূলে কাক্সিক্ষত অবকাঠামো নির্মাণ। সে কারণেই ‘চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফ (সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপ) অংশে জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। প্রকল্পটির আওতায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য মিরসরাই ও সন্দ্বীপ অংশে জেটিসহ আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া কক্সবাজারের সোনাদিয়া এবং টেকনাফের সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপে জেটিসহ আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ করা হবে পর্যটকদের জন্য। এর মধ্য দিয়ে ব্লু ইকোনমিতে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের অবদান নিশ্চিত হবে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে বিআইডব্লিউটিএ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশনকে (বিআরটিসি) পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেয়। তারা জেটিসহ প্রয়োজনীয় সুবিধাদী স্থাপনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করেছে।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সন্দ্বীপে নৌ যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপ ও মহেশখালীর সোনাদিয়া এলাকায় ইকো-ট্যুরিজম জোন স্থাপনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই মূলত প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্প ইউনিটসমূহে ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনায় বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করাসহ মিরসরাই ও আশপাশের এলাকায় যোগাযোগ ও যাতায়াতের উন্নত সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) এই চাহিদা বিবেচনায় রেখেই এই এলাকায় নৌপথের সুবিধাদি নিশ্চিত করার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। তারই অংশ হিসেবে জেটিসহ নান্দনিক অবকাঠামো উন্নয়নের এই কার্যক্রম। এই কার্যক্রমের আওতায় যাত্রী পরিবহন সুবিধার জন্য নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। নারী, শিশু ও প্রবীণসহ শারীরিকভাবে অক্ষম জনগোষ্ঠীর যাতায়াতের বিষয়টিও এখানে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এই প্রকল্পের অর্থনৈতিক বেনিফিট কম নয়। সমীক্ষা অনুযায়ী, বেজার চাহিদা মোতাবেক এলাকাগুলোর নৌপথের সুবিধাদি উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থনৈতিক সুবিধাও অনেক। মিরসরাই, সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপ উন্নয়নে গৃহীত সমীক্ষা প্রকল্পে বেজার আয়ের ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বিআইডব্লিউটিএ নিয়োগকৃত পরামর্শকের প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে বছরে থোক ২৮,৯০৬ লাখ টাকা পরোক্ষ আয় হবে এবং প্রথম পাঁচ বছর আয় একই থাকবে। পরবর্তী ২০ বছর শতকরা ২ দশমিক ৫ ভাগ থেকে ১০ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাবে বলে হিসাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সূচক বিবেচেনায় নিয়ে ২০৪৯-৫০ অর্থবছরে ৯১,৪৫৬.০১ লাখ টাকা বেনিফিট প্রাক্কলন করা হয়েছে।

ব্লু ইকোনমির অনুষঙ্গ হিসেবে পণ্য পরিবহন

ব্লু ইকোনমির অন্যতম খাত হচ্ছে সমুদ্র বাণিজ্য ও জাহাজ চলাচল। উপকূলীয় জাহাজ চলাচল/ফিডার সার্ভিস, সমুদ্রবন্দর ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন এর আওতার মধ্যে পড়ে। বন্দর ও হিন্টারল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথ এই ভূমিকা রাখতে পারে। হিন্টারল্যান্ড হচ্ছে সাধারণত বন্দরের কাছাকাছি অবস্থিত দেশের অভ্যন্তরীণ অঞ্চল। বন্দরগুলোতে রপ্তানি পণ্য প্রেরণ এবং বন্দর থেকে আমদানিকৃত কার্গো সারা দেশে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে হিন্টারল্যান্ড যোগাযোগ। অভ্যন্তরীণ নৌপথ যাতে এই সুবিধা দিতে পারে সেজন্যই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বহুমুখী জেটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। সন্দ্বীপ চ্যানেল দিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলে আগত যাত্রীবাহী জাহাজ, ফেরি ও কার্গো জাহাজ এই জেটি ব্যবহার করবে।

 মিরসরাইয়ে বহুমুখী জেটি নির্মাণ

প্রস্তাবিত মিরসরাই বহুমুখী জেটিটি নির্মিত হবে চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চলে। বহুমুখী কাজে ব্যবহার করা যাবে জেটিটি। জেটিটিতে বৃহদাকৃতির যাত্রীবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে, যার ফলে সন্দ্বীপ ও অন্যান্য এলাকার

মানুষ সহজেই মিরসরাইয়ে পৌঁছানোর সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি কার্গো জাহাজও ভিড়তে পারবে প্রস্তাবিত জেটিতে।

প্রায় ৩০ হাজার একর জমির ওপর মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, যা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল। অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে যে একাধিক জেটি থাকবে বিআইডব্লিউটিএর জেটিটি তার একটি। যাত্রী ও পণ্য ওঠা-নামার কাজে ব্যবহারযোগ্য জেটিটির হেডের দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটার এবং প্রস্থ ৭ দশমিক ৫ মিটার। জেটি এক্সেস বা স্টেমের দৈর্ঘ্য হবে এক হাজার মিটার এবং স্টেমের প্রস্থ ১৩ দশমিক ৫ মিটার। জেটি এলাকায় নদীর গভীরতা পাওয়া গেছে ৪ দশমিক ১ থেকে ৫ মিটার। সারা বছর জেটিটি কার্যকর রাখতে ৩ লাখ ২ হাজার ১৮০ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে। সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের দরকার হবে বার্ষিক ৯ হাজার ঘনমিটার।

প্রস্তাবিত মিরসরাই জেটির অবস্থান মেঘনার মোহনায় সন্দ্বীপ চ্যানেলের বাম তীরে মিরসরাইয়ের উত্তর-পশ্চিমাংশে। এটি মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ উন্নয়নের যে পরিকল্পনা তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

জেটি এলাকায় বর্তমানে ফেরি বা যাত্রীবাহী নৌযান সেবা চালু নেই। ফলে অনেক নির্মাণ সামগ্রী ও সরঞ্জাম নেভাল রুট দিয়ে পরিবহন করতে হয়। এ ছাড়া বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্পিড বোটে মিরসরাই বা চট্টগ্রাম যাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় যাত্রীবাহী জাহাজ ও ফেরি এবং কার্গো জাহাজ নোঙর করার উপযোগী জেটি থাকাটা জরুরি।

প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে পরিবেশগত ও সামাজিক কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে তা মূল্যায়ন করেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ। বুয়েটের মাধ্যমে এ মূল্যায়ন করা হয়েছে। সেই সাথে হাইড্রোলজিক্যাল ও মরফোলজিক্যাল স্টাডি, সিভিল ও আর্কিটেকচারাল ডিজাইন, ট্রাফিক সার্ভে ও ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।

পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ) করা হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃত যে ইআইএ নীতিমালা তার আলোকে। পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নে অন্য সব উন্নয়ন প্রকল্পের মতো এই প্রকল্পেও নেতিবাচক কিছু প্রভাবের কথা উঠে এসেছে। তবে ইতিবাচক যেসব প্রভাবের ধারণা পাওয়া গেছে তা নেতিবাচক প্রভাবের চেয়ে অনেক বেশি। যদিও নেতিবাচক প্রভাব প্রশমনের ও ইতিবাচক প্রভাব বৃদ্ধির পদক্ষেপ  হলে নিট সুফল আরও বাড়িয়ে র সুযোগ রয়েছে। বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর নজরও সেদিকেই।

জেটি নির্মাণে সেখানকার বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্যের ওপর কিছুটা বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এর বিপরীতে ইতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি। নিরাপদ ভ্রমণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এর মধ্যে অন্যতম। প্রধানত অর্থনৈতিক অঞ্চলে যেতে এবং সেখান থেকে আসতে জেটিটি ব্যবহৃত হবে। এর ফলে নতুন ট্রাফিক সৃষ্টি হবে।

তবে নেতিবাচক প্রভাব সর্বনিম্ন পর্যায়ে রেখে প্রকল্পের সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে প্রকল্প চলাকালীন ও প্রকল্প শেষে পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে। সেই সাথে পরিবেশগত মান যাতে নিশ্চিত হয় সেটাও দেখতে হবে। এজন্য পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশ অনুযায়ী, প্রকল্প এলাকার জীববৈচিত্র্যকে বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যমান কোনো অবকাঠামো উন্নয়ন বা নতুন অবকাঠামো নির্মাণের সময় এদিকটাতে বিশেষ যত্নবান হতে হবে।

যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন ও বাস্তবায়নোত্তর-দুই পর্যায়েই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। এর প্রভাব পড়ে স্থানীয় অর্থনীতির ওপর। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অর্থাৎ স্থানীয় তরুণরা যাতে কাজের সুযোগ পান সেজন্য যতটা সম্ভব ঠিকাদারদের স্থানীয় লোকজনকে নির্মাণকাজে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের ওপর প্রকল্পের আর্থ-সামাজিক প্রভাব কী হতে পারে সেই সমীক্ষাও করা হয়েছে। সামাজিক প্রভাব মূল্যায়নের (এসআইএ) ক্ষেত্রে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প মূল্যায়নের নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে। মূল্যায়ন অনুযায়ী, প্রকল্পটি লক্ষণীয় সামাজিক প্রভাব ফেলবে। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি, জীবনের নিরাপত্তা, নারীর মর্যাদা ও লিঙ্গ সমতা, সাংস্কৃতিক ও বিনোদন সুবিধা এবং জীবনমানের উন্নতি। নিশ্চিতভাবেই জেটি প্রকল্পটি বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা এনে দেবে। এসবের মধ্যে রয়েছে কর্মসংস্থান ও মজুরি বৃদ্ধি, জমির মূল্য বৃদ্ধি, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি গড়ে ওঠার পাশাপাশি পণ্য মূল্যের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষি, প্রাণিসম্পদ, মৎস্যসম্পদ, বনভূমি, শিক্ষা ও স্বাক্ষরতার হার, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সুবিধা এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর।

অন্য সব প্রকল্পের মতো মিরসরাইয়ের এই জেটি প্রকল্পেও সামাজিক কিছু নেতিবাচক প্রভাব আছে। বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব থেকেই এটা সৃষ্টি হবে। তবে জেটি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে লোকজনের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর ইতিবাচক যে প্রভাব পড়বে তা নেতিবাচক প্রভাবকে বহুগুণে ছাপিয়ে যাবে।

সন্দ্বীপে জেটি নির্মাণ

মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রস্তাবিত বহুমুখী জেটি

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার অবস্থান বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে। চারদিকে নদী আর সাগর বেষ্টিত এই দ্বীপটি দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। এই দ্বীপের অদূরেই গড়ে তোলা হচ্ছে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেই সাথে পর্যটক আকর্ষণের জন্য নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। তবে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে স্থলপথে দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের কোনো সংযোগ নেই। ফলে নৌপথই যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। যদিও যাতায়াতের জন্য যে কয়েকটি নৌপথ রয়েছে সেগুলোও অনিরাপদ। তাই ঝুঁকি নিয়েই যাতায়াত করতে হয় সন্দ্বীপের বাসিন্দাদের।

সন্দ্বীপবাসীর এই দুর্ভোগ লাঘবের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সন্দ্বীপ অংশে আরসিসি জেটিসহ আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ করছে সংস্থাটি।

‘চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফ অংশে (সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপ) অংশে জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি’ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় সন্দ্বীপে জেটি ও টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। সন্দ্বীপ অংশে জেটি এক্সেসের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৩ কিলোমিটার ও প্রস্থ প্রায় ১০ মিটার। যাত্রী পারাপার, পর্যটন ও কার্গো ওঠানো-নামানোর কাজে জেটিটি ব্যবহৃত হবে।

সন্দ্বীপ জেটির টার্মিনাল ভবন

এ ছাড়া সন্দ্বীপের গাছুয়া ঘাটে একাধিক টার্মিনাল ভবন, মালামাল ওঠানামার জন্য আরসিসি জেটিসহ বেশকিছু স্থাপনা নির্মিত হবে। বাহ্যিক বৈদ্যুতিক কাজ ছাড়াও নেভিগেশন বয়া, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, তীররক্ষা ও সাব-স্টেশন নির্মাণ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। প্রকল্পটি সম্পন্ন হতে সময় লাগবে ১৮ মাস।

সম্প্রতি বিদেশী কনসালটেন্টসহ বিআইডব্লিউটিএর কর্মকতারা প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করেছেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে চরাঞ্চলের নৌ-বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাবে। কারণ, পণ্য পরিবহনের জন্যও ব্যবসায়ীদের কাছে চ্যানেলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া সন্দ্বীপ চ্যানেলটি ব্যবহার করে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ। তাদেরও যাতায়াতের দুর্ভোগ লাঘব হবে।

পর্যটন যখন ব্লু ইকোনমির খাত

সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে অস্তাচলের রক্তিম সূর্যটায় চোখ রাখতে চায় চরম নিরাসক্ত ব্যক্তিটিও। সূর্যাস্ত সেখানেই সব সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয়। সেখানে যোগ দেয় সি অরগানের অনন্য সুর। সমুদ্রের ঢেউয়ের সুর আর অস্তগামী সুর্য কিরণের নৃত্য পর্যটকদের কাছে সমুদ্র উপকূলকে করে তোলে আকর্ষণীয় গন্তব্য। এর টানেই পর্যটকরা ছুটছেন মালদ্বীপের মিরু দ্বীপ থেকে ইন্দোনেশিয়ার বালি, তুরস্কের ব্লু লেগুন থেকে ফ্লোরিডার পেনসাকোলা সৈকতে। ইংল্যান্ডের ব্যামবার্গ, ভিয়েতনামের বাই সাও কিংবা সেইশলসের লা দিগু দ্বীপই বা বাদ যাবে কেন। সেদিকেও ছুটছেন পর্যটক বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকার ধনাঢ্য ভ্রমণপিপাসুরা।

সমুদ্র উপকূলকে ঘিরে মানুষের এই যে বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড সেটাই কোস্টাল বা উপকূলীয় পর্যটন। বন্যপ্রাণী দর্শনও এর মধ্যে পড়ে। পর্যটন শিল্পের সবচেয়ে আদিম ও বৃহত্তম এই শাখা একই সাথে দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটন খাত।

স্বতঃস্ফূর্ত অর্থ হস্তান্তর সবচেয়ে বেশি হয় পর্যটনের মাধ্যমে, যা যায় ধনী থেকে দরিদ্র্যের কাছে; সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু স্তরে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক উপদেষ্টা লেলেই লেলুলু মন্তব্যটি যখন করেছিলেন সে বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালেও আন্তর্জাতিক পর্যটকরা পর্যটন গন্তব্যগুলোয় খরচ করেছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ২০২৪ সালে অংকটা আরও স্ফীত হয়েছে।

কর্মসংস্থানের নিরিখেও খাত হিসেবে পর্যটনের অবস্থান উপরের দিকে। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল ও ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি দশটি কর্মসংস্থানের অন্তত একটি তৈরি হচ্ছে পর্যটনের হাত ধরে। এই অবদানে কোস্টাল ট্যুরিজমের হিস্যা কতখানি? ডব্লিউটিটিসির প্রাক্কলন বলছে, সমুদ্রকেন্দ্রিক শিল্পে মোট যে বৈশ্বিক মূল্য সংযোজন, ২০৩০ সাল নাগাদ তাতে কোস্টাল ট্যুরিজমের হিস্যা দাঁড়াবে ২৬ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে পর্যটনের বিশেষ এই শাখাটিই হয়ে উঠবে ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির বৃহত্তম খাত। শুধু তাই নয়, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী খাতটি নতুন করে ১৫ লাখ মানুষকে কাজের সুযোগ করে দেবে। অর্থাৎ ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী এ খাতে ৭০ লাখ কর্মসংস্থান ২০৩০ সালে পৌঁছে যাবে ৮৫ লাখে।

বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্পের সাফল্যের গল্পটাও চমকপ্রদ। পর্যটন শিল্প এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে প্রতি বছর জোগান দিচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি ডলার, যার উল্লেখযোগ্য অংশের জোগান দিচ্ছে উপকূলীয় পর্যটন। এক্ষেত্রে অগ্রভাগে আছে মালদ্বীপ, ভারত ও শ্রীলংকা।

তবে সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশেরও। কারণ, আমাদের আছে সোনালি বালির পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত, নীল জলের অপূর্ব ঢেউরাশি ও বিরল প্রজাতির শামুক যাকে দিয়েছে অনন্যতা। কক্সবাজার শহরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত সোনাদিয়া দ্বীপ শহরটিকে ভাঙনের হাত থেকে নিরন্তর রক্ষা করে চলেছে। বিস্তৃত বালিয়াড়ি ও নোনা পানির বিচিত্র সব গুল্মের পাশাপাশি সোনাদিয়ার মেরিন অঞ্চলকে আশ্রয় করে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে মেরিন কচ্ছপ, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও স্তন্যপায়ী তিমি। সর্বশেষ টিকে থাকা চঞ্চুমুখ গাঙশালিকেরও আবাস এই দ্বীপ। উপকূলে আছে বিপন্নপ্রায় লাল কাঁকড়া, রাজকীয় এশিয়ান হাতি, লাল পিঠের বিরল প্রজাতির ফ্লাওয়ারপেকার। বিস্তীর্ণ সৈকতের পাশাপাশি বিচিত্র ও বিরল এসব উদ্ভিদ ও প্রাণীই বাংলাদেশে কোস্টাল ট্যুরিজমের আকর্ষণ। এখন প্রয়োজন একে দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের দেখার সুযোগ করে দেওয়া। সেই উদ্যোগই নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার জালিয়ার দ্বীপ ও সাবরাং এবং মহেষখালীর সোনাদিয়ায় প্রস্তাবিত পর্যটনভিত্তিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে জেটিসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা নির্মাণ করতে যাচ্ছে সংস্থাটি। এর উদ্দেশ্য ইকো-ট্যুরিজম পার্কগুলোতে পর্যটকদের যাতায়াত সুগম করা।

সন্দ্বীপ প্রস্তাবিত আরসিসি জেটি

জালিয়ার দ্বীপে নাফ নদীতে জেটি নির্মাণ

কক্সবাজারের টেকনাফে নাফ ট্যুরিজম পার্ক নামে পরিচিত জালিয়ার দ্বীপ অর্থনৈতিক জোনে একটি জেটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ। নাফ নদী দিয়ে আসা জাহাজ ভিড়তে পারবে জেটিটিতে। সেই সাথে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জালিয়ার দ্বীপ ইকো-ট্যুরিজম পার্কে পৌঁছানোর এবং নাফ নদী, ম্যানগ্রোভ বন ও বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্যের সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ করে দেবে এটি। তবে পার্শ্ববর্তী দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অবনমনের কারণে জেটি নির্মাণকাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে। আশা করা যায়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দ্রুতই নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব হবে।

জালিয়ার দ্বীপের অবস্থান বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে টেকনাফ উপদ্বীপের পূর্ব উপকূলের খুব কাছাকাছি। দ্বীপটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থ সর্বোচ্চ দশমিক ৬ কিলোমিটার। সবমিলিয়ে এর আয়তন ২৭১ একর। যদিও মূল ভূখণ্ড থেকে জালিয়ার দ্বীপের সর্বনিম্ন দূরত্ব মাত্র ২০০ মিটার, কিন্তু বর্তমানে এর সাথে মূল ভূখণ্ডের সুনির্দিষ্ট কোনো সংযোগ নেই। নাফ নদীর যে মোহনা সেটাই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সীমান্ত।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, নাফ নদী একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। মিয়ানমারে উৎপন্ন হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এই নদীতেই জালিয়ার দ্বীপ ইকো-ট্যুরিজম পার্কের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে জেটিটি নির্মাণ করা হবে।

প্রস্তাবিত জেটি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত কোনো ফেরি সার্ভিস নেই এবং নদী পারাপারের প্রাথমিক মাধ্যম হচ্ছে ছোট ছোট নৌকা, যা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু নদীর যে প্রশস্ততা তাতে করে ফেরি সার্ভিস চালু করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাছাড়া এটা টেকনাফ হয়ে ভ্রমণ পথটি সীমিত করে দেবে। সেটা হলে ইকো-ট্যুরিজম পার্কটির আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের যে উদ্দেশ্য তা ব্যর্থ হবে। এ ছাড়া বর্তমানে যে অবস্থা তাতে করে বর্ষা মৌসুমে নদীটি পাড়ি দেওয়া উচ্চ ঝুঁকির। এ অবস্থায় যাত্রীবাহী নৌযান নোঙর করতে সক্ষম একটি জেটির ব্যবস্থা করা আবশ্যকীয়। শুধুমাত্র যাত্রী ওঠা-নামার কাজেই ব্যবহৃত হবে প্রস্তাবিত জেটিটি। এর হেডের দৈর্ঘ্য ৭১ মিটার এবং প্রস্থ ১৪ মিটার। এ ছাড়া স্টেমের দৈর্ঘ্য ৮৬ দশমিক ৩৫ মিটার এবং প্রস্থ ৫ মিটার। জেটি এলাকায় নদীতে পানির গভীরতা ৮ দশমিক ১ থেকে ৯ মিটার। প্রস্তাবিত জেটির জন্য খুব বেশি ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়বে না। জেটিটি সচল রাখতে ৮ হাজার ৫০০ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং বছরে ৬০ হাজার ঘনমিটার সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে।

প্রস্তাবিত জেটি স্থানীয় ও আঞ্চলিক লোকজনের সামনে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ উন্মোচন করবে। প্রকল্প চলাকালীন সময়ে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে, একইভাবে সুযোগ থাকবে প্রকল্প শেষে জেটি পরিচালন পর্যায়েও। নির্মাণ পর্বে লোকজন নির্মাণশ্রমিক, নির্মাণসামগ্রী পরিবহন ও নির্মাণ সরঞ্জাম পরিচালনায় সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন। আর জেটি নির্মাণ শেষে পরিচালন পর্বে অর্থাৎ নতুন জেটিতে অনেকে ইকো-ট্যুরিস্ট গাইড, বোটম্যান ও টার্মিনাল কর্মী হিসেবে কাজের সুযোগ পাবেন।

প্রস্তাবিত জেটি সাইটটির অবস্থান প্রান্তিক এলাকায় হলেও প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যটক দ্বীপটির ইকোলজিক্যাল রিসোর্স উপভোগ করে থাকেন। কিন্তু উন্নত জেটি সুবিধা না থাকায় সেখানে পৌঁছাতে পর্যটকদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রস্তাবিত জেটিটির নির্মাণ সম্পন্ন হলে এলাকার পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। এর ফলে নতুন ট্রাফিক সৃষ্টি হবে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও বিনোদনের সুযোগ বৃদ্ধি এবং জীবনমানের উন্নতি ঘটবে। সেই সাথে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। উন্নত হবে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রকল্পটির ফলে উন্নতি আসবে কৃষি, প্রাণিসম্পদ, মৎস্যসম্পদ, সামাজিক বনসহ সার্বিক বনভূমি, শিক্ষা ও সাক্ষরতার হার, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থায়।

সোনাদিয়ায় জেটি নির্মাণ

প্রস্তাবিত জেটিটি নির্মাণ করা হবে কক্সবাজারের মহেষখালী উপজেলার সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক বা সোনাদিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে। প্রাথমিকভাবে জেটিটির অবস্থান বিচেনা করা হয়েছিল বালুময় সৈকতের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। বিকল্প স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল মহেষখালী চ্যানেলে নদীর মুখে। তৃতীয় বিকল্পটি ছিল সেতুর কাছে নদীর চ্যানেলের মধ্যে।

প্রস্তাবিত জেটিতে কেবল যাত্রীবাহী নৌযান ভিড়বে। চ্যানেলের যে গভীরতা তাতে করে মাঝারি আকারের জাহাজ অথবা বৃহদাকৃতির স্পিডবোট এখানে নোঙর করতে পারবে।

সোনাদিয়া বাস্তুতান্ত্রিকভাবে সংবেদনশীল। বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্রের ক্ষতি যাতে না হয় সেজন্য জেটিটি হবে স্টিলের পাইলের ওপর কাঠের তৈরি। জেটি নির্মাণে প্রয়োজনীয় ভূমির সংস্থান করবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ।

মহেষখালী উপজেলার অংশ সোনাদিয়া লাল কাঁকড়ার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধ। এই দ্বীপটিই বিপন্নপ্রায় প্রজাতির অবশিষ্ট একমাত্র আবাস। ম্যানগ্রোভ ও সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের জন্যও খ্যাতি রয়েছে দ্বীপটির। জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ দ্বীপটিকে পর্যটক আকর্ষণ হিসেবে গড়ে তুলতে সোনাদিয়া ইকো-ট্যুরিজম পার্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ  হয়েছে। সোনাদিয়া ও তৎসংলগ্ন ৩৭ হাজার একর জায়গা নিয়ে পার্কটি গড়ে তোলার কথা। দ্বীপটিকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে অটুট রাখতে এর মাত্র ২৫ শতাংশে অবকাঠামো নির্মাণের কথা। এই অবকাঠামোর মধ্যে থাকবে মেরিন পার্ক, মিউজিয়াম, মেরিন ক্রুজ, ওয়াটার স্পোর্টস এবং ছোট ছোট শপিং সেন্টার। সবগুলোই হবে প্রতিবেশবান্ধব। প্রস্তাবিত জেটিটি এই পার্কের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হলেও সেখানে যেতে বিশেষ করে সোনাদিয়ার দক্ষিণ অংশে যেতে ফেরি বা যাত্রীবাহী জাহাজ সেবা বর্তমানে অনুপস্থিত। সেখানে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবেই কার্যকর পর্যটন গন্তব্য হিসেবে ইকো-ট্যুরিজম পার্কটিকে গড়ে তুলতে যাত্রীবাহী জাহাজ ও ফেরি নোঙর করতে সক্ষম জেটি নির্মাণের বিকল্প নেই।

সোনাদিয়ায় পর্যটকদের জন্য প্রস্তাবিত কাঠের জেটি

সংবেদনশীল সোনাদিয়া দ্বীপ প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর। এটা বিপন্ন প্রজাতির লাল কাঁকড়ার যেমন আবাস, একইভাবে উপস্থিতি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সরীসৃপেরও। বাটাগুড় বাস্কা এর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়াও রয়েছে ফিশিং ক্যাট, গাঙ্গেয় ডলফিন। ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ ছাড়াও রোপণকৃত বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে নারিকেল ও সুপারি। এ ছাড়া বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা সোনাদিয়াকে বাংলাদেশের ইম্পর্টেন্ট বার্ড এরিয়া (আইবিএ) হিসেবে ঘোষণা করেছে। বেশ কিছু সামুদ্রিক কচ্ছপেরও গুরুত্বপূর্ণ প্রজননক্ষেত্র দ্বীপটি। বাস্ততান্ত্রিক অতি সংবেদনশীলতার কারণে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার সোনাদিয়াকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) ঘোষণা করে। তবে সম্প্রতি ইসিএ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সেখানে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা নেই।

প্রস্তাবিত জেটি স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই কর্মসংস্থান নির্মাণ পর্যায়ে যেমন হবে, একইভাবে হবে পরিচালন পর্বেও। অর্থাৎ, কেউ নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজের সুযোগ পাবেন। কেউ নির্মাণসামগ্রী পরিবহন ও নির্মাণ যন্ত্রপাতি চালানোর সাথে সম্পৃক্ত হতে পারবেন। অনেকে আবার ইকো-ট্যুরিস্ট গাইড, বোটম্যান ও টার্মিনাল কর্মী হিসেবেও কাজ করতে পারবেন।

প্রস্তাবিত সাবরাং জেটির টার্মিনাল ভবন

সাবরাং ইকোনমিক জোনে জেটি নির্মাণ

প্রস্তাবিত জেটিটি নির্মাণ করা হবে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ সাবরাংয়ে। উদ্দেশ্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) ইকো-ট্যুরিজম পার্কের পর্যটকদের সেবা দেওয়া। বড় ক্রুজ শিপ জেটিটিতে ভিড়তে পারবে এবং বঙ্গোপসাগর, সমুদ্রসৈকত, টেকনাফ উপদ্বীপ এবং টেকনাফ বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যের প্রাকৃতিক যে সৌন্দর্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকগণ তা উপভোগের সুযোগ পাবেন।

অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভৌত উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ আগেই শুরু হয়েছে। এক হাজার ২৭ একর জায়গা নিয়ে এটিই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম সিফ্রন্ট ট্যুরিজম পার্ক। বিআইডব্লিউটিএর প্রস্তাবিত জেটিটি এরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটির অবস্থান টেকনাফ শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে এবং কক্সবাজার-সাবরাং মেরিন ড্রাইভ ধরে সহজেই এখানে যাওয়া যায়। একই সাথে এটি জাতীয় মহাসড়কের (এন১) সাথেও সংযুক্ত।

কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে পার্কটির দূরত্ব ৯৬ কিলোমিটারের মতো। টেকনাফ স্থলবন্দর থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৯ কিলোমিটার। সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের অবস্থান থেকে সূর্যাস্ত যেমন দেখা যায়, একইভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় সূর্যোদয়ের সৌন্দর্যও। সৈকতের সম্মুখে পার্কটি যে জায়গায় অবস্থিত সেখান থেকে সি ক্রুজের মাধ্যমে মাত্র আধ ঘণ্টায় সেন্টমার্টিন যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। একে সম্ভব করে তুলতে পারে কেবল প্রস্তাবিত জেটিটি।

বঙ্গোপসাগরমুখী সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের অবস্থান সাবরাংয়ে। প্রাথমিকভাবে পার্কটি ২০২০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা ছিল এবং প্রস্তাবিত জেটিটি এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেরই অংশ। কাক্সিক্ষত নাব্যতা না থাকায় টেকনাফ বা কক্সবাজারে বড় জাহাজ ভিড়তে না পারলেও সাবরাংয়ে এই সুবিধাটি রয়েছে। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্রুজ শিপিংয়ের মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাওয়া উচ্চ ঝুঁকির। এ কারণেই যাত্রীবাহী জাহাজ ভিড়তে পারে এমন একটি জেটি নির্মাণ জরুরি।

সাবরাংয়ে জেটির কার্যক্রম সারা বছর সচল রাখতে সাহায্য করবে চ্যানেলের ব্রেক ওয়াটার

বছরব্যাপী পর্যটকদের যাতায়াত নিশ্চিত করতে চ্যানেলের দুই পাশে ব্রেক ওয়াটার (ঢেউ নিরোধক বাঁধ) তৈরি করা হচ্ছে। এটি জেটি এলাকার উত্তাল ঢেউ প্রতিহত করে জলরাশি শান্ত ও স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি পলি জমে চ্যানেল ভরাট হওয়ার ঝুঁকিও হ্রাস করবে। ফলে জেটিটি ব্যবহার করে বছরব্যাপী সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাতায়াত করা যাবে, যা ট্যুরিজম পার্কে আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণে ভূমিকা রাখবে।

যাত্রী ওঠা-নামার কাজে ব্যবহৃত হবে প্রস্তাবিত জেটিটি। এর হেডের দৈর্ঘ্য হবে ১০০ মিটার ও হেডের প্রস্থ ১৮ মিটার। এ ছাড়া জেটির স্টেমের দৈর্ঘ্য হবে ১ হাজার ৮৫০ মিটার এবং প্রস্থ ৯ দশমিক ৬ মিটার। নাফ নদীর যে স্থানে জেটিটি নির্মাণ করা হবে সেখানে পানির গভীরতা ৪ দশমিক ১ থেকে ৫ মিটার। কাক্সিক্ষত নাব্যতার জন্য ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে ২৩ হাজার ১০০ ঘনমিটার। আর প্রতি বছর সংরক্ষণ ড্রেজিং করতে হবে ২ লাখ ৭৬ হাজার ১০০ ঘনমিটার।

প্রস্তাবিত জেটিটির অবস্থান বায়ো-ইকোলজিক্যাল জোনের মধ্যে পড়ে। টেকনাফ বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য প্রস্তাবিত জেটির কাছাকাছি অবস্থিত এবং এখনো এটা স্বল্প সংখ্যক বিপন্নপ্রায় এশিয়ান এলিফ্যান্টের আবাস। আরও নানা জলজ ও স্থলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদেরও আবাস এলাকাটি।

ট্যুরিজম পার্কের জেটিটি ব্যবহার করে সেন্টমার্টিন পরিদর্শনে যাবেন পর্যটকরা, যা এলাকাটিতে নতুন শিল্প কার্যক্রম তৈরিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে। একই সাথে বিদ্যমান স্থানীয় শিল্পগুলোর সম্প্রসারণে সহায়ক হবে।

ট্যুরিজম পার্কে জেটি নির্মাণের ফলে সবচেয়ে বড় যে সুফলটি পাওয়া যাবে তা হচ্ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। প্রকল্প চলাকালীন ও পরিচালন-উভয় পর্যায়েই স্থানীয় ও আশেপাশের বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। নির্মাণ শ্রমিক, নির্মাণসামগ্রী পরিবহন, নির্মাণ যন্ত্রপাতি পরিচালনা সর্বোপরি ইকো-ট্যুরিস্ট গাইড, বোটম্যান ও টার্মিনাল কর্মী হিসেবে কাজের সুযোগ পাবেন তারা।

 

ট্যুরিজম পার্কটি দূরবর্তী অঞ্চলে হলেও প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যটক ইকোলজিক্যাল রিসোর্স উপভোগের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। কিন্তু সেন্টমার্টিনে উন্নত জেটি সুবিধা না থাকা অনেক সময় সেটা সম্ভব হয় না। বর্তমানে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার আগে নাফ নদীতে অবস্থিত নদীবন্দরে পৌঁছাতে পর্যটকদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এরপর জাহাজ ও বোটের সাহায্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যেতে হয়। এখানে জীবনের ঝুঁকি থেকেই যায়। প্রস্তাবিত জেটিটি সেই ঝুঁকি প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনবে। এ ছাড়া বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে যাতায়াতের জন্য নাফ নদী ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না। প্রস্তাবিত জেটিটি নিশ্চিতভাবেই সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের যাতায়াতে ব্যাপক উন্নতি আনবে।

খুরুশকুলে আরসিসি জেটি নির্মাণ

পর্যটনের পাশাপাশি সামুদ্রিক মৎস্য ব্লু ইকোনমির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপখাত। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কক্সবাজারের খুরুশকুল এলাকায় একটি পর্যটন জেটির পাশাপাশি মৎস্যজীবীদের জন্যও একটি জেটি নির্মাণ করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ।

জেটি দুটি নির্মাণ করা হচ্ছে খুরুশকুল এলাকায় জলবায়ু উদ্বাস্তু এবং কক্সবাজার বিমানবন্দর আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের কারণে ভূমিহীন হওয়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসিত করার প্রকল্প খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে জেটিগুলো নির্মাণের লক্ষ্যে দুটি সম্ভাব্য স্থান বিবেচনায় নিয়ে আরসিসি জেটির ডিজাইন ও নকশা বিআইডব্লিউটিএ চূড়ান্ত করে। প্রস্তুতকৃত ডিজাইন ও নকশায় আছে পর্যটনের জন্য একটি বড় জেটি। মৎস্যজীবীদের ব্যবহারের জন্য রয়েছে আরেকটি ছোট জেটি।

পর্যটন জেটিতে স্পিড বোট বার্থিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই প্যাকেজের আওতায় দুটি আরসিসি জেটির পাশাপাশি যাত্রী ছাউনি, জেটিতে পানি সরবরাহ এবং বৈদ্যুতিক কাজও সম্পাদন করা হবে। পর্যটন জেটিটি সরিয়ে নিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে হারবারের মধ্যে। আগে যেখানে ২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারত এখন সেখানে ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। এ ছাড়া দুর্যোগকালীন সময়ে নৌবাহিনীর জাহাজও এখানে নোঙর করতে পারবে।

জেটিগুলোকে অধিকতর কার্যকর করতে কাজের পরিমাণে সংশোধন আনা হয়েছে। এতে পরিবর্তন এসেছে প্রাক্কলিত ব্যয়েও। আরসিসি জেটি-১ এ শুরুতে স্টেমের দৈর্ঘ্য ছিল ৬০ মিটার ও প্রস্থ ৫ মিটার। তা সংশোধন করে দৈর্ঘ্য করা হয়েছে ১৩০ মিটার এবং প্রস্থ ১০ মিটার। এতে করে আয়তন ১ হাজার ৬৫০ বর্গমিটার থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার বর্গমিটার।

একইভাবে বাড়ানো হয়েছে আরসিসি জেটি-২ এর কাজের পরিমাণও। শুরুতে জেটিটির দৈর্ঘ্য ৬০ মিটার ও প্রস্থ ৫ মিটার থাকলেও সংশোধনের মাধ্যমে তা যথাক্রমে ১৯০ মিটার ও ৫ মিটার করা হয়েছে। এতে করে আয়তন এক হাজার বর্গমিটার থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬৫০ বর্গমিটারে।

থাকছে প্রয়োজনীয় প্রশমন ব্যবস্থা

যেকোনো প্রকল্পেরই নির্মাণ পর্যায়ে পরিবেশগত নেতিবাচক কিছু প্রভাব থাকে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে জেটি নির্মাণ প্রকল্পও এর বাইরে নয়। তবে এই প্রভাবকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থাও রয়েছে। আর সেটা নির্ভর করে কতটা কার্যকর প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার ওপর।

প্রশমন ব্যবস্থা হিসেবে মিরসরাইয়ে জেটি নির্মাণকালীন সময়ে কনস্ট্রাকশন ক্যাম্প যতটা সম্ভব অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভেতরে রাখা হবে। এ ছাড়া অবকাঠামোটি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রী ও ভারী যন্ত্রপাতি যতটা সম্ভব নদীপথে আনার ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি নির্মাণকাজ যতটা সম্ভব কম সময়ে সম্পন্ন করা হবে এবং সাব-স্ট্রাকচার নির্মাণকালীন চ্যানেলের খুব কম এলাকা বন্ধ থাকবে। ভূমি অধিগ্রহণও যতটা পারা যায় কম করা হবে এবং তা হতে হবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর প্রতি ন্যায্যতার ভিত্তিতে। ভূমির মালিক উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ যাতে পান সেটা নিশ্চিত করা হবে।

জালিয়ার দ্বীপে অ্যাপ্রোচ রোড ও টার্মিনালের মতো আনুষঙ্গিক অবকাঠামো যাতে বন্যার পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত জেটি প্রকল্প এলাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ওপর যাতে কোনো ধরনের প্রভাব না ফেলে সেদিকে দৃষ্টি থাকবে।

টেকনাফের নাফ নদীর মোহনার বাস্তুতন্ত্র বিশেষ ধরনের এবং মোহনাটি মিয়ানমারের ইরাবতী ও আকিয়াব হিল অববাহিকা থেকে বিপুল পরিমাণ স্বাদু পানি পেয়ে থাকে। এ ছাড়া মোহনাটি মৎস্য সম্পদের জন্যও বিখ্যাত। ইলিশের একটি উপ-প্রজাতি নাফ মোহনার আত্মজ। পার্শ্ববর্তী বন হচ্ছে এশিয়ান এলিফ্যান্ট, বার্কিং ডিয়ার, ওয়াইল্ড বোর, বিন্টুরং, হগ ব্যাজার, লেপার্ড ক্যাট ও বন বিড়ালের সমৃদ্ধ আবাস। বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরও নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র এটি। পাশাপাশি কার্বন শোষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ এখানকার বিশেষ পরিচিতি। জেটি নির্মাণে এসবের ওপর যাতে নেতিবাচক প্রভাব সেভাবে না পড়ে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

প্রকল্প চলাকালীন ও বাস্তবায়ন শেষে পরিবেশগত মান নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত চলকগুলোর ওপর দৃষ্টি রাখা হবে। সেই সাথে জেটি নির্মাণকালীন সময়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি ও বিদ্যমান ব্যবহারকারীদের অসুবিধা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখতে উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকবে।

নির্মাণপ্রস্তাবিত জেটিটি পর্যটকরা কেবল জালিয়ার দ্বীপে পৌঁছানো ও পরিদর্শনের কাজে ব্যবহার করবেন। তাই জেটিটি স্থানীয়ভাবে নতুন

কক্সবাজারের খুরুশকুল এলাকায় পর্যটকদের জন্য প্রস্তাবিত জেটির স্থান

শিল্পের পত্তন বা বিদ্যমান শিল্পের সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। এই নিরিখে জেটির নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি আসছে না।

তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রকল্পটির ফলে নেতিবাচক যে প্রভাব দেখা দেবে ইতিবাচক প্রভাব হবে তার চেয়ে বহু গুণ বেশি। এ ছাড়া সঠিক

প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব। সেজন্য বেশ কিছু সুপারিশের কথা বলা হয়েছে, বাস্তবায়নকারী

সংস্থা হিসেবে

বিআইডব্লিউটিএ সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।

সোনাদিয়ায় জেটি অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে সরকারি খাস জমিতে। তাই কারো ব্যক্তিগত জমি হারানোর বিষয় এখানে নেই। এ ছাড়া জেটিটি কেবলমাত্র সোনাদিয়া দ্বীপ পরিদর্শনে ইচ্ছুক পর্যটকরা

ব্যবহার করবেন। তাই এর বাইরে ওই এলাকায় নতুন কোনো শিল্প কর্মকাণ্ড সৃষ্টি হবে না। তাই জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও হবে সীমিত। এর বিপরীতে ভবিষ্যতে শিল্প খাতের বিপুল সংখ্যক কর্মীর নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত হবে।

সাবরাং ইকোনমিক জোনেও জেটিসহ আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মিত হবে খাস জমিতে। তাই স্থানীয়দের ওপর ব্যক্তিগত জমি হারানোর প্রভাব পড়বে না। এ ছাড়া ওই এলাকার পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থার ওপরও এর কোনো প্রভাব নেই।

সম্ভাবনার আরও ক্ষেত্র

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলের বাইরেও পর্যটনে সহায়ত করতে চায় বিআইডব্লিউটিএ। সুন্দরবনের উপকূলীয় নৌ পর্যটনে আগে

থেকেই নৌপথে মার্কা, বয়া সহায়তা দিয়ে আসছে। জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে বায়ুবিদ্যুতের মতো গ্রিন পাওয়ার নিয়েও। প্রয়োজন হলে এবং সুযোগ থাকলে এক্ষেত্রেও সহায়তা দিতে প্রস্তুত কর্তৃপক্ষ।

শেষ কথা

ব্লু ইকোনমিকেন্দ্রিক এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে তার সুফল পর্যটকরা যেমন পাবেন, একইভাবে পাবেন সাধারণ জনগণও। এসব সুবিধাদি ব্যবহার করে তারা নৌপথে নিরাপদে যাতায়াতের সুযোগ পাবেন। সেই সাথে নৌযানের সংখ্যাও বাড়বে। অর্থাৎ, নৌবাণিজ্যের বড় একটি সুযোগ তৈরি হবে, যার ওপর ভর করে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া নৌপথ সবচেয়ে জ্বালানিদক্ষ ও পরিবেশবান্ধব পরিবহন মাধ্যম হওয়ায় কার্বন নিঃসরণও হ্রাস পাবে। সর্বোপরি পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমে আসবে।

আধুনিক ল্যান্ডিং সুবিধাদি প্রদানের মধ্য দিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করে ব্লু ইকোনমির অন্যতম খাত পর্যটন কার্যক্রমের প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে। প্রসার ঘটবে নৌপরিবহনকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের তথা সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের। উন্নত হবে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য। গোটা অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে হ্রাস পাবে বেকারত্ব। কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অপেক্ষাকৃত কম সময়ে ও সাশ্রয়ে পণ্য বাজারজাতের সুযোগ পাবেন, যা তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here