বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুধবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
18 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

নদীপথে কনটেইনার পরিবহনের বড় আয়োজন

নদীবাংলা ডেস্ক,

প্রাক-কথন

১৯৫৬ সালের ২৬ এপ্রিল নিউইয়র্কের আবহাওয়া মোটেই প্রসন্ন ছিল না। একটানা না হলেও হিমশীতল বৃষ্টি ছিল দিনভর। বিকালের দিকে পারদ কিছুটা চড়লেও ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের ওপর উঠতে পারেনি। আপার ম্যানহাটনের পোলো গ্রাউন্ডে নিউইয়র্ক জায়ান্টস ও ব্রুকলিন ডজার্সের মধ্যকার নির্ধারিত বেজবল ম্যাচটি তাই বাতিল হয়ে যায়। বিনোদন প্রত্যাশী নিউইয়র্কারদের আপাত ঠিকানা হয় চার দেওয়াল। অনেকেই মুভি থিয়েটারে ঢুঁ মারেন। বাকি চোখগুলো ছিল টেলিভিশনের পর্দায়।

অর্ধ-শতাব্দী আগে এপ্রিলের সেই দিনটিতে রাজনৈতিক অঙ্গনের দুটি ঘটনা বড় হয়ে ওঠে। একটি ছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকানদের প্রার্থী ঘোষণা। আরেকটি প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার প্রস্তাবিত সড়ক নির্মাণ কর্মসূচি নিয়ে প্রতিনিধি পরিষদে দ্বিদলীয় চুক্তি স্বাক্ষর।

নিউইয়র্কের নৌপথ দিয়ে বন্দরে যাত্রী ও কার্গোবাহী জাহাজগুলোর আগমন-নির্গমন চলছিল স্বাভাবিক নিয়মেই। তুলনামূলক কম জৌলুসপূর্ণ নিউইয়র্ক হারবারে বিভিন্ন আকৃতির ৩০টি বা তার বেশি জাহাজ সেদিন ভিড়েছিল। কোনোটা এসেছিল আরুবা থেকে, কোনোটা জিব্রাল্টার থেকে, কেনোটা আবার পাল তুলেছিল হামবুর্গ থেকে। ইয়োকোহামা, ম্যানিলা, লা হাভরে, হাভানার উদ্দেশেও ছেড়ে গিয়েছিল দুই ডজনের মতো জাহাজ। নিউইয়র্কের জন্য আনা পণ্যগুলো খালাসে মনোযোগের সবটা দিয়ে কাজ করছিলেন জাহাজকর্মীরা। অন্য সব দিনে যেমনটা হয়। সাত দশক আগের বৃষ্টিবহুল ও মেঘাচ্ছন্ন ওই দিনটিতে সমুদ্র পরিবহনের ইতিহাসে নতুন কিছু একটা যে ঘটতে যাচ্ছে কেউ-ই তেমন একটা আঁচ করতে পারেননি। রুটিন যাত্রার মতোই টেক্সাসের হিউস্টনের উদ্দেশে ছেড়ে যায় টি-২ ট্যাঙ্কার। ভিন্ন নামে; আইডিয়াল এক্স। তবে আইডিয়াল এক্স টেক্সাসে বাড়তি পেট্রোলিয়াম বোঝাই করতে যাওয়া আর দশটা খালি ট্যাঙ্কারের মতো ছিল না। নিউয়ার্ক বের দিকে যাত্রা করে যখন কিল ভ্যান কালে পৌঁছায় তখন ৫৪টি আনকোরা নতুন ট্রেইলার ট্রাক স্পার ডেকে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়। ট্রেইলার ট্রাকের সমুদ্র যাত্রা যে এবারই নতুন, তেমন নয়। যা নতুন তা হলো আইডিয়াল এক্সের ট্রাকগুলো সাধারণ অর্থে ট্রাক ছিল না। সেগুলো ছিল কনটেইনারবক্স যার মধ্য দিয়ে সূচনা হয় সমুদ্রপথে আধুনিক কনটেইনার পরিবহনের যাত্রা, ম্যালকম ম্যাকলিনের হাত ধরে।

আশির দশক পর্যন্ত এসব কনটেইনারবাহী জাহাজের আগমন-নির্গমন ছিল উন্নত দেশের বন্দরগুলো কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের বন্দরে ভিড়ত মূলত প্রথাগত জেনারেল কার্গো জাহাজ। ১৯৮৫ সালেই বিশ্বব্যাপী কনটেইনার পরিবহন সাড়ে ৫ কোটি টিইউজে উন্নীত হয়, যার ৭০ শতাংশেরই গন্তব্য ও উৎস ছিল উন্নত দেশের সমুদ্রবন্দরগুলো। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে মানিয়ে নিতে বিশেষায়িত জাহাজ বিশেষ করে কনটেইনার জাহাজ ছাড়া যে উপায় নেই সেই উপলব্ধি তৈরি হয় সত্তরের দশকেই। এশিয়ায় কনটেইনার পরিবহনও শুরু হয় ওই সময়ই। আর বাংলাদেশের কনটেইনার যুগে প্রবেশ ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে। এরপর থেকেই কনটেইনার পরিবহনে উড্ডয়নের পর্ব। ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরেই বাংলাদেশে কনটেইনার ট্রাফিক ৫০ হাজার টিইউজে উন্নীত হয়। শুরুর দিকে আমদানি কনটেইনারের সিংহভাগই আসত চট্টগ্রাম বন্দরে। তবে রপ্তানি কনটেইনারের উল্লেখযোগ্য অংশ পরিবাহিত হতো মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে এবং তা ছিল মূলত পাট।

প্রথম এক দশকে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কনটেইনার হ্যান্ডলিং খুব বেশি না হলেও প্রবৃদ্ধি ছিল ঈর্ষণীয়। ১৯৮২ সালে দেশে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় মাত্র ৫ হাজার ৯০০ টিইউজ। এটা ৫ লাখ টিইউজে উন্নীত হতে সময় নেয় মাত্র ছয় বছর। ১৯৮৭ সালেই ৫ লাখ ৭ হাজার টিইউজ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর। অর্থাৎ, পাঁচ বছরের ব্যবধানে কনটেইনার পরিবহন বৃদ্ধি পায় ৮ হাজার ৪৯৩ শতাংশ। আর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৩ থেকে ১২৫ শতাংশ। বর্তমানে শুধু চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়েই কনটেইনার পরিবহন হচ্ছে বছরে ৩০ লাখ টিইউজের বেশি।

একটা লম্বা সময় পর্যন্ত সমুদ্রবন্দর ও হিন্টারল্যান্ডের মধ্যে কনটেইনার আনা-নেওয়ার মাধ্যম ছিল মূলত সড়ক ও রেলপথ। সড়কপথের আধিপত্যই এখানে বেশি। রেলপথে কিছু কনটেইনার পরিবহন হলেও অভ্যন্তরীণ নৌপথ ছিল ব্রাত্য। ২০১৩ সালে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) চালুর মধ্য দিয়ে এর অবসান হয়। শুরু হয় দেশের নদীপথে কনটেইনার পরিবহন। এখন চলছে একে সম্প্রসারণের বড় আয়োজন।

কনটেইনার

কনটেইনারের আভিধানিক অর্থ ভেতরে ফাঁকা জায়গাযুক্ত কোনো বস্তু, যা কোনো কিছুকে ধারণ করে। এ ব্যাপারে অনুপুঙ্খিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘কাস্টমস কনভেনশন অন কনটেইনারস, ১৯৭২’-এ। সেখানে কনটেইনার বলতে এমন পরিবহন ইকুইপমেন্টকে বোঝানো হয়েছে, যা হবে:

● পুরোপুরি বা আংশিক আবদ্ধ, যেখানে থাকবে পণ্য ধারণ করার মতো কম্পার্টমেন্ট।

● বৈশিষ্ট্যগতভাবে এটা হবে স্থায়ী ধরনের। সেই সাথে বারংবার যাতে ব্যবহার করা যায় সেজন্য যথেষ্ট শক্তপোক্ত।

● নকশা হতে হবে এমন যাতে করে নির্বিঘেœ সব মাধ্যমেই এটি পরিবহন করা সম্ভব হয়।

● সহজেই যাতে পণ্য বোঝাই ও খালি করা যায় সেই সুবিধা থাকতে হবে।

● ভেতরের আয়তন হতে হবে এক ঘনমিটার বা তার বেশি।

কনটেইনার সেবার ব্যাপক প্রসারে এর আকারের আদর্শমান নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। রেলওয়ে কারের সীমাবদ্ধতার কারণে কনটেইনারের সাধারণ প্রস্থ ও উচ্চতা ছিল ৮ ফুট করে। তবে দৈর্ঘ্যে ভিন্নতা ছিল। ১৯৬৩ সালে আন্তর্জাতিক মান সংস্থা (আইএসও) কনটেইনারের আকারের একটি আদর্শমান বেঁধে দেয়। তাদের বেঁধে দেওয়া মান অনুযায়ী কনটেইনারের প্রস্থ ৮ ফুট, ১০ ফুট, ৬.৬৬ ফুট ও ৫ ফুট। তবে দৈর্ঘ্যরে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সি-ল্যান্ড ৩৫ ফুট এবং ম্যাটসন ২৪ ফুট লম্বা কনটেইনার পরিবহন শুরু করে। অন্য শিপিং লাইনগুলো যথাক্রমে ২০ ফুট ও ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কনটেইনার ব্যবহার করতে থাকে। তবে ইকোনমি অব স্কেলের স্বার্থে বর্তমানে সাড়ে ৯ ফুট উচ্চতার ৪৫ ফুট লম্বা কনটেইনারও ব্যবহৃত হচ্ছে।

ব্যবহৃত উপকরণের নিরিখে কনটেইনারকে মোটা দাগে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এর একটি হলো স্টিল কনটেইনার। এই কনটেইনারের কাঠামোর বেশিরভাগই তৈরি হয় ইস্পাত পাত ও ইস্পাতের উপাদান দিয়ে। এ ধরনের কনটেইনার তৈরিতে সাধারণত খরচ পড়ে কম এবং মজবুত হয়। তবে এর একটা অসুবিধা হলো এটি ক্ষয়রোধী নয়।

আরেকটি হচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম কনটেইনার। এ ধরনের কনটেইনারের বাইরের পাত রেইল অ্যালুমিনিয়ামের অ্যালয় দিয়ে তৈরি। অ্যালুমিনিয়াম কনটেইনারের প্রধান সুবিধা হচ্ছে এটি ওজনে হাল্কা। পাশাপাশি ক্ষয়রোধী এবং অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল স্টিল কনটেইনারের চেয়ে বেশি। তবে এ ধরনের কনটেইনার তৈরিতে খরচ পড়ে বেশি এবং ব্যবহারের অসতর্কতায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

তৃতীয় অর্থাৎ ফাইবার-রিএনফোর্সড প্লাস্টিক (এফআরপি) কনটেইনারের বাহ্যিক প্লেট হয়ে থাকে প্লাইউডের, যা ফাইবারে আবৃত থাকে। এ ধরনের কনটেইনার অন্য দুই ধরনের কনটেইনারের তুলনায় বেশি তাপ ও ক্ষয়রোধী।

সব মাধ্যমেই পণ্য পরিবহনে এসব কনটেইনার ব্যবহৃত হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ নৌপথও এর বাইরে নয়। অভ্যন্তরীণ নৌপথে এসব কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে দরকার হয় উপযুক্ত অবকাঠামো। সেই অবকাঠামো হচ্ছে ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি)।

আইসিটি

ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) হচ্ছে সেই ধরনের অবকাঠামো সুবিধা, যা আমদানি-রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং ও স্বল্পকালীন মজুদের সুবিধা দিয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে খালি কনটেইনার মজুদের সুবিধাও থাকে এই অবকাঠামোয়। তবে এসবই হয় শুল্ক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে।

এর আলোকে আইসিটির প্রাথমিক কার্যাবলির সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা আমরা করতে পারি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে  –

● কার্গো গ্রহণ ও হস্তান্তর

● কার্গো ও কনটেইনারের সাময়িক মজুদ

● কনটেইনার বোঝাই করা ও খোলা

● শুল্কায়ন কার্যক্রম

● এলসিএল কার্গো

এসব সেবা দিতে গেলে আইসিটিতে মৌলিক কিছু অনুষঙ্গ থাকতে হয়। এগুলোর সমন্বয়েই একেকটি আইসিটি গড়ে ওঠে এবং কার্যাবলি সম্পন্ন করে। এসব অনুষঙ্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –

ফটক: টার্মিনালের উদ্দেশে এবং টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার জন্য পণ্যবাহী বাহনের আগমন-নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ফটক। নথিকরণ, নিরাপত্তা এবং কনটেইনার পরিদর্শন প্রক্রিয়াও ফটকেই সম্পন্ন হয়।

কনটেইনার ইয়ার্ড: আইসিটির বড় অংশজুড়ে থাকে কনটেইনার ইয়ার্ড। ডিসপ্যাচ বন্দরে নেওয়ার আগে রপ্তানি কনটেইনার এখানে জড়ো করা হয়। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের আগে আমদানি কনটেইনার ইয়ার্ডে সংরক্ষণ করা হয়। গন্তব্যে পাঠানোর আগে খালি কনটেইনারও এখানেই রাখা হয়।

ওয়্যারহাউস: ওয়্যারহাউস হচ্ছে টার্মিনালের অভ্যন্তরে আবদ্ধ স্থান। রপ্তানি কার্গো এবং আমদানি কার্গো ডেলিভারির আগে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এখানে রাখা হয়। পাশাপাশি কনটেইনারে পণ্য ভর্তি ও খোলা হয়। রপ্তানি এলসিএল কার্গো এখানে কনটেইনার বোঝায় করা হয়। আমদানি এলসিএল হলে তা ও খোলা হয় এখানেই। কাস্টমস কর্মকর্তারা কার্গোর কায়িক পরিদর্শনও করেন ওয়্যারহাউসে। সর্বোপরি রপ্তানি ও আমদানি চালান সাধারণত ওয়্যারহাউসের পৃথক স্থানে অথবা নির্ধারিত আলাদা ওয়্যারহাউস বা শেডে হ্যান্ডল করা হয়।

ইনল্যান্ড কনটেইনার জাহাজ

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল ও মুক্তারপুর টার্মিনালের মধ্যে নদীপথে কনটেইনার পরিবহন অনেকদিন ধরেই চলছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত উপক‚লীয় নৌযান চলাচল চুক্তির আওতায়ও এরই মধ্যে কনটেইনার জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহন যাতে নির্বিঘ্নে চলতে পারে সেজন্য ইনল্যান্ড কনটেইনার জাহাজের স্পেসিফিকেশন নির্ধারণ করে দিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তর। ২০১৬ সালে এই স্পেসিফিকেশন নির্ধারণ করে দেয় সংস্থাটি। সে অনুযায়ী, ইনল্যান্ড কনটেইনার জাহাজের দৈর্ঘ্য হবে সর্বোচ্চ ৮৩ মিটার। এ ছাড়া ব্রেডথ মোল্ডেড হবে সর্বোচ্চ ১৫ মিটার ও ডেপথ মোল্ডেড সর্বোচ্চ ৮ মিটার। পূর্ণাঙ্গ পণ্য বোঝায় অবস্থায় এর সর্বোচ্চ ড্রাফট হবে ৪ মিটার। প্রায় দুই হাজার ডেড ওয়েট টনের (ডিডব্লিউটি) ইনল্যান্ড কনটেইনার জাহাজের গতি হতে হবে ঘণ্টায় ১০ থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল। প্রধান ইঞ্জিনের ক্ষমতা হতে হবে দুই হাজার অশ্বশক্তির মতো। এ ছাড়া ১৫ জনের মতো ক্র ধারণের ব্যবস্থা থাকতে হবে অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী কনটেইনার জাহাজের।

নদীপথে কনটেইনার পরিবহনের সুবিধাসমূহ

সড়ক ও রেলের সাথে তুলনা করলে অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহনের সুবিধা বহুধা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সুবিধাটি হলো ব্যয় সাশ্রয়। নানাভাবে অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহনে ব্যয়সাশ্রয়ী সুবিধা পাওয়া যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি সংখ্যক কনটেইনারবোঝাই বার্জ পরিবহন সম্ভব হলে ট্রাক ও রেলের তুলনায় পরিবহন খরচ ২০ থেকে ৫০ শতাংশ হ্রাস পায়।

এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌপথে সড়কপথের মতো যানজট না থাকায় সময় অপচয় ছাড়াই সমুদ্রবন্দর থেকে বা সমুদ্রবন্দরের দিকে সরাসরি কনটেইনার পরিবহন করা যায়। এর ফলে টিইউপ্রতি কনটেইনার পরিবহনের খরচ কম হয়। একসাথে বেশি কনটেইনার পরিবহন করলে ব্যয় সাশ্রয়ের সুবিধাটি বেশি পাওয়া যায়।

অভ্যন্তরীণ নৌপথে বার্জের সাহায্যে কনটেইনার পরিবহনে যে জ্বালানি খরচ হয় তা অন্য দুই মাধ্যমের তুলনায় বেশ কম। বার্জ, ট্রাক ও ট্রেনে কনটেইনার পরিবহনের বাহ্যিক ব্যয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন গবেষক ঘারেগজলি ও জায়েরপোর। এই তিন মাধ্যমে প্রতি টন-কিলোমিটার কনটেইনার পণ্য পরিবহনে কত পারসেন্ট জ্বালানি খরচ হয় সেটা বিশ্লেষণ করেছেন তারা। তাতে দেখা গেছে, নদীপথে বার্জে কনটেইনার পরিবহনে জ্বালানি ব্যয় সবচেয়ে কম প্রতি টন-কিলোমিটারে দশমিক ২৭ সেন্ট। একই পণ্য ট্রাকে পরিবহনে জ্বালানি বাবদ খরচ পড়ে দশমিক ৮ সেন্ট এবং ট্রেনে ২ দশমিক ০১ সেন্ট। ২০১৮ সালের উপাত্তের ভিত্তিতে এই হিসাব করেন তারা।

পাশাপাশি নদীপথে বার্জ পরিবহন সংক্রান্ত অবকাঠামো ব্যয়ও সড়ক ও রেলের তুলনায় মাত্র ২৫ শতাংশ। কনটেইনার স্ট্যাকিং উচ্চতা ও টার্মিনালের আকারও ব্যয় কমাতে ভূমিকা রাখে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌপথে পরিবেশ দূষণ হয় অন্য দুই মাধ্যমের তুলনায় নগণ্য, যা বাহ্যিক ব্যয় কমিয়ে আনতে সাহায্য করে।

পরিবেশবান্ধব

নদীপথে কনটেইনার পরিবহনের আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে এটি অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব। গবেষক লুন ২০১৩ সালে বার্জে কনটেইনার পরিবহনের বাহ্যিক ব্যয় নিয়ে একটি গবেষণা করেন। গবেষণায় তিনি এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, হংকংয়ে প্রথাগত কনটেইনার জাহাজের তুলনায় বার্জে কনটেইনার পরিবহনের বাহ্যিক ব্যয় অনেক কম। গবেষক রোসো ২০১৫ সালে আরেক গবেষণায় দেখান, খালি কনটেইনার পরিবহনে ট্রাকের পরিবর্তে নদীপথে বার্জ ব্যবহার করলে জ্বালানি পুড়বে অনেক কম, যার ফলে পরিবেশগত ক্ষতি অনেক কমে আসবে। গবেষক ফুর যুক্তি হচ্ছে, বার্জ জ্বালানিদক্ষ হওয়ায় বাতাসে ক্ষতিকর ক্ষুদ্র কণা নির্গত হয় কম। তাই কার্বন নিঃসরণ, শব্দদূষণ ও ভূমির ব্যবহার কমিয়ে এনে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস করতে কনটেইনার পরিবহন ট্রাক থেকে বার্জে স্থানান্তরের সুপারিশ করেছেন গবেষক কটোস্কা।

সড়ক, রেল ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রতি কিলোগ্রাম জ্বালানিতে কার্বন নিঃসরণের অনুপাত হচ্ছে ১৪.৮:১.২:১। (অযসবফ ২০১২). আরেকটি বিষয় হলো অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন হয়ে থাকে জনবসতি থেকে অনেক দূরে। যার ফলে কার্বন নিঃসরণের প্রভাবটা জনগণের ওপর তুলনামূলক কম পড়ে।

সড়কের ওপর চাপ হ্রাস

নদীপথে কনটেইনার পরিবহনের আরেকটি বড় যুক্তি হচ্ছে সড়কের যানজট। সমুদ্রবন্দর এলাকায় যানজট একটি নিয়মিত সমস্যা, যা কনটেইনার পরিবহনে বিলম্ব সৃষ্টি করে। ইন্টারমোডাল পরিবহনে বার্জ কনটেইনারের অন্তর্ভুক্তি এর একটি সমাধান হতে পারে। পোর্ট অব রটারডামে বার্জ কনটেইনার সেবা চালু এর একটি ভালো উদাহরণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফ্রান্সের তুলনামূলক জনবহুল শহরগুলোতেও ট্রাক ও বার্জের সমন্বয়ে যানজটমুক্ত কনটেইনার পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। একই রকম সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশেও।

অন্যান্য সুবিধা

অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহন করলে রপ্তানি চালানের কাট অফ টাইম ৬ ঘণ্টা বা তার কম সময়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। কারখানার কাছেই খোলা পণ্য নিজস্ব তত্ত্বাবধানে কনটেইনার বোঝাই করার সুযোগ তৈরি হবে। পাশাপাশি আমদানিকৃত এলসিএল কার্গো নিকটবর্তী স্থানে খুলে নগরীর মধ্যে স্বল্প সময়ে নিরাপদে নির্ধারিত গুদামে পাঠানো যাবে। অর্থাৎ, এসব কার্গো পরিবহনের সময় পথিমধ্যে নষ্ট হওয়ার কোনো ঝুঁকি থাকবে না। এফসিএলে কাঁচা তুলা ও টেক্সটাইল পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে নামার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চলে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

তাজা ফলের আমদানিকারকরা ক্ষতি এড়াতে নিজেদের সীমানার মধ্যেই রিফার কনটেইনার থেকে তাদের পণ্য বুঝে নিতে পারবেন। কনটেইনারভর্তি ভারী শিল্প রাসায়নিক, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি সড়কপথ এড়িয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপথে পরিবহন করা যাবে। এতে সড়কপথে পরিবহনের সময় পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার যে ঝুঁকি থাকে তা আর থাকবে না।

পণ্য খালাসের পর একই কনটেইনারে পণ্য বোঝাই করে পাঠানো যাবে। তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয় সেটি হলো অভ্যন্তরীণ নৌপথে সড়কপথের মতো যানজটের মতো কোনো পরিস্থিতিতে পড়ার ঝুঁকি থাকবে না।

সাফল্যের শর্ত

নদীপথে কনটেইনার পরিবহনের সাফল্য নির্ভর করে বেশ কিছু শর্তের ওপর। এর মধ্যে প্রধান শর্তটি হচ্ছে অবকাঠামো অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগ। এর পরে রয়েছে কনটেইনারের বাজার প্রবৃদ্ধি। নদীপথের নাব্যতাও আরেকটি জরুরি শর্ত। সর্বোপরি কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দক্ষতা। এ ছাড়া প্রধান প্রধান সমুদ্রবন্দরের সাথে হিন্টারল্যান্ডের সংযোগ এবং সরকারের নীতিও এক্ষেত্রে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

অবকাঠামো

নদীপথে কনটেইনার পরিবহন সাফল্যের প্রধান নিয়ামক অবকাঠামো। অভ্যন্তরীণ নৌপথ অবকাঠামোর সক্ষমতা ভালো না হলে কাঙ্খিত সময়ের মধ্যে বেশি টিইউজ কনটেইনার পরিবহন সম্ভব নয়। সমুদ্রবন্দরের কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও নদীবন্দরের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে ইউরোপীয় দেশগুলোর বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজটি করছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ একটি বড় বিষয়। অভ্যন্তরীণ নৌপথ অবকাঠামোয় বিনিয়োগ যত বেশি হবে নিরাপদে, নির্ভরযোগ্যতার সাথে ও দক্ষভাবে নদীপথে বেশি সংখ্যক কনটেইনার পরিবহন তত নিশ্চিত হবে। সবশেষে অবকাঠামোয় বড় বিনিয়োগ এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করবে, যার ফলে ভবিষ্যতে অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কমে আসবে। সরকারের ওপর থেকে ব্যয়ের বোঝা হ্রাস পাবে। উদাহরণ হিসেবে চীনের ইয়াংজি নদীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রদেশ ও বেসরকারি খাতের বর্ধিত বিনিয়োগের ফলে নদীটিতে শক্তিশালী কনটেইনার পরিবহন অবকাঠামো গড়ে উঠেছে, যা ইয়াংজিকে কনেটইনার পরিবহন উপযোগী বিশ্বের শীর্ষ নদী ব্যবস্থায় পরিণত করেছে।

বাংলাদেশেও বিস্তৃত নৌপথে ব্যাপক পরিসরে কনটেইনার পরিবহনের সম্ভাবনা রয়েছে। নাব্যতা উন্নয়নের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারিভাবে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল গড়ে তোলার মাধ্যমে সেই সম্ভাবনা ঘরে তোলার কাজ চলছে।

নৌপথের নাব্যতা ও প্রাপ্যতা

অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহনের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে অভ্যন্তরীণ নৌপথের নাব্যতা ও প্রাপ্যতার ওপর। কনটেইনার বার্জ নেটওয়ার্ক নৌপথের নাব্যতা ও প্রাপ্যতার সাথে আন্তঃসম্পর্কিত। নৌপথের নাব্যতা বেশি হলে স্বাভাবিকভাবেই বেশি ড্রাফটের বার্জ চলাচল করবে। ফলে একসাথে বেশি পরিমাণে কনটেইনার পরিবহন সম্ভব হবে। এ ছাড়া নদীপথ অনেক বেশি বিস্তৃত হলে লম্বা দূরত্বে কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ বাড়বে। একসাথে পরিমাণে বেশি ও লম্বা দূরত্বে কনটেইনার পরিবাহিত হলে পরিবহন খরচ কমে আসবে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করে বৃহৎ নগরীতে কনটেইনার পরিবহন করা গেলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও বাড়বে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ রয়েছে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে। কারণ, সব সমুদ্রবন্দর থেকেই দেশের রাজধানী তথা প্রধান হিন্টারল্যান্ড ঢাকায় অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করে কনটেইনার পরিবহন করা সম্ভব। পানগাঁওয়ে নির্মিত অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের মাধ্যমে তা হচ্ছেও। তবে অতটা ব্যাপকভিত্তিতে নয়। এই বিবেচনা থেকেই নারায়ণগঞ্জের খানপুরে আরেকটি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল গড়ে তোলা হচ্ছে, যাতে করে প্রধান হিন্টারল্যান্ডে আরও বেশি কনটেইনার পরিবহন সম্ভব হয়।

কনটেইনার বাজারের প্রবৃদ্ধি

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও কনটেইনার বাজারের প্রবৃদ্ধি ঈর্ষণীয়। সেই সাথে বাড়ছে ইন্টারমোডাল পরিবহনের প্রবৃদ্ধিও। এই দুই প্রবৃদ্ধি থেকেই সুবিধা পেতে পারে নদীপথে কনটেইনার পরিবহন। এর অসংখ্য নিদর্শনও এরই মধ্যে দৃশ্যমান। উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে বার্জের মাধ্যমে নদীপথে কনটেইনার পরিবহনে দুই দশকে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। (Braekers et al. 2013). এর ফলে ২০০৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দশ বছরে ইউরোপের অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহন বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। (Shobayo and van Hassel 2019). আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যাপক উল্লম্ফনের সুবিধা পুঁজি করে কেবল চীনের ইয়াংজি নদী দিয়েই প্রতি বছর ২০০ কোটি টন কার্গো পরিবহন হচ্ছে, যা চীনের অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহনে মৌলিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এ ছাড়া চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি ইউরোপীয় দেশগুলো ও চীনকে ট্রাক, রেল ও বার্জের সমন্বয়ে ইন্টারমোডাল কনটেইনার পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যাপক বিনিয়োগ ও নীতি বাস্তবায়নে তাড়িত করেছে। এর ফলে সমুদ্রবন্দরগুলোতে প্রাত্যহিক যে বিপুল পরিমাণ কনটেইনার আসছে তার বড় অংশ ট্রাক ও রেলের পাশাপাশি বার্জে নদীপথেও পরিবাহিত হচ্ছে।

একইভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হচ্ছে প্রতিবেশী ভারত এবং প্রতি বছরই দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ছে। আগামীতে আরও বাড়বে। কিন্তু এই বাণিজ্যের সিংহভাগ পরিচালিত হচ্ছে স্থলপথে। অথচ ভারতের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী। সেই সাথে নৌ প্রটোকল চুক্তি। ধারাবাহিকভাবে এই প্রটোকল রুট সম্প্রসারিত হচ্ছে। নতুন নতুন পোর্ট অব কলও যুক্ত হচ্ছে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় পণ্য বাণিজ্যের বড় অংশ প্রটোকল রুট দিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনারে সম্পন্ন হতে পারে। প্রটোকল রুটে কনটেইনার পরিবহন এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় কনটেইনার বাণিজ্য আরও বাড়াতে উভয় দেশ কাজ করছে।

সরকারের নীতি

কোনো উদ্যোগের সাফল্য-ব্যর্থতার অনেকখানি নির্ভর করে সরকারের নীতির ওপর। নদীপথে কনটেইনার পরিবহনও এর বাইরে নয়। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে স্থানীয় নীতি অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন বিশেষ করে কনটেইনার পরিবহনে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। ১৯৯০ এর দশক থেকে ইউরোপের প্রথাগত কনটেইনার পরিবহনের এই যে ইন্টারমোডাল পরিবহনে রূপান্তর তার কৃতিত্ব সরকারের বিদ্যমান নীতি সহায়তা। ইউরোপীয় নীতির কারণে ২০১০ সাল থেকে মোট কনটেইনার পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথের হিস্যা উল্লেখযোগ্য বেড়েছে, যা আবার নদীপথে কনটেইনার পরিবহন অবকাঠামোয় নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণে ভূমিকা রাখছে। এক্ষেত্রেও আমরা চীনকে উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি। ২০১৬ সালে চীন ইয়াংজি রিভার ডেল্টা এলাকায় কনটেইনার পরিবহনে নীতি সহায়তা দেয়, যা ইয়াংজিকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বার্জ কনটেইনার পরিবহন বাজারে পরিণত করেছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহনের সম্ভাবনা

বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ নৌপথ। এর মধ্যে বর্ষা মৌসুমে নৌ চলাচলের উপযোগী থাকে প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ। তবে ৬ হাজার কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে, যা সারা বছরই নৌযান চলাচলের সুযোগ দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত কার্গোর বড় অংশ পরিবাহিত হয় অভ্যন্তরীণ এই নৌপথ দিয়েই। বিশেষ করে খোলা পণ্য ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের অর্ধেকই পরিবাহিত হয় নদীপথে। আর মোট যাত্রীর এক-চতুর্থাংশ তাদের যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় অভ্যন্তরীণ নৌপথকে। এই যাত্রী ও কার্গো পরিবহনের জন্য রয়েছে ২২ হাজার ৩০০টি নিবন্ধিত নৌযান।

তবে সমুদ্র বন্দরগুলো দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কনটেইনারের মাত্র ৩ শতাংশ পরিবাহিত হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নৌপথে। কনটেইনারের বড় অংশই পরিবাহিত হচ্ছে সড়কপথে। রেলপথেও কনটেইনার পরিবাহিত হলেও হিস্যাটা খুব বেশি নয়।

অভ্যন্তরীণ নৌপথে সবচেয়ে বেশি কনটেইনার পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর ও পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনালের মধ্যে। এ ছাড়া ঢাকা ও মোংলা বন্দরের মধ্যে ফিডার ভেসেলের সাহায্যে কিছু কনটেইনার পরিবহন হয়ে থাকে। এর বাইরে যে কনটেইনার পরিবহন তা খুবই সামান্য।

পানগাঁওয়ে কনটেইনার পরিবহনে নিয়োজিত জাহাজগুলোর অন্যতম পানগাঁও এক্সপ্রেস

উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশে কনটেইনারের সিংহভাগ হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে চট্টগ্রাম বন্দরে। এই কনটেইনারের প্রায় ৭০ শতাংশ উৎপন্ন হয় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে। অথবা মোট কনটেইনারের ৭০ শতাংশের গন্তব্য ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ অঞ্চল। এই কনটেইনারের আবার সিংহভাগ পরিবাহিত হয় সড়কপথে। রেলপথে পরিবাহিত ১০ শতাংশের মতো।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ও অন্যন্য উৎস থেকে চট্টগ্রাম বন্দরগামী কনটেইনারের বড় অংশ পরিবাহিত হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে। গত এক দশকে মহাসড়কটি দিয়ে কনটেইনার পরিবহনে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর ফলে সড়কে ব্যাপক মাত্রায় চাপ তৈরি হচ্ছে এবং যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

বর্তমানে ৭০০ থেকে ১২০০ ডিডব্লিউটির ৩০০ এর মতো ড্রাই কার্গো ভেসেল অভ্যন্তরীণ নৌপথে কলকাতা/হলদিয়া বন্দর ও বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য আনা-নেওয়া করছে। সরকারের গৃহীত অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে কনটেইনার পরিবহন অনেক বেশি সহজ, দ্রুতগতির ও সাশ্রয়ী হবে। তবে সেজন্য নৌপথের নাব্যতার উন্নয়ন করতে হবে সবার আগে।

ক্যাপিটাল ও মেইনটেইন্যান্স ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌ নেটওয়ার্ক সংরক্ষণ করতে হয় নিয়মিত ভিত্তিতে। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত সেদিকে মনোযোগ ছিল কম। নৌপথের উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগও ছিল সীমিত। অভ্যন্তরীণ নৌপথ সচল রাখতে বর্তমানে বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অনাব্য নৌপথে নাব্যতা ফেরানো এবং হারিয়ে যাওয়া নৌপথ পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে। এজন্য বিআইডব্লিউটিএর বহরে ড্রেজারের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। অর্থায়নও বাড়ানো হয়েছে। নৌপথ খননে বেসরকারি খাতকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।

নদীপথে কনটেইনার পরিবহন যে কারণে

দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও প্রধান হিন্টারল্যান্ড ঢাকার মধ্যে কনটেইনারসহ সব ধরনের পণ্য আনা-নেওয়া ব্যাপকভাবে ট্রাকনির্ভর। ঢাকাগামী কনটেইনারের মাত্র ২০ শতাংশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে যায়। বাকি ৮০ শতাংশ কনটেইনার বোঝাই বা খোলা হয় চট্টগ্রাম বন্দর ও অন্যান্য অফডক টার্মিনালে। খোলা অবস্থায় এসব পণ্য ট্রাকে করে পরিবাহিত হয়। ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়, বিলম্ব ঘটে এবং নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। কখনো কখনো পণ্য চুরির ঘটনাও ঘটে।

পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভাড়া। ভাড়ার ব্যাপারে কিছু নীতিমালা থাকলেও সেগুলো চর্চায় আনা হয় কম। দর-কষাকষির মাধ্যমেই মূলত ভাড়া নির্ধারিত হয়। আবহাওয়া ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাড়া কম-বেশি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যান একই সড়কপথে চলাচল করায় যানজট নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, যার ফল হিসেবে পণ্য পরিবহনে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগে।

পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সবচেয়ে বেশি। নিরাপদে পণ্য পৌঁছানোই তাদের মূল লক্ষ্য থাকে। যদিও সড়কপথে দুর্ঘটনা ও পণ্য হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বেশি। এ ছাড়া পরিবেশ দূষণের বিষয়টি তো আছেই।

সব ঋতু ও সব সময়ে সড়কপথে পণ্য পরিবহন একই রকম নিরাপদ থাকে না। বিশেষ করে বন্যা ও বর্ষাকালে পণ্য পরিবহনে অনিরাপদ মাধ্যম হয়ে ওঠে সড়কপথ। তাছাড়া ভাড়া বেশি হওয়ায় তুলনামূলক কম দামি ও ভারী পণ্য লম্বা দূরত্বে সড়কপথে পরিবহন লাভজনক হয় না।

এসব বিবেচনায় কনটেইনার পরিবহনে সড়কের ভালো বিকল্প রেলপথ। ঢাকা-চট্টগ্রাম পার্সেল এক্সপ্রেস ট্রেনের মাধ্যমে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ রেলপথে কনটেইনার পরিবহন শুরু করে। শুধুমাত্র কনটেইনার ট্রেনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯১ সালে। চট্টগ্রাম থেকে লাকসাম পর্যন্ত রেলপথটি মোটামুটি সোজা এবং দূরত্ব ১২৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার। কিন্তু ঢাকা থেকে লাকসাম পর্যন্ত রেলপথে রাউন্ডিং লুপ রয়েছে প্রায় ৯০ কিলোমিটার, যার ফলে দূরত্ব বেড়ে হয়েছে ১৯১ দশমিক ১৯ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে রেলপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৩২০ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার। সড়কপথে দূরত্ব যেখানে ২৭৮ কিলোমিটার। এ কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে রেলপথে পণ্য পরিবহনে সময় লাগে বেশি।

এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে কনটেইনার ট্রেনের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা নিয়েও সমস্যা রয়েছে। সর্বোপরি কমলাপুর অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) দিনের বেলায় পণ্য পরিবহনে বিধিনিষেধ রয়েছে। ফলে কমলাপুর আইসিডি থেকে কনটেইনার বোঝাইয়ের পর তা পরিবহনের জন্য রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

সব মিলিয়ে কনটেইনার পরিবহনে রেল ও সড়কপথের ভালো সম্পুরক হতে পারে অভ্যন্তরীণ নৌপথ। কারণ, বাংলাদেশের রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অভ্যন্তরীণ নৌপথ নেটওয়ার্ক। ২৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই নৌ নেটওয়ার্ক দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১১ শতাংশ। দেশের প্রায় সব বড় নগর, শহর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোকে ছুঁয়ে গেছে অভ্যন্তরীণ এই নৌপথ। যদিও রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে ১৯৭০ সালের ১২ হাজার কিলোমিটার শ্রেণিবদ্ধ অভ্যন্তরীণ নৌপথ কমতে কমতে এক সময় ৬ হাজার কিলোমিটারে নেমে আসে। বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া নৌপথ পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে। হারিয়ে যাওয়া অভ্যন্তরীণ নৌপথ ফিরিয়ে আনতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। দেশের বৈদেশিক পণ্য বাণিজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ সারাবছর ধরে নাব্য প্রথম শ্রেণির পাঁচটি নৌরুট দিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক গবেষণা বলছে, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন লজিস্টিকস ব্যবস্থাকে দক্ষ ও প্রতিযোগিতা সক্ষম করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার মোট দেশজ উৎপাদন ১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারবে। বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়তে পারে ২০ শতাংশের মতো। এজন্য কেবল খোলা পণ্য পরিবহন করলে হবে না, ব্যাপক পরিসরে কনটেইনার পরিবহনও করতে হবে অভ্যন্তরীণ নৌপথ দিয়ে। তারই আয়োজন চলছে জোরেশোরে।

যেখানে এগিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপথ

পরিবহনের কোন মাধ্যম কতটা জ্বালানিদক্ষ তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে মাধ্যমটি কতটা টেকসই ও লাভজনক। পরিবহনের ক্ষেত্রে জ্বালানিদক্ষতা হিসাব করা হয় নির্দিষ্ট সেবা দিতে কী পরিমাণ জ্বালানি খরচ হয় তার ভিত্তিতে। নির্দিষ্ট করে বললে প্রতি টন কার্গো প্রতি মাইল (টন-মাইল) পরিবহনে কত বিটিইউ (ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন গবেষণায় রেল, ট্রাক ও নৌপথের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অগভীর ড্রাফটের নৌযান সবচেয়ে বেশি জ্বালানিদক্ষ। চীনা বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক, রেল ও নৌপরিবহনে জ্বালানি ব্যবহারের অনুপাত ১৪:১.৮:১। (Ahmed 2012) । রেল ও নৌপথের জ্বালানিদক্ষতার তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের ক্ষেত্রে প্রতি টন-মাইলে বিটিইউ খরচ হয় গড়ে ৪৩৩। রেলপথে এর পরিমাণ যেখানে ৬৯৬। ২০০২ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ট্রাকে এক গ্যালন জ্বালানি ব্যবহার করে এক টন পণ্য ৫৯ মাইল পরিবহন করা যায়। একই পরিমাণ জ্বালানিতে একই পণ্য রেলপথে পরিবহন করা যায় ২০২ মাইল। অভ্যন্তরীণ নৌপথে বার্জের মাধ্যমে একই পণ্য একই পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহার করে পরিবহন করা সম্ভব ৫১৪ মাইল। এ হিসেবে সড়ক ও রেলের তুলনায় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অনেক বেশি জ্বালানিদক্ষ। নৌযানের আকৃতিও দক্ষতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অভ্যন্তরীণ নৌযান একসাথে কমপক্ষে ১৬টি কনটেইনার পরিবহন করতে পারে। অন্যদিকে ট্রাকে সর্বোচ্চ দুটি কনটেইনার পরিবহন করা সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রীবাহী যানবাহনের নির্বিঘ্নে চলাচলে বিঘ্নও সৃষ্টি করে কনেটইনারবাহী এসব ট্রাক। এ ছাড়া কনটেইনার পরিবহনে সড়কের পূর্ণাঙ্গ অবচয় যদি ট্রাককে পরিশোধ করতে হয় তাহলে সড়কপথে কনটেইনার পরিবহনের ব্যয় অভ্যন্তরীণ নৌপথের তুলনায় ৫০ গুণ বেশি দাঁড়ায়। (Ahmed 2012)

কার্গো কতটা নিরাপদে পরিবহন হলো সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বিবেচনায় অভ্যন্তরীণ নৌপথই সর্বোত্তম। কারণ, ট্রাকের তুলনায় নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটে সামান্যই। এ ছাড়া ট্রাক ও রেল ট্যাঙ্ক কারের তেল নিঃসরণ ঘটে বার্জের তুলনায় বেশি। এমনটা হয় বার্জের বৃহৎ পণ্য ধারণক্ষমতার কারণে, যা পরিবহনে ট্রাক ও ট্রেনের তুলনায় জ্বালানি প্রয়োজন হয় অনেক কম। এ কারণে তেল নিঃসরণের ঝুঁকিও তুলনামূলক কম হয়। এ ছাড়া বার্জের নকশার কারণেও দুর্ঘটনা কম হয়।

ট্রাকে কনটেইনার পরিবহন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানজটের কারণে সরাসরি প্রভাবিত হয়। যানজটের প্রভাবও হয় বহুবিধ। যানজট দুর্ঘটনা ও জ্বালানি ব্যয় যেমন বাড়িয়ে দেয় একইভাবে পরিবেশগত ক্ষতির পাশাপাশি সময়ের অপচয়ও বেশি ঘটায়। সেই সাথে তৈরি করে বৃহত্তর সামাজিক চাপ। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহনের ক্ষেত্রে যানজটের কোনো বিষয় নেই। এ ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ওপর নৌপরিবহনের নেতিবাচক প্রভাবও সেভাবে নেই। কারণ, অগভীর নৌযানগুলো তীর থেকে বহু দূরে মাঝনদী দিয়ে চলাচল করে এবং একসাথে অনেক বেশি পরিমাণ পণ্য পরিবহনের কারণে জনবসতির ওপর নেতিবাচক প্রভাবও হয় কম।

অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহনের আরেকটি সুবিধাজনক দিক হলো শব্দ ও বায়ুদূষণ কম হওয়া। এই দুই দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস হলো পরিবহন ব্যবস্থা। বায়ু দূষণের এককভাবে সবচেয়ে বড় উৎস হলো সড়ক পরিবহন। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সে তুলনায় অনেক কম বায়ু দূষণের কারণ হয়। এমনকি রেলের তুলনায়ও কম হয়। যদিও নৌযান থেকে শব্দ দূষণের মাত্রা সংক্রান্ত উপাত্তের অস্তিত্ব খুব একটা নেই। কারণ, এ থেকে যে পরিমাণ শব্দ উৎপন্ন হয় তাকে সাধারণত সমস্যা হিসেবে দেখা হয় না। নৌযান চলাচল করে নদীতীর থেকে অনেক দূর দিয়ে এবং ইঞ্জিনের শব্দ লোকালয়ে খুব কমই পৌঁছে।

এদিকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে ব্যাপক ভিত্তিতে কনটেইনার পরিবহন শুরু করা গেলে দেশীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য তা আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবে। ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ ডিডব্লিউটির ৩০-৩৫ ক্লাসের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বার্জ তৈরি হবে। কম করে হলেও সেগুলোর কনটেইনার ধারণক্ষমতা হবে ৮০ টিইউজ।

দেশের প্রধান প্রধান আইসিটি

দেশের প্রধান অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল হলো কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গায় নির্মিত পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) যৌথভাবে এটি নির্মাণ করেছে।

বেসরকারি আইসিটির মধ্যে রয়েছে সামিট অ্যালায়েন্স গ্রুপের নির্মিত মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরে সামিট অ্যালায়েন্স টার্মিনাল। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের ধামগড়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রূপায়ণ গ্রুপ গড়ে তুলছে রূপায়ণ পোর্ট অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেড (আরপিএল)।

বেসরকারি উদ্যোগে প্রস্তাবিত আরও কিছু আইসিটি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিআইডব্লিউটিএর খানপুর বন্দর সংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীতে কুমুদিনী কনটেইনার টার্মিনাল। আনন্দ গ্রুপের আনন্দ কনটেইনার পোর্ট। এটির অবস্থান ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার পূর্বে মেঘনা ঘাটের আশারিয়ার চরে মেঘনা নদীর তীরে।

চট্টগ্রামভিত্তিক এ কে খান গ্রুপ নরসিংদীর পলাশে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে এ কে খান কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে কাজ করছে।

সরকারি উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জের খানপুরে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে দুটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পগুলোতে ঠিকাদার নিয়োগের কাজ চূড়ান্ত হয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল

পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যৌথ উদ্যোগে ২০১২ সালে নির্মিত হয়েছে পানগাঁও নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল। উদ্দেশ্য সড়কের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমাতে অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহনে উৎসাহিত করা। সে লক্ষ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ৬৪ একর জমিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। এর প্রায় ৩৫ একর জমিতে আরসিসি ইয়ার্ড, জেটি ও শেড নির্মাণ করা হয়েছে। বাকী ২৯ একর জমিতে নদীর তীররক্ষা বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।

পানগাঁও জেটির দৈর্ঘ্য ১৮০ মিটার ও প্রস্থ ২৬ মিটার। এখানে একসাথে দুটি জাহাজ ভিড়তে পারে। বন্দর ও টার্মিনাল এলাকার আয়তন ৩২ একর। ইয়ার্ড এলাকার আয়তন ৫৫,০০০ বর্গমিটার ইয়ার্ডের এককালীন কনটেইনার ধারণ ক্ষমতা ২,৪০০ টিইউজ। কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন ৫,৮১৫ বর্গমিটার। এখানে রিফার প্লাগ ইন পয়েন্ট রয়েছে ৪৮টি। এর স্টাফিং ও আনস্টাফিং এলাকা ১৩,৯৬৯ বর্গমিটার।

যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে একটি মোবাইল হারবার ক্রেন, দুটি স্ট্র্যাডেল ক্যারিয়ার। ট্রাক্টর ট্রেইলর আছে দুটি। নৌ-কনটেইনার টার্মিনালটির পরিচালন কার্যক্রম যাতে নির্বিঘ্নে চলতে পারে সেজন্য ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। এখানে রয়েছে দুটি জেনারেটর, যার প্রত্যেকটির ক্ষমতা ১,২৫০ কেভিইআই/আইএমডাব্লিউ।

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ৬৪ একর এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালে রয়েছে ১৮০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২৬ মিটার প্রস্থের জেটি

ঢাকার পানগাঁও থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত নৌপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫৭ নটিক্যাল মাইল। সন্দ্বীপ এলাকা ছাড়া নৌপথটির গভীরতা প্রায় ৪ দশমিক ৫ মিটার। সন্দ্বীপে গভীরতা কম থাকলেও ৫ থেকে ৬ মিটার জোয়ারের সময় এখান দিয়ে কনটেইনারবাহী জাহাজ খুব সহজে চলাচল করতে পারে। এ ছাড়া বুড়িগঙ্গার যে স্থানে টার্মিনালটি অবস্থিত সেখানে নদীর গভীরতাও ৪ দশমিক ৫ মিটার। পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বছরে প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার টিইউজ।

পানগাঁও বন্দরে টার্মিনাল নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল অভ্যন্তরীণ নদীপথের মাধ্যমে পণ্য ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া, আবার সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা। কিন্তু শুরুর দিকে নির্ধারিত মাশুল টার্মিনালটি ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৬ সালে টার্মিনাল ব্যবহারের চার্জ নতুন করে নির্ধারণ করে। এতে প্রায় বিভিন্ন ধরনের সেবার মাশুল ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসে। এ ছাড়া এতে বাড়ানো হয় জাহাজের টার্মিনালে অবস্থানের সময়।

এসব উদ্যোগের ফলও পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৩ সালে চালু হওয়ার প্রথম বছরে বন্দরে জাহাজ ভেড়ে আটটি। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬টিতে। আগে বন্দরে গড়ে প্রতি ১৫ দিন অন্তর একটি কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়ত, বর্তমানে প্রতি তিন দিনে একটি করে জাহাজ ভিড়ছে। কনটেইনার জট না থাকার কারণে আমদানি ও রপ্তানিকারকরা এখন এই বন্দর ব্যবহারের আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে পানগাঁও-এ পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে তিনটি জাহাজ, এগুলো হচ্ছে পানগাঁও সাকসেস, পানগাঁও এক্সপ্রেস, পানগাঁও ভিশন, যাদের একেকটির ধারণ ক্ষমতা ১২০ টিইউজ।

খানপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ও বাল্ক টার্মিনাল

দেশে কনটেইনার পরিবহনের প্রায় ৯৮ শতাংশই হয়ে থাকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এই কনটেইনারের প্রায় ৭০ শতাংশের উৎস বা গন্তব্য ঢাকা অঞ্চল। এসব কনটেইনারের মাত্র ১৭ শতাংশ পরিবাহিত হয় রেল ও নদীপথে। বাকি কনটেইনার পরিবাহিত হয় সড়কপথে। কিন্তু সড়কে যানজটের কারণে অনেক সময়ই শিপমেন্টে বিলম্ব ঘটে।

এই সমস্যা এড়াতে রেলপথে চট্টগ্রাম বন্দরে ও সেখান থেকে ঢাকায় কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ রয়েছে। তবে ঢাকায় অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিডি) আছে মাত্র একটি। তাই ঢাকা অঞ্চল ও চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যে কনটেইনার পরিবহনের সর্বোত্তম বিকল্প হতে পারে অভ্যন্তরীণ নৌপথ। নারায়ণগঞ্জের খানপুরে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কেন্দ্র হতে পারে। কারণ, নৌপথের সাথে খানপুর ভালোভাবেই সংযুক্ত। এ ছাড়া এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও ব্যাপক।

খানপুর আইসিটি নির্মিত হলে কনটেইনার পরিবহনে সড়ক নির্ভরতা কমবে। এর ফলে সড়কের ওপর চাপ ও কনটেইনার পরিবহন ব্যয়-দুই-ই হ্রাস পাবে। কারণ, অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহন ব্যয় রেলপথের প্রায় অর্ধেক এবং সড়কপথের এক-চতুর্থাংশ। এ ছাড়া সড়কের তুলনায় এটা অনেক বেশি নিরাপদ পরিবহন মাধ্যম।

ব্যবসায়ীদের আগ্রহে পানগাঁওয়ে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে কনটেইনার হ্যান্ডলিং

খানপুরে আইসিটি নির্মিত হলে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরগামী এবং সেখান থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে আসা কনটেইনারের দক্ষ হ্যান্ডলিং নিশ্চিত হবে। নৌ প্রটোকল চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নদীপথে কনটেইনারে পরিবহনেরও সুযোগ তৈরি হবে। সর্বোপরি গন্তব্যের কাছাকাছি এলাকায় অর্থাৎ খানপুর আইসিটিতেই কনটেইনার বোঝাই করা ও খোলার সুযোগ মিলবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেবাও ব্যবহারকারীরা হাতের কাছে পাবেন। এসব বিবেচনা থেকেই খানপুরে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ও বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গৃহীত ‘নারায়ণগঞ্জের খানপুরে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার এবং বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয় পরের বছর ৮ জুলাই। প্রকল্পটির জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার খানপুর এলাকা।

একনেক বিভাগ থেকে ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পের অনুমোদন আদেশ জারি করার পর ওই বছরের ৬ মার্চ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদন আদেশ জারি করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় একই বছরের ৩১ জুলাই।

খানপুরে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের মূল উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম, মোংলা ও অন্যান্য বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথের মাধ্যমে পরিবাহিত কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা। বাংলাদেশের নৌপথে কনটেইনার পরিবহনের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্যের সক্ষমতা বাড়ানোও এর আরও একটি উদ্দেশ্য। সেই সাথে কার্গো ট্রাফিকের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ট্রানজিট শেড ও বহুমুখী আরসিসি জেটি সুবিধা প্রদান করা। টার্মিনালটির কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা এক পর্যায়ে ১ লাখ ২২ হাজার টিইউজে উন্নীত হবে।

খানপুরে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ও বাল্ক টার্মিনাল প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হবে একটি প্রশাসনিক ভবন, আরসিসি মাল্টিপারপাস জেটি, তীররক্ষা, সিএফএস ওয়্যারহাউস, ফার্টিলাইজার ওয়্যারহাউস, অন্যান্য ড্রাই বাল্ক ওয়্যারহাউস, কনটেইনার ও জেনারেল ইয়ার্ড, কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি, বিদ্যুতের সাবস্টেশন ও অভ্যন্তরীণ রাস্তা।

৩৯২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের পুরোটাই বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে। প্রকল্পটি ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের উদ্ভূত সমস্যা সমাধান এবং প্রকল্পের অর্থায়ন জিওবি অনুদানের পরিবর্তে জিওবি ঋণ হিসেবে সংস্থানের লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের সাথে ঋণচুক্তি সম্পাদন করতে তিন বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই নির্ধারিত সাড়ে তিন বছর মেয়াদকালে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো জরুরি।

প্রকল্পের শুরু থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ৩.১৯১৮ কোটি টাকা। শুরু থেকে ২০২৩ সালের ৩০ মে পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ১ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে দশমিক ৮১ শতাংশ।

 

নারায়ণগঞ্জের খানপুরে নির্মাণাধীন অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ও বাল্ক টার্মিনালের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা হবে ১ লাখ ২২ হাজার টিইউজ

আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নদীবন্দর

দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে কনটেইনার হ্যান্ডলিং যে হারে বাড়ছে তাতে করে দেশজুড়ে উন্নত কনটেইনার বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে হ্যান্ডল হওয়া বিপুল কনটেইনার বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) প্রতিষ্ঠা। রেলওয়ের সাথে যুক্ত ঢাকায় আইসিডি আছে মাত্র একটি। এর কনটেইনার সক্ষমতাও সীমিত বছরে মাত্র ৯০ হাজার টিইউজং। তারপরও কিছুটা হলেও পণ্যভর্তি কনটেইনার বিতরণে শুরু থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরকে সহায়তা করে আসছে। পরের দিকে অবশ্য অভ্যন্তরীণ নৌপথের সুবিধার কথা বিবেচনা করে কেরাণীগঞ্জের পানগাঁওয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল চালু করা হয়েছে। তবে বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের যে প্রবৃদ্ধি তা হাতে গোনা একটি/দুটি টার্মিনাল দিয়ে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে মেঘনা নদীর তীরে কনটেইনার নদীবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এজন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন ২৫ দশমিক ৬০৫ একর এবং আশুগঞ্জ সার কারখানার ৬ দশমিক ১৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

আপাতত নদীবন্দরটি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা হবে বছরে এক লাখ টিইউজ। তবে পরবর্তীতে এই সক্ষমতা দুই লাখ টিইউজে উন্নীত করা হবে।

আশুগঞ্জকে কনটেইনার নদীবন্দর হিসেবে বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এর অবস্থানগত সুবিধা। অবস্থানগত এই সুবিধার কারণে আশুগঞ্জ নদীবন্দর নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের লজিস্টিকস চাহিদা সহজেই পূরণ করতে পারবে। অর্থাৎ, কনটেইনার নদীবন্দরটি ঢাকা ও চট্টগামের বিভাগের পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।

এ ছাড়া নৌ প্রটোকল চুক্তির আওতায় আশুগঞ্জকে পোর্ট অব কল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রটোকলের ২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আশুগঞ্জে আসা ট্রান্সশিপমেন্ট জাহাজ থেকে কার্গো নিয়ে বাংলাদেশি ট্রাক/ট্রেইলার ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছে দিতে পারবে। একই অনুচ্ছেদের আওতায় গ্রীষ্মের ছয় মাস নদীতে পানির গভীরতা কমে গেলে অর্থাৎ আশুগঞ্জ/শেরপুর থেকে জকিগঞ্জ/করিমগঞ্জ অংশে নাব্যতা হ্রাস পেলে বড় জাহাজ থেকে পণ্য নিয়ে ছোট ছোট নৌযানে করে তা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে তা পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

এদিকে আগরতলা থেকে আশুগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ৫০ কিলোমিটার। তাই ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে আশুগঞ্জ থেকে আগরতলায় সহজেই কনটেইনার পরিবহন করা সম্ভব হবে। সুতরাং, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের স্থানীয় লজিস্টিকস খাতের পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতের সাথে সংযুক্তির ক্ষেত্রে আশুগঞ্জ কনটেইনার নদীবন্দরটির গুরুত্ব বিশেষ।

বেসরকারি আইসিটি

দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর মাধ্যমে কনটেইনার পরিবহন ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মতো অবকাঠামো অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার সেভাবে গড়ে না ওঠায় আমদানি-রপ্তানি কনটেইনারের প্রায় পুরোটাই সড়ক ও রেলপথে দেশের অভ্যন্তরে পরিবাহিত হচ্ছে। এতে করে কনটেইনার পরিবহনে সড়কের ওপর চাপ বাড়ছে। কনটেইনার পরিবহন ব্যয়ও তুলনামূলক বেশি হচ্ছে। সড়কের ওপর চাপ কমাতে ও আমদানি-রপ্তানিকারকদের সাশ্রয়ে কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ দিতে বেসরকারি বিনিয়োগে অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনালের সুযোগ দিয়েছে। ২০১৩ সালে বেসরকারি উদ্যোগে অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) নির্মাণ ও পরিচালনা সংক্রান্ত একটি নির্দেশিকা জারি করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

এই নির্দেশিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বেসরকারি উদ্যোগে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনে প্রয়োজনীয় নীতি পদ্ধতি নির্ধারণপূর্বক সহায়তা প্রদান করা। সেই সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, ল্যান্ডিং ও শিপিং সুবিধাসহ এ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনা। সর্বোপরি ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর ও নদীবন্দরের সীমানাভুক্ত তীরভূমিতে বা নদীবন্দরের সীমানাবর্হিভূত নাব্য নৌ চলাচলের তীরভূমি ও তৎসংলগ্ন জায়গায় বেসরকারি উদ্যোগে অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে সমসুবিধা প্রদান করা।

এই নির্দেশিকার আলোকে বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত একটি অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নির্মাণাধীন আছে আরও কয়েকটি। এর বাইরেও কিছু বেসরকারি উদ্যোক্তা আছেন, যারা অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন।

স্থানীয় লজিস্টিকস চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতের সাথে সংযুক্তির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আশুগঞ্জ কনটেইনার নদীবন্দর

মুক্তারপুর টার্মিনাল

বেসরকারি উদ্যোগে দেশের প্রথম ইনল্যান্ড ওয়াটার কনটেইনার টার্মিনাল গড়ে তুলেছে সামিট পোর্ট অ্যালায়েন্স লিমিটেড। মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরে ধলেশ্বরী নদীর তীরে ১৫ দশমিক ১৯ একর জমির ওপর টার্মিনালটি গড়ে উঠেছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্টসহ বন্ডিং ওয়্যারহাউস সুবিধা রয়েছে টার্মিনালটিতে। কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও স্টাফিং-আনস্টাফিং সুবিধা প্রদানের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রামভিত্তিক অফ-ডকগুলোর বিকল্প সেবা দিয়ে যাচ্ছে মুক্তারপুর টার্মিনাল।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে নিয়মিত আমদানি ও রপ্তানি কার্গো পরিবহনের পাশাপাশি ভারতের পূর্ব উপকূলের বন্দরগুলোর সাথে মুক্তারপুর টার্মিনালকে সংযুক্ত করে দেশটির সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহজ করার দিকে জোর দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য বাংলাদেশের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও ভারতের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (আইডব্লিউএআই) প্রয়োজনীয় রেগুলেটরি অনুমোদনও পেয়েছে এসএপিএল।

তৈরি পোশাকের অন্যতম কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ নিট পল্লীর কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় ভারতের সাথে সরাসরি বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানগুলো টার্মিনালটি থেকে অভূতপূর্ব সুবিধা পাচ্ছে। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি এই অঞ্চলে রয়েছে বেশ কিছু খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, যেগুলো কাঁচামালের জন্য মূলত ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়াও রয়েছে প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তারাও ভারত থেকে স্টিল প্লেট আমদানি করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানও টার্মিনালটির কারণে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে।

বর্তমানে ভারত থেকে আমদানিকৃত কনটেইনারজাত সব পণ্য কলম্বো, সিঙ্গাপুর ও পোর্ট কেলাংয়ের মতো হাব পোর্ট হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যায়। এই খরচ কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা মুক্তারপুর টার্মিনাল।

শিপিং লাইনগুলোর সহায়তায় মুক্তারপুর টার্মিনাল থেকে থ্রু বিল অব ল্যাডিং ইস্যু করার সুযোগ রয়েছে। এর ফলে রপ্তানিকারকরা আগেভাগেই তাদের নথিপত্রের কাজ করতে পারেন। সর্বোপরি ঢাকাভিত্তিক রপ্তানিকারকরা তাদের উৎপাদন ও রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বাড়তি সময় হাতে পান।

মোটা দাগে মুক্তারপুর টার্মিনাল ঢাকা ও এর আশপাশে আমদানি-রপ্তানিকারকদের পণ্য আমদানি-রপ্তানি সহজ করার সুযোগ দিচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৭০ শতাংশের গন্তব্য ও উৎস ঢাকা। পাশাপাশি বিশেষায়িত কনটেইনার ভেসেলের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে নিরাপদে কনটেইনার পরিবহনের সুবিধা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সবশেষে টার্মিনালটির মাধ্যমে রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকরা নির্ভরযোগ্য ও সময়ানুগ সেবা পাচ্ছেন।

এ কে খান কনটেইনার টার্মিনাল (একেকেসিটি)

নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা নামক স্থানে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করছে এ কে খান গ্রুপ। ডিজাইন অ্যান্ড বিল্ড পদ্ধতিতে এ কে খান কনটেইনার টার্মিনাল বা একেকেসিটি নির্মাণের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও কারিগরি সহায়তায় দিচ্ছে জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসাল্ট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেড। টার্মিনাল নির্মাণকাজ তদারকী এবং নির্মাণ পরবর্তী এক বছর বন্দর পরিচালনাসহ অন্যান্য কারিগরি সহায়তা দেবে প্রতিষ্ঠানটি।

কনটেইনার টার্মিনালটির জন্য ২ দশমিক ৩৮ একর নদীতীর ব্যবহার করা হবে। এজন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ কনটেইনারটি যাতে বৃহৎ পরিসরে পরিচালনা করা সম্ভব হয় সে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব মালিকানাধীন ২০০ একর ভ‚মি উন্নয়ন করেছে। কনটেইনার টার্মিনালটি হবে এ কে খান অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিআইডব্লিউটিএ সেটাই ঘোষণা করেছে। কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প সংলগ্ন স্থানে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ চলছে।

এ ছাড়া সড়কপথে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালটিতে কনটেইনার আনা-নেওয়া সহজ করতে প্রয়োজন উন্নত সড়ক যোগাযোগ। সে লক্ষ্যে পাঁচদোনা ডাঙ্গা-ইসলামপুর ঘাট সড়ক নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।

টার্মিনালটি যাতে সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয় তা নিশ্চিত করতে জাপানের মিতসুই অ্যান্ড কোম্পানির মালিকানাধীন সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠান পোর্টেক পোর্ট হোল্ডিংস প্রাইভেট লিমিটেডের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে একেকেসিটি। পোর্টেক পোর্ট হোল্ডিংস বিভিন্ন দেশে ১৩টির মতো বন্দর পরিচালনা করছে।

সর্বোচ্চ দক্ষতা নিশ্চিত করতে টার্মিনাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের ব্যবস্থাপনায় কনটেইনারসমূহ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে টার্মিনালে এবং টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পরিবহনের ব্যবস্থা করবে। চট্টগ্রাম ও পলাশ প্রান্তে কনটেইনার বোঝাই ও খালাসের জন্য দুটি করে চারটি, চট্টগ্রাম থেকে পলাশগামী দুটি এবং পলাশ থেকে চট্টগ্রামগামী দুটিসহ মোট আটটি কনটেইনার ভেসেল সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এসব ভেসেলের মাধ্যমে টার্মিনালটিতে বছরে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ টিইউজ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্য রয়েছে।

সড়ক যোগাযোগ সক্ষমতা ব্যাপক বাড়ানো সত্ত্বেও আগামী দিনে কনটেইনার পরিবহনের ক্রমবর্ধমান চাপ সড়ক ও রেলপথের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। অভ্যন্তরীণ হয়ে উঠবে এর সর্বোত্তম বিকল্প। নদীপথে কনটেইনার পরিবহনের মাধ্যমে সড়কের ওপর বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। সরকারেরও অগ্রাধিকার এটি। এমনটা হলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপরও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের মাধ্যমে লজিস্টিক দক্ষতা বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতামূলক করা গেলে বাংলাদেশের জিডিপি এক শতাংশের বেশি বাড়বে। বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়বে ২০ শতাংশের বেশি।

যেসব আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করেন তাদের জন্য এ কে খান কনটেইনার টার্মিনাল কনটেইনার সরবরাহ শৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করবে। কনটেইনার টার্মিনালটি দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে কনটেইনার পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে গতি সঞ্চার করবে।

এ ছাড়া নরসিংদী, গাজীপুর, সাভার ও টঙ্গীর আওতাধীন শিল্প কারখানার উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে কনটেইনার টার্মিনালটি বড় ভূমিকা রাখবে। এ কে খান অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য পরিবহনেও মূল ভ‚মিকা পালন করবে কনটেইনার টার্মিনালটি।

রূপায়ন কনটেইনার টার্মিনাল

চট্টগ্রাম বন্দর এবং ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় কনটেইনার পরিবহন দ্রুত ও সহজ করতে রাজধানী ঢাকার কাছে ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করছে রূপায়ন গ্রুপ। রূপায়নের কনটেইনার টার্মিনালটির অবস্থান নারায়ণগঞ্জের আদমজী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের বিপরীতে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ধামগড় এলাকায়। টার্মিনালটির কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা হবে বার্ষিক ২ লাখ ৫০ হাজার টিইউজ।

অবস্থানগত কারণে টার্মিনালটি নারায়ণগঞ্জ, আদমজী ইপিজেড, কাঁচপুর-রূপগঞ্জ-সোনারগাঁ বেল্ট, টঙ্গী, সাভার, ঢাকা ইপিজেড, জয়দেবপুর, গাজীপুর ও ভালুকার মতো শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোকে সহজেই কনটেইনার পরিবহন সুবিধা দিতে পারবে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, টার্মিনালটিতে দুটি বার্থ থাকবে। একটির দৈর্ঘ্য ৯০ মিটার এবং অন্যটির ১১০ মিটার। ২৭ একর জমির ওপর টার্মিনালটি নির্মিত হবে এবং আধুনিক কনটেইনার স্ক্যানার, অ্যাগ্রো ইন্সপেকশন ও কোয়ারেন্টাইন সুবিধা থাকবে। সেই সাথে থাকবে ফিউমিগেশন এরিয়া।

বন্দর ব্যবহারকারীরা যাতে লোডিংয়ের আগে ও পরে যেকোনো সময় তাদের কনটেইনার অবস্থান জানতে পারেন সেজন্য থাকবে ওয়েব-বেজড ইন্টারফেসসহ আধুনিক ও কম্পিউটারাইজড সিস্টেম। কনটেইনারবাহী বার্জের মাধ্যমে ভারতীয় শিপাররা টার্মিনালটিকে ট্রান্সশিপমেন্ট নদীবন্দর হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলো দিয়ে এসব বার্জ টার্মিনালটিতে পৌঁছানোর পর ঢাকা শহরকে পাশ কাটিয়ে রোড ট্রেইলারযোগে এসব কনটেইনার ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে নেওয়া যাবে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানিকারকদের কনটেইনার পরিবহনের খরচ কমিয়ে আনতে ভ‚মিকা রাখবে টার্মিনালটি।

ঢাকা ও আশপাশের ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানি-রপ্তানি সহজ করতে ভূমিকা রাখছে ধলেশ্বরীতে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা মুক্তারপুর টার্মিনাল

শেষ কথা

দেশে কনটেইনার পরিবহন ধারাহিকভাবে বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর একাই প্রতি বছর ৩০ লাখ টিইউজের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি কনটেইনারের গন্তব্য ঢাকা, যার মাত্র ১০ শতাংশ পরিবাহিত হয় রেলপথে। এই অবস্থায় অভ্যন্তরীণ নৌপথে কম খরচে কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ রয়েছে। নদীপথে কনটেইনার পরিবহন সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেওয়া গেলে তা কেবল ব্যয় সাশ্রয়ী ও সড়কের ওপর চাপই কমাবে না, জিডিপি প্রবৃদ্ধিও ১ শতাংশ বাড়বে বলে প্রাক্কলন করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

অভ্যন্তরীণ নৌপথে কনটেইনার পরিবহনের এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর অংশ হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ নৌপথে বেসরকারি অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষায় ক্যাপিটাল ও মেইনটেইন্যান্স ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে পারফরম্যান্সভিত্তিক চুক্তিতে যেতে হবে। জাহাজ আধুনিকায়নের পাশাপাশি নৌযানের নকশায় নতুনত্ব আনতে হবে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে যাতে কোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় সেজন্য এইডস টু নেভিগেশনের উন্নতি করতে হবে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করাও জরুরি। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংক্রান্ত নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে অংশীজনদের পরামর্শ নিতে হবে এবং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। সর্বোপরি অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহারকারীদের জন্য সমন্বিত লজিস্টিকস সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here