প্রাক-কথা
‘নদ-নদীর প্রবাহ সুপ্রাচীন কালে জলপথ নির্ণয় করিত, এখনও করে; নদীর খাত যখন বদলায় সঙ্গে সঙ্গে পথও বদলায়; খাত মরিয়া গেলে নতুন খাতে জলপ্রবাহ ছুটিয়া চলে, জলপথও তাহা অনুসরণ করে। সমুদ্রস্রোতে ও বিভিন্ন ঋতুর বায়ুপ্রবাহ প্রাচীনকালে সমুদ্রপথ নির্ণয় করিত; বাস্প-জাহাজ পর্বের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে ইহাই ছিল নিয়ম। বাংলাদেশেও তার ব্যত্যয় ঘটে নাই। (বাঙালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়)।’
ঐতিহাসিক কাল থেকে নদীমাতৃক এই বঙ্গদেশে স্থলপথ অপেক্ষা নদীপথেই যাতায়াত ও বাণিজ্য প্রশস্ততর ছিল। এ পথ প্রাগৈতিহাসিক পথ। এমনকি রেলপথে দ্রুত বাণিজ্য-সম্ভার যাতায়াতের যখন সূত্রপাত হয় তার আগ পর্যন্তও বাণিজ্যলক্ষ্মীর যাতায়াত অভ্যন্তরীণ নদীপথেই বেশি ছিল। সেকালে উত্তর ভারতের সাথে বঙ্গদেশের যে যোগাযোগ তা ছিল নদীপথেই, গঙ্গা-ভাগীরথী বেয়ে। বিভিন্ন জাতক কাহিনীর বয়ানে মধ্যপ্রদেশের বণিকরা বারাণসী বা চম্পা থেকে জাহাজে করে গঙ্গা-ভাগীরথীপথে প্রথমে তাম্ররলিপ্তি (বন্দর) আসতেন। সেখান থেকে বঙ্গপসাগরের কূল ধরে সিংহলে অথবা উত্তাল সমুদ্র অতিক্রম করে সুবর্ণভূমিতে নোঙর করতেন।
১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ ভারতে রেল যোগাযোগ চালু হওয়ার পর ধারাক্রমে যাতায়াত ও বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠতে থাকে এটি। তারও প্রাক-পর্বে সড়ক যোগাযোগের উত্থান। তারপরও ব্রিটিশ ভারতে এবং পাকিস্তান পর্বে আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্বে টান পড়েনি। পাকিস্তান ইকোনমিক সার্ভে, ১৯৬৯-৭০ এর তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৬৯-৭০ সালেও ২৪,০০০ কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে ৫,৪১৭ কিলোমিটার (৩,৩৫২ মাইল) স্থায়ীভাবে নাব্যতা ধরে রেখেছিল। স্বাভাবিকভাবেই যাত্রী ও কার্গো পরিবহন অভ্যন্তরীণ নৌপথের তাৎপর্যপূর্ণ হিস্যা ছিল। ১৯৭৫ সালের দিকেও মোট যাত্রী পরিবহনের ১৫ শতাংশ হতো অভ্যন্তরীণ নৌপথে।
পরিবহন মাধ্যম
বাণিজ্য লক্ষ্মী চলে মূলত দুটি পথে-জলে ও স্থলে। আজও তা আকাশপথ নির্ভর হয়নি। আকাশপথ হলো হাল আমলের। আর যাত্রী পরিবহনে জল, স্থল ও আকাশপথ-তিন মাধ্যমই প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে যাত্রী হোক বা পণ্য উভয় পরিবহনেরই সবচেয়ে প্রাচীন ও সাশ্রয়ী মাধ্যম হচ্ছে জলপথ, যা হাজার বছরের পুরনো। এর পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। আর তা হচ্ছে, মানুষের টিকে থাকার প্রয়োজনে পানি অপরিহার্য। তাই সভ্যতাও গড়ে উঠেছে পানিকে অর্থাৎ নদ-নদীকে ঘিরে। ঐতিহাসিক কাল থেকেই পানির কাছাকাছি সমাজের পত্তন ঘটেছে। স্থলের তুলনায় জলপথে দক্ষ ও সহজ পরিবহণ এর একটা কারণ। সেই থেকেই বিশ্বব্যাপী যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে নৌপথ।
জলপথ: স্থলে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াতের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পথঘাট ও যানবাহন। জলপথে সে দায় নেই। পালে হাওয়া লাগলে বাণিজ্য ভেসে চলে গন্তব্যের দিকে। রণতরী চলে শত্রু রাজ্য জয়ে, মানুষ যায় ভিন দেশে। এজন্য শুধু একটি সুবিধামত নদী প্রয়োজন। আর গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রের মতো বিপুল বক্ষা সুখদা নদী পেলে তো আর কথাই থাকে না। এই কারণেই ভারতীয় ভূখণ্ডের সমুদ্রযাত্রা, নৌকা ইত্যাদির কিছু কিছু উল্লেখ পাওয়া যায় সেই বৈদিক যুগে ও তার প্রাক্কালেও। দীর্ঘজীবী ঋষি শেষ জীবনে নৌ-চালক হয়েছিলেন। বেদাদী গ্রন্থে নৌকার উল্লেখ আছে। অথর্ব বেদে ‘ভিন্ন পোত’ অর্থাৎ ভগ্ন নৌকা-ডুবির সাথে রাজত্ব নষ্ট হওয়ার তুলনা করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, সমুদ্রযাত্রা, নৌচালনা বিষয়ে বৈদিক যুগের আর্যদের পারদর্শিতা ছিল।
প্রধান বাণিজ্য মাধ্যম হিসেবেই কেবল নয়, সেই মৌর্য যুগেই এই অঞ্চলের নৌবাণিজ্য যে শৃঙ্খলিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। এছাড়া মনুস্মৃতি ও অন্যান্য গ্রন্থেও নৌবাণিজ্য এবং শুল্ক ও রাজস্ব সংগ্রহের নানা নিদর্শন আছে। নৌপথে আমদানি পণ্যকে সেকালে আতিক্য (প্রবাস্য) বলা হতো। আর নৌবাণিজ্যের প্রধান ছিলেন নাবাধ্যক্ষ। জীর্ণপোতের সংস্কার, দুর্গত পোতের সহায়তা, বন্দরে পণ্য বোঝাই ও খালাস, জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে বন্দর রক্ষা ইত্যাদি বহুবিধ কাজের ভার ছিল নাবাধ্যক্ষ ও তার অধস্তনদের উপর। নদী পারাপারের জন্য নির্দিষ্ট ঘাট ছিল এবং পণ্যের ওজন ও মূল্য অনুযায়ী মাশুল পরিশোধ করতে হতো। নদী ও সাগরগামী পোতের আয়তন অনুযায়ী নাবিক নিযুক্ত করার নিয়ম ছিল। নদীর দুই তীরে জলরক্ষীরা নৌচলাচলের উপর নজর রাখতেন। বিদেশের পণ্য বন্দরে রাখার জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতো। রাজার নির্দেশে বিদেশি বণিকরা অনেক সময় বিশেষ সুবিধাও পেতেন। বাণিজ্য সম্পর্কিত এইসব বিধিবিধান সেই প্রাচীনকালেই গঙ্গা তীরবর্তী নদীবন্দরগুলোতে প্রযোজ্য ছিল।
সেন রাজাদের আমলেও বঙ্গের নৌ সেনা ও নৌবাণিজ্যের বিশেষ খ্যাতি ছিল। পাল ও সেন রাজাদের চতুরঙ্গ বলের মধ্যে একটি ছিল জলের বাহন নৌকা। উত্তরবঙ্গ অভিযানকালে রাজা রামপাল ভাগীরথীতে নৌসেতু বন্ধন করেছিলেন।
মধ্যযুগে অর্থাৎ মুঘল আমলেও বাংলার অনেক জায়গায় নৌ নির্মাণ কেন্দ্র গড়ে ওঠে। গঙ্গা ও তার অপরাপর শাখঅ নদীতে মুঘল শাসনামলে বড় পরিসরে পণ্য চলাচল জারি ছিল। সুবাদার ইসলাম খান সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরের পর নৌবাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে এই অঞ্চল। তবে রাজমহলেও নৌবাণিজ্যের খামতি ছিল না। সেবাস্টিয়ান মানরিকের (১৬২৯-৪৩) ভ্রমণকালেও সেখানকার বন্দরে কমপক্ষে দুই হাজার সওদাগরী নৌকা লেগে থাকতো। বিদেশি জাহাজ ও নৌকাকে স্থানীয় শুল্ক বিভাগে নিবন্ধিত হতো।
মানরিকের মতো ভ্যানলিন স্কোটান নামে এক ওলন্দাজ ব্যবসায়ীও বঙ্গের নৌবাণিজ্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। মানরিকে রাজমহলের কাছে গঙ্গার সাথে যুক্ত বহু খালপথের উল্লেখ করেন। ফরাসী পর্যটক বার্ণিয়েরও একইরকম অনেক কাটা খাল দেখেছিলেন। হয়তোবা নৌ চলাচলের জন্যই খালগুলো কাটা হয়েছিল।
মধ্যযুগে কলকাতার সাথে ঢাকার যোগাযোগের কয়েকটি নৌপথ ছিল। এগুলো হলো যমুনা নদী, ইছামতী ও সুন্দরবনের খাড়ি পথে খুলনা হয়ে, জলঙ্গী নদী হয়ে পদ্মাবক্ষে এবং চূর্ণী-মাথাভাঙ্গা নদী হয়ে পদ্মাবক্ষে। অনেক সময় গুন টেনে নদী পাড়ি দিতে হতো। তবে রাতের বেলায় নৌকা চলাচলের চল ছিল না।
১৮২৫ সালে বাস্পীয় পোত এদেশে নৌ যোগাযোগের নবযুগের সূচনা করে। এরপর থেকে মানুষ গতি ও সময়ের প্রয়োজনীয়তা প্রচ-ভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করল এবং নৌকা ক্রমশ অকেজো হয়ে পড়তে লাগলো। কলকাতার বাইরেও স্টিমার সার্ভিস চালু হতে থাকলো। যন্ত্রচালিত নৌযানের প্রসারে উত্তর-পশ্চিম, পূর্ববঙ্গ ও আসামে যাতায়াতের সময় অনেক কমে গেলো। অশোক কুমার বসু তার গঙ্গাপথের ইতিকথা গ্রন্থে লিখেছেন-‘‘বিংশ শতাব্দির প্রাক্কাল থেকে সবল বাষ্পীয় পোত বিপুলভাবে বংশ বৃদ্ধি করে দুর্বল মন্থরগতির পালতোলা জাহাজকে হটিয়ে দিলো। যেন ‘স্ট্রাগল ফর এক্সিস্ট্যান্স’ তত্ত্বটি এক্ষেত্রেও প্রমাণিত হলো। সভ্যতার ঊষাকাল থেকে যে জলযান সমুদ্র যাত্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য প্রায় অষ্টাদশ শতাব্দির শেষভাগ পর্যন্ত মানুষের পক্ষে অপরিহার্য ছিল, সে বিনা আড়ম্বরে কোন সময়ে যে বিদায় নিলো, কেউ জানতেও পারল না।’’
সময়ের সাথে সাথে পালতোলা জাহাজের আধিপত্য যেমন কমতে থাকে, একইভাবে নৌপথের বিকল্পও তৈরি হতে থাকে জোরেশোরে। তবে নদীপ্রধান দেশ হওয়ায় ব্রিটিশ পরবর্তী অখ- পাকিস্তানেও অভ্যন্তরীণ নৌপথই ছিল যোগাযোগ ও পরিবহনের আধিপত্যকারী মাধ্যম এবং সে সময়ও এ অঞ্চলে নৌ চলাচলের উপযোগী ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শিতা ও উদ্যোগে ভালোভাবেই বহমান ছিল এদেশের নদী ও নৌপথ। ৭৫ পরবর্তী সময়ে সে অবস্থা আর ধরে রাখা যায়নি। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে নৌযানের পালে নতুন করে হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। খননের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া নৌপথ জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। এই সরকারের আমলেই অর্থাৎ ২০২৪ সালের মধ্যেই ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালুর লক্ষ্যে কাজ চলছে।
অভ্যন্তরীণ নৌপথের স্থিতি: বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে হচ্ছে ৭০০ এর বেশি নদ-নদী। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে সংখ্যাটি ৪০৬। এগুলোই বাংলার ধমনী, শিরা-উপশিরা। এই ধমনী, শিরা-উপশিরা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বার্ষিক ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি ঘনমিটার পানি। আর ২৫০ কোটি টনের মতো পলি। আর এই বিশাল-বিস্তৃত প্রবাহের উপর দিয়ে যে নৌপথ তার দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে বর্ষা মৌসুমে নাব্য থাকে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার নৌপথ। তবে শুকনো মৌসুমে এ দৈর্ঘ্য নেমে আসে ৩ হাজার ৮৬৫ কিলোমিটারে।
১ দশমিক ৫ থেকে ৩ দশমিক ৯ মিটার গভীর এই নদীপথ দিয়েই প্রতি বছর পরিবাহিত হয় ৮ কোটি ৭৮ লাখ যাত্রী। বছরে ৫ কোটি ৮০ লাখ টন কার্গোও পরিবাহিত হয় অভ্যন্তরীণ এই নৌপথ দিয়ে। গভীরতার তারতম্যভেদে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। ৩ দশমিক ৬৬ থেকে ৩ দশমিক ৯৬ মিটার গভীর নৌপথকে ক্লাস-১ বা প্রথম শ্রেণির নৌপথ হিসেবে গণ্য করা হয়। ক্লাস-২ বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে রাখা হয় ২ দশমিক ১৩ থেকে ২ দশমিক ৪৪ এবং ৩ দশমিক ৬৬ মিটারের কম গভীর নৌপথকে। ২ দশমিক ১৩ মিটারের কম অর্থাৎ ১ দশমিক ৫২ থেকে ১ দশমিক ৮৩ মিটারের মধ্যে থাকলে সেই নৌপথকে ধরা হয় ক্লাস-৩ বা তৃতীয় শ্রেণির নৌ রুট। গভীরতা ১ দশমিক ৫২ মিটারের কম হলে সেটি ক্লাস-৪ বা চতুর্থ শ্রেণির নৌ রুট। বর্ষা মৌসুমে যে ছয় হাজার কিলোমিটার নৌপথ নৌযান চলাচলের উপযোগী থাকে তার ৪০ শতাংশ অর্থাৎ দুই হাজার ৪০০ কিলোমিটার চতুর্থ শ্রেণির। এছাড়া এক হাজার ৮৮৫ কিলোমিটার বা ৩২ শতাংশ তৃতীয় শ্রেণির, এক হাজার কিলোমিটার বা ১৭ শতাংশ দ্বিতীয় শ্রেণির এবং অবশিষ্ট ৬৮৩ কিলোমিটার বা ১১ শতাংশ প্রথম শ্রেণির নৌপথ।
বিস্তৃত এই অভ্যন্তরীণ নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায়িত্ব নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীভুক্ত সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)। এছাড়া বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন নৌযান পরিচালনা করে অভ্যন্তরীণ নৌপথে। আর নৌপথের নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ, পরিদর্শন এবং নৌযানের নিবন্ধন প্রদানের কাজটি করে থাকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আরেক সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তর। নিয়ন্ত্রণমূলক বিভিন্ন বিধিবিধান ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন বাস্তবায়নের দায়িত্বও অধিদপ্তরের উপরই ন্যাস্ত।
স্থলপথ: স্থলপথে পরিবহনের শুরুটা চাকা আবিস্কারের সময় থেকে। তাও এই এশিয়াতেই। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে মেসোপোটেমিয়ায়। চাকার ওপর ভর করেই পরবর্তীতে রথের আবির্ভাব। কালের পরিক্রমায় বাস্প ইঞ্জিন এবং তারও পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ডিজেল ইঞ্জিনের আগমন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় স্থল যোগাযোগ ও পরিবহনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যুগ। পর্যায়ক্রমে পরিবর্তনের এই ঢেউ লাগে বিশ্বের সব প্রান্তেই এবং আমাদের এই ভূখণ্ডেও।
স্থল যোগাযোগ ও পরিবহনের আবার তিনটি মাধ্যম-সড়ক, রেল ও পাইপলাইন। এর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত যোগাযোগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সড়ক পথ। সারাদেশে বর্তমানে মহাসড়ক ও জেলা সড়ক আছে ৩৮৩টি। এর মধ্যে শুধু সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের (আরএইচডি) ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ২১ হাজার ৫৯৬ কিলোমিটার সড়ক, যার ১৮ শতাংশ মহাসড়ক, ২০ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ৬২ শতাংশ জেলা মহাসড়ক।
দেশের সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক আরও উন্নত করতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। কিছু প্রকল্প শুরুর অপেক্ষায় এবং কিছু আছে পরিকল্পনার মধ্যে। এর মধ্যে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এলেঙ্গা-রংপুর মহাসড়কের কাজ চলছে। শুরুর অপেক্ষায় আছে ঢাকা-সিলেট, মদনপুর-জয়দেবপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এছাড়া আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ক এবং ফেনী-নোয়াখালী ও কুমিল্লা-নোয়াখালী জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজও চলমান রয়েছে। এর বাইরে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ এবং ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেস ওয়ের কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সম্পন্ন হয়েছে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের কাজও।
এছাড়া গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সংস্থাটির অধীনে কাঁচা-পাকা মিলে সড়ক রয়েছে মোট ৫৪ হাজার ২২১ কিলোমিটার। এর মধ্যে কাঁচা সড়ক ৩২ হাজার ৫০০ এবং পাকা সড়ক ২১ হাজার ৭২১ কিলোমিটার। গ্রামীণ অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন করছে এলজিইডি। আরএইচডি ও এলজিইডির অধীন বিপুল বিস্তৃত এই সড়কই এখন বাংলাদেশে পরিবহন ও যোগাযোগে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে।
রেলপথ: বিশ্বে রেল যোগাযোগের শুরুটা হয় ১৮২৫ সালে। আর অখ- ভারতে এর আবির্ভাব ১৮৫৩ সালে মুম্বাই ও থানের মধ্যে ৩৪ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। এরপর বাংলায় রেল যোগাযোগ চালু হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ১৮৫৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি নির্মিত হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেলপথ চালুর মধ্য দিয়ে ১৮৫৪ সালে বাংলায় প্রথম রেলযোগাযোগের সূত্রপাত হয়। ১৮৬২ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতা থেকে রাণাঘাট পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করে, পরবর্তীতে ১৮৬২ সালে যা দর্শনা থেকে জগতী পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ উন্মোচন করা হয়। সে সময় কুষ্টিয়া ছিল প্রান্তিক স্টেশন, কিন্তু ১৮৬৭ সালে পদ্মার ভাঙনের কারণে তা স্থানান্তরিত হয় গড়াই নদীর পাড়ে নেওয়া হয়। কুষ্টিয়া থেকে গোয়ালন্দ নদীবন্দর পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটার রেলপথ চালু করা হয় ১৮৭১ সালে। ১৮৭৪ থেকে ১৮৭৯ সালের মধ্যে ব্রিটিশ সরকার নর্থ বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে নামে একটি নতুন ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ মিটারগেজ রেলপথ স্থাপন করে। রেলপথটি পদ্মার বামতীর ঘেঁষে সারা থেকে চিলাহাটি হয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই লাইন পূর্বে পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া এবং পশ্চিমে পার্বতীপুর থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত দীর্ঘ। একই সময়ে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে দামুকদিয়া থেকে পোড়াদহ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন সংযোজন করে। এতে রেলওয়ে নিয়ন্ত্রিত স্টিমারের পক্ষে ফেরিতে পদ্মা নদী পারাপারে সুবিধা হয়।
পাট উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে ঢাকা ও ময়মনসিংহ থেকে কলকাতা বন্দরে পাট সরবাহের প্রয়োজনে ১৮৮৫ সালে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিমি দীর্ঘ মিটারগেজ রেললাইন স্থাপন করা হয়। ক্রমান্বয়ে এটিকে ময়মনসিংহ থেকে জামালপুর হয়ে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট এবং পরবর্তীকালে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ১৮৮৭ সালে আরও ভাল ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে নর্দান বেঙ্গল রেলওয়ে এবং ঢাকা স্টেট রেলওয়েসহ কাউনিয়া থেকে কুড়িগ্রাম (ধরলা) পর্যন্ত ন্যারোগেজের (৭৬২ মিমি) রেললাইনকে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে একীভূত করা হয়। একই কারণে ১৮৮২-৮৪ সালের মধ্যে সেন্ট্রাল রেলওয়ে নামে পরিচিত বনগাঁ-যশোর-খুলনা ব্রডগেজ রেললাইন এবং ১৮৯৯ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে শান্তাহার থেকে ফুলছড়ি (তিস্তামুখ ঘাট) পর্যন্ত ৯৪ কিমি মিটারগেজ লাইন চালু করা হয়েছিল।১৯০৫ সালে কাউনিয়া ও বোনারপাড়ার মধ্যে ৪৪ কিমি মিটারগেজ রেল লাইন চালু হয়। এভাবে ঢাকা এবং রাজশাহী বিভাগের ব্যাপক এলাকায় রেল যোগাযোগের বিস্তৃতি ঘটে। ১৯১৫ সালে পদ্মার উপর নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালু হলে রেল যোগাযোগে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ১৯৩০ সালে আব্দুলপুর থেকে আমনুরা পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইন নির্মিত হয়।
চা শিল্পও এ অঞ্চলে রেলযোগাযোগে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। চা বাজারজাত করার জন্য ১৯০২ সালে বেঙ্গল ডুয়ার্স ন্যারোগেজের রেলপথটি কাউনিয়ার উত্তরে নর্থ বেঙ্গলের কুচবিহার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে ১৯৪১ সালে প্রশাসনিক ভাবে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এর দক্ষিণাংশ বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের আওতায়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর বেঙ্গল-আসাম রেলওয়ে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান উত্তরাধিকারসূত্রে পায় ২,৬০৬ হাজার ৫৯ কিলোমিটার রেললাইন এবং তা ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে (ইবিআর) নামে পরিচিতি পায়। স্বাধীনতার পর এদেশের রেলওয়ের নতুন নাম হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে, যা উত্তরাধিকারসূত্রে ২,৮৫৮ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেলপথ ও ৪৬৬টি স্টেশন পায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে রেলওয়ে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেগুলো মেরামত করা হয়। ৭৫ পরবর্তী সময়ে লাভজনক না হওয়ার কারণ দেখিয়ে বেশ কিছু রেলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এই সরকারের সময়ে রেলওয়ে মহাপকিল্পনা ২০১০-২০৩০ এর আওতায় রেলপথ পুনর্জাগরণের নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৩ সালে প্রণীত মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট পলিসিতেও এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে হাতে নেওয়া হয় ২৩১টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে নতুন রেলপথ নির্মাণ, যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে রোলিংস্টক ক্রয়, বিদ্যমান রেলওয়ে স্টেশনগুলোর আধুনিকায়ন ও সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন। যাত্রী সেবার নিরিখে এর লক্ষ্যণীয় ফলাফলও পেয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ৪ হাজার ৪৩৮ দশমিক ৪০ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে দেশের রেলপথ। এর মধ্যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ১৫১ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার এবং পশ্চিমাঞ্চলে ২ হাজার ২৮৬ দশমিক ৬১ কিলোমিটার। তবে আর্থিক উন্নতিতে এখনও অনেক কিছু করার আছে।
আকাশপথ: পরিবহনের আধুনিকতম মাধ্যম হচ্ছে আকাশপথ, যার সূত্রপাত রাইট ব্রাদারদের হাত ধরে। সর্বপ্রথম আমেরিকা ও ইউরোপে এর বাণিজ্যিক চলাচল শুরু হয়। ২০ এর দশকের শেষ দিকে ও ৩০ এর দশকের গোড়ার দিকে উড়োজাহাজ নির্মাণ প্রযুক্তির অগ্রসরতায় ইউরোপ, আমেরিকার পাশাপাশি লাতিন আমেরিকাতেও আকাশপথে যোগাযোগের প্রসার ঘটে। পর্যায়ক্রমে তা বিশ্বের সব প্রান্তিকেই ছুঁয়ে যায়।
ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সালে গঠিত হয় ডিপার্টমেন্ট অব সিভিল এভিয়েশন অব পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে বেসামরিক উড়োজাহাজ পরিচালনার দায়িত্বে ছিল তারাই। স্বাধীনতার পরপরই প্রায় শূন্য হাতে যাত্রা আরম্ভ করে ডিপার্টমেন্ট অব সিভিল এভিয়েশন (ডিসিএ)। অ্যারোড্রম ও বিমানবন্দর নির্মাণ এবং ডিসিএর পক্ষে ইলেক্ট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল কাজগুলো করতে ১৯৬৫ সালে গঠিত এয়ারপোর্টস ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (এডিএ)। ১৯৮২ সালে এই দুই প্রতিষ্ঠান একীভূত হয়ে গঠিত হয় বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ। ১৯৮৫ সালে এক অধ্যাদেশের এটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা ক্ষমতা পায়। সংস্থাটিই বেসামরিক বিমান পরিবহন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আছে।
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ ও পর্যটন খাতের প্রসারে গত দুই দশকে আকাশপথে ভ্রমণের চাহিদায় উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিক, সাতটি অভ্যন্তরীণ ও দুইটি শর্ট টেক-অফ অ্যান্ড ল্যান্ডিং (এসটিওএল) বন্দর রয়েছে। এর মধ্যে আটটি বিমানবন্দর সচল আছে, যার মধ্যে পাঁচটি অভ্যন্তরীণ। প্রতি বছর গড়ে ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে আকাশপথে যাত্রী পরিবহন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের আকাশপথে মোট ১ কোটি ৩০ লাখ ৯০ হাজার যাত্রী ও ৪ লাখ ১২ হাজার টন কার্গো পরিবাহিত হয়েছে। দেশের বিমানবন্দরগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ২৬০টি ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। বেসরকারি খাতের জন্য আকাশপথ উন্মুক্ত করে দেওয়ায় ফ্লাইট ও সেবার মান উভয়েই বেড়েছে।
মোডাল শেয়ার
সড়ক পরিবহন বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হলেও এতে জায়গার প্রয়োজন পড়ে অনেক বেশি। সড়কে যানবাহন ও অবকাঠামো উভয়েরই রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। তবে স্বল্প দূরত্বের ক্ষেত্রে সড়কপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন খরচ তুলনামূলক কম পড়ে। ভারী শিল্প তাদের পণ্য পরিবহনের জন্য সাধারণত রেলযোগাযোগের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। সড়ক ও মেরিটাইম রুটের সাথেও সাধারণত রেল সংযোগের ব্যবস্থা থাকে। আকাশপথে পরিবহনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। এছাড়া একটি বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য কমপক্ষে ৩ হাজার ৩০০ মিটার রানওয়ের প্রয়োজন পড়ে। সেই হিসাবে দূরবর্তী গন্তব্যে বৃহৎ পরিসরে পণ্য পরিবহনে নৌপথ হচ্ছে সবচেয়ে আদর্শ। তবে নৌপথে পরিবহনে উচ্চ হারে টার্মিনাল খরচ পড়ে। কারণ, বন্দর অবকাঠামো নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা বেশ খরচসাপেক্ষ।
এই বঙ্গে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের বড় অংশই হতো অভ্যন্তরীণ নৌপথে। ১৯৭৫ সালেও মোট যাত্রী পরিবহনের ১৬ শতাংশ ছিল অভ্যন্তরীণ নৌপথে। পরের দিকে তা কমে আসতে থাকে এবং ১৯৯৬ সালে তা নেমে আসে ১৫ ও ২০০৫ সালে ৮ শতাংশে। একইভাবে ৭০-এর দশকে কার্গো পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথের হিস্যা ছিল ৩৭ শতাংশ এবং ২০০৫ সালে তা নেমে আসে ১৬ শতাংশে। এর বিপরীতে যাত্রী ও কার্গো পরিবহনে সড়কপথের হিস্যা ২০০৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮৮ ও ৮০ শতাংশে।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে অবশ্য কার্গো পরিবহনের সামান্যই অভ্যন্তরীণ নৌপথে হয়ে থাকে। সেখানে পণ্য পরিবহন সড়কনির্ভর। স্ট্যাটিস্টার হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতে মোট কার্গো পরিবহনের ৬৪ শতাংশই সম্পন্ন হয়েছিল সড়কপথে। সড়কপথের আধিপত্যে রেলপথে পণ্য পরিবহনও সময়ের পরিক্রমায় কমে এসেছে। ১৯৫০-এর দশক থেকেই ভারতে পণ্য পরিবহনে রেলপথের হিস্যা ধারাবাহিকভাবে কমছে এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ২৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে উপকূলীয় নৌযানে পণ্য পরিবহন হয়েছে ৫, অভ্যন্তরীণ নৌপথে ২ এবং পাইপলাইনে ২ শতাংশ পণ্য। তবে পরিবেশ ও খরচের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ভারতও এখন অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনের ওপর জোর দিচ্ছে এবং নতুন নতুন জাতীয় নৌরুট চালু করছে। বর্তমানে দেশটিতে সাড়ে ১৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ নৌপথ রয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ২০০ কিলোমিটার নদী এবং ৪ হাজার কিলোমিটার ক্যানেলে যন্ত্রচালিত নৌযান চলাচল করতে পারে।
তবে অভ্যন্তরীণ নৌপথ সবচেয়ে সফলভাবে কাজে লাগাচ্ছে চীন। দেশটিতে পণ্য পরিবহনের সিংহভাগই হয় অভ্যন্তরীণ নৌপথে। এর কারণ মূলত নৌপথ ব্যবহারে দেশটির সুদীর্ঘ ইতিহাস। খ্রিষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে তারাই সর্বপ্রথম নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং খ্রিষ্টপূর্ব ২১৪ অব্দে ইয়াংজি ও ঝুজিয়াং নদীকে সংযোগকারী ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খনন করে তারা। চীনে রয়েছে ৫০ হাজারের মতো প্রাকৃতিক নদী ও ৯০০ হ্রদ। বিপুল বিস্তৃত এই নদী ও হ্রদের সুবাদে দেশটিতে অভ্যন্তরীণ নৌপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে সাকুল্যে ১ লাখ ২৬ হাজার ৩০০ কিলোমিটার।
বিশাল এই নৌপথের সুবাদে চীনে মোট পণ্য পরিবহনের ৫১ শতাংশ হয়ে থাকে নৌপথে। এছাড়া ৩৪ শতাংশ পণ্য পরিবাহিত হয় সড়কপথে ও ১৫ শতাংশ রেলপথে। চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের বরাত দিয়ে এমন উপাত্তই দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
রাশিয়ায় আছে ৫ লক্ষ কিলোমিটার নৌপথ, যার মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার কিলোমিটারে নিয়মিত যন্ত্রচালিত নৌযান চলাচল করতে পারে। এই নৌপথের মধ্যে ৮৪ হাজার কিলোমিটার পথে চার মিটার গভীর থাকে। এত বেশি নাব্য থাকার কারণে বড় ড্রাফটের জাহাজও অনায়াসে অভ্যন্তরীণ এই নৌপথে চলাচল করতে পারে। এতে ট্রান্সশিপমেন্টের ঝক্কি অনেকটাই কমে গেছে। নাব্য ও বিস্তৃত অভ্যন্তরীণ নৌপথের কারণে রাশিয়ায় প্রতি বছর প্রায় ৬৮ কোটি ৫০ লাখ টন পণ্য এই পথে পরিবাহিত হয়।
ফ্রান্সে রয়েছে ৬৪ হাজার কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ নৌপথ এবং এর খ্যাতি বহুকাল ধরেই। বৈজ্ঞানিক উপায়ে রাইন নদীর যথেষ্ট উন্নতি করা হয়েছে। নদীটিতে এখন সারা বছর ২ দশমিক ৭৫ মিটার গভীরতা থাকে। রাইনের শাখানদী মেইনকেও ক্রমাগত ড্রেজিং করে গভীর করা হয়েছে। রাইনের প্রচুর খাল এখন জার্মানিকে সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের সাথে যুক্ত করেছে। রোমানিয়ার দানিয়ুবকে কৃষ্ণসাগরের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ হাজার কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ নৌপথে নিয়মিত পণ্য পরিবাহিত হয়। মিসিসিপির নৌপথের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে সেখানে আধুনিক বড় বড় বার্জ পণ্য নিয়ে দূরপাল্লায় নিত্য আসা-যাওয়া করে।
অভ্যন্তরীণ নৌপথই বেশি ব্যয়সাশ্রয়ী
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কার্যক্রম সাধারণত তিনভাবে পরিচালিত হয়ে থাকেÑজাতীয়, স্থানীয় এবং ফেরি। জাতীয়ভাবে বন্দর ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে নিয়মিত রুটে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন হয়। এ ধরনের ট্রিপ মধ্যম থেকে দূরপাল্লার হয়ে থাকে এবং পণ্যের পরিমাণ ও যাত্রীর সংখ্যাও বেশি হয়। এসব রুটে ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ যাত্রী এবং ২০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টন ধারণক্ষমতার নৌযান চলাচল করে।
স্থানীয় পরিবহন সাধারণ স্বল্পপাল্লার ও কম ধারণক্ষমতার নৌযান দিয়ে পরিচালিত হয়। এ ধরনের রুটে যাত্রীর চাহিদাই মূলত বেশি থাকে। তবে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের পণ্য পরিবহনও হয় এসব রুটে। এ ধরনের ট্রিপ হয় সাধারণ ১০০ যাত্রী ১০০ টন পণ্য ধারণক্ষমতার কান্ট্রি বোট দিয়ে। নদীর ওপর যেখানে সেতু নেই সেখানে সড়কের সাথে সংযোগের জন্য ফেরি পরিচালনা করা হয়। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থার চেয়ে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার সাথেই এটি বেশি সম্পৃক্ত।
অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন পরিবেশবান্ধব এবং অনেক বেশি ব্যয়সাশ্রয়ী। বিশ্বেব্যাংকের ২০০৭ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, রেলের ট্যারিফ হার সবচেয়ে কম থাকা সত্ত্বেও দূরত্বের কারণে প্রকৃত ব্যয় অভ্যন্তরীণ নৌপথের চেয়ে বেশি হয়। আর পণ্য পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ট্যারিফ হারই অন্য সব মাধ্যমের তুলনায় কম।
অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয় এক টাকারও কম। একই পরিমাণ পণ্য একই দূরত্বে পরিবহনে সড়কপথে খরচ পড়ে যেখানে সাড়ে ৪ টাকা এবং রেলপথে ২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪ টাকা। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক হিসাব করে দেখিয়েছিল, ১২ টন ধারণক্ষমতার ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে প্রতিটি কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া সড়কপথে ১২ হাজার টাকা ও রেলপথে ৬ হাজার টাকা। একই পণ্য অভ্যন্তরীণ নৌপথে পরিবহন করলে ভাড়া দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০০ টাকা। এটাই এখন বিভিন্ন পরিবহন মাধ্যমে পণ্য পরিবহন ব্যয়ের তুলনামূলক সর্বশেষ গবেষণা। এরপর ভাড়ার হার বাড়লেও মাধ্যমগুলোর মধ্যকার ব্যয়ের ব্যবধান মোটামুটি একই রকম আছে। ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় বেশি প্রতিযোগী সক্ষম হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে সড়কপথে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয় ২ দশমিক ২৮ রুপি। একই পরিমাণ পণ্য একই দূরত্বে রেলপথে পরিবহনে খরচ হয় ১ দশমিক ৪১ রুপি। এই দুই মাধ্যমের তুলনায় কম খরচ পড়ে একই পণ্য অভ্যন্তরীণ নৌপথে পরিবহন করলে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ভারতে অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় ১ দশমিক ১৯ রুপি।
নিচের সারণিতে দুটি রুটে সড়ক, রেল ও নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের তুলনামূলক চিত্র দেখানো হলো :
প্রোডাক্টিভিটিও বেশি নৌপথে
মোট ধারণক্ষমতার অনুপাতে প্রকৃত চাহিদার শতকরা হারকে ইউটিলাইজেশন রেশিও বা উপযোগ অনুপাত বলা হয়। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থায় এ হার সবচেয়ে বেশি। যাত্রীবাহী নৌযানের ক্ষেত্রে এ হার ৮৩ শতাংশ। যদিও সব সময় এ হার একই রকম থাকে না। ছুটির মৌসুমগুলোতে অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী পরিবহনে ইউটিলাইজেশন রেশিও বেশি হয়ে থাকে। তবে কার্গো পরিবহনের ক্ষেত্রে ইউটিলাইজেশন রেশিও তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। আবার এক প্রান্তে হারটা এক রকম এবং আরেক প্রান্তে অন্য রকম হয়ে থাকে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাত মাসে নাব্যতা কমে যাওয়ায় কিছু রুটে পণ্যবাহী নৌযানের উৎপাদনক্ষমতা লক্ষণীয় হারে হ্রাস পায়। তার পরও যাত্রী ও কার্গো পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি প্রোডাক্টিভিটি সড়কপথের তুলনায় নৌপথে অনেকটাই বেশি। তবে কিলোমিটারপ্রতি প্রোডাক্টিভিটি সবচেয়ে বেশি রেলপথে।
আরও যেসব সুবিধা
সবুজ অর্থনীতি শব্দবন্ধ এখন আর দূরবর্তী কিছু নয়। উন্নত ও উন্নয়নশীলÑসব দেশেরই এটা কাক্সিক্ষত লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য অর্জনে জোর দেওয়া হচ্ছে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের দিকে। এজন্য প্রয়োজন জ্বালানি দক্ষতা অর্জন। কারণ, কার্বন নিঃসরণে এর কোনো বিকল্প নেই। পরিবহনের মাধ্যম বিবেচনায় নিলে অভ্যন্তরীণ নৌপথ এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। পরিবহনের সবগুলো মাধ্যমের মধ্যে অভ্যন্তরীণ নৌপথ সবচেয়ে বেশি জ্বালানি দক্ষ। গবেষণার তথ্য বলছে, সড়কপথে প্রতি লিটারে জ্বালানি পুড়িয়ে পণ্য পরিবহন করা যায় ২৪ টন/কিলোমিটার। একই পরিমাণ জ্বালানি পুড়িয়ে রেলপথে পণ্য পরিবহন করা যায় ৮৫ টন/কিলোমিটার। অথচ সমপরিমাণ জ্বালানির সাহায্যে ১০৫ টন/কিলোমিটার পণ্য পরিবহন করা সম্ভব অভ্যন্তরীণ নৌপথে। জ্বালানি খরচ কম হওয়ার অর্থ হলো কার্বন নিঃসরণ সীমিত রাখা। সেই সাথে পরিচালন ব্যয়ও অনেক কমে আসে।
বিশ্বব্যাংকের ২০০৭ সালের হিসাবে, সড়কের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করলে বছরে ৫ কোটি ৮৫ লাখ লিটার ডিজেল সাশ্রয় করা সম্ভব। এর ফলে বছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হবে। তবে কান্ট্রি বোটগুলোতে গিয়ারবক্স সংযুক্ত করা গেলে বছরে আরও প্রায় ১০ কোটি লিটার ডিজেল সাশ্রয় করা সম্ভব, যার ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদন কমবে ২ লাখ ৬০ হাজার টন। দেশের নৌপথগুলোতে সাড়ে সাত লাখের মতো কান্ট্রি বোট চলাচল করে। এর মধ্যে সাড়ে ৪ লাখের বেশি যাত্রী পরিবহনে এবং অবশিষ্টগুলো পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। এগুলোসহ অভ্যন্তরীণ অন্যান্য নৌযান সারা বছর যে পরিমাণ ডিজেল ব্যবহার করে তা দেশে মোট ব্যবহৃত ডিজেলের ১৩ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশে ট্রাকে প্রতি টন পণ্য ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পরিবহন করতে যে পরিমাণ জ্বালানি প্রয়োজন হয়, একই পরিমাণ জ্বালানিতে প্রতি টন পণ্য রেলপথে ৩০০ কিলোমিটার এবং অভ্যন্তরীণ নৌপথে ৩৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত পরিবহন করা যায়।
জ্বালানি দক্ষতার পাশাপাশি বৈশ্বিকভাবেই অভ্যন্তরীণ নৌপথের মূলধনি বিনিয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় পরিবহনের অন্য মাধ্যমগুলোর চেয়ে অনেক কম। ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটি অব ইন্ডিয়া ২০০৮-০৯ সালে এক হিসাবে দেখিয়েছে, চার লেন মহাসড়ক ও রেলপথ নির্মাণে যে ব্যয় হয় অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়নে মূলধনি বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে তার মাত্র ৫-১০ শতাংশ। এছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌপথের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হয় সড়কপথের ২০ শতাংশের মতো।
একই কথা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সমানভাবে এমনকি বেশি করে প্রযোজ্য। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, বাংলাদেশে সড়কের পরিবর্তে নৌপথে কার্গো পরিবহন করলে প্রতি বছর সাশ্রয় হয় প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরে সংরক্ষণ খননে ১৭৪ কোটি টাকা ব্যায় হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৬০ কোটি টাকা বাজেট প্রাপ্ত হয়।
দারিদ্র্য হ্রাসের অন্যতম শর্ত হচ্ছে যোগাযোগের সহজগম্যতা। সেদিক থেকে বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে অভ্যন্তরীণ নৌপথের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বা ১২ দশমিক ৩ শতাংশের যোগাযোগের সুযোগ রয়েছে কেবল নৌপথের মাধ্যমে। স্বাভাবিকভাবে অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগের প্রাপ্যতার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে তাদের জীবনযাত্রার ওপর। অন্যদিকে সড়কের দুই কিলোমিটারের মধ্যে বাস করে মাত্র ৩৭ শতাংশ পরিবার।
আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়ানোর সুযোগ
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার পললভূমিতে গড়ে ওঠা এই বদ্বীপে নদীই হচ্ছে পরিবহনের প্রাচীনতম মাধ্যম। এক সময় এ অঞ্চলে মোট যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ৭০ শতাংশই সম্পাদিত হতো নদীপথে। এখন ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। যদিও উপমহাদেশের পূর্বাংশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পারে ইস্টার্ন ওয়াটারওয়েজ গ্রিড। এর সুফল পাবে এই অঞ্চলের ৬০ কোটি মানুষ। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
ইন্দো-বাংলাদেশ প্রটোকল রুটগুলো (আইবিপি) রয়েছে এই গ্রিডের আওতায়। বর্তমানে ১০টি রুট ইন্দো-বাংলাদেশ প্রটোকল ফর ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেডের আওতায় রয়েছে। এই রুটগুলো ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে দ্রুত ও সাশ্রয়ে পণ্য পরিবহন করছে নয়াদিল্লি। এর সুবিধা কেবল ভারতই যে পাচ্ছে এমন নয়। একইভাবে সুফলভোগী হচ্ছে বাংলাদেশও। প্রটোকল রুটগুলো একদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে ভারতের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ সহজ করছে, অন্যদিকে বন্দর মাশুল, কার্গো হ্যান্ডলিং ও অন্যান্য সেবা প্রদানের মাধ্যমে রাজস্ব পাচ্ছে বাংলাদেশও। স্থল পরিবেষ্টিত নেপাল ও ভুটানও নৌপথের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চাইছে। নৌপথ ব্যবহার করে তারা সহজেই বাংলাদেশ ও ভারতে পণ্য পরিবহনে আগ্রহী। সেই সাথে সমুদ্রবন্দরও ব্যবহার করতে চায় তারা। ভুটানতো ইতোমধ্যেই অভ্যন্তরীণ নৌপথে বাংলাদেশ নির্মাণসামগ্রী রপ্তানিও করেছে।
অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহন এক-পঞ্চমাংশ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ইস্টার্ন ওয়াটারওয়েজ গ্রিড উপমহাদেশের পূর্বাংশের বাণিজ্যের উল্লম্ফনে ভূমিকা রাখবে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র শিল্প তুলার মতো কাঁচামাল অভ্যন্তরীণ নৌপথে ভারত থেকে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে আমদানির সুযোগ পাবে। একই পথে ভারতের বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজারে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য প্রবেশও সহজ হবে। গঙ্গার পথ ধরে পণ্যবাহী নৌযান এলাহাবাদ ও বারাণসী পর্যন্তও পৌঁছতে পারবে।
বাড়তে পারে প্রবৃদ্ধিতে অবদান
অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগের বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এর সুফল পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় অভ্যন্তরীণ নৌপথের অবদান সম্ভাবনার তুলনায় পিছিয়ে আছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে স্থির মূল্যে বাংলাদেশের জিডিপিতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের অবদান ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ হলেও নৌপথের হিস্যা ১ শতাংশেরও কম, দশমিক ৬৬ শতাংশ। এছাড়া সার্বিকভাবে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত প্রতি বছর ৫-৭ শতাংশ হারে বাড়লেও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের প্রবৃদ্ধি ২০২০-২১ অর্থবছরের আগ পর্যন্তও ৩ শতাংশের ঘরে আটকে ছিল। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে নৌপরিবহন খাতে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে নৌপরিবহন খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। যদিও আগের অর্থবছরে এ হার আরও কম ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নৌপরিবহন খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পক্ষান্তরে ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থল পরিবহনের প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। উল্লেখ করার মতো প্রবৃদ্ধিতে আছে আকাশ পরিবহন খাতও।
নৌপরিবহন খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়লে স্থির মূল্যে জিডিপিতে খাতটির হিস্যা এখনো ১ শতাংশে পৌঁছায়নি। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে খাতটির হিস্যা দশমিক ৬৬ শতাংশে আটকে আছে। যদিও মোট দেশীয় উৎপাদনে স্থল পরিবহনের হিস্যা আগেই ৭ শতাংশ পেরিয়ে গেছে। সর্বশেষ দুই অর্থবছরে এ হার দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৯১ ও ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে।
বাড়ছে বিনিয়োগের চাহিদা
যাত্রী ও কার্গো পরিবহনে সড়কপথের হিস্যার বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে এ খাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ। যোগাযোগ অবকাঠামোয় যে বাজেট বরাদ্দ তার ৪৫ শতাংশের বেশি পাচ্ছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। ২০ শতাংশের বেশি যাচ্ছে রেলওয়েতে। এই সরকারের আমলে নৌপথে বিনিয়োগ বাড়লেও তা বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটে যোগাযোগ অবকাঠামোয় মোট বরাদ্দের ২ শতাংশের কম। গত কয়েক বছরে পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামোয় মন্ত্রণালয় ও বিভাগভিত্তিক বরাদ্দের দিকে দৃষ্টি দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
যদিও যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়নে সরকার ব্যাপক জোর দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই অভ্যন্তরীণ নৌপথের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অন্য রকম গতি এসেছে। সরকারের এই মেয়াদের মধ্যেই ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সাথে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগের বিদ্যমান অবকাঠামোর আধুনিকায়ন ও নতুন অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। এছাড়া নতুন নৌপথ চালু ও বিদ্যমান নৌপথের নাব্যতা উন্নয়নে প্রতি বছরই ক্যাপিটাল ও মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং বাড়ছে।
অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের কারণে কর্মকা-ের পাশাপাশি প্রতি বছরই বাড়ছে বিআইডব্লিউটিএর উন্নয়ন বরাদ্দের চাহিদা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যেখানে সংস্থাটির উন্নয়ন বরাদ্দের চাহিদা ছিল দেড় হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, চলতি অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে তার আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকায়। উন্নয়ন কর্মকা- সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ। তা হচ্ছে কিনা গত কয়েক অর্থবছরে বিআইডব্লিউটিএর চাহিদা ও বরাদ্দের পরিসংখ্যান দেখলেই তা প্রতীয়মান হবে।
শেষ কথা
বর্তমান সরকারের এই মেয়াদে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালুর যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নে আগামীতে আরও বেশি ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে। আধুনিকায়ন করতে হবে নদীবন্দরসহ অন্যান্য অবকাঠামোর। নজর দিতে হবে কনটেইনার হ্যান্ডলিং উপযোগী নদীবন্দর তৈরির। আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নদীবন্দর নির্মাণের মধ্য দিয়ে তা শুরুও হয়েছে। এজন্য প্রয়োজন পড়বে উন্নয়ন খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর। এটা হলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের হিস্যা ও প্রবৃদ্ধি উভয়েই বাড়বে। কারণ অভ্যন্তরীণ নৌপথই এখন পর্যন্ত পরিবহনের সবচেয়ে সাশ্রয়ী মাধ্যম। এখন প্রয়োজন নাব্য ও নিরাপদ করে অভ্যন্তরীণ নৌপথকে ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলা। সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে সরকার।