বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুধবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
17 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

যমুনা নদী ইকনোমিক করিডোর নদীভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভরকেন্দ্র হওয়ার সম্ভাবনা

নদীবাংলা ডেস্ক,

বিপ্রদাশের কালে পঞ্চদশ শতকে যমুনা অতিকায় নদী। তাঁর বয়ানে ‘গঙ্গা আর সরস্বতী যমুনা বিশাল অতি, অধিষ্ঠান উমা মাহেশ্বরী’। তবে ১৭৮৭ সালে প্রকাশিত মেজর জেমস রেনেলের বেঙ্গল অ্যাটলাসে যমুনা ধরা দিয়েছে ক্ষীণ রেখা রূপে। তাঁর সময়ে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকে মধুপুর গড়ের পূর্ব দিক দিয়ে ব্রহ্মপুত্র প্রবাহিত হতো। এখন পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের যে প্রবাহপথ ঠিক সেই বরাবর। ঊনবিংশ শতকে কর্নেল উইলকক্সের জরিপে শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর ১৭৮২ থেকে ১৭৮৭ সালের মধ্যে নদটি নতুন গতিপথ পায় এবং যমুনা নামে ছোট নদী হিসেবে প্রবাহিত হতে থাকে। বাংলাদেশে প্রবেশের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের পুরোনো নাম মুছে যায়। লিঙ্গ পরিবর্তিত করে ব্রহ্মার পুত্র হয়ে যায় যমুনা। অবয়ব ও চরিত্র ধরে রেখে এটিই এখন প্রধান প্রবাহপথ। নতুন এই প্রবাহই আজকের যমুনা।

বাংলাদেশের সবচেয়ে সক্রিয় নদীগুলোর অন্যতম এই যমুনা। চরোৎপাদী নদীরও ধ্রপদী উদাহরণ। ছোট ছোট অসংখ্য চর বহু চ্যানেল তৈরি করেছে যমুনায়। এসব চ্যানেলের স্থানান্তর ঘটে খুব দ্রুত। নদীতীরও বদলায় সহসাই। যমুনার অতিমাত্রায় সক্রিয়তার কারণে এই পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান হতে খুব একটা সময় লাগে না।

এ ছাড়া দুই মৌসুমে যমুনার দুই রূপ তো চিরন্তন। শুষ্ক মৌসুমে নদীর গভীরতা সেভাবে থাকে না। চারদিকে ধু-ধু বালুচর। জেগে ওঠে অসংখ্য চর। সেই চরেই মানুষের ঘর-বাড়ি, গবাদিপশু, গাছপালা, চাষবাস। বর্ষায় আবার এই যমুনারই ভয়ঙ্কর রূপ। তখন সে প্রলয়ঙ্করী। বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে গ্রাস করতে চায় চরের সব কিছু। দুকল ছাপিয়ে মানুষের সব স্মৃতিচিহ্নকে সে মিশিয়ে দিতে তৎপর। যমুনা তাই অনেক বেশি জীবন্ত। কখনো সে ভয়াল-সর্বগ্রাসী। কখনো আবার প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর দয়াময়ী, আশ্রয়দাত্রী। তার জলেই দুপারে ফসল ফলে। বনভূমি রসদ পায়। পাখির কলতানে ভরে ওঠে প্রকৃতি।

ভৌত বৈশিষ্ট্য

সাধারণ দৃষ্টিতে নদীর ধরন বলতে এর বাহ্যিক আকারকে বুঝিয়ে থাকে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন দিক থেকে নদীর শ্রেণিবিভাগ করেছেন। তবে এসব শ্রেণিবিভাজনকে দুটো প্রধান ধারায় বিভক্ত করা যায়-একক প্রবাহধারা ও বহু প্রবাহধারা। এই দুই প্রবাহধারার মধ্যেই অন্যান্য যে ধারা সেগুলো দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, সেগুলো প্রধান দুই ধারারই পরিবর্তিত রূপ। একক প্রবাহধারা বিশিষ্ট নদীগুলো কিছু পরিমাণে সর্পিলতার মাত্রা প্রদর্শন করে পরবর্তীকালে সর্পিল আকার ধারণ করে। অপরদিকে চরোৎপাদী নদীর বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে বহুধারা বিশিষ্ট প্রবাহ। লিওপোল্ড ও ওলম্যান পলিজ নদীর ধরনকে তিনটি শেণিবিভাগে উপস্থাপন করেছেন-সরলাকার নদী, চরোৎপাদী নদী ও সর্পিলাকার নদী। শ্রেণিবিভাজনের ভিত্তি হিসেবে সর্পিলতার মাত্রাকে তারা আদর্শ হিসেবে নিয়েছেন। যেসব নদীর সর্পিলতার মাত্রা ১.৫ এর সমান বা বেশি, সেসব নদী সর্পিলাকার নদী। এই মাত্রার কম নদীগুলোকে চরোৎপাদী নদী এবং সরলাকার নদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

তবে প্রত্যেক ধরনেই নদী তার চরম মাত্রার পর অন্য ধরনে পরিবর্তিত হয়। কোনো নদীতেই সব সময় সর্পিলতার মাত্রার ধারা একই অবস্থায় থাকে না। সরলাকার নদী তার প্রবাহ ধারায় চরোৎপাদী ধরন বা কিছুটা সর্পিলাকার মাত্রা প্রদর্শন করে থাকে। যমুনার ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। উইলকক্সের ১৮৩০ সালের মানচিত্রে যমুনা ছিল একক প্রবাহের সর্পিলাকার নদী। ১৯১৪ সালের মানচিত্রেও যমুনাকে সর্পিলাকারই দেখা যায়। যদিও প্রবাহ ক্রমাগত পশ্চিম দিকে সরে যেতে থাকে। এর প্রশস্ততাও সেই সময় তুলনামূলক কম ছিল। গড় প্রস্থ ৫ দশমিক ৫৫ কিলোমিটারের বেশি ছিল না। তবে ১৮৩০ সালে উইলকক্সের মানচিত্রে যমুনার গড় প্রস্থ ছিল ৬ দশমিক ২৪ কিলোমিটারের মতো।

১৯১৪ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত যমুনা প্রবাহ পশ্চিম দিকে সরে যাওয়া অব্যাহত রাখে এবং আরও বেশি প্রসারিত হতে থাকে। এই সময় সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটা দেখা যায় তা হলো সর্পিলাকার ধরন থেকে যমুনার চরোৎপাদী বা ব্রেইডেড রূপ ধারণ করা। এই সময়ে আবার প্রস্থ কিছুটা হ্রাস পায়।

চরোৎপাদী প্রকৃতির যমুনায় পরবর্তীতে একাধিক চ্যানেল তৈরি হয়, যেগুলো অসংখ্য চরের মাধ্যমে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রসারতা বৃদ্ধির প্রবণতাও তীব্রতা পায়। এরপর থেকে অনেকটা থিতু হয়েছে বলা যায়। অর্থাৎ, যমুনা আর আগের মতো অত প্রচণ্ড গতিতে দুই কূল প্রসারিত করছে না। কল্লোলিনী যমুনা বোধহয় প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে চাইছে। গত ৪৬ বছরে যমুনা নদীর গড় প্রস্থ ৮ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ১২ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে।

যমুনার প্রসারতার হ্রাস-বৃদ্ধির ঐতিহাসিক প্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কালিহাতীতে যমুনা নদীর প্রসারতা ছিল ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার থেকে ৭ দশমিক ৬ কিলোমিটারের মধ্যে। তবে ভূয়াপুরে যমুনার প্রস্থ সবসময়ই বেশি। ১৯৭৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ভূয়াপুরে নদীটির প্রসারতা ছিল ৮ দশমিক ১ কিলোমিটার থেকে ৯ দশমিক ৯ কিলোমিটার।

বাংলাদেশের প্রায় সব নদ-নদীই সর্পিল অথবা চরোৎপাদী ধরনের। নদীর এই সর্পিল ও চরোৎপাদী বৈশিষ্ট্য ভাঙনের বিশেষ অনুকূল। এই বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের ছোট-বড়, সাধারণ বা সহসা প্রবাহী, উপকূলীয় বা সমতলীয় সব নদীতেই দেখা যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ১৬টি নদীর ২৫৪টি স্থানে উল্লেখযোগ্য নদীভাঙন লক্ষ্য করা গেছে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীতে ভাঙনের স্থান সর্বাধিক। এই ভাঙন যমুনার উভয় তীরেই প্রায় সমানভাবে হয়।

যেকোনো নদীর মতো যমুনার ভাঙন প্রবণতাও এর প্রসারতার হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রাপ্ত নদীতীরের স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে প্রসারতা ও ভাঙনের একটা তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায়। ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত যমুনার ভাঙনের হার ছিল ১ হাজার ১০০ হেক্টর থেকে ৫ হাজার ৮০০ হেক্টরের মধ্যে। এরপর প্রস্থ মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও প্রধান চ্যানেলগুলোর কারণে ভাঙনের হারে তারতম্য দেখা যায় লক্ষণীয়ভাবে। কারণ, তীরবর্তী চ্যানেলগুলোর প্লাবনভূমি ভাঙার প্রবণতা সবসময়ই বেশি।

সময়ের ব্যাপ্তি আরেকটু বাড়িয়ে নিলে দেখা যাবে, ১৯৭৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যমুনায় ভাঙনের হার ছিল প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার ২৫ হেক্টর। যমুনা নদীর অর্থনৈতিক করিডোরের কালিহাতীতে ভাঙনের হার গড়ে বার্ষিক ৪৮ দশমিক ৩৩ মিটার এবং ভূয়াপুরে বছরে গড়ে ৩২ দশমিক ৫ মিটার।

বৃষ্টিপাতের তারতম্য বছরজুড়েই পরিলক্ষিত হয়। মাসিক হিসাবে এর পরিমাণ ১০ মিলিমিটার থেকে ১ হাজার ২০০ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে। গত ৫৯ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণে বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পাওয়া গেছে এক হাজার থেকে ৫ হাজার মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতের এই তারতম্যে প্রভাবিত হয় যমুনার পানি সমতল। নদীটিতে পানি সমতল সবচেয়ে বেশি থাকে জুলাই-আগস্ট সময়ে এবং সবচেয়ে কম থাকে ফেব্রুয়ারিতে। আগস্টে পানি সমতল থাকে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ১১ মিটার এবং সবচেয়ে কম থাকে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ৬ দশমিক ১৩ মিটার। ১৯৮০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই হিসাব পাওয়া গেছে।

যমুনায় সর্বোচ্চ পানি প্রবাহিত হয় জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে। সবচেয়ে কম পানি প্রবাহিত হয় নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে। গত ৪০ বছরে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পানি প্রবাহের তারতম্য ছিল গড়ে ১ লাখ ৩ হাজার ১২৮ দশমিক ৮ কিউমেক (সেপ্টেম্বর) থেকে ১৪ হাজার ৯৬৮ কিউমেক (ফেব্রুয়ারি)। ঐতিহাসিক উপাত্ত অনুযায়ী, একক মাস হিসাবে যমুনায় সর্বোচ্চ পানি প্রবাহিত হয় ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ৩ লাখ ১২৯ কিউমেক। সে বছর প্রবল বৃষ্টিপাত এবং তার ফলে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছিল। আর সর্বনিম্ন পানি প্রবাহিত হয় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ৩৭ কিউমেক।

মাত্রাতিরক্তি সেডিমেন্ট বহন বাংলাদেশের নদীগুলোর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। যমুনা এদিক থেকে আরও এগিয়ে। বিশ্বের যে কয়টি নদী সবচেয়ে বেশি সেডিমেন্ট বহন করে, যমুনা সেগুলোর অন্যতম। যে বছর বন্যা দেখা দেয়, সে বছর যমুনা ১ কোটি ৩০ লাখ টন সেডিমেন্ট বহন করে থাকে।

নদ-নদীর পানির মান কেমন তা পরীক্ষা করে থাকে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর। পানিতে পর্যাপ্ত দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা জলজ প্রাণীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্ষা মৌসুমে যমুনা নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকে প্রতি লিটারে ৫ দশমিক ৪৪ থেকে ১১ দশমিক ৩৬ গ্রাম। তবে শুষ্ক মৌসুমে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রতি লিটারে ৫ দশমিক ৬২ থেকে ৮ দশমিক শূন্য ৫ গ্রাম। বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) পাওয়া গেছে বর্ষা মৌসুমে প্রতি লিটারে শূন্য মিলিগ্রাম থেকে ৫ দশমিক ১ মিলিগ্রাম। ব্যতিক্রম ছিল কেবল ২০১৩ সাল। ওই বছর যমুনা নদীতে বিওডির উপস্থিতি পাওয়া যায় প্রতি লিটারে ১৬ মিলিগ্রাম। যমুনার পানিতে পিএইচের মান থাকে সাধারণত ৬ দশমিক ৭৪ থেকে ৮ দশমিক ২২। এ ছাড়া পানির উপরিতলের তাপমাত্রা হয়ে থাকে স্বভাবত ২৪ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।

বহু বছর ধরেই দূষণ আমাদের নদীগুলোর জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই দূষণের প্রধানতম উৎস শিল্প। যমুনাকে কেন্দ্র করে শিল্পায়ন এখনো সেই মাত্রায় না পৌঁছানোয় এর দূষণের মাত্রা অতটা তীব্র নয় এবং দূষণের উৎস মূলত গৃহস্থালি বর্জ্য। জনঘনত্বপূর্ণ ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্য দিয়ে যমুনা প্রবাহিত হচ্ছে। এইসব জনবসতিতে উৎপন্ন গৃহস্থালি বর্জ্যরে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় হয় যমুনার প্রবাহতে। দূষণের আরেকটি সম্ভাব্য উৎস হচ্ছে কৃষি জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। তবে দূষণের বড় উদ্বেগ হয়ে উঠছে মাইক্রো-প্লাস্টিক এবং এর বেশিরভাগের উৎস দেশের বাইরে।

জীববৈচিত্র্য

যমুনায় সাধারণত তিন ধরনের ইকোসিস্টেম পরিলক্ষিত হয়- টেরেস্ট্রিয়াল, ফ্রেশওয়াটার এবং চরল্যান্ড। প্রাণ-প্রকৃতির বসতি পর্যবেক্ষণ করে এখানে সাত ধরনের আবাস শনাক্ত করা গেছে। এর মধ্যে অধুনাসৃষ্ট চরভূমি ও কর্দমাক্ত ভূমি যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে নদীতীর, কৃষি জমি, বালুময় উঁচু স্থান, বৃক্ষ এবং নদীর পানি। এর মধ্যে চরভূমি, কর্দমাক্ত নিম্নাঞ্চল এবং নদীর পানি প্রাকৃতিক বসতি। বাকিগুলো পরিবর্তিত বসতি। তবে কৃষিজমি, বসতি এবং উন্নয়নকৃত এলাকা এখন প্রাকৃতিক বসতির তুলনায় বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

যমুনা নদী জলজ প্রাণী ও মৎস্যসম্পদের এক অনন্য আধার। বড় ও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাট ফিশ এবং কার্পজাতীয় মাছের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রজননক্ষেত্রগুলোর অন্যতম এই নদী। এর প্লাবনভূমিগুলো মৎস্যসম্পদে সমৃদ্ধ। স্বাভাবিকভাবেই যমুনাপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা ব্যাপকভাবে এই মৎস্যসম্পদের ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া বিপুল বৈচিত্র্যের এই ধরনের চরোৎপাদী নদী এমন পরিবেশের তৈরি করে, যা বৃহৎ আকারের মাছ ও বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিনের জন্য উপযুক্ত আবাস তৈরি করে। বিচিত্র পাখিরও আবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয় যমুনার অববাহিকা। চরোৎপাদী নদীতে যে বালিয়াড়ি থাকে তা কচ্ছপ ও কুমিরের বসবাসের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের জোগান দেয়। ধ্রুপদী চরোৎপাদী নদী হওয়ায় যমুনাতে গাঙ্গেয় ডলফিনের দুটি অভয়াশ্রম গড়ে উঠেছে। বোস্তামি কচ্ছপেরও দেখা মেলে এই যমুনায়, কিছুদিন আগ পর্যন্তও যা বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল।

এ ছাড়া যমুনা-ব্রহ্মপুত্র ইম্পর্টেন্ট বার্ড অ্যান্ড বায়োডাইভারসিটি এরিয়া (আইবিএ), মধুপুর জাতীয় উদ্যান এবং গাঙ্গেয় ডলফিনের দুটি অভয়াশ্রমও রয়েছে এখানে। এর মধ্যে মধুপুর জাতীয় উদ্যান প্রকল্প এলাকা থেকে ৩২ দশমিক ৭ কিলোমিটার এবং ডলফিনের অভয়াশ্রম দুটি প্রকল্প এলাকা থেকে যথাক্রমে ৩৫ দশমিক ৮ এবং ৩৬ দশমিক ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

যমুনায় মোট ৭৬ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কমপক্ষে ৪০ প্রজাতির বৃক্ষ, ৩৩ প্রজাতির গুল্ম এবং তিন প্রজাতির বাঁশ।  মেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে ৩৩২টি। এর মধ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ২৫ প্রজাতির, পাখি ২২৩ প্রজাতির, সরীসৃপ ৩৬ প্রজাতির, উভচর প্রাণী ১৫ প্রজাতির এবং মাছ ১৫ প্রজাতির।

ইন্টিগ্রেটেড বায়োডাইভারসিটি অ্যাসেসমেন্ট টুলের (আইবিএটি) তালিকা অনুযায়ী, যমুনায় বিপন্ন ও অতি বিপন্ন প্রজাতি রয়েছে মোট ৩৮টি। এর মধ্যে স্তন্যপায়ী প্রজাতি রয়েছে দুইটি, পাখি ৯টি, মাছ ১৩টি। এর মধ্যে ২৭টি প্রজাতি রয়েছে প্রকল্প এলাকায়। এর মধ্যে গাঙ্গেয় ডলফিন যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে ঘড়িয়াল, ফিশিং ক্যাট, থ্রি-স্ট্রাইপড রুফড টার্টল, ব্ল্যাক সফটশেল টার্টল, ইন্ডিয়ান স্কিমার ও বেশ কয়েক প্রজাতির মাছ।

যমুনা নদী কার্পজাতীয় মাছের গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন ক্ষেত্রও। মৎস্য বিভাগ ২০২০ সালে নদীর ২২টি স্থানকে মাছের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মাছের প্রজননের জন্য বর্ষা মৌসুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে ঘড়িয়াল ও ডলফিনের প্রজননের জন্য প্রয়োজন হয় শুষ্ক মৌসুমের। শুধু প্রজনন হলেই হবে না, মাছের বেড়ে ওঠার জন্যও উপযোগী পরিবেশ প্রয়োজন। পানির প্রবাহ ও গভীরতা এক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

যমুনা বিপুল সম্ভাবনার এক বিস্তৃত নদী। নদীটি অতিমাত্রায় ভাঙনপ্রবণ এবং ভয়াবহ বন্যা প্রায় প্রতিবছরের ঘটনা। এ ধরনের দুর্যোগ পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে দুর্যোগ পরবর্তী যে ব্যয় তা বিপুল। কারণ, বাসিন্দাদের স্থানচ্যুতি তো হয়-ই, জমির সাথে সাথে ফসলও হারিয়ে যায়। গবেষণার হিসাব অনুযায়ী, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ পরিবারপ্রতি বার্ষিক ১ হাজার ২৫০ থেকে ২ হাজার ডলার।

এমনিতেই যমুনা নদী অববাহিকার মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য তুলনামূলক বেশি, যার হার প্রায় ৩৭ শতাংশ। এই দারিদ্র্য হ্রাস করতেও এসব দুর্যোগ কমিয়ে আনাটা জরুরি, যেটা সম্ভব শক্তিশালী বন্যা ও ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে।

এই অঞ্চলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথের চল প্রাগৈতিহাসিক। বাংলাদেশকে ঘিরে নদ-নদীর প্রাচুর্যই এই ঐশ্বর্যের মূলে। তিনটি প্রধান নদীর একটি হিসেবে যমুনার অবদান এখানে বিশেষ। নদীটিতে উন্নত তথা নাব্য নৌপথ নিশ্চিত করা গেলে এর অর্থনৈতিক সুফল হবে নানামুখী।

শুষ্ক মৌসুমে চ্যানেলের পর্যাপ্ত গভীরতা না থাকায় যমুনার উজানের অংশ সাধারণত ৫০০ টনের বেশি কার্গো বোঝাই জাহাজ চলাচল করতে পারে না। এই অপ্রতুলতার মধ্যেও যমুনার উজানের অংশ দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতি বছর ৩৫ লাখ মেট্রিক টন কার্গো পরিবাহিত হয়। তবে নৌপথটি যদি সারা বছর নাব্য রাখা যায় এবং ভালোমতো সংরক্ষণ করা হয় তাহলে নৌপথটিতে কার্গো পরিবহনের পরিমাণ বছরে ১ কোটি ১৫ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে। এখানে কেবলমাত্র ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পরিবাহিত কার্গো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তবে ভুটান ও নেপালে পরিবাহিত কার্গো হিসাবে নিলে এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে।  বিশ্বব্যাংক তাদের প্রকল্প তথ্য সংক্রান্ত যে নথি তাতে এই প্রাক্কলন করেছে।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে লজিস্টিক ব্যয়, তার বড় অংশই পরিবহন বাবদ। পরিবহনের বিভিন্ন মাধ্যমের তুলনামূলক বিশ্লেষণে অভ্যন্তরীণ নৌপথই সবচেয়ে বেশি সাশ্রয়ী। তাই পণ্য পরিবহনের হিস্যা সড়ক ও রেল থেকে অভন্তরীণ নৌপথে বাড়াতে পারলে সামগ্রিক লজিস্টিকস ব্যয় অনেক কমে আসবে। পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ, দুর্ঘটনা, জট, শব্দ এবং এ খাতের পরিচালনা ও সংরক্ষণে তুলনামূলক যে ব্যয়স্বল্পতা তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাবও অনেক।

উজানের দেশগুলো শুষ্ক মৌসুমে ভাটি অঞ্চলে পানিপ্রবাহের সুযোগ দিলে মৌসুমভেদে যমুনা নদীতে পানির পরিমাণে যে বড় তারতাম্য তা নিরসন হবে। এর ফলে বাংলাদেশের বর্ধিত পানির চাহিদা পূরণ হবে। কারণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এর বিকল্প নেই।

বন্যা ও ভাঙন নিয়ন্ত্রণের সুফলপ্রাপ্তি এবং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পর যমুনা নদীর অববাহিকা ঘিরে নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ তৈরি হবে। এর আওতায় সেচ ব্যবস্থা, সবুজ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং নদীভিত্তিক পর্যটনে সহজেই বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যমুনা নদীকে ঘিরে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি সুবিধা পাবে এর কয়েকগুণ। দেশের রপ্তানি বাড়বে বছরে ৩ হাজার কোটি ডলার। এই বিনিয়োগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে বিনিয়োগ প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৮০ কোটি, নদী শাসনে ৩৭০ কোটি, ইকোনমিক গ্রিন জোন উন্নয়নে ৫৯০ কোটি এবং পরিচালন ও ব্যবস্থাপনায় ১০০ কোটি ডলার।

যমুনা অর্থনৈতিক করিডোর উন্নয়ন

সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহাপরিকল্পনা হচ্ছে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০। এর আওতায় যেসব প্রকল্প ও তাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে ইন্টিগ্রেটেড যমুনা রিভার স্ট্যাবিলাইজেশন অ্যান্ড রিক্লেমেশন প্রকল্প। প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুরোধ করার পর সংস্থাটির সহায়তায় একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে যমুনা রিভার অর্থনৈতিক করিডোর উন্নয়ন প্রকল্প শীর্ষক একটি মেগা প্রকল্পের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে।

যমুনা নদীর ২০৫ কিলোমিটার বরাবর তিন পর্যায়ে তিনটি প্রকল্প দিয়ে যমুনা নদী অর্থনৈতিক করিডোর উন্নয়ন পরিকল্পনাটি সাজানো হয়েছে। এতে প্রকল্পে সম্ভাব্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৮০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১২০ কোটি ডলার জোগান দেবে বিশ্বব্যাংক। বাকি অর্থায়ন করবে সরকার ও উন্নয়ন অংশীদার এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক। মোট ১৫ বছরে কর্মসূচিটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। সাড়ে চার বছর মেয়াদি প্রথম প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ২০২৩ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত। সাড়ে ছয় বছর মেয়াদি দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ২০২৫-২০৩১ সাল পর্যন্ত এবং সাড়ে সাত বছর মেয়াদে প্রকল্পের তৃতীয় ও শেষ পর্যায়টি বাস্তবায়ন করা হবে ২০৩০ থেকে ২০৩৭ সালের মধ্যে।

প্রকল্পের একেক পর্যায়ের ধরন ও বৈশিষ্ট্য একেক রকম। যেমন প্রথম পর্যায়টি সাজানো হয়েছে পরীক্ষামূলক দুটি স্থানে নদী শাসন ও কিছু অংশ খনন কার্যক্রম দিয়ে। পুরো কর্মসূচি এলাকায় নৌ সহায়ক সরঞ্জাম স্থাপন, হাইড্রো-ডাইনামিক মডেলিং ও হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ পরিচালনা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দুর্যোগ তহবিলের পদ্ধতি তৈরিও প্রকল্পের এই পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে উদ্ভাবনীমূলক নদী অবকাঠামো, প্রথাগত নদী সংরক্ষণ সম্প্রসারণ এবং খনন কার্যক্রম ও নৌ চলাচল উন্নয়নে গতি আনা। তৃতীয় ও শেষ পর্যায়ে রেজিলিয়েন্ট যমুনা ইকোনমিক করিডোর উন্নয়নের কাজকে আরও এগিয়ে নেওয়া হবে।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের পাঁচটি অঙ্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নেভিগেশন চ্যানেল উন্নয়ন, যা বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। নেভিগেশন চ্যানেল উন্নয়ন অংশের সমীক্ষা ও প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষার ভিত্তিতে ‘যমুনা নদীর ইকোনমিক করিডোর উন্নয়ন (নেভিগেশনাল চ্যানেল উন্নয়ন-১ম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। এখানে প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পের আলোচনাই বেশি করে থাকছে। সেই সাথে আলোচনায় প্রকল্পের বিআইডব্লিউটিএ অংশ বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে পাঁচটি কম্পোনেন্ট বা অঙ্গের দ্বিতীয়টি হচ্ছে চ্যানেল উন্নয়ন কার্যক্রম, যা বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে বিআইডব্লিউটিএ। এই কম্পোনেন্টের আবার চারটি সাব-কম্পোনেন্ট রয়েছে- হাইড্রোগ্রাফি ও আরআইএস, প্রোটোটাইপ স্ট্রাকচার, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দ্বিতীয় প্রকল্পের প্রস্তুতি গ্রহণ। এই কম্পোনেন্টটি বাস্তবায়নে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ কোটি ডলার।

প্রকল্পের অবস্থান

উৎস থেকে ধরলে সাংপো-ব্রহ্মপুত্র-যমুনার দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটারের বেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশে পড়েছে মাত্র ২৫০ কিলোমিটার। যমুনা চরোৎপাদী নদী এবং এর রয়েছে অসংখ্য চ্যানেল। এইসব চ্যানেল আবার প্রতিনিয়ত পরিবতর্তিত হতে থাকে। অর্থাৎ, সরে যায়। সরে যাওয়ার এই হার বার্ষিক কয়েক শ মিটার থেকে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ৮ থেকে ১৮ কিলোমিটার প্রশস্ত যমুনা নদীতে রয়েছে বহু চরভূমি। এসব চরভূমির কোনো কোনোটিতে রীতিমতো জনবসতি গড়ে উঠেছে। আবাদি জমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পুরোদমে। বর্ষা এলে যমুনা ভিন্ন মূর্তিতে আবির্ভূত হয় এবং ভাঙন ও বন্যা দেখা দেয়, যা পার্শ্ববর্তী জনবসতিকে নিঃস্ব করে দেয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি এতটাই কমে যায় যে, সর্পিলাকার অসংখ্য অগভীর চ্যানেল দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। অগভীর এইসব চ্যানেলের মাঝে মাঝে উঁকি দেয় ঊর্বর চরভূমি, যেখানে দোল খায় নানা জাতের ফসল।

সাংপো-ব্রহ্মপুত্র-যমুনার এই যে ২৫০ কিলোমিটার বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সেই অংশকেই ঘিরেই এই প্রকল্প। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জ থেকে ভারত সীমান্তে দইখাওয়া পর্যন্ত ২০৫ কিলোমিটারে নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন করা হবে। সেই সাথে নদীকেন্দ্রিক যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তা কাজে লাগানো হবে। এই প্রকল্পের বড় অংশ থাকবে নদী খনন, যা বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

প্রকল্পের বিস্তারিত

প্রকল্পটির আওতায় নৌ সহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হবে। অর্থাৎ, যমুনা নদীর এই নৌপথে বয়া, ল্যাটারাল বয়া, সেফ ওয়াটার বয়া, আইসোলেটেড ডেঞ্জার বয়া, সাইন ও মার্কিং স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি অপটিমাল বার্জ প্রোটোটাইপ এবং ভাসমান ও স্থানান্তরযোগ্য জেটির ডিজাইন, নির্মাণ, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা করার কথা রয়েছে। হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের মাধ্যমে বিদ্যমান হাইড্রোগ্রাফিক চার্টও হালনাগাদ করা হবে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায় চলাকালেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন চুক্তির খসড়ার পাশাপাশি যমুনা রিভার নেভিগেশন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কথা রয়েছে। নৌপথ উন্নয়নের পরবর্তী কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের পর তার ভিত্তিতে।

হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ ও আরআইএস: অতিমাত্রায় সক্রিয় নদী হওয়ায় যমুনার তলদেশ ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। চ্যানেলগুলোও নদীর এক পাশ থেকে আরেক পাশে স্থানান্তরিত হচ্ছে নিরন্তর। এ অবস্থায় নেভিগেশন চার্টের নিয়মিত হালনাগাদ অত্যন্ত জরুরি, যাতে করে শিপাররা চাইলেই সহজে তা দেখতে পারেন। এ ছাড়া পিআইএএনসি মানের আরআইএস সিস্টেম উন্নয়ন ও পরিচালনা করা হবে, যাতে থাকবে ফিজিক্যাল এইডস টু নেভিগেশন, ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি (ভিএইচএফ) রেডার, হাইড্রোগ্রাফিক অ্যান্ড ইনল্যান্ড ইলেক্ট্রনিক চার্ট (আইইএনসি), অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস) এবং নোটিশ টু স্কিপারস (এনটিএস) সুবিধা।

ফিজিক্যাল এইডস টু নেভিগেশন দিবা-রাত্রি নিরাপদে নৌ চলাচলে সহায়তা করে থাকে। এগুলো স্থাপনের ক্ষেত্রে যেসব স্থানে নৌ চলাচলে প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি বেশি সেসব স্থান অগ্রাধিকার পাবে। পাশাপাশি হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে বছরে বেশ কয়েকবার নৌ সহায়ক সরঞ্জাম পুনঃস্থাপনের প্রয়োজন পড়বে।

ভিএইচএফ রেডার নৌযান ও স্থলের মধ্যে অবস্থানগত সতর্কীকরণের পাশাপাশি যোগাযোগে সহায়তা করবে। প্রকল্পের আওতায় স্থলে এটি স্থাপন করা হবে এবং নৌযানে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট করে দেবে। হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ জাহাজের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আইইএনসি নদীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য প্রদানে সহায়তা করবে। নৌযানের রুট প্রদর্শন, শুষ্ক মৌসুমের আগে আগে ফিজিক্যাল এইডস টু নেভিগেশন পুনঃস্থাপন, ড্রেজিং প্রয়োজন নৌরুটের এমন স্থান চিহ্নিতকরণে সর্বোপরি নৌপথে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কাজে আসবে এসব তথ্য।

প্রকল্পের আওতায় উজানে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এবং ভাটিতে বঙ্গবন্ধু সেতুতে এআইএস স্থাপন করা হবে এর ফলে যমুনা নদীতে চলাচলকারী নৌযানের ওপর সহজেই নজর রাখা যাবে। নৌযানের অবস্থান ও গতিপথ কাজে লাগিয়ে এনটিএস যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো তথ্য থাকলে চালককে তা সরবরাহ করবে। এজন্য অবশ্য আন্তর্জাতিক এনটিএস মানদণ্ড অনুসরণ ও তা প্রকাশ করতে হবে, যা নৌপথ সংক্রান্ত উপাত্ত ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত থাকবে।

বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থায় যমুনার অবস্থান

প্রকল্পের তাৎর্পয

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে মেঘালয়-আসাম থেকে বাংলাদেশে নৌ চলাচলের জনপ্রিয়তা অনেক দিনের। নৌ চলাচলের সুবিধার্থে এর চ্যানেলগুলো খনন করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগে। সেই সময় থেকেই যমুনা নদীর উভয় তীরে ছিল বেশ কিছু যাত্রী ও কার্গো বার্থিং ব্যবস্থা। সিরাজগঞ্জ ছিল এক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। দেশের উত্তরাঞ্চলের জন্য চিলমারী বন্দরের গুরুত্ব ছিল অশেষ।

ঢাকার সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট ও গাইবান্ধার তিস্তামুখ ঘাটে ফেরি সার্ভিস চালু করে। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর তিস্তামুখ ঘাটে তীব্র নাব্যতা সংকট দেখা দিলে সেটি বালাসী ঘাটে সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাপক পলি জমায় যমুনা নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল।

নাব্যতা সংকটের কারণে যমুনা নদীতে বড় নৌযানের চলাচল সীমিত হলেও দেশীয় নৌকা চলে অসংখ্য। জেগে ওঠা চরগুলোতে বসবাসকারী হাজারো মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এসব নৌকা। তাদের উৎপাদিত ও ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রী আনা-নেওয়ারও একমাত্র মাধ্যম এটি। তবে এই চলাচলে যে ঝুঁকি আছে সেটা মানতেই হবে। যদিও সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা, যেমন নদী শাসন, ড্রেজিং, তীর রক্ষার মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমিয়ে যমুনা নদীতে নৌ চলাচল বাড়ানোর যে সুযোগ রয়েছে তা অবারিত।

যমুনা নদীতে বার্ষিক পানিপ্রবাহ প্রায় গড়ে ৪ হাজার কিউমেক, যা দিয়ে শুষ্ক মৌসুমেও নদীটিকে নৌ চলাচলের উপযোগী রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে ব্রেইডেড প্রকৃতির কারণে চ্যানেল থাকে খুবই সক্রিয় এবং অগভীর। একই কারণে নতুন চ্যানেল তৈরি ও পুরোনো চ্যানেল পরিত্যক্ত হয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটে নিয়মিত। এগুলো এত দ্রুত ঘটে যে, অনেক সময় কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যেই একটি চ্যানেলের নাব্যতা কমে গেলে আরেকটি চ্যানেলের নাব্যতা তৈরি হয়ে যায়। আবার অনেক সময় এক বছরের মধ্যেই তীর রেখা ও চ্যানেল কয়েক শ মিটার থেকে এক কিলোমিটার পর্যন্ত সরে যেতে দেখা যায়।

এ ছাড়া যমুনা নদীতে পলি পড়ার হারও অন্যান্য নদীর তুলনায় বেশি। এ কারণে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের তুলনায় সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের ব্যয় তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। এসবই যমুনা নদীতে নৌ চলাচলকে চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। যমুনার যেকোনো একটি চ্যানেল নৌ চলাচলের জন্য সুনির্দিষ্ট করা এক প্রকার দুরূহ কাজ।

গত কয়েক দশকে যমুনা নদীর সর্পিলতা ও প্রস্থ দুটোই বেড়েছে। এর বিপরীতে হ্রাস পেয়েছে গভীরতা ও সর্পিলাকার চ্যানেলের স্থায়িত্ব। এই ঘটনা প্রবাহ নৌ চলাচল নিয়মিত রাখতে সংরক্ষণ ড্রেজিংকে অনেকটা অপরিহার্য করে তুলেছে। যদিও ভাটিতে নিয়মিত সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের সুফল যতটা পাওয়া যায় উজানে ততটা পাওয়া যায় না।

প্রথম পর্যায়ের অন্যান্য কম্পোনেন্ট

যমুনা নদী অর্থনৈতিক করিডোর উন্নয়ন কর্মসূচির আওতাধীন প্রকল্প-১ এ আরও চারটি কম্পোনেন্ট রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে এগুলো বাস্তবায়ন করবে তারা। কম্পোনেন্টগুলোর একটি হলো বন্যা ও নদীভাঙন ব্যবস্থাপনা, যাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে আনুমানিক সাড়ে চার কোটি মার্কিন ডলার। কম্পোনেন্টটি বাস্তবায়নের জন্য টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুর ও কালিহাতী নামক দুটি স্থানকে পরীক্ষামূলক সাইট হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। নদীর তীর রক্ষাকারী বাঁধ নির্মাণ ও ভাঙন রোধ করা এই কম্পোনেন্টের প্রধান উদ্দেশ্যে।

এই কম্পোনেন্টের আওতায় আরও কিছু কাজ হবে। কাওয়াখোলা চর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ এবং খাল খনন এর মধ্যে অন্যতম। চর মেছরা ও অর্জুনা এলাকায় ১ হাজার ৫০০মিটার ও ৪ হাজার ৬৫০ মিটার তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে। সীমিত পরিসরে ও চরের ভেতরকার খাল খনন ও কালিহাতী এলাকায় নদী খনন এই কম্পোনেন্টের আওতায় করা হবে।

আরেকটি কম্পোনেন্ট হচ্ছে এলাকাবাসীর অর্থায়ন নিশ্চিতকরণ। এতে ব্যয় হবে এক কোটি ডলার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে এলাকাবাসী বন্যা ও দুর্যোগ পরবর্তী অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিতকরণ এবং কমিউনিটি প্রটেকশন তহবিল গঠন এই কম্পোনেন্টের মূল উদ্দেশ্য।

কমিউনিটি সংযুক্তি ও প্রকল্প পরিচালনা শীর্ষক কম্পোনেন্টটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে পরিচালনা করবে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ডলার। এই কম্পোনেন্টের সব কাজ এলাকার স্থানীয় জনগণের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ সতর্কতা ও যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ, বয়া ব্যবস্থাপনা, কাওয়াখোলা চর উন্নয়ন।

কন্টিনজেন্ট ইমার্জেন্সি রেসপন্স কম্পোনেন্টের (সিইআরসি) সাথে কোনো ব্যয় জড়িত নয়। এই কম্পোনেন্টের আওতায় জরুরি পরিস্থিতিতে প্রকল্পের অন্যান্য কম্পোনেন্ট থেকে দ্রুত লোন প্রসিড স্থানান্তর করা যাবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রকল্পে আরও বেশি তহবিলের জোগানে সহায়ক হবে কম্পোনেন্টটি।

সম্ভাব্য ফলাফল

সরকারের ব-দ্বীপ পরিকল্পনার কৌশল অনুযায়ী যমুনা নদী বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র। এই বিনিয়োগ বন্যা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কৌশল এবং নদীকে ঘিরে হটস্পটভিত্তিক যে কৌশল তা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। এর ফলে বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা মিলবে। সেই সাথে টেকসই ও সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনার পথ তৈরি হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তঃসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনার চলমান যে উদ্যোগ তাতে গতি সঞ্চার করবে এই কর্মসূচি। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনকে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণের চালিকাশক্তি হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ বিশেষ করে ভারত সক্রিয়ভাবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের সম্ভাবনাগুলো খুঁজে দেখে তা বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতের ন্যাশনাল ওয়াটারওয়েজ অ্যাক্টে (২০১৬) যার প্রতিফলন স্পষ্ট। এই আইনের আওতায় তারা নতুন করে ১০৬টি জাতীয় নৌপথ সংযুক্ত করেছে। সেই সাথে জাতীয় অভ্যন্তরীণ নৌপথের দৈর্ঘ্য চারগুণ বাড়িয়ে ১৮ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে সংযোগ স্থাপনে বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল রুটের কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। প্রটোকল রুট ব্যবহার করে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যমুনা নদী অন্যতম প্রধান ধমনী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ, প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগে যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহারে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ভুটানের ব্যবসায়ীরা যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদী ব্যবহার করে ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পাথর রপ্তানি করেছে। নেপালও অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহারের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। সেই হিসেবে বলা যায়, যমুনা নদীতে অর্থনৈতিক করিডোর উন্নয়নের প্রভাব বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরেও প্রসারিত হবে।

এই কর্মসূচির আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে যমুনা নদীর তীরকে বন্যা ও ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করে। সেই সাথে যমুনার নাব্যতা বাড়ানো এবং খাতভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি।

প্রকল্প চলাকালীন নেতিবাচক প্রভাব

সব প্রকল্পেরই বাস্তবায়নকালে নেতিবাচক কিছু প্রভাব থাকে। যমুনা নদী ইকোনমিক করিডোর উন্নয়ন প্রকল্পও এই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। নির্মাণ কর্মকাণ্ডের ফলে প্রকল্প এলাকায় সবচেয়ে বেশি যেটা হয় তা হলো শব্দ দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি। প্রকল্পের আওতায় ভূয়াপুরে ৩৬৬টি এবং কালিহাতীতে ৫৪০টি পাইল ড্রাইভের প্রয়োজন হবে। এর ফলে নির্মাণস্থান থেকে ৫০ মিটারের মধ্যে শব্দের মাত্রা দাঁড়াবে ৮৪ দশমিক ৯৩ ডেসিবল, ১০০ মিটারের মধ্যে ৭৭ দশমিক ৪০ ডেসিবল, ৫০০ মিটারের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৯৩ ডেসিবল, এক কিলোমিটারের মধ্যে ৫২ দশমিক ৪০ ডেসিবল এবং দুই কিলোমিটারের মধ্যে ৪৪ দশমিক ৮৮ ডেসিবল। প্রকল্পের বড় অংশজুড়ে থাকছে ড্রেজিং কার্যক্রম। ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি নির্মাণস্থান থেকে আসা বর্জ্য ও বালুভর্তি জিওব্যাগ পানিতে ফেলার ফলে পানি ঘোলা হয়ে যেতে পারে। ড্রেজিংয়ের সময় ড্রেজার থেকে তেল নিঃসরনেরও ঝুঁকি রয়েছে। যদিও এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সোশ্যাল কোডস অব প্র্যাক্টিসেস (এসকপ) অবলম্বনের মধ্য দিয়ে নির্মাণ পর্যায়ে নেতিবাচক এসব প্রভাব কমানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। প্রশমনের এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়েই প্রকল্পের কাজ করা হবে।

এ ছাড়া নির্মাণ কার্যক্রমের ফলে ধূলিকণা ছড়াতে পারে। সেটাও এসকপ, জিআইআইপি এবং অন্যান্য প্রশমন পদ্ধতির প্রয়োগে হ্রাস করা হবে। যেকোনো প্রকল্পেই পরামর্শ ও সুফল থেকে কিছু মানুষ বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এই কর্মসূচির ক্ষেত্রে সেটা যাতে না হয় সেজন্য আলাদা একটি স্টেকহোল্ডার এনগেজমেন্ট প্ল্যান (এসইপি) প্রস্তুত করা হয়েছে।

প্রকল্প শেষে পরিচালন পর্যায়েও নেতিবাচক কিছু প্রভাব দেখা যায়। এগুলোর বেশিরভাগই নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও ড্রেজিং সংশ্লিষ্ট। বিশেষ করে তীররক্ষা কার্যক্রম ভাটির দিকে ভাঙনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে সে ধরনের ঝুঁকি খুবই কম। প্রকল্পের ব্যাপ্তি, অপেক্ষাকৃত কম আগ্রাসী নদী শাসন পদ্ধতি অবলম্বন এবং সতর্ক ড্রেজিং এর মূল কারণ।

প্রকল্পের দ্বিতীয় কম্পোনেন্ট অর্থাৎ নেভিগেশন চ্যানেল উন্নয়নের ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ অভ্যন্তরীণ কার্গো পরিবহন বাড়বে বার্ষিক ২০ লাখ টনের মতো। আর যাত্রী পরিবহন বাড়বে বছরে ৫০ লাখ। বর্ধিত এই যাত্রী ও কার্গো পরিবহনের প্রয়োজনে বৃদ্ধি পাবে নৌযানের আনাগোনা। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই দূষণও কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দূষণ যাতে না ঘটে বা কম হয় সেজন্য পরিবেশসম্মত কার্গো ভেসেল ও পন্টুনের নির্মানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। সব মিলিয়ে এসব প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী কোনো নেতিবাচক প্রভাব যে পড়বে না সেটা বলাই যায়।

শেষ কথা

ভাঙা-গড়া নদীর চিরন্তন বৈশিষ্ট্য হলেও যমুনার বেলায় সেটা আরও বেশি সত্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যমুনায় ভাঙনের প্রবণতা কিছুটা কমেছে। তারপরও গত এক দশকে প্রতি বছর গড়ে ৯৭০ হেক্টর ভূমি যমুনায় হারিয়ে গেছে। ভাঙনের এই হার আগামীতে কমবে হয়তো। তবে বন্ধ হবে সেই নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। এজন্য প্রয়োজন নদীর সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা।

হ্রাস-বৃদ্ধি হলেও যমুনায় পলল সঞ্চার চলবেই। স্বাভাবিকভাবেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নদীর চরিত্র বুঝে সঠিক ব্যবস্থাপনা না করলে ভাঙন, বন্যা ও চ্যানেল স্থানান্তরের প্রক্রিয়াও চলতে থাকবে একইভাবে। যার ফল হবে যমুনার পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা বসতিগুলোর স্থানচ্যুতি। সেই সাথে দেশের সার্বিক অর্থনীতির লক্ষণীয় ক্ষতি। নদী ব্যবস্থাপনার সঠিক প্রকল্প না নিলে জাতীয় অর্থনীতিই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, স্থানীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়ন কর্মকান্ডও বাধাগ্রস্ত হবে। অবনতি হবে যমুনাপাড়ের মানুষের সার্বিক জীবনমানের। এর বিপরীতে কর্মসূচিটি বাস্তবায়িত হলে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া নাব্যতা উন্নয়নের ফলে যমুনায় বড় জাহাজ চলাচলের সুযোগ পাবে এবং আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here