সভ্যতার সূচনাকালে নৌপথই ছিল প্রধান। মানুষ থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি বা পণ্য সবই পরিবাহিত হতো এই পথে। সেজন্য প্রয়োজন হতো নৌযান। তার চেয়েও বেশি দরকার পড়ত এই নৌযান চলাচলের উপযোগী গভীরতার নৌপথ। কিন্তু নদীর তলদেশে পলি জমে নৌপথের নাব্যতা কমে যাওয়া প্রকৃতিরই নিয়ম। এই পলি অপসারণ করে নৌপথকে নাব্যতা দানের লড়াইটাও মানুষের চিরন্তন। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সেই লড়াইটা তারা চালিয়ে গেছে খালি হাতেই, খুব বেশি প্রয়োজন পড়লে কেবল মাটি খুড়ে।
পঞ্চদশ শতকে বৈদেশিক বাণিজ্যের বড়োসড়ো উল্লম্ফনে বন্দরের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। সেই সাথে বড় হতে থাকে জাহাজের আকৃতি। প্রয়োজনের তাগিদেই আবির্ভাব ঘটে ড্রেজিংয়ের নতুন পদ্ধতির। ‘জিউস ক্রাবেলার’ এর নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হয়। অন্যান্য আদিম বেড লেভেলারের মতো এটিও ব্যবহৃত হয়েছিল বন্দর চ্যানেলের নাব্যতা উদ্ধারে।
ড্রেজিংয়ের মঞ্চে মাড মিলের আবির্ভাব আরেকটু পরে, ১৫৭৫ সালের দিকে। এই ধরনের ড্রেজিং কেবল বন্দর এলাকায় খননের কাজে ব্যবহৃত হতো এবং খননে কাঠের বোর্ডের সাথে ঘূর্ণায়মান শৃঙ্খল (চেইন) সন্নিবেশিত থাকত। প্রাথমিকভাবে এগুলো চালিত হতো মানুষ বা ঘোড়ার সাহায্যে। পরবর্তীতে মানুষ ও ঘোড়ার জায়গা নেয় বাষ্পীয় ইঞ্জিন। মাড মিলের জায়গাটাও চলে যায় বাস্পচালিত বাকেট ড্রেজারের অধিকারে। কিন্তু সমস্যা হলো এই বাকেট ড্রেজারের ওপর সেভাবে নির্ভর করা যেতে না। তারপরও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পর্যন্ত নৌপথ সচল রাখতে অনির্ভরযোগ্য এই বাকেট ড্রেজারের ওপরই ভরসা রাখতে হয়। এরপর ১৮৫৭ সালে ৪৭ সেন্টিমিটার ব্যাসের সাকশন পাইপ ও ডেক-মাউন্টেড সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প সম্বলিত ড্রেজার জেনারেল মলট্রি উদ্ভাবন করে যুক্তরাষ্ট্র। চার্লসটন নদীতে জেনারেল মলট্রি খননকাজ শুরুও করে। কিন্তু পরের বছরই ১৮৫৮ সালে এটি ডুবে যায়।
পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী বড় বড় খনন প্রকল্পের ফলে নতুন ধরনের কার্যকরী ড্রেজিং যন্ত্রের উন্নয়ন ও নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়ে। সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই ১৮৬৭ সালে সাকশন ড্রেজারের নকশা প্রণয়ন করেন ফরাসী প্রকৌশলী হেনরি-এমিল বাজিন এবং ড্রেজারটি দিয়ে সুয়েজ খাল খনন করা হয়। সেই থেকে সাকশন ড্রেজারের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং এই খাতের পরিচিত নাম হয়ে ওঠে। কিন্তু সাকশন ড্রেজারেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং শক্ত মাটি খনন এর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এই সীমাবদ্ধতা থেকে উৎরানোর উপায় হিসেবে উনিশ শতকে আবির্ভাব ঘটে কাটার সাকশন ও ট্রেইলিং সাকশন হপার ড্রেজারের। এগুলোই এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর ড্রেজার।
বাংলাদেশে ড্রেজিংয়ের শুরুটা ব্রিটিশ আমলে, স্বল্প পরিসরে মাদারীপুর বিল রুট খননের মধ্য দিয়ে। খুলনা থেকে মাদারীপুর, গোয়ালন্দ, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, কাছাড় এবং আসামের মধ্যে নৌপথের দূরত্ব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে স্যার আর্থার কটন ১৮৫৮ সালে নৌপথটি খননের প্রস্তাব করেন। ১৮৭৫ সালে স্যার বেডফোর্ড ল্যাসলি ও ১৮৮৬ সালে রিচার্ড টমসন নৌপথটি খননে কিছু সশোধনী দেন। এরপর ১৮৯৯ সালে সার আর. বি. বেকেল হরিদাসপুরের কাছে মধুমতি নদীর সাথে টেকেরহাটে কুমার নদের সযোগ স্থাপনের প্রস্তাব করেন।২ সেই মোতাবেক খনন শুরু হয়।
এ অঞ্চলের নৌপথ খননে প্রথম ড্রেজারটি কেনা হয় ১৯০৭ সালে, যার নাম ছিল ‘ফয়ার’। ড্রেজারটি দিয়ে মধুমতি নদী, মাদারীপুর বিল রুট, কুমার নদের নিম্নাংশে ও গোপালগঞ্জ লুপ খনন করা হয়। দ্বিতীয় যে ডেজারটি সংগ্রহ করা হয় সেটি ছিল ‘অ্যালেক্সান্দিয়া’। ড্রেজারটি নৌপথ সংরক্ষণে অর্থাৎ সংরক্ষণ ডেজিংয়ে ববহার করা হয়। তারপরও নাব্যতা সংক্রান্ত বহু সমস্যাই তখনও অমীমাংসিত থেকে যায় এবং সেগুলোতে মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ড্রেজার আসে সত্তরের দশকেই। নৌপথের নাব্যতা রক্ষার গুরুত্বের কথা ভেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জন্য দুই দফায় বিদেশ থেকে সাতটি ড্রেজার সংগ্রহ করেন। ডেল্টা-১, ডেল্টা-২, ড্রেজার-১৩৫, ড্রেজার-১৩৬, ড্রেজার-১৩৭, ড্রেজার-১৩৮ ও ড্রেজার-১৩৯ এখনো বিআইডব্লিউটিএর বহরে যুক্ত ও সচল রয়েছে।
ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল
প্রকৃতিগতভাবেই নদ-নদী উজান থেকে প্রতিনিয়ত সেডিমেন্ট বহন করে আনে। অন্তিম গন্তব্য সমুদ্রে পড়ার আগে এইসব সেডিমেন্টের কিছু অংশ নদীর তলদেশে জমা হতে থাকে। এছাড়া অ্যান্থ্রোপোজেনিক নানা কর্মকাণ্ড যেমন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, কৃষি ও নদী ভাঙনের ফলে নদীর তলদেশে সেডিমেন্টের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই সেডিমেন্ট আস্তে আস্তে জমা হয় পোতাশ্রয়, বন্দর ও চ্যানেলে এবং এর গভীরতা কমিয়ে দেয়। কিন্তু স্বাভাবিক নৌ চলাচলের জন্য পোতাশ্রয় ও নেভিগেশন চ্যানেলে সুনির্দিষ্ট গভীরতার প্রয়োজন পড়ে। দরকার হয় এই সেডিমেন্ট অপসারণের, যা সম্পাদন করা হয় ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে।
নৌপথের ড্রেজিংকে মোটাদাগে দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয় ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও মেইনটেন্যান্স বা সংরক্ষণ ড্রেজিং। ক্যাপিটাল ড্রেজিং পরিচালিত হয় মূলত বিদ্যমান নৌপথ ও বন্দর এলাকা সম্প্রসারণ এবং গভীরতা বাড়ানোর উদ্দেশে। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নতুন নৌপথও সৃষ্টি করা হয়। আর বিদ্যমান ও নতুন সৃষ্ট নৌপথের নাব্যতা লক্ষ্য অনুযায়ী ধরে রাখতে নিয়মিত যে ড্রেজিং কার্যক্রম সেটাই সংরক্ষণ ড্রেজিং। এর বাইরে ভূমি পুনরুদ্ধার, দূষণ রোধের মতো কার্যক্রমেও ড্রেজিং করা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) তাদের ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে নৌপথের নাব্যতা উন্নয়নে এবং নাব্য নৌপথ ধরে রাখার প্রয়োজনে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও সংরক্ষণ ড্রেজিং দুই ধরনের ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন এই সংস্থাটি।
আর এই ড্রেজিংয়ের ফলে যে বিপুল পরিমাণ ম্যাটেরিয়াল উৎপন্ন হয়, তা অপসারণের প্রয়োজন পড়ে। ড্রেজিংয়ের ফলে উৎপন্ন এই পদার্থই ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল। মনুষ্য কর্মকাণ্ডের ফলে এই ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের সামান্য অংশ অতিমাত্রায় দূষিত থাকে। তবে বিশ্বব্যাপী ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের ৯০ শতাংশই দূষণমুক্ত। অথবা মনুষ্য কর্মকাণ্ডের কারণে দূষিত হলেও মাত্রা বেশি নয়।৪ এ ছাড়া দূষিতমাত্রই ব্যবহার অযোগ্য এমনটাও নয়। আইনি বিধিনিষেধ ও স্থানবিশেষের শর্ত অনুযায়ী এর ব্যবহারের সুযোগ সীমিত হয়ে থাকতে পারে কেবল। যদিও পরিশোধনের মাধ্যমে দূষিত এই ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল লাভজনক উদ্দেশে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই ব্যয় বেশি হবে।
ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা
বিশ্বব্যাপী নৌপথ নাব্য রাখতে ড্রেজিং কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ায় ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শুধু বিশেষ একটি বা দুটি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই। অর্থনৈতিক, প্রকৌশল ও পরিবেশগত দিক, সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন এবং সামাজিক প্রেক্ষিত সবকিছুতেই সমান গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
ড্রেজিং এবং এর ফলে উৎপন্ন ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল উভয়েরই পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। যেকোনো ড্রেজিং প্রকল্পের সব পর্যায়েই পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া তাই বাঞ্ছণীয়। সেই সাথে প্রশমন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিবেশের ক্ষতি যতটা সম্ভব কমানোর চেষ্টা করাও জরুরি।
অর্থাৎ, ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার দর্শন হওয়া উচিত প্রকৃতি রক্ষা। এর অর্থ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা করা। সেই সাথে ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালকে বর্জ্য না ভেবে সম্পদ মনে করা। এই অর্থে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা হচ্ছে নদী অববাহিকার সেডিমেন্ট ব্যবস্থাপনারই অংশ। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে তাই ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনার সমান্তরালে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল স্থানান্তরের দিকেও গুরুত্ব দিতে হয়। ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পরিবেশগত চর্চা এক্ষেত্রে পূর্বশর্ত, যাতে করে ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের পরিমাণ সীমিত থাকে এবং এর অপসারণের ফলে পরিবেশগত ক্ষতি কম হয়।
নৌপথের নাব্যতা রক্ষার স্বার্থে ড্রেজিংয়ের ফলে উৎপন্ন ম্যাটেরিয়াল সার্বিক ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির অংশ হিসেবে নিয়মিত অপসারণের প্রয়োজন পড়ে। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা এবং এজন্য প্রয়োজন দক্ষ, ব্যয়সাশ্রয়ী ও পরিবেশসম্মত নীতিমালা। এই চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা অনেক আগেই এ সংক্রান্ত নানা কনভেনশন, চুক্তি ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, বৈশ্বিককভাবে যেগুলো চর্চাও করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশন
ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার উত্তম চর্চার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নানা আইন ও কনভেনশন রয়েছে। এসব আইন ও কনভেনশন পরিপালনের মাধ্যমে প্রকৃতির ক্ষতি না করেই কীভাবে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা করা যায় বিশ্বব্যাপী তার নানা উদাহরণ রয়েছে। নৌপরিবহন অবকাঠামোর বৈশ্বিক সংগঠন পার্মানেন্ট ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব নেভিগেশন কংগ্রেসের (পিআইএনএনসি) ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা নীতিমালার কথা এক্ষেত্রে বলতেই হয়। ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের ধরন, এর টেকসই স্থানান্তর ও লাভজনক ব্যবহার সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই সাথে দূষিত সেডিমেন্টের ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, দূষণের উৎসই বা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সে সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট দিশা রয়েছে এই নীতিমালায়।
ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার আরেকটি আন্তর্জাতিক নীতিমালা হচ্ছে ‘অসপার গাইডলাইন্স ফর দ্য ম্যানেজমেন্ট অব ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল’। ১৯৯৮ সালে অসপার কমিশনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে নীতিমালাটি গৃহীত হয়। ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সব পক্ষের এই নীতি পরিপালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে জাতীয় ও স্থানীয় সব পরিস্থিতিতেই যে নীতিমালাটি প্রযোজ্য হবে তেমন নয়।
১৯৭২ সালের অসলো কনভেনশন ও ১৯৭৪ সালের প্যারিস কনভেনশন একীভূতকরণের মধ্য দিয়ে ১৯৯২ সালে অসপার কনভেনশনের সূচনা হয়। ইউরোপের ১৫টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর সদস্য। কমিশনের সদস্য দেশগুলো ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল যাতে এমনভাবে ব্যবস্থাপনা করে, যার ফলে দূষণ এড়িয়ে মেরিটাইম অঞ্চলকে রক্ষা করা যায়, সেই লক্ষ্যেই অসপার নীতিমালাটি প্রণয়ন করা হয়েছে। পিআইএএনসিসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিবেশসম্মত গ্রহণযোগ্য ড্রেজিং কৌশল সংক্রান্ত পরামর্শও নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এ সংক্রান্ত আরেকটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কনভেনশন হলো ‘দি কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস অব ইন্টারন্যাশনাল ইম্পর্টেন্স’ যার পোশাকি নাম রামসার কনভেনশন। জলাভূমি ও এর সম্পদ সংরক্ষণ এবং যৌক্তিক ব্যবহারের কর্মকাঠামোটি আসলে আন্তঃসরকার চুক্তি। ১৯৭১ সালে ইরানের রামসার শহরে কনভেনশনটি গৃহীত হয়, যা কার্যকর হয় ১৯৭৫ সালে। এরপর থেকে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত প্রায় ৯০ শতাংশ দেশই কনভেনশনটিতে স্বাক্ষর করেছে। নিকট অতীতে পরিবেশ সংক্রান্ত যেসব আন্তঃসরকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, এটি তার মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো এবং টেকসই ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত হেলকম কনভেনশন গৃহীত হয় ২০১৫ সালে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল মূল্যায়ন সম্পর্কিত আইএমও লন্ডন প্রটোকল ও লন্ডন কনভেনশন অনুযায়ী পর্যবেক্ষণের পর। কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী পক্ষগুলোকে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নীতিমালায় উল্লেখিত নির্দেশিকাগুলো প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। সেই সাথে জাতীয় ও স্থানীয় যেসব পরিস্থিতিতে নীতিমালাটি প্রযোজ্য হবে না সে সংক্রান্ত সুপারিশও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
হেলসিংকি কমিশন (হেলকম) নামে পরিচিত ‘দি বাল্টিক মেরিন এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন কমিশন একটি আন্তঃসরকার সংস্থা ও বাল্টিক সাগর এলাকার একটি আঞ্চলিক সমুদ্র কনভেনশন। সব ধরনের দূষণের উৎস থেকে বাল্টিক সাগরকে রক্ষার প্রয়োজনে ১৯৭৪ সালে হেলকম প্রতিষ্ঠিত হয়। বাল্টিক সাগর উপকূলীয় সবগুলো দেশ এর সদস্য।
এর বাইরেও আন্তর্জাতিক একাধিক কনভেনশন, চুক্তি ও প্রটোকল রয়েছে, যেগুলো ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিবেচনাযোগ্য। এর মধ্যে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রিভেনশন অব পলিউশন ফ্রম শিপস (মারপল), ১৯৭৩; বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি, রিও ডি জেনিরো, ১৯৯২; ইউনাইটেড নেশন্স ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, রিও ডি জেনিরো, ১৯৯২; কনভেনশন অন কনজার্ভেশন অব মাইগ্রেটরি স্পিসিস অব ওয়াইল্ড অ্যানিম্যালস, ১৯৭৯; কিয়োটো প্রটোকল, ১৯৯৭; কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড, ২০০৯ এবং কনভেনশন অব মেরিটাইম পলিউশন বাই ডাম্পিং অব ওয়েস্টস অ্যান্ড আদার ম্যাটারস, ১৯৭২।
বর্জ্য নয়, সম্পদ
ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের লাভজনক ব্যবহারের ধারণা নতুন কিছু নয়; হাজার বছরের পুরোনো প্রথা। বলা যায়, যখন থেকে ড্রেজিংয়ের শুরু, ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের লাভজনক ব্যবহারের পত্তনও প্রায় তখন থেকেই। বিশেষ করে ভূমি পুনরুদ্ধারে। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগানের সৃষ্টি ইউফ্রেটিস নদীর ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করেই। পোটোমাক নদীর ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয়েছে পেন্টাগন ভবন নির্মাণে। ইতালি ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করেছে ভেনিস নগরীকে বন্যা থেকে রক্ষার জন্য ফ্লাডগেট তৈরিতে।
ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের এই লাভজনক ব্যবহার এখনো বিশ্বব্যাপী সর্বত্রগামী না হলেও কিছু দেশ এর সর্বোচ্চ ব্যবহারের নজির সৃষ্টি করেছে। জাপানের কথা এক্ষেত্রে সবার আগে উল্লেখ করতে হয়। এশিয়ার দেশটি তাদের ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের প্রায় ৯০ শতাংশই লাভজনক কাজে ব্যবহারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক দেশই লাভজনক উদ্দেশে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করতে পারছে না। এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে প্রথাগত অপসারণের তুলনায় বেশি ব্যয়, অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন, সঠিক সময়ে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের সঠিক প্রকল্পের অভাব। অনেক সময় মানুষের ভ্রান্ত ধারণাও ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের লাভজনক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে ইউরোপেও ১০ শতাংশেরও কম ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল লাভজনক উদ্দেশে ব্যবহার হয়ে থাকে। যদিও নদী এবং পার্শ্ববর্তী উপকূলীয় ব্যবস্থায় এর স্থানান্তর এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ইউরোপে ৩০ শতাংশের মতো ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের ব্যবস্থাপনা হয় এই পদ্ধতিতেই।
পিআইএএনসি ২০০৯ সালে ‘ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল অ্যাজ আ রিসোর্স অপশন্স অ্যান্ড কনস্ট্রেইন্টস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ড্রেজিংয়ের পর উৎপন্ন ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল নির্মাণ খাত, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও উপকূল রক্ষা এবং ভূমি উন্নয়নে ব্যবহারের অসংখ্য নজির সেখানে তুলে ধরা হয়েছে। আবার পরিবেশ উন্নয়নেও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। জলজ প্রাণী ও কৃষির স্বার্থেও এটি ব্যবহার করা যায়।
বিশ্বব্যাপী লাভজনক উদ্দেশে ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের যে ব্যবহার, মোটা দাগে তাকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়ঃ ১. প্রকৌশলগত কাজে ও ২. পরিবেশগত উন্নয়নে।
১. প্রকৌশলগত কাজে ব্যবহার: প্রকৌশলগত অনেক প্রকল্পে কিছু উপকরণের বিকল্প হিসেবে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। যেমন, ভিত্তি উপকরণ হিসেবে, দূষিত সাইটকে আলাদা করতে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও উপকূল রক্ষায় এবং ভূমি উন্নয়নে ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের সর্বোত্তম ব্যবহরা করা যেতে পারে। প্রকৌশলগত কাজে ড্রেজ ম্যাটেরিয়ালের সর্বোত্তম লাভজনক ব্যবহারের একটি ভালো উদাহরণ হচ্ছে বেলজিয়ামের ফেসিভার প্রকল্প।
প্রকল্পটির আওতায় বেলজিয়ামের লেইয়ি ও শেল্ডট নদীর সংগমস্থলে বন্দর নগরী ঘেন্টের ৪২ হেক্টর দূষিত এলাকাকে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল পরিশোধন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয়। ১৩ লাখ টন শুষ্ক ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল সেখানে স্থানান্তর করে স্থানটিকে পাঁচ মিটার উঁচু করা হয়। এভাবে দূষিত মাটিকে ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালে ঢেকে দিয়ে পরিত্যক্ত স্থানটিকে ভবন নির্মাণের উপযোগী করে শিল্প এলাকা হিসেবে প্লট বিক্রি করা হয়। এর মধ্য দিয়ে নতুন শিল্পাঞ্চল সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি তিনটি সমস্যার টেকসই সমাধানও পাওয়া গেছে। ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল স্থানান্তরের যুৎসই স্থানের অভাবে বন্ধ হতে যাওয়া ঘেন্ট অঞ্চলের খালগুলোর সংরক্ষণ ড্রেজিং কাঙ্খিত মাত্রায় সম্পাদনের সুযোগ পাওয়া গেছে। সেই সাথে ঘেন্টের নিকটবর্তী স্থানে শিল্পাঞ্চলের যে স্বল্পতা সে সমস্যারও সমাধান হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে নকশা প্রণয়নের মধ্য দিয়ে ১৯৯৭ সালে ফেসিভার প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের ভৌতকাজ বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০০ সালে এবং ২০০৭ সালের মধ্যে সাড়ে আট লাখ টন ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল পরিশোধনের পর প্রকল্প এলাকায় ফেলা হয়। ২০০৯ সালের শেষ নাগাদ প্রকল্পের ১৫ হেক্টর ভবন নির্মাণের উপযোগী হয়ে ওঠে। পিপিপির ভিত্তিতে প্রকৌশলকাজে ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের সফল ব্যবস্থাপনার অনন্য দৃষ্টান্ত এই ফেসিভার প্রকল্প।
তবে প্রকল্পটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা চ্যালেঞ্জ ছিল এবং তা উত্তরণে দক্ষতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। প্রথমত- ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের মাধ্যমে পরিত্যক্ত ও দূষিত ভূমিকে শিল্পাঞ্চলে উন্নীত করার প্রকল্পটি ছিল দীর্ঘমেয়াদী। স্বাভাবিকভাবেই সব পক্ষকে সম্পৃক্ত করে দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রস্তুতিপর্ব শেষ করতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত- প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নানা ঝুঁকিও ছিল এবং সেগুলো অংশীজনদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে, যাতে করে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। পিপিপির ভিত্তিতে নির্মাণ এক্ষেত্রে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সর্বোত্তম মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি হলো প্রকল্পে অর্থায়ন। পরিশেগত বিষয় জড়িত থাকায় প্রকল্পে অর্থায়ন প্রয়োজন পড়ে সাধারণ প্রকল্পের দ্বিগুন। সর্বোপরি এ ধরনের প্রকল্পে স্থানীয় জনগণের সমর্থন সবচেয়ে বেশি দরকার পড়ে এবং একাধিক পরামর্শ সভার মাধ্যমে সেই সমর্থনও সংগ্রহ করা হয়। প্রকৌশলগত প্রয়োজনে ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের লাভজনক ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় উদাহরণ হয়ে আছে বেলজিয়ামের এই প্রকল্পটি।
২. পরিবেশগত উন্নয়নে ব্যবহার: ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের সবচেয়ে ভালো ব্যবহার হতে পারে পরিবেশ উন্নয়নে; ‘পরিবেশের সাথে কাজ’ এই দর্শনের ভিত্তিতে। পিআইএএনসিও এটা গ্রহণ করেছে। তবে সেটা হতে হবে স্থানবিশেষে ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের গঠনগত ও রাসায়নিক গুণাগুণের ভিত্তিতে। সেই সাথে স্থানীয় আইন-কানুনও এক্ষেত্রে সমানভাবে বিবেচ্য। মোটা দাগে, পরিবেশগত উন্নয়নের স্বার্থে যেসব কাজে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা যেতে পারে সেগুলো হলো আবাস তৈরি ও তার উন্নতি, পানির গুণগত মানের উন্নয়ন, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের চাষ, কৃষি, বিনোদন এবং গর্ত ভরাট।
তবে পরিবেশগত উন্নয়নের স্বার্থে যে কাজেই ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হোক না কেন এর গঠনগত এবং উপস্থিত রাসায়নিকের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে নেওয়াটা জরুরি। পাশাপাশি যে স্থানের পরিবেশ উন্নয়নে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে, প্রস্তাবিত সেই স্থানটিও ভালোমতো মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে, যাতে করে সাফল্য পাওয়াটা নিশ্চিত হয় এবং অন্যান্য ইস্যু একে প্রভাবিত করতে না পারে। একইভাবে স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক আইন এর প্রকৌশলগত ব্যবহারের অনুমতি দেয় কিনা সেটাও নিশ্চিত হয়ে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশগত উন্নয়নে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের উৎকৃষ্ট নজির হচ্ছে যুক্তরাজ্যের ওয়ালাসিতে ওয়েটল্যান্ড (জলাভূমি) তৈরি।
যুক্তরাজ্যের ওয়ালাসি আইল্যান্ডের উত্তর ফোরশোরে নতুন একটি ওয়েটল্যান্ড তৈরি করা হয়েছে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে। পাখিদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাভূমি বন্দর উন্নয়নের প্রয়োজনে বিশেষ সংরক্ষিত এলাকার তালিকা থেকে বাদ পড়লে একই ধরনের নতুন আরেকটি ওয়েটল্যান্ড তৈরি জরুরি হয়ে পড়ে। আগের ধ্বংস হয়ে যাওয়া জলাভূমিটিতে বিচরণকারীরা সমসংখ্যক পাখিকে যাতে আকৃষ্ট করা যায়, সেজন্য প্রয়োজন ছিল মোহনায় বড় আয়তনের একটি এলাকা। সেই সাথে জলাভূমিটি তৈরি করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় অথবা মোহনায় এরই মধ্যে বিচরণকারী পাখিদের ওপর যাতে ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়েছিল। তিন বছর ধরে গবেষণা ও জনগণের মতামত নেওয়ার পর ২০০৪ সালে ওয়ালাসিকেই উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। কারণ, স্থানটি যে মোহনার ওপর অবস্থিত, বিপুল সংখ্যক পাখি আকৃষ্ট করার জন্য তা যথেষ্ট।
এ ছাড়া উত্তর দিকের শোরের ওপর সি ওয়ালগুলো ছিল খারাপ অবস্থায় এবং ভেঙে যাবার ফলে এতে বন্যার ঝুঁকিও ছিল। সেজন্য দরকার ছিল ওয়েটল্যান্ডের উচ্চতা বাড়ানো। তাই পুরো সি ওয়ালের পেছনের ভূমি উঁচু করা হয়। এর ফলে পুরোনো প্লাবনভূমিতে স্রোত ফিরে আসার সুযোগ পায়। এরপর শোরের কাছাকাছি নতুন একটি উঁচু সি ওয়াল নির্মাণ করা হয়। আর এ কাজে ব্যবহার করা হয় হরউইচ হারবার কর্তৃপক্ষের হারবার ও অ্যাপ্রোচ চ্যানেলে নিয়মিত সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের ফলে সৃষ্ট দূষণমুক্ত ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল।
ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশগত উন্নয়নের এই কর্মযজ্ঞ সমাধা করতে হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে। এজন্য স্থানীয় ও অন্যান্য একাধিক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়। সেই সাথে জনমত সংগ্রহেরও প্রয়োজন পড়ে। এর ফলে পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে স্থানীয় ও জাতীয় একাধিক পরিবেশবাদী গ্রুপকে সাথে নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তা মূল্যায়ন করা হয়। বিচেনায় নিতে হয় স্থানীয় লোকজন, ব্যবসা, মৎস্যসম্পদ ও নৌ চলাচলের ওপর প্রকল্পের আর্থ-সামাজিক প্রভাবও। এসব কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে ২০০৫ সালের গোড়ার দিকে পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করে। ২০০৬ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর স্থানটি ও বন্যপ্রাণীর ক্ষেত্রে কি ধরনের পরিবর্তন এসেছে তা পর্যবেক্ষনের ব্যবস্থা করা হয় এবং পরবর্তী পাঁচ বছর পর্যন্ত তা জারি থাকে। সব পক্ষকে সম্পৃক্ত করে পরিবেশ উন্নয়নে ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের লাভজনক ব্যবস্থাপনার অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে যুক্তরাজ্যের এই প্রকল্পটি, যা থেকে অন্যদের শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
পঁচাত্তরের বছরখানেক বা তার কিছু আগে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে স্বজনদের সাথে একদিন আলাপ করতে করতে শৈশবে ফিরে গিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্মৃতি রোমন্থন করে বলছিলেন, শৈশবে নদীর পাড়ে ড্রেজিং কোম্পানির ব্রিটিশ কর্মীদের সাথে ফুটবল খেলতাম। এরপর যুদ্ধ শুরু হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বার্মা অভিযানের জন্য ড্রেজারগুলো বার্জ হিসেবে ব্যবহারের জন্য সরিয়ে নেওয়া হলো। এরপর সেগুলো আর ফিরল না। শৈশবে যেখানে ফুটবল খেলতাম, সেখানে এখন আর কোনো নদী নেই। কেবল বালি। এবং প্রতি বছরই আমাদের ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
নদীর নাব্যতা হ্রাস ও নিয়মিত এই বন্যা বঙ্গবন্ধুকে ভীষণভাবে ভাবিয়েছিল। এই সমস্যা সমাধানে তিনি উদগ্রীব ছিলেন এবং নানা কর্মসূচিও হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এক প্রকার ব্রাত্যই থেকে যায় নদী ও নৌপথ। নাব্যতা হারিয়ে নৌপথ ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে। দেশজুড়ে বিস্তৃত ২৪ হাজার কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ নৌপথের মধ্যে সারাবছর নৌ চলাচলের উপযোগী নৌপথ কমে দাঁড়ায় এক সময় মাত্র সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারে। অবশেষে সংকুচিত এই নৌপথ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও তা উল্লেখ করেন তিনি। তাতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকেই ঐতিহ্যগতভাবে নৌপথ একটি নিরাপদ ও সাশ্রয়ী এবং পরিবেশ ও দরিদ্রবান্ধব যোগাযোগ মাধ্যম। একসময় যোগাযোগের ৮৫ শতাংশ হতো নৌপথে। দেশে সর্বমোট প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে। যার মাত্র ছয় হাজার কিলোমিটার পরিবহনকাজে ব্যবহার হয় এবং শুষ্ক মৌসুমে তা অর্ধেকে নেমে আসে।’১৫
অভ্যন্তরীণ নৌপথের পুনরুদ্ধার ও এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে ইশতেহারে আরও উল্লেখ করা হয়, ব্যাপক খননের পরিকল্পনা হিসেবে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে। আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরের সাথে অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলোর সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি সুগম করা হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্যকে সহজ করার লক্ষ্যে ভারতের সাথে নৌপথে বাণিজ্য আরও বাড়িয়ে একে নেপাল-ভুটান পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে।
সেই আলোকে ড্রেজিং মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার, যার আওতায় ১৭৮টি নদী খননের মাধ্যমে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। ড্রেজিং কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে আছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এই ড্রেজিংয়েরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা। ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল স্থানান্তরের জায়গা সীমিত হওয়ার কারণে কাজটি বেশ চ্যালেঞ্জিংও। এছাড়াও রয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা আইন, নীতি, নীতিমালা ও কনভেনশন, ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার উত্তম চর্চা নিশ্চিত করতে যেগুলো বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।
স্থানীয় আইন ও নীতি
ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও কনভেনশন যেমন মেনে চলতে হয়, একইসাথে এ সংক্রান্ত দেশীয় আইন ও বিধিবিধানও যাতে লঙ্ঘন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখাটা জরুরি। ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে আইনটি পরিপালন করা সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ ও সংশোধিত, ২০১০। এই আইনের অধীনে প্রকল্পের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্রের প্রয়োজন পড়ে। ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটিসহ স্থানীয় আরও যেসব আইন, বিধি, নীতি ও নীতিমালা বিবেচনায় নিতে হয় সেগুলো হলো:
১. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭
২. পানি আইন, ২০১৩
৩. বাংলাদেশ পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০
৪. মৎস্য সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০
৫. এমবাঙ্কমেন্ট অ্যান্ড ড্রেনেজ আইন, ১৯৫২
৬. শিল্পের জন্য পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন নীতিমালা, ১৯৯৭
৭. অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ ও সংশোধনী
৮. বাংলাদেশ জাতীয় পরিবেশ নীতি, ১৯৯২
৯. অভ্যন্তরীণ নৌপরিহন নীতি (আইডব্লিউটিপি), ২০০৯
১০. বাংলাদেশ জাতীয় পরিবেশগত কর্মপরিকল্পনা (এনইএমএপি), ১৯৯৫
১১. ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে টেকসই নদী ব্যবস্থাপনা: প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনগত সর্বোত্তম চর্চার মধ্য দিয়ে পরিবেশগত প্রভাব প্রশমন
১২. জাতীয় পানি নীতি, ১৯৯৯
১৩. জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, ২০০১ (অনুমোদন ২০০৪)
১৪. জাতীয় মৎস্যসম্পদ নীতি, ১৯৯৬
১৫. বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০
১৬. বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১১
১৭. বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬
১৮. জাতীয় ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি, ২০০১
এছাড়া প্রকল্পের অবস্থান ও পরিবেশের ওপর তার প্রভাবের ভিত্তিতে পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক। এই হিসেবে প্রকল্পকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকেঃ সবুজ, কমলা-এ, কমলা-বি ও লাল। বন্যা নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত সব প্রকল্পই লাল শ্রেণিভুক্ত। ক্যাপিটাল ড্রেজিংও লাল শ্রেণিভূক্ত এবং পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন জরুরি। পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের কাজটি করতে হয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকেই এবং তা পর্যালোচনা করে পরিবেশ ছাড়পত্র দিয়ে থাকে পরিবেশ অধিদপ্তর।
ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা নীতি
পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের কার্যকর এবং লাভজনক ব্যবস্থাপনা কেমন হতে পারে সে সংক্রান্ত একটি খসড়া নীতি ২০১৩ সালে প্রণয়ন করে সরকার। এ সংক্রান্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতীয় বিভিন্ন আইন-কানুন ও উত্তম চর্চাগুলো বিবেচনায় নিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। ড্রেজিং প্রকল্প গ্রহণ সম্পর্কে খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ডাম্পিংয়ের স্থান চিহ্নিত করার পরই প্রকল্প তৈরি করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে কোনো অবস্থাতেই ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল নদীতে ফেলা যাবে না। তবে, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের নদীগুলোতে জোয়ারের প্রভাব খুব শক্তিশালী হওয়ায় ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল নদীতে ফেলা যেতে পারে। সেটাও হতে হবে উপযুক্ত গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল নদীতে অপসারণ করা যাবে। যদিও তা হবে হাইড্রো-মরফোলজিক্যাল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত গবেষণার সুপারিশের ভিত্তিতে।
ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, কৃষি জমি কোনোভাবেই নষ্ট করা বা কৃষিতে ব্যাঘাত ঘটানো যাবে না। কারিগরি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ও সংযোগকারী খালগুলো যাতে বিযুক্ত হয়ে না পড়ে সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে নদীর অগভীর স্থানে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ডাম্প করা যেতে পারে। ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো পরিবেশ সংরক্ষণ আইন মেনে এগুলো নিম্নাঞ্চলে স্থানান্তর করা অথবা সরকারের মালিকানাধীন খাস জমিতে স্তুপ করে রাখা। এ কাজে অর্থাৎ ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল অপসারণের উদ্দেশে কোনোমতেই কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা যাবে না।১৭ তবে আমাদের জমির স্বল্পতা থাকায় সবচেয়ে ভালো বিকল্প হতে পারে প্রকৌশলকাজে ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের লাভজনক ব্যবহার। বিভিন্ন অবকাঠামো ও আবাসন প্রকল্পে এসব ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’। শতবর্ষী এই পরিকল্পনার পাশাপাশি ‘জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯’ ও ‘জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, ২০০১’ সঠিকভাবে ও পরিবেশসম্মত উপায়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা নীতিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ‘ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, ২০২১’ শীর্ষক এই খসড়ায় ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল উত্তোলন ও তা অপসারণের সর্বোত্তম চর্চাগুলো তুলে ধরা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্যই যা পরিপালনযোগ্য।
নীতিমালা অনুযায়ী, ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল উত্তোলনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সমীক্ষা, হাইড্রোগ্রাফিক/ব্যাথিমেট্রিক জরিপ এবং অনুমোদিত নকশার ভিত্তিতে ড্রেজিংয়ের এলাকা চিহ্নিত করে ওই স্থানের উত্তোলনযোগ্য ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে। এরপর ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল নিক্ষেপণ বা স্তুপীকরণের স্থান চিহ্নিত করে তফসিলসহ ম্যাপে তার উল্লেখ থাকতে হবে। হাইড্রোগ্রাফিক/ব্যাথিমেট্রিক জরিপ ও সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রণীত চার্টে নদ-নদীর তলদেশ থেকে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল উত্তোলনের ক্ষেত্রে যথাযথ ঢাল সংরক্ষণ সাপেক্ষে খননযোগ্য ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের গুণাগুণের বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে নদীর তলদেশ সুষম স্তরে খনন করতে হবে। ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল কোনো অবস্থাতেই নদীর প্রবাহে নিক্ষেপ করা যাবে না। নদী থেকে ভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যেই কেবল ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল নদীতে ফেলা যেতে পারে; তবে এক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে সমীক্ষা সম্পাদন করতে হবে। সমীক্ষার সুপারিশের আলোকে সুনির্দিষ্ট স্থানে স্ব-স্ব মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রত্যায়িত নকশার আলোকে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল সেখানে ফেলা যাবে। কার্যক্রমটি সম্পাদন করতে হবে নদীর হাইড্রো-মরফোলজি, পানির প্রবাহ বিশ্লেষণ এবং যথাযথ সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে। প্রয়োজন হলে জেলা সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রদর্শিত ম্যাপে স্থান নির্ধারণপূর্বক অনুমোদিত স্থানে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল সাময়িকভাবে স্তুপ করা যেতে পারে।
ড্রেজিংয়ের ফলে নদীবক্ষ থেকে উত্তোলিত বিপুল পরিমাণ ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল নিক্ষেপণ বা স্তুপীকরণের জন্য বিশাল জায়গার প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে জমির প্রাপ্যতার সীমাবদ্ধতার কারণে জনস্বার্থে লাভজনক উদ্দেশে দক্ষতার সাথে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সরকারের নীতি হচ্ছে ড্রেজিংয়ের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়নকালেই ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের কৌশল এবং কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ এর ব-দ্বীপ নির্দিষ্ট অভীষ্ট-৩ এর আওতায় কৌশল ৩.১ অনুযায়ী ‘ড্রেজিং মহাপরিকল্পনা’ তৈরি করতে হবে। ড্রেজিংয়ের পর বন্যার কারণে ড্রেজিং এলাকা আংশিক পুনঃভরাট হওয়ার আশঙ্কা থাকায় প্রতি বছর সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং এই ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল একটি সুষ্ঠু পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে।
ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হচ্ছে পরিবেশগত সুরক্ষা। সেজন্য ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার আগে বেশ কিছু শর্ত পরিপালন করা বিধেয়। প্রযোজ্য শর্তগুলো হচ্ছে:
১. মাটির ধরন, পানির গুণগতমান, খনিজ সম্পদ. পলির ধরন ইত্যাদি যাচাই
২. নদীতীর ও প্লাবনভূমির প্রকৃতি এবং প্রাধনভূমি ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ অক্ষুন্ন রাখা
৩. স্থানীয় ও অন্যান্য চাহিদা যেমন- ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের সরকারি কিংবা বেসরকারি চাহিদা আছে কিনা এবং সেখানে বর্ধিষ্ণু জনপদ আছে কিনা
৪. ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের পরিমাণ (প্রতি কিলোমিটারে ড্রেজিংকৃত মাটির পরিমাণ), ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের গুণগতমান (শিল্প, পয়ঃ ইত্যাদি বর্জ্য আছে কিনা) ইত্যাদি
৫. উত্তোলিত ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের একটি পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা করা, যাতে এর সংলগ্ন কৃষিজমি, জলাভূমি ও জলাধার ক্ষতিগ্রস্ত না হয়
৬. নদীসমূহের ক্ষেত্রে সমীক্ষার সুপারিশের ভিত্তিতে প্রাপ্ত অগভীর স্থানে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ফেলা যেতে পারে। ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা এমন হবে যাতে সংযোগ খালসমূহ ভরে গিয়ে নদীর সাথে প্লাবনভূমির সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়
৭. ভূমি উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি স্থানে একশ একরের বেশি হলে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল মজুদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণ
৮. পুনরুদ্ধারকৃত জমিতে শিল্পপার্কসহ টাউনশীপ/হাউজিং ইত্যাদি তৈরি করে ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য যে লে আউট প্ল্যান প্রস্তুত করা হবে তাতে যেন বায়োটিক ও অ্যাবায়োটিকসহ প্রতিবেশগত ভারসাম্যের বিষয়টি সংরক্ষিত হয়।
সারাবিশ্বই এখন ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের লাভজনক ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। কীভাবে সেটা সম্ভব, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও কনভেনশনে তা বিবৃত হয়েছে। এগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে লাভজনক উদ্দেশে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল দ্বারা নিচু জমি ভরাট করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে এসকল নিচু জমি যেন পরিবেশ ও প্রতিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর না হয়। সেই সাথে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ পরিপালন এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক।
ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল কেবল সরকারি খাস জমিতে স্থায়ীভাবে স্তূপীকরণ করলেই হবে না; নানাবিধ কাজে তার ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি জমি না পাওয়া গেলে প্রয়োজনে বেসরকারি জমি ভাড়া করা যেতে পারে। তবে তা যেনো কৃষিজমি না হয়। ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল স্তূপীকরণের কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশের পাশাপশি স্থানটি বিভিন্ন পাখির অভয়ারণ্য ও অন্যান্য গবাদি পশুর বা অন্যান্য প্রাণীর চারণভূমির ওপর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে কিনা এবং এর ফলে জীববৈচিত্র্যের অবনতি ঘটে কিনা তা বিবেচনায় নিতে হবে। স্তুপীকৃত ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল যেনো বৃষ্টির পানি বা অন্য কোনো কারণে পুনরায় ড্রেজিংকৃত স্থানে না আসে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরি।এছাড়া ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল দ্বারা বিস্তীর্ণ সমতল ভূমিতে উঁচু চাতাল বা প্ল্যাটফরম সৃষ্টি করা যেতে পারে, যাতে করে ভয়াবহ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের সময় এসব উঁচু স্থান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের মাধ্যমে ভূমি উন্নয়ন করে তাতে বনায়নের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবেশগত ও কারিগরি দিক বিবেচনা করে উপকূলীয় অঞ্চল ও বাংলাদেশের সমুদ্রবক্ষে বিস্তীর্ণ কনটিনেন্টাল শেলফে ভূমি পুনরুদ্ধার, বন্যার সাথে অভিযোজনের জন্য বাড়ি উঁচু করা এবং ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের সুযোগ অবারিত।
লাভজনক উদ্দেশে সড়ক-মহাসড়ক, বেড়িবাঁধ, উপকূলীয় এলাকায় ভূমি পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি, হাওর এলাকায় ভিলেজ প্ল্যাটফরম নির্মাণ, কেল্লা ও ব্রিজ নির্মাণ, শিল্পাঞ্চল, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা যেতে পারে। বৃহৎ নদীসমূহের ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে কারিগরি দিক বিবেচনায় নিয়ে উভয় পাড়ে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল দ্বারা কৃষিজমি উদ্ধার, নগরায়ন, বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী সৃজন, অর্থনৈতিক অঞ্চল, পর্যটন এলাকা, বাঁধ/রাস্তা ইত্যাদি নির্মাণ করার সুযোগ রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেমন হাওর, চরাঞ্চল ইত্যাদি, যেখানে জল কিংবা স্থলপথে পরিবহনের কোনো সুবিধা নেই, সেখানকার জনগণকে তাদের বসতভিটা উঁচু করার জন্য এই মাটি ব্যবহার করতে দেয়া যেতে পারে। সেই সাথে উর্বর নিচু জমির ক্ষেত্রে মাটির উর্বর উপরিস্তর অন্যত্র সরিয়ে রেখে অনুর্বর ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল দ্বারা ভরাট করে উক্ত উর্বর উপরিস্তর পুনঃস্থাপন করা যেতে পারে।
অত্যধিক প্রশস্ত নদীর ক্ষেত্রে নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে নদীর গতিপথ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে (পরিবেশগত ও কারিগরি দিক বিবেচনা করে) ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে দুই তীর বরাবর বিপুল খাস জমি পুনরুদ্ধার ও নদীতীর সংরক্ষণ করা সম্ভব।
অত্যধিক মনুষ্য কর্মকাণ্ডের কারণে নদী দূষণ বেড়েছে। ফলে আমাদের ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের শতভাগ দূষণমুক্ত, এমনটা বলা যাবে না। তবে দূষিত এই ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে এবং বৈশ্বিকভাবে সেই চর্চা হচ্ছেও। এজন্য যেসব নদ-নদীর তলদেশে পয়ঃ, শিল্প ও অন্যান্য বর্জ্যমিশ্রিত মাটি/বালু/পলি ইত্যাদি রয়েছে, সেসব নদ-নদীর জন্য প্রযোজ্য ড্রেজিং পদ্ধতি নির্ধারণ করে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল দূষণমুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান মেনে ও কারিগরি দিক বিবেচনায় রেখে এসব ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে।
ড্রেজিংয়ের ফলে উৎপন্ন ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল স্থানান্তর ও পরিবহন ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনারই অংশ। এক্ষেত্রে ড্রেজড ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার নির্দিষ্ট করে তা স্থানান্তর ও পরিবহনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ড্রেজিং কার্যক্রমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল স্থানান্তর কার্যক্রম শুরু করলে নদীতীরের জমিতে দীর্ঘ সময় খননকৃত মাটি স্তূপীকরণের প্রয়োজন হবে না। নিয়মিত অপসারণের মাধ্যমে স্তুপীকরণ স্থান প্রস্তুত রেখে খননকাজ অব্যাহত রাখা যাবে।
নদ-নদীই কেবল নয়, বালুমহালও ড্রেজিং করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং প্রযোজ্যক্ষেত্রে সেতু কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির সমন্বয়ে সমীক্ষা করে ড্রেজিং নকশাসহ বালুমহাল এলাকা চিহ্নিত করতে হবে। সে অনুযায়ী বালুমহালের ডাক অনুষ্ঠিত হবে।
বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ ও বিধিমালা, ২০১১ এর বিধানসমূহ মেনে চলা বাঞ্ছণীয়। আর এই বালুমহাল থেকে উত্তোলিত বালু স্থায়ী স্তূপীকরণ, পরিবহন, অপসারণ, প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে ‘ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, ২০২১’ এ বর্ণিত বিধানসমূহ প্রযোজ্য হবে।
শেষ কথা
ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সহজ পদ্ধতি হচ্ছে নদীতেই তা স্থানান্তর করা। সবক্ষেত্রেই যে তা সম্ভব, এমন নয়। যেসব নদী ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল স্থানান্তরের উপযোগী নয়, সেক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হয় সরকারি কোনো খাসজমি। কিন্তু সরকারি খাসজমিও অতটা সহজপ্রাপ্য নয়। তাই ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনায় বিআইডব্লিউটিএকে এর লাভজনক ব্যবহারের যে দর্শন তার ওপরই বেশি জোর দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ, লাভজনক উদ্দেশে পরিবেশগতভাবে গ্রহণযোগ্যতা ও চাহিদার ভিত্তিতে নতুন ভূমি উন্নয়ন, ডাইক ও বাঁধ নির্মাণ এবং জলজ ও বন্যপ্রাণীর আবাস উন্নয়নে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের উপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। আর কোনো ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল দূষিত হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশিকা অনুযায়ী কারিগরিভাবে প্রযোজ্য হলে তা নদীতে ফেলার ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। তবে নেভিগেশন চ্যানেলে এর কোনো প্রভাব যাতে না পড়ে সেটাও গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেওয়া হয়। কাঙ্খিত সীমার মধ্যে নদীতে কাঙ্খিত গভীরতা না থাকার ফলে দূষিত ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল স্থলে যদি ফেলতেই হয় সেক্ষেত্রে ওই স্থানটিকে আশপাশের এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হয়। সম্ভব হলে পরিশোধনও করা যেতে পারে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিআইডব্লিউটিএর অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প বাংলাদেশ রিজিওনাল ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট-১ (চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ করিডোর) এ বিকল্পগুলো রাখা হয়েছে।
তথ্য উৎস
১. History of Dredging’, Start Dredging
২. বাংলাপিডিয়া
৩. বিআইডব্লিউটিএ
৪. Encyclopedia of Ocean Sciences (Second Edition)
5. Dredged Material Management Guide, PIANC
6. OSPAR GUIDELINES FOR THE MANAGEMENT OF DREDGED MATERIAL
7. The Convention on Wetlands of International Importance
8. HELCOM Guidelines for Management of Dredged Material at Sea
9. Karim A. Abood, et al., Barriers to the Beneficial Use of Dredged Material and Potential Solutions
10. EnviCom WG 104: Dredged Material as a Resource (2009)
11. CEDA
12. EnviCom WG 104: Dredged Material as a Resource (2009)
13. EnviCom WG 104: Dredged Material as a Resource (2009)
14. Syed Mehdi Momin, Dredging must be sustainable and eco-friendly
১৫. সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮
১৬. সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮
১৭. Dredging and Dredged Material Management Draft Policy 2013
১৮. ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, ২০২১