বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৫
29 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

নতুন শ্রেণীকরণে নৌপথ বাড়ছে ১০ হাজার কিমি

নদীবাংলা ডেস্ক,

প্রাক-কথা

নদী বাংলার চিরন্তন, শাশ্বত রূপ। নদীকে আশ্রয় করেই লোকালয়, শহর ও নগরের পত্তন। ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়াতেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে নদী ও নৌপথ। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে জাতীয় মহাসড়ক যখন খুব বেশি ছিল না তখন এই নৌপথই ছিল যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম। এখনো শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সবচেয়ে সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব মাধ্যম অভ্যন্তরীণ নৌপথ। এই নদী ও নৌপথের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা এমনকি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।

তবে অপরিকল্পিত অবকাঠামোর কারণে এই নদীই কোথাও কোথাও হয়ে পড়েছে বিশীর্ণ-কৃশকায়। বিঘ্নিত হচ্ছে বাধাহীন, নিরাপদ, নিরবচ্ছিন্ন নৌ চলাচল। অপরিকল্পিত এসব অবকাঠামো থেকে নৌপথগুলোকে রক্ষায় এবার বড় পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এরই অংশ হিসেবে অ-শ্রেণীকৃত আরও ১০ হাজার ১৮৭ কিলোমিটার নৌপথ শ্রেণীকরণ করা হচ্ছে। সংশোধন করা হচ্ছে নৌপথে অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা।

অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্ব

নদীমাতৃক এই বঙ্গদেশে বরাবরই স্থলপথ অপেক্ষা নদীপথে যাতায়াত ও বাণিজ্য প্রশস্ততর। এ পথ প্রাগৈতিহাসিক। এমনকি রেলপথে দ্রুত বাণিজ্য-সম্ভার যাতায়াতের সূচনা হওয়ার আগ পর্যন্তও বাণিজ্যলক্ষ্মীর যাতায়াত অভ্যন্তরীণ নদীপথেই বেশি ছিল। পরের দিকে রেলের আবির্ভাব ও সড়ক যোগাযোগের উন্নতির কারণে পণ্য পরিবহনে নদীপথের হিস্যা কমেছে। তাই বলে ব্রাত্য হয়ে পড়েনি। পাকিস্তান ইকোনমিক সার্ভে, ১৯৬৯-৭০-এর তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৬৯-৭০ সালেও ২৪,০০০ কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে ৫,৪১৭ কিলোমিটার (৩,৩৫২ মাইল) স্থায়ীভাবে নাব্যতা ধরে রেখেছিল। স্বাভাবিকভাবেই যাত্রী ও কার্গো পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথের তাৎপর্যপূর্ণ হিস্যা ছিল। ১৯৭৫ সালের দিকেও মোট যাত্রী পরিবহনের ১৫ শতাংশ হতো অভ্যন্তরীণ নৌপথে।

ব্যয়সাশ্রয়ী ও নিরাপদ মাধ্যম হওয়ার কারণে সেই গুরুত্ব এখনো ধরে রেখেছে দেশের বিস্তৃত অভ্যন্তরীণ নৌপথ। বরং, পরিবেশবান্ধব এই মাধ্যমটি ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরেও দেশের প্রধান নৌরুটগুলো দিয়ে ১৩ কোটি ৫৩ লাখ টন কার্গো পরিবাহিত হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ নৌপথে বেশি পরিবাহিত হয় নির্মাণ সামগ্রী, খাদ্যশস্য, সার, সিমেন্ট তৈরির উপাদান ক্লিংকার, ফ্লাই অ্যাশ, কয়লা, জ্বালানি তেল প্রভৃতি। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা ক্লিংকারের ৮০ শতাংশই বার্জের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথে নিজস্ব জেটিতে নিয়ে থাকে ঢাকা অঞ্চলের সিমেন্ট কারখানাগুলো। বাকি ২০ শতাংশ ক্লিংকার বার্জের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কারখানাগুলোর নিজস্ব জেটিতে নেওয়া হয়। আর মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি করা ক্লিংকারের প্রায় পুরোটাই অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করে বার্জের সাহায্যে খুলনা অঞ্চলের সিমেন্ট কারখানাগুলোর নিজস্ব জেটিতে আনা হয়।

সিমেন্ট উৎপাদনের আরেক কাঁচামাল ফ্লাই অ্যাশ আমদানি করা হয় ভারত থেকে এবং এগুলোর সবই অভ্যন্তরীণ নৌপথে বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল রুট ব্যবহার করে পরিবাহিত হয়। দেশে উৎপাদিত সিমেন্টেরও ৩০ শতাংশ পরিবাহিত হয় অভ্যন্তরীণ নৌ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত ও আমদানি করা ৩৫ লাখ টনের বেশি সার অভ্যন্তরীণ নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবাহিত হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে সার আমদানির পর অভ্যন্তরীণ নৌপথে তা পরিবহন করা হয়। বিশেষ করে বাঘাবাড়ী, নগরবাড়ী ও নওয়াপাড়া নদীবন্দরে এই সার খালাসের পর তা বিসিআইসি ও বিএডিসির গুদামে সংরক্ষণ করা হয়। দেশীয় উৎপাদিত সারও বিশেষ করে চট্টগ্রামে উৎপাদিত সার অভ্যন্তরীণ নৌপথের মাধ্যমে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের নদীবন্দর বাঘাবাড়ী ও নগরবাড়ীতে খালাস হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গম আমদানির পর তার প্রায় ৮০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ নৌপথে নারায়ণগঞ্জের ফ্লাওয়ার মিলগুলোতে পৌঁছায়। বাকি গম চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। আর মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি করা গম অভ্যন্তরীণ নৌপথে নওয়াপাড়া নদীবন্দর ও খুলনা অঞ্চলের বেসরকারি বিভিন্ন জেটিতে পৌঁছায় এবং সেখানে খালাস করা হয়।

অভ্যন্তরীণ নৌপথের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন পেট্রোলিয়াম পণ্য চট্টগ্রাম থেকে খুলনা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ ও বাঘাবাড়ীতে নেওয়া হয়। সারাদেশে বিতরণ করা পেট্রোলিয়াম পণ্যের ৯০ শতাংশই অভ্যন্তরীণ নৌপথে এসব ডিপোর মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। বাকি ১০ শতাংশ পরিবাহিত হয় রেল ও সড়কপথে। স্বাভাবিকভাবেই যাত্রীর পাশাপাশি পণ্য পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ভূমিকা ব্যাপক। তাই অভ্যন্তরীণ এসব নৌপথে বাধাহীন নৌ চলাচল নিশ্চিত করা গেলে জাতীয় অর্থনীতিতে তা আরও বড় ভূমিকা রাখবে।

নৌপথের বিদ্যমান শ্রেণি

অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনাদি নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ৮০টি নদীর সমন্বয়ে ৯৫টি অভ্যন্তরীণ নৌরুট রয়েছে। গেজেটভুক্ত এসব রুটের মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার। এর বাইরেও বিভিন্ন নৌরুট রয়েছে, যেগুলোতে নৌকা ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ নৌযান অনানুষ্ঠানিকভাবে চলাচল করে।

সাধারণত চারটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ এসব নৌপথের শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, সর্বনিম্ন প্রাপ্য গভীরতা (এলএডি); বর্তমান ও ভবিষ্যতে কার্গো ও যাত্রী বিবেচনায় নৌপথের

গুরুত্ব; নৌরুটের ওপর নির্ভরশীলতার মাত্রা এবং ট্রাফিক ঘনত্ব। ট্রাফিক ঘনত্ব বলতে বোঝায় যাত্রী, পণ্য ও নৌযানের সংখ্যার নিরিখে ট্রাফিকের বার্ষিক পরিমাণ।

এসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌরুটগুলো চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত। কোনো নৌপথের গভীরতা ৩ দশমিক ৬ থেকে ৩ দশমিক ৯ মিটার হলে তা ক্লাস-১ বা প্রথম শ্রেণির নৌরুট হিসেবে গণ্য। ক্লাস-২ বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে রাখা হয়েছে ২ দশমিক ১ থেকে ২ দশমিক ৪ মিটার গভীর নৌরুটকে। কোনো নৌরুটের গভীরতা ২ দশমিক ১ মিটারের কম অর্থাৎ ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৮৩ মিটারের মধ্যে থাকলে সেই নৌপথকে ধরা হয় ক্লাস-৩ বা তৃতীয় শ্রেণির নৌরুট। গভীরতা ১ দশমিক ৫ মিটারের নিচে হলে সেটি ক্লাস-৪ বা চতুর্থ শ্রেণির নৌরুট। বর্ষা মৌসুমে যে ছয় হাজার কিলোমিটার নৌপথ নৌযান চলাচলের উপযোগী থাকে তার ৪০ শতাংশ চতুর্থ শ্রেণির। এ ছাড়া ৩২ শতাংশ তৃতীয় শ্রেণির, ১৭ শতাংশ দ্বিতীয় শ্রেণির এবং অবশিষ্ট ১১ শতাংশ প্রথম শ্রেণির নৌপথ।

নতুন শ্রেণীকরণ

বহু আগে থেকেই বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ নৌপথ সংক্রান্ত নানা প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত নেদারল্যান্ডসের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান নেডেকো। দেশে অভ্যন্তরীণ নৌরুটের প্রথম শ্রেণীকরণ করে তারাই ১৯৬৭ সালে। পরবর্তীতে নেদারল্যান্ডসেরই আরেক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল হাসকোনিং ডিএইচভি ১৯৮৯ সালে নৌরুটের আরেকটি শ্রেণীকরণ করে। এটাই এখন পর্যন্ত চালু আছে। পণ্যভর্তি অবস্থায় যন্ত্রচালিত কার্গো ভেসেলের ড্রাফট এবং সর্বনিম্ন গভীরতা প্রাপ্যতার ভিত্তিতে এই শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। কিন্তু গত সাড়ে তিন দশকে অনেক নদীতে পলি জমে নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। সেই সাথে নদীর প্রধান প্রধান চ্যানেলগুলো পরিবর্তিত হয়েছে। বড় নৌযান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কম উচ্চতার অসংখ্য সেতু নৌপথের ওপর নির্মিত হয়েছে। নদীর ওপর এসব সেতু নির্মাণের ফলে আনুভূমিক ও উল্লম্ব ছাড় হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু চালুর ফলে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও ফেরি সেবা কমেছে। যদিও কার্গো পরিবহন বাড়ছে দ্রুত গতিতে। সর্বোপরি পরিবর্তন এসেছে নৌযানের আকার এবং ধরনেও। এসব বিবেচনায় নৌরুটের নতুন শ্রেণীকরণ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

নতুন করে শ্রেণীকরণ বা পুনঃশ্রেণীকরণের জন্য সারাদেশে ৩৬৭টি নদীর একটি তালিকা করেছে বিআইডব্লিউটিএ। একটি গবেষণা প্রকল্পের অধীনে এগুলোর স্ট্যান্ডার্ড হাই-ওয়াটার লেভেল (এসএইচডব্লিউএল) এবং স্ট্যান্ডার্ড লো-ওয়াটার লেভেল (এসএলডব্লিউএল) নির্ধারণ করেছে কর্তৃপক্ষ। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সহায়তায় ‘ডিটারমিনেশন অব এসএইচডব্লিউএল, এসএলডব্লিউএল অ্যান্ড রি-ক্লাসিফিকেশন অব ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

এসএইচডব্লিউএল এবং এসএলডব্লিউএল নির্ধারণে বিভিন্ন সংস্থার ৪৪২টি গেজ স্টেশনের গত ২৫ বছরের উপাত্ত বিচেনায় নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্টেশনের সংখ্যা ৩৪৩, বিআইডব্লিউটিএর ৮৯, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ৮ এবং মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ২টি।

এসএইচডব্লিউএল (SHWL) হচ্ছে এমন পানি সমতল, যা বিবেচিত সময়সীমার ২ শতাংশ ক্ষেত্রে অতিক্রম করে যায়। আর এসএলডব্লিউএল (SLWL) হচ্ছে এমন পানি সমতল, যা বিবেচিত সময়ের ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে অতিক্রম করে যায়।

গবেষণায় নৌরুটের শ্রেণি বিদ্যমান চারটির পরিবর্তে ছয়টি প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ শ্রেণি নামে নতুন একটি শ্রেণির কথা বলা হয়েছে। বিশেষ শ্রেণি হিসেবে সেইসব নৌরুটকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যেগুলোতে সারাবছর নৌ চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় নাব্যতা থাকে এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের সাথে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করেছে। এই নৌরুটের সর্বনিম্ন গভীরতা ৪ দশমিক ৫ মিটার। প্রথম শ্রেণির নৌরুটগুলো সারাবছর নৌযান চলাচলের উপযোগী থাকে এবং এগুলো চাঁদপুর/বিশেষ শ্রেণির রুটকে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং সংলগ্ন নৌরুটগুলোর সাথে সংযুক্ত করেছে। এই শ্রেণির রুটের সর্বনিম্ন প্রাপ্য গভীরতা ৪ মিটার। দ্বিতীয় শ্রেণির নৌরুটগুলোতেও সারাবছর নৌযান চলাচলের উপযোগী নাব্যতা থাকে এবং প্রধান নদীবন্দরগুলোকে প্রটোকলভুক্ত রুটগুলোসহ সেকেন্ডারি বন্দরগুলোর সাথে সংযুক্ত করেছে। এই শ্রেণির নৌরুটগুলোর সর্বনিম্ন প্রাপ্য গভীরতা ২ দশমিক ৫ মিটার। তৃতীয় শ্রেণির রুটগুলোও সারাবছর নৌ চলাচলের উপযোগী থাকে এবং এগুলো সেকেন্ডারি বন্দরগুলোকে আইডব্লিউটি স্টেশনগুলোর সাথে সংযুক্ত করেছে, যার সর্বনিম্ন গভীরতা ২ মিটার। চতুর্থ শ্রেণির নৌরুটগুলো মৌসুমি এবং বন্দর/ল্যান্ডিং স্টেশনগুলোকে প্রধান কেন্দ্রগুলোর সাথে সংযোগকারী। এই শ্রেণির রুটের সর্বনিম্ন প্রাপ্য গভীরতা ১ দশমিক ৫ মিটার। পঞ্চম শ্রেণির নৌরুটগুলোও মৌসুমি এবং বর্ষা মৌসুমেও ১ দশমিক ৫ মিটারের কম গভীরতা থাকে।

প্রস্তাবিত নতুন শ্রেণীকরণের ফলে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌপথের শ্রেণি যেমন চারটি থেকে ছয়টিতে উন্নীত হচ্ছে, একইভাবে নৌপথের দৈর্ঘ্য বাড়ছে ১০ হাজার ১৮৭ কিলোমিটার। কারণ, সর্বশেষ ডিএইচভির শ্রেণীকরণে গেজেটভুক্ত নৌপথের দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার থাকলেও নতুন শ্রেণীকরণে তা বেড়ে হচ্ছে ১৬ হাজার ১৫৫ কিলোমিটার। প্রস্তাবিত শ্রেণীকরণে বিশেষ ও শ্রেণি-৫ এ নতুন নৌপথ তো থাকছেই, পাশাপাশি বিদ্যমাণ সব শ্রেণিতেও নৌপথের দৈর্ঘ্য বাড়ছে। নতুন শ্রেণীকরণে বিশেষ ও শ্রেণি-৫ এ নৌপথের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে যথাক্রমে ৪৪৬ ও ২ হাজার ৯১৬ কিলোমিটার। এ ছাড়া শ্রেণি-৪ এ নৌপথের দৈর্ঘ্য বিদ্যমান ২ হাজার ৩৮০ কিলোমিটার থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৪ হাজার ৪৪৭ কিলোমিটারে। অন্যান্য শ্রেণির মধ্যে শ্রেণি-৩ এ নৌপথের দৈর্ঘ্য বিদ্যমান ১ হাজার ৯০৫ থেকে বেড়ে হচ্ছে ৩ হাজার ৪৮০ কিলোমিটার, শ্রেণি-২ এ এক হাজার থেকে বেড়ে দুই হাজার কিলোমিটার এবং শ্রেণি-১ এ ৬৮৩ কিলোমিটার থেকে নৌপথের দৈর্ঘ্য বেড়ে হচ্ছে ২ হাজার ৮৩৬ কিলোমিটার।

নতুন শ্রেণীকরণে বারোমাসি ও মৌসুমি উভয় শ্রেণির নৌপথের দৈর্ঘ্যই উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বারোমাসি নৌপথের দৈর্ঘ্য। ১৯৮৯ সালে ঘোষিত বিদ্যমান শ্রেণীকরণে বারোমাসি নৌপথের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৫৮৮ কিলোমিটার থাকলেও প্রস্তাবিত শ্রেণীকরণে তা বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৭৬২ কিলোমিটার। এ ছাড়া বিদ্যমান শ্রেণীকরণে মৌসুমি নৌরুটের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৩৮০ কিলোমিটার। প্রস্তাবিত শ্রেণীকরণে তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৭ হাজার ৩৯৩ কিলোমিটারে।

নতুন শ্রেণীকরণে বিশেষ শ্রেণিতে পড়েছে তিনটি রুট। এ ছাড়া প্রথম শ্রেণির নৌপথে রুট পড়েছে ৪১টি, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৪৬টি, তৃতীয় শ্রেণিতে ১১২টি, চতুর্থ শ্রেণিতে ১০৯টি এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ৫৬টি।

আন্তর্জাতিক চর্চা

নৌপথের শ্রেণীকরণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু রীতি আছে। বাংলাদেশে নৌপথের নতুন শ্রেণীকরণেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এসব রীতিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ইউরোপের নদীপথের শ্রেণীকরণে গৃহীত মানদণ্ডকে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, একইভাবে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে প্রতিবেশী দেশের দিকেও।

ইউরোপে নৌপথের শ্রেণীকরণে প্রধান যেসব মানদণ্ড বিবেচনায় নেওয়া হয় তার মধ্যে রয়েছে নৌযানের উল্লম্ব আকার, সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য এবং সর্বোচ্চ বিম, ড্রাফট ও টনেজ। আনুষঙ্গিক মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয় আনুভূমিক আকারকে অর্থাৎ, কার্গোভর্তি নৌযানের সর্বোচ্চ উচ্চতা ও সেতুর তলদেশের উচ্চতার মধ্যকার ব্যবধানকে। এসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে ইউরোপের নৌপথগুলোকে সাতটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে শ্রেণি-৫কে দুইটি এবং শ্রেণি-৬কে তিনটি উপ-শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এখানে সপ্তম শ্রেণির নৌপথ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের শ্রেণি-১ থেকে শ্রেণি-৩ পর্যন্ত নৌপথগুলোতে যান্ত্রিক নৌযান ও বার্জ চলাচল করে, যেগুলোর গুরুত্ব জাতীয় পর্যায়ে। এ ছাড়া শ্রেণি-৪ থেকে শ্রেণি-৭ পর্যন্ত নৌরুটগুলোতে চলাচল করে যন্ত্রচালিত নৌযান ও বার্জ এবং পুশ কনভয়। এগুলোর গুরুত্ব কেবল জাতীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়; আন্তর্জাতিকভাবেও সমান তাৎপর্যপূর্ণ এসব নৌপথ।

অভ্যন্তরীণ নৌপথ সবচেয়ে সফলভাবে কাজে লাগাচ্ছে চীন। দেশটিতে পণ্য পরিবহনের সিংহভাগই হয় অভ্যন্তরীণ নৌপথে। এর কারণ মূলত নৌপথ ব্যবহারে দেশটির সুদীর্ঘ ইতিহাস। খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে তারাই সর্বপ্রথম নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২১৪ অব্দে ইয়াংজি ও ঝুজিয়াং নদীকে সংযোগকারী ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খনন করে। চীনে রয়েছে ৫০ হাজারের মতো প্রাকৃতিক নদী ও ৯০০টি হ্রদ। বিপুল বিস্তৃত এই নদী ও হ্রদের সুবাদে দেশটিতে অভ্যন্তরীণ নৌপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে সাকুল্যে ১ লাখ ২৬ হাজার ৩০০ কিলোমিটার।

বিশাল এই নৌপথের সুবাদে চীনে মোট পণ্য পরিবহনের ৫১ শতাংশ হয়ে থাকে নৌপথে। এ ছাড়া ৩৪ শতাংশ পণ্য পরিবাহিত হয় সড়কপথে ও ১৫ শতাংশ রেলপথে। চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের বরাত দিয়ে এমন উপাত্তই দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

চীন সরকারের জারি করা ‘দ্য নেভিগেশন স্ট্যান্ডার্ড ফর ইনল্যান্ড রিভার্স’ অনুযায়ী, দেশটির অভ্যন্তরীণ নৌপথ মোট সাতটি শ্রেণিতে বিভাজিত। একাধিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে রুটগুলোর শ্রেণীকরণ করেছে তারা। এর মধ্যে রয়েছে নৌযান, নৌপথ ও লকের আকার এবং সেতুর ক্লিয়ারেন্স।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে অবশ্য কার্গো পরিবহনের সামান্যই অভ্যন্তরীণ নৌপথে হয়ে থাকে। সেখানে পণ্য পরিবহন এখনো মূলত সড়কনির্ভর। তবে পরিবেশ ও খরচের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তারাও অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনের ওপর জোর দিচ্ছে এবং নতুন নতুন জাতীয় নৌরুট চালু করছে। বর্তমানে দেশটিতে জাতীয় নৌপথ রয়েছে ১১১টি, যার দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৪ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৩টি জাতীয় নৌপথে জাহাজ চলাচল এবং কার্গো ও যাত্রী পরিবহন চালু আছে। এসব নৌপথের মধ্যে ৫ হাজার ২০০ কিলোমিটার নদী এবং ৪ হাজার কিলোমিটার ক্যানেল। তাদেরও অভ্যন্তরীণ নৌপথের শ্রেণি রয়েছে সাতটি।

নতুন বিধিমালা

অভ্যন্তরীণ নৌপথে বড় জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন করতে তীর ও ফোরশোর বরাবর অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ন্ত্রণে ২০১০ সালে বিধিমালা প্রকাশ করে সরকার। সেখানে নদীর ওপর অবকাঠামো নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএর কাছ থেকে অনুমোদন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০১০ সালের বিধিমালা অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণির নৌপথে আনুভূমিক ও উলম্ব ছাড় যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৩ ও ৭৬ দশমিক ২২ মিটার। দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথের ক্ষেত্রে এই সীমা যথাক্রমে ১২ দশমিক ২ ও ৭৬ দশমিক ২২ মিটার; তৃতীয় শ্রেণির নৌপথের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৭ দশমিক ৬২ ও ৩০ দশমিক ৪৮ মিটার এবং চতুর্থ শ্রেণির নৌপথের ক্ষেত্রে আনুভূমিক ও উলম্ব ছাড় যথাক্রমে ৫ ও ২০ মিটার।

কিন্তু বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন নদীর ওপর কম উচ্চতার সেতু নির্মাণ করলেও বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র নেয়নি, যার ফলে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। এরপর ২০১৮ সালে বিআইডব্লিউটিএ ৯৫টি রুটের ৫ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার নৌপথ অন্তর্ভুক্ত করে এই বিধিমালা সংশোধন করে। এ ছাড়া পরিকল্পনা কমিশনও নদীর ওপর সেতু নির্মাণ এবং এ ধরনের অবকাঠামো প্রকল্পের অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটিএর কাছ থেকে ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে।

তারপরও অ-শ্রেণীকৃত নৌপথের ওপর কম উচ্চতার সেতু নির্মিত হচ্ছে। এটা যাতে না হয় সেজন্যই ‘অভ্যন্তরীণ নৌপথে স্থাপনা নির্মাণ বিধিমালা ২০২৪’ নামে নতুন একটি খসড়া বিধিমালা প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়া বিধিমালায় উপকুলীয় নৌপথের যে অংশে অভ্যন্তরীণ নৌযান চলাচল করে এই বিধিমালায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তাও অভ্যন্তরীণ নৌপথ হিসেবে গণ্য হবে।

ছাড়পত্র গ্রহণ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রস্তাবিত খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি, বেসরকারি বা বিধিবদ্ধ যেকোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ওপর স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র গ্রহণের জন্য তফসিলে সংযুক্ত নির্ধারিত ফরম মোতাবেক আবেদন করতে হবে।

স্থাপনা পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সম্পর্কে খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে উল্লম্ব ছাড় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত এসএইচডব্লিউএল ভিত্তি ধরে ওপরের দিকে পরিমাপযোগ্য হবে। উল্লম্ব ছাড় নদীর মাঝখানে/মূলপ্রবাহ/মূলপ্রবাহসমূহের ক্ষেত্রে এসএইচডব্লিউএল থেকে গণনা করতে হবে।

খসড়া বিধিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে, ১ম ও ২য় শ্রেণির নৌপথে বিদ্যমান কোনো সেতুর উজানে বা ভাটিতে এক হাজার মিটারের অনধিক দূরত্বে অন্য কোনো সেতু নির্মাণ করা যাবে না। বিদ্যমান দুইটি সেতুর মধ্যকার দূরত্ব এক হাজার মিটারের কম হলে তার মধ্যে প্রথম যে সেতুটি প্রতিস্থাপন অথবা পুনর্নির্মাণ করা হবে সেটি এক হাজার মিটারের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নির্মাণ করতে হবে। যদি সড়কের প্রস্থ বাড়ানোর ক্ষেত্রে পাশাপাশি এক হাজার মিটারের মধ্যে নতুন সেতু নির্মাণের প্রয়োজন পড়ে সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় সেতু নির্মাণে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে ওই সেতু আলোচ্য নৌপথে নৌযান চলাচলে কোনোভাবেই বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না এবং আলোচ্য নৌপথের আনুভূমিক ও উল্লম্ব ছাড় অনুসরণ করা হবে।

সেতুর নকশা প্রণয়নের পরে করণীয় সম্পর্কে খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, ডিজাইন ভেটিং পরীক্ষার লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ গঠিত কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করবে।

অভ্যন্তরীণ নৌপথের ওপর বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন বা তার টেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে নির্ধারিত উল্লম্ব ছাড়ের ন্যূনতম পরিমাপের সাথে অতিরিক্ত ৫ মিটার যোগ করতে হবে।

অভ্যন্তরীণ নৌপথের তলদেশে টানেল, পাইপ লাইন, কেবল লাইন ইত্যাদি স্থাপনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত পরিমাপ অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ হাইড্রোলজিক্যাল ও জিও-মরফলজিক্যাল সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।

নদীর তলদেশে স্থাপনাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ গঠিত কমিটি নির্মাণকারী সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত সমীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা, স্থানীয় বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধির সাথে আলোচনাসাপেক্ষে ছাড়ের পরিমাপ বিবেচনা করবে ও কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে ছাড় প্রদান করা হবে।

ছাড়পত্র পাওয়ার সময়সীমার ব্যাপারে বলা হয়েছে, আবেদন পাওয়ার পর বিধি মোতাবেক নকশার সংশ্লিষ্ট অংশ কর্তৃপক্ষের দপ্তরে দাখিলের ৩০ দিনের মধ্যে নির্ধারিত শর্তসাপেক্ষে কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র ইস্যু করবে।

ফি ও শুল্ক পরিশোধের ব্যাপারে প্রস্তাবিত বিধিমালায় বলা হয়েছে, নির্মাণ/স্থাপনের ছাড়পত্র প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সময়ে সময়ে কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত হার ও শর্তে ফি পরিশোধ করতে হবে।

অংশীজনদের পর্যবেক্ষণ

অভ্যন্তরীণ নৌপথ সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) হলেও অংশীজন রয়েছে একাধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগ (আরএইচডি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। প্রস্তাবিত বিধিমালা ও নৌরুটের নতুন শ্রেণীকরণের ব্যাপারে সংস্থাগুলো তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে। পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন অ্যাকাডেমিশিয়ানরাও।

নতুন বিধিমালার ফলে বন্ধ হবে নৌপথে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ। ছবি: সংগৃহীত

তারা কিছু নৌপথের শ্রেণি পরিবর্তনের পক্ষে মত দিয়েছেন। এ ছাড়া চার শ্রেণির নদীর উল্লম্ব ছাড় বাড়ানোর ফলে সরকারের সেতু প্রকল্পগুলোর ব্যয়ের ওপর এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তারা। তাই কোন ধরনের নৌযান কোন নৌপথে চলাচল করবে সবার আগে সেই প্রশ্নের মীমাংসার পর ওইসব নৌযানকে বিবেচনায় নিয়ে নৌপথের শ্রেণীকরণের প্রস্তাব করেছেন তারা। কারণ, নতুন শ্রেণীকরণ বাস্তবায়ন হলে বহু সেতু ভাঙতে হবে। যদিও বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফার ভাষায়, তারা সেতুগুলো ভাঙতে বলছেন না। তবে ভবিষ্যতে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে যেন এই শ্রেণীকরণের বিষয়টি স্মরণে রাখা হয় সেই আহ্বান জানাচ্ছেন।

নতুন সেতু নির্মাণের সময়ই নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান যাতে পরিত্যক্ত সেতুটি নদীর তলদেশ পর্যন্ত অপসারণ করে বিধিমালায় সেই নির্দেশনা যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে এলজিইডি, যাতে করে পরিত্যক্ত সেতু দ্রুত অপসারণ সম্ভব হয়। প্রস্তাবটি বিবেচনার পক্ষে মত দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।

৫ম শ্রেণির নৌপথে ৩ দশমিক ৫ মিটার উল্লম্ব ছাড়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। শ্রেণীকরণ চূড়ান্ত করার আগে এই ছাড় স্থানীয় জনগণের বা জনপ্রতিনিধিদের চাহিদা মোতাবেক নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ। পাশাপাশি শাখা-প্রশাখা নৌপথের আনুভূমিক ও উলম্ব ছাড়ের ক্ষেত্রে নৌপথের উপশ্রেণি প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। এই প্রস্তাবকেও বিবেচনাযোগ্য বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ।

পণ্য পরিবহনে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী শীতলক্ষ্যা। ছবি: সংগৃহীত

প্রস্তাবিত বিধিমালায় ১ম ও ২য় শ্রেণির নৌপথে বিদ্যমান কোনো সেতুর উজানে বা ভাটিতে এক হাজার মিটারের অনধিক দূরত্বে অন্য কোনো সেতু নির্মাণ করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিধিটি কেবলমাত্র ১ম ও ২য় শ্রেণির নৌপথের পরিবর্তে সকল শ্রেণির ক্ষেত্রে প্রয়োজন বা প্রযোজ্য হতে পারে বলে মত দিয়েছে এলজিইডি। একই সাথে দুটি সেতুর মধ্যে দূরত্ব এক কিলোমিটারের পরিবর্তে দুই কিলোমিটার করার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। এলজিইডির এই প্রস্তাবের সাথে একমত পোষণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

ভবিষ্যতে কোনো নদীতে এসএইচডব্লিউএল-এর সঠিক মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ গঠিত স্থানীয় কমিটির উদ্যোগে ওই স্থানের পানি সমতল পুনর্নিরীক্ষা ও পুনর্বিশ্লেষণ করে যথোপযুক্ত মান নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ। কর্তৃপক্ষ এই প্রস্তাবটিও বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে।

বেশ কিছু নৌপথের প্রস্তাবিত শ্রেণি পুনর্বিবেচনার সুপারিশও করেছে এলজিইডি। যেমন বাউলাই নদী দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা যুক্তিসঙ্গত হয়নি বলে মনে হয়েছে তাদের কাছে। তারা বলছে, বর্তমানে নদীটির প্রস্থ ৫০-৬০ মিটার এবং গভীরতাও খুবই কম। এ ছাড়া চলাচলকারী নৌযানের আকার ও উৎসমুখে বছরব্যাপী যথেষ্ট পানিপ্রবাহ না থাকায় নৌপথটিকে দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত করাতে বাড়তি সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি হবে। নৌপথটি তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করলে ভবিষ্যতে তা সেতু নির্মাণে অর্থের অপচয় ও জনদুর্ভোগ হ্রাসে সহায়ক হবে বলে মনে করে সংস্থাটি। তবে টেকেরহাট নৌবন্দর থাকায় নৌপথটি খননের মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণির নাব্যতা সৃষ্টি করা হবে বলে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।

‘অভ্যন্তরীণ নৌপথে স্থাপনাদি নির্মাণ বিধিমালা ২০২৪’ এর বিভিন্ন জায়গায় কেবল শব্দের পাশাপাশি অপটিক্যাল ফাইবার কেবল উল্লেখের প্রস্তাব করেছে বিটিসিএল। এ ছাড়া সাবমেরিন কেবল স্থাপনের ক্ষেত্রে এর গভীরতা কোন শ্রেণির নৌপথে কত হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা সংযোজন করার পক্ষে মত দিয়েছে তারা। পাশাপাশি নৌপথের যে স্থান দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করা হবে, সে স্থানে ‘নো অ্যাংকরিং’ ওয়ার্নিং সাইন স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। সর্বোপরি যেসব নৌপথের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবল গেছে, তা ড্রেজিংয়ের অন্তত এক মাস আগে কেবল মালিককে অবহিতকরণের বিধান সংযোজন করার সুপারিশ করা হয়েছে।

নতুন শ্রেণীকরণে বিভিন্ন নৌরুট

সুপারিশসমূহ

নৌপথের জন্য কেবল নতুন শ্রেণীকরণ ও অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা জারি করাই যথেষ্ট নয়। এগুলো যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় সেদিকেও সমান দৃষ্টি রাখা জরুরি। এজন্য বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • সরকারিভাবে জারির পর নৌপথে অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ন্ত্রণের বিধিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা।
  • অভ্যন্তরীণ রুটগুলো নিয়মিত পর্যালোচনা ও হালনাগাদ করা।
  • এসএইচডব্লিউএল এবং এসএলডব্লিউএল-এর মান নিয়মিত হালনাগাদ করা।
  • জোয়ার-ভাটার প্রভাব আছে এমন নদীতে স্বয়ংক্রিয় ওয়াটার লেভেল গেজ স্থাপন এবং পরিস্থিতির কোনো ধরনের পরিবর্তন হলে, গেজ স্থানান্তর হলে অথবা পরিমাপে বিঘ্ন ঘটলে তা অবহিত করা।
  • শ্রেণীকৃত প্রত্যেক নদীতে অন্তত দুটি দীর্ঘমেয়াদি ওয়াটার লেভেল স্টেশন স্থাপন করা।
  • নদীর তলদেশে টানেল ও ওপরে সেতু নিমাণের ক্ষেত্রে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় জারি করা সার্কুলারের আওতায় কম সংখ্যক পিয়ার ব্যবহার করা, যাতে করে সংশ্লিষ্ট নদীতে পানিপ্রবাহ ও নাব্যতা বজায় থাকে।
  • অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলো রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিস্থিতি নিয়মিত নজরদারি ও হালনাগাদের জন্য বিআইডব্লিউটিএর প্রাতিষ্ঠান সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা।

এ ছাড়া ব্যবস্থাপনা কৌশল হিসেবে বিশেষ শ্রেণির নৌপথ উন্নয়ন ও তাতে সর্বনিম্ন গভীরতা ৪ দশমিক ৫ মিটার ধরে রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নাইট নেভিগেশন ইকুইপমেন্ট বাড়ানো এবং এআইএস ও ইলেক্ট্রনিক পাইলটেজ সেবা চালুর সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রথম শ্রেণীভুক্ত প্রতিটি নৌরুটে প্রয়োজনীয় নাব্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি যেসব রুটে নাইট নেভিগেশন ইকুইপমেন্ট নেই সেখানে তা স্থাপনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ শ্রেণির মতো এই শ্রেণির নৌরুটেও দক্ষ পাইলটেজ সেবা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।

দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথের নাব্যতা ২ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত বাড়ানোর পাশাপাশি নাইট নেভিগেশন ও পাইলটেজ সেবা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীবাহী রুটগুলোতে নাইট নেভিগেশনের নিশ্চিত করার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির নৌপথগুলোতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। আর সেচকাজ, বনায়ন ও পর্যটনে সহায়ক-এমনটা প্রতীয়মান হলে পঞ্চম শ্রেণির নির্বাচিত নৌরুটে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মত দেওয়া হয়েছে।

শেষ কথা

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও গতিশীল ও অবারিত করতে প্রয়োজন বাধাহীন নৌপথ। শুধু ছোট নৌযান নয়; প্রয়োজন বড় নৌযানের অবাধ চলাচল। এতে করে একসাথে বেশি পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হবে। কমে আসবে পরিবহন খরচ, যার ফলে নৌপথ ব্যবহারে আগ্রহ আরও বাড়বে। বাড়বে জাহাজ চলাচল। সেই সাথে যাত্রী চলাচলও সুগম হবে। সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ। নতুন শ্রেণীকরণের মাধ্যমে নাব্য নৌপথের বিস্তৃতি বাড়ানো হচ্ছে। সেই সাথে কম উচ্চতার সেতুর মতো অপরিকল্পিত অবকাঠামোর কারণে নদীর প্রবাহ ও নৌ চলাচল যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য হালনাগাদ করা হচ্ছেু নৌপথে স্থাপনাদি নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা। বিআইডব্লিউটিএর এ উদ্যোগ কার্যকর হলে সড়ক নির্ভরতা কাটিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপথ হয়ে উঠবে পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ধনপতির সপ্তডিঙার মতো নদী¯স্রোতে ভেসে চলবে নানা পণ্যেপূর্ণ নানান দৈর্ঘ্যরে নদীযান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here