বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুধবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
17 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিআইডব্লিউটিএ’র অর্জন

At present, sampans carry cargo from ocean-going freighters to the river docks to unload. This is a scene at the port of Narayanganj.

এই অঞ্চলের নদীপথে যন্ত্রচালিত নৌযানের যাত্রা প্রায় দুই শতক আগে, ১৮৩৪ সালে। বছর দশেক পর ১৮৪৪ সালে গঠিত হয় দ্য ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে কোম্পানি লিমিটেড (আইজিএনআর)। এর কয়েক বছর পর আসে আরও একটি কোম্পানি রিভার স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি লিমিটেড (আরএসএন)। উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলা, আসাম ও বিহারে নৌপথে বাণিজ্য এই দুই কোম্পানিই নিয়ন্ত্রণ করত। মোট যাত্রী ও কার্গো পরিবহনের ৭০ শতাংশই করত তারা।

ব্রিটিশ আমলে নৌপথের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল তাদেরই। নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণে বা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো ভূমিকা তখন ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে নৌপথের যে উন্নতি ও উন্নয়ন তা ছিল তাদের মুনাফাকেন্দ্রিক। এই নীতির কারণে মাদারীপুর বিল রুট বাদ দিলে বিশ শতকের গোড়ার দিকেও এই অঞ্চলের নৌপথের উন্নয়ন সেভাবে চোখে পড়েনি। ১৯০৭ সালে কেনা ফয়ার ড্রেজার দিয়ে কেবল মধুমতী নদী, মাদারীপুর বিল রুট এবং লোয়ার কুমার ও গোপালগঞ্জের লুপ খনন করা হয়েছিল। পরের দিকে কেনা হয়েছিল আলেক্সান্দ্রা নামে আরও একটি ড্রেজার।

‘লর্ড উইলিয়াম বেনটিক’ নামে ইঞ্জিনচালিত প্রথম নৌযানটি ভাসানোর পর সুন্দরবন চ্যানেল দিয়ে কলকাতা ও খুলনার মধ্যে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক নৌযান চলাচল করলেও নৌপথের জন্য পৃথক কোনো কর্তৃপক্ষ গঠন করা যায়নি দীর্ঘ সময়েও। এমনকি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম এক দশকও অভ্যন্তরীণ নৌপথ পরিচালিত হয়েছে পৃথক কোনো কর্তৃপক্ষ ছাড়াই। অথচ একুশ শতকের প্রথম প্রান্তিকেই সুন্দরবন দিয়ে কলকাতা-খুলনা রুটে চলাচলকারী নৌযানের সংখ্যা পৌঁছে গিয়েছিল বার্ষিক গড়ে ৪ হাজার ৮৩০।

বিআইডব্লিউটিএ প্রতিষ্ঠার পূর্বাপর

নৌযান চলাচল বাড়তে থাকায় এই অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ নৌপথের জন্য আলাদা একটি বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া অবশ্য শুরু হয় তিরিশের দশকেই। সেই লক্ষ্যে ১৯৩৪ সালে বেঙ্গল আইনসভা ‘দি ইনল্যান্ড ওয়াটরওয়েজ বিল’ও পাস করে। কিন্তু সেটি আর কাজে আসেনি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরপরই অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও উন্নয়নে বিভিন্ন সংস্থা, কমিটি ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে উপযুক্ত একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দাবি উঠতে থাকে।

এই অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের জন্য সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রথম সুপারিশ আমরা দেখতে পাই ১৯৪৮ সালের ইউনাইটেড স্টেটস সার্ভে মিশনে। ১৯৫১ সালে জাতিসংঘের আইডব্লিউটি স্টাডি গ্রুপেও একই প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। ১৯৫৩ সালে জে জি সুরি ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের ওপর জাতিসংঘের জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। ওই প্রতিবেদনেও আলাদা কর্তৃপক্ষের বিষয়টি উঠে আসে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন নিয়ে ১৯৫২ ও ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে দুই দফা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে খাতটির ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও উন্নয়নে পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবি আবারও উচ্চারিত হয়। ১৯৫৫-৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করে। একই বছর পূর্ব পাকিস্তানের পানিসম্পদ নিয়ে জাতিসংঘের জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন জে জে ক্রুগ। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের জন্য কর্তৃপক্ষের বিষয়টি উঠে আসে সেখানেও। একই সুপারিশ করা হয় ১৯৫৭ সালে বিশ^ব্যাংকের সার্ভে মিশন, আইসিএ সার্ভে মিশন ও পাকিস্তান সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতে। সর্বশেষ ১৯৫৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের যে আইডব্লিউটি ইকুইটি কমিটি, সেখানেও কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়টি আসে জোরেশোরেই।

দীর্ঘ সময় ধরে চলা এসব সুপারিশ ও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ নৌপথের জন্য পৃথক একটি কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃতি পায়। এরপর ১৯৫৮ সালের ৩১ অক্টোবর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌযান চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে ও সুনির্দিষ্ট কিছু নাব্য নৌপথের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দি ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৫৮ (ইস্ট পাকিস্তান) জারি করে। ওই বছরের ৪ নভেম্বর চেয়ারম্যান হিসেবে মাসুদ হোসেন ও সদস্য (প্রকৌশল) হিসেবে বিএম আব্বাসকে নিয়োগদানের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (ইপিআইডব্লিউটিএ)। কর্তৃপক্ষের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৫৮ সালের ১৮ নভেম্বর মাসুদ হোসেন দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে অধ্যাদেশে সংশোধনী এনে ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান শব্দগুচ্ছটি বাদ দেওয়া হয়।

কার্যপরিধি

কর্তৃপক্ষের কার্যপরিধি কী হবে অধ্যাদেশেই তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। অধ্যাদেশটিতে প্রথম সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৭ সালে। এরপর ১৯৯৭ সালে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (সংশোধনী) আইন নামে আরেকটি সংশোধনী আনা হয়। এসব সংশোধনীর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কার্যপরিধি আরও সুনির্দিষ্ট ও বিস্তৃত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে যেসব কার্যক্রম তা হলো:

১। নৌপথ নাব্য রাখার উদ্দেশ্যে নদী শাসনসহ নদী সংরক্ষণ এবং নৌ চলাচলে সহায়তা যেমন মার্কা, বয়াবাতি, বিকন বাতিসহ নৌ-সহায়ক সামগ্রী স্থাপন;

২। নাব্যতা ও আবহাওয়া-সংক্রান্ত তথ্য প্রচার করা

৩। পাইলটেজ সুবিধা প্রদান ও হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ পরিচালনা করা;

  • ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হলে সে সম্পর্কিত কর্মসূচি তৈরি ও বিদ্যমান নাব্য নৌপথগুলো দক্ষতার সাথে সংরক্ষণ করা। নৌ চলাচলের জন্য নতুন চ্যানেল ও ক্যানেল উন্নয়নের পাশাপাশি মরে যাওয়া বা শুকিয়ে যাওয়া নদী, চ্যানেল ও ক্যানেল পুনরুজ্জীবিত করা;
  • নদীবন্দর, ঘাট এবং এসব নদীবন্দর ও ঘাটের টার্মিনাল সুবিধাদির উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও পরিচালনা করা
  • নাব্য নৌপথে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা অপসারণ করা;
  • প্রধান নদী, ফিডার ও ক্রিক রুটে যাত্রী এবং কার্গো পরিবহন নির্বিঘ্ন করতে ট্রাফিক জরিপ পরিচালনা করা;
  • যন্ত্রচালিত নৌযানে স্বাচ্ছন্দ্যে, নিরাপদে ও দ্রুত যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যে সাশ্রয়ী নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলো;
  • সরকারের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও কার্গো পরিবহনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা;
  • যাত্রীবাহী নৌযানের টাইম-টেবিল অনুমোদন করা;
  • দেশীয় জলযানগুলোর আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীরণের কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামীণ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা;
  • বাণিজ্য ও কৃষির স্বার্থে বিদ্যমান পরিবহন সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারে অন্যান্য পরিবহন মাধ্যম, সমুদ্র বন্দরের সাথে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের সমন্বয় সাধন করা;
  • জলযানের নকশা, টাওয়েজ কৌশল, ল্যান্ডিং ও টার্মিনাল সুবিধাদি ও বন্দর স্থাপনার উন্নয়নসহ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা;
  • দেশের ভেতর ও বাইরে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য কর্মসূচির ব্যবস্থা করা;
  • অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন বহরে থাকা জলযান মেরামত ও নতুন জলযান নির্মাণের লক্ষ্যে শিপইয়ার্ড ও জাহাজ মেরামত শিল্পের সাথে লিয়াজোঁ রক্ষা করা;
  • অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন শিল্পের জন্য মেরামত সরঞ্জাম আমদানিকে সহজীকরণ করা;
  • উপরোক্ত কার্যক্রমগুলো সম্পাদনের জন্য পরিকল্পনা বা উন্নয়ন কর্মসূচি প্রস্তুত করা;
  • এর বাইরে সময় সময় সরকার নির্দেশিত যেকোনো কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা;

স্বাধীনতা-পূর্ব কার্যক্রম

পরিবহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনা থাকার পরও স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে দশকের পর দশক ধরে অবহেলিত থেকে গেছে এই অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থা। খাতটি পুরোপুরি বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে থাকাই এর প্রধানতম কারণ। পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যম যেমন সড়ক, রেল ও আকাশপথে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাত ছিল ঠিক এর বিপরীত। এর আরেকটি কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে পাকিস্তান ইকোনমিক সার্ভে ১৯৬০-৬১-তে। সেটা হলো নৌপথের নাব্যতা ও নৌযান পরিচালনার কর্তৃত্ব আলাদা করে রাখা এবং এটাকেই অভ্যন্তরীণ নৌপথের অনুন্নয়নের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই অসামঞ্জস্য দূর করতেই ১৯৫৮ সালের নভেম্বরে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ গঠন করে সরকার।

কর্তৃপক্ষ গঠনের পরও যে নৌপথের খুব দ্রুত উন্নতি হয়েছে তেমনটা বলা যায় না। কারণ প্রকৌশলগত বা পরিসংখ্যানগত উপাত্তের ভিত্তিতে উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করেছিল এ ধরনের কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই। দক্ষ জনবলের সংকটও ছিল প্রকট। নৌপথ, বন্দর, সংরক্ষণ, পাইলটেজ, মেরিন, ট্রাফিক ও সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিভাগগুলো দেখভালেই কারিগরিভাবে প্রশিক্ষিত কর্মকর্তার প্রচ- অভাব ছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠার প্রথম দেড় বছরে অর্থনীতিতে উল্লেখ করার মতো বাড়তি কিছু যোগ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

অথচ সেই সময়েও পূর্ব পাকিস্তানে নাব্য নৌপথ ছিল ২ হাজার ৭০০ মাইল, বর্ষা মৌসুমে যা ৪ হাজার মাইল পর্যন্ত উন্নীত হতো। পাকিস্তান ইকোনমিক সার্ভে ১৯৬০-৬১ এর তথ্য অনুযায়ী, বিস্তৃত এই নৌপথে চলাচল করত ১৭৭টি স্টিমার, ৭৪৭টি মোটরভেসেল, ৪৫৮টি যাত্রীবাহী লঞ্চ ও ৬৯৬টি ডাম্ব ক্রাফট। সবমিলিয়ে এসব নৌযানের যাত্রী পরিবহনের ক্ষমতা ছিল ৯২ হাজার ৫৩ ও কার্গো পরিবহন ক্ষমতা ১ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। ২৭০টি প্রতিষ্ঠান এসব নৌযান পরিচালনা করত। পাশাপাশি চলাচল করত ৩ লাখ দেশীয় নৌকা, যেগুলোর ১৪ লাখ যাত্রী ও ১২ লাখ মেট্রিক টন কার্গো পরিবহনের সক্ষমতা ছিল।

বিস্তৃত এই নৌপথ ও বিপুল সংখ্যক নৌযানকে কাজে লাগিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়াস জোরেশোরে শুরু করে ১৯৬০ সালে। পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৬০-৬৫) আওতায় ২৩ কোটি রুপির কর্মসূচি হাতে নেয়। প্রকৌশলগত ও মাঠ জরিপকারীদের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজও এই সময়ে সম্পাদন করা হয়।

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে সাকল্যে চারটি প্রকল্প সম্পাদন করে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ। ১৯৬১ সালের জুনে সমাপ্ত একটি প্রকল্পের আওতায় চারটি ফেরি ক্রয় করে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে সেগুলো বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরের বছর কেনা হয় ছয়টি জরিপ ও পরিদর্শন জাহাজ। রাত-দিন সবসময় নৌপথে যাতে নিরাপদে নৌযান চলাচল করতে পারে, সেজন্য ১৯৬৪ সালে বয়া, বিকন, মার্ক সংগ্রহ ও সেগুলো স্থাপন করা হয়। এছাড়া কর্তৃপক্ষের নৌযান মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৯৬৫ সালে বরিশালে স্থাপন করা হয় একটি ওয়ার্কশপ।

তবে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমে অনেকটাই গতি আসে। দেশের প্রধান পাঁচটি নদীবন্দর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল ও খুলনায় কার্গো জেটি ও প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল উন্নয়ন করা হয়। উপকূলীয় দ্বীপগুলোতে ১৭টি টিম্বার জেটি ও ছোট রিভার স্টেশনগুলোতে ১৮টি ভাসমান পন্টুন নির্মাণ করা হয়। বরিশাল রিপেয়ার ওয়ার্কশপেও শুরু হয় সব ধরনের ও আকারের নৌযানের মেরামত কার্যক্রম। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে ২০০টি লঞ্চ ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণের কথা থাকলেও ১১৪টির নির্মাণ সম্পন্ন হয়। তিনটি ড্রেজার ক্রয়েরও লক্ষ্যমাত্রা ছিল এই সময়ে। যদিও ওই সময়ের মধ্যে তা কেনা যায়নি।

পাকিস্তান ইকোনমিক সার্ভে ১৯৬৯-৭০ এর তথ্য অনুযায়ী, সরকারি খাতে এই সময়ে ২৭ কোটি ৪৭ লাখ রুপি ব্যয়ের পরিকল্পনা থাকলেও খরচ হয় ১১ কোটি ৫০ লাখ রুপি। একই সময়ে বেসরকারি খাতে পরিকল্পিত ৬৫ কোটি ৫০ লাখ রুপির বিপরীতে বিনিয়োগ হয় ৭ কোটি রুপি।

স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্জন

উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষকে স্বাধীনতার পর নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বলা যায় নতুন করে শুরু করতে হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে কর্তৃপক্ষের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান ক্যাপ্টেন নুরুল হক। এক বছর পর্যন্ত তার এ নিয়োগ ছিল খ-কালীন। পূর্ণকালীন চেয়ারম্যান হিসেবে ক্যাপ্টেন হক নিয়োগ পান ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে। ১৯৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।

স্বাধীনতার কিছুদিন পরই ১৯৭২ সালের ১৮ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সাথে নিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের জাহাজ ‘ইনভেস্টিগেটরে’ করে শীতলক্ষ্যায় নৌবিহারে বেরিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে গিয়েছিলেন। প্রায় ৬ ঘণ্টার নৌবিহারে তারা নদীমাতৃক বাংলার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করেছিলেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৮ পর্যন্ত কার্যক্রম: যুদ্ধকালীন তো বটেই, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম ছিল অভ্যন্তরীণ নৌপথ। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় সড়ক ও রেলপথের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ২৯৯টি রেল সেতু ও ২৭৪টি সড়ক সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেগুলো মেরামতের পর চালু করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। রেল ও সড়কের তুলনায় অভ্যন্তরীণ নৌপথ অবকাঠামোয় অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগের দরকার পড়ায় সেদিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় ১৯৭৩-৭৮ মেয়াদি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতে। নৌপথ ঘিরে বেশকিছু বড় ধরনের কর্মসূচি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেগুলো সম্পাদনের দায়িত্ব পড়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের ওপর। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল চালুকরণ;
  • ৫০০ মাইল নৌপথ উন্নয়ন;
  • ১,০০০ মাইল নৌপথের জরিপ ও সংরক্ষণ;
  • প্রধান প্রধান নদীবন্দরগুলোতে ডিসচার্জ পয়েন্ট বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষ লোডিং ও আনলোডিং ব্যবস্থা এবং কিছু ট্রানজিট শেড নির্মাণ;
  • নতুন নদীবন্দর নির্মাণ;
  • গৃহীত পরীক্ষামূলক প্রকল্পের ভিত্তিতে ফেরো-সিমেন্ট নৌযান/পন্টুন নির্মাণসহ দেড় হাজার দেশীয় নৌকার যান্ত্রীকীকরণ;
  • ১০টি ড্রেজার ক্রয় ও
  • কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
  • এছাড়া বিভিন্ন স্থানে নৌপথ ও নদীবন্দর উন্নয়নে সমন্বিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনার কথা বলা হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতে। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় শুকিয়ে ও মরে যাওয়া এমন নদী পুনরুদ্ধারে বিস্তারিত গবেষণার সুপারিশও করা হয় সেই সময়। স্বাধীনতার পর ভারতের সাথে নতুন ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় নিয়ে জোর দেওয়া হয় নতুন নতুন নদীবন্দর নির্মাণের ওপর।

এই সময়েই উন্নয়ন কর্মকা-ের জন্য কয়েক দফায় বিভিন্ন নদীর মৌলিক হাইড্রোগ্রাফিক ডাটা সংগ্রহ করে বিআইডব্লিউটিএ। বিভিন্ন নদীর খননকাজও করা হয়। ডেককর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র অধীনে নারায়ণগঞ্জে ডেক অ্যান্ড ইঞ্জিন পার্সোনেল ট্রেইনিং সেন্টারও (ডিইপিটিসি) প্রতিষ্ঠিত হয় এই সময়ে। 

১৯৮০-৮৫ : আশির দশকেও বাংলাদেশের পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্ব কমেনি। তখনো মোট কার্গো পরিবহনের ৫০ শতাংশ এবং যাত্রী পরিবহনের ২৫ শতাংশ হতো নৌপথে। পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও নৌপথগুলোর নাব্যতা কমে আসতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। নদী ও চ্যানেলগুলোয় পলি জমে তিন দশকের মধ্যে সাড়ে ৪ হাজার মাইল দীর্ঘ নৌপথ কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার মাইলে। সেচের কাজে অত্যধিক মাত্রায় ভূ-উপরস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তোলে। নৌপথের গভীরতা কমে যাওয়ার পাশপাশি নৌপথগুলোর ব্যবস্থাপনাগত সমস্যাও ছিল। রাত্রিকালে নির্বিঘ্নে নৌযান চলাচলের জন্য মার্কিংয়ের অভাব ছিল। চলাচলকারী নৌযানগুলোও পুরনো হয়ে গিয়েছিল। ল্যান্ডিং সুবিধাও পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল না।

এসব বিবেচনায় দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ড্রেজিং ও মার্কিংয়ের মাধ্যমে চ্যানেলগুলোর উন্নয়ন, ল্যান্ডিং সুবিধা বৃদ্ধি ও নৌযানের সংখ্যা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। নদীগুলোর শুকিয়ে যাওয়া ছয়টি সেকশনে ১ কোটি ২০ লাখ কিউবিক ইয়ার্ড খনন, নৌযান চলাচলকারী তিনটি চ্যানেল খনন, আরও চারটি নদীবন্দর ও ৫০টি ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ এবং ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় দ্রুত চলাচল উপযোগী এলসিটি (ল্যান্ডিং ক্রাফট ট্রান্সপোর্ট) ভেসেল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় পরিকল্পনায়। আর ল্যান্ডিং স্টেশনগুলো টোল ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়।

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদকালে বিআইডব্লিউটিএ পাবনার বাঘাবাড়িতে নদীবন্দর নির্মাণের কাজ শেষ করে। পাশাপাশি খাদ্যশস্য খালাসের জন্য ইকরামপুর, খানপুর ও মহেশ^রপাশায় আরসিসি জেটি নির্মাণ করে কর্তৃপক্ষ। বাড়তি নৌ চলাচলের ব্যবস্থা করে ঢাকা নদীবন্দর সম্প্রসারণ, গ্রামাঞ্চলে ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ, আরিচা, নগরবাড়ী, সিরাজগঞ্জ ও ভুঞাপুরে ফেরি টার্মিনালও নির্মাণ করা হয় এই সময়ে। একই সাথে সুরমা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও তিতাস নদী খননের পাশাপাশি হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ জাহাজ ও নেভিগেশনাল যন্ত্রপাতিও কেনা হয়। ১৯৮৩ সালে সংগ্রহ করা হয় উদ্ধারকারী জাহাজ ‘রুস্তম’। আরেকটি উদ্ধারকারী জাহাজ ‘হামজা’ সংগ্রহ করা হয় ১৯৬৮ সালে।

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন বহু আগে থেকেই ছিল বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। আগামীতে যে এটা অনেক বাড়বে সেটা ধরেই নেওয়া হয়। এটা বিবেচনায় নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকাণ্ডে মনোযোগ বাড়ায়, যাতে করে যাত্রী পারাপার নিরাপদ ও আরামদায়ক হয়। পাশাপাশি নৌ চ্যানেল ও ল্যান্ডিং স্টেশনগুলোর উন্নয়নেও জোর দেয় কর্তৃপক্ষ।

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতে সরকারের এই নীতির কারণে স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি মালিকানায় নৌযান পরিচালনা এবং যাত্রী ও কার্গো পরিবহন বাড়তে থাকে। ১৯৭৯-৮০ সালে যন্ত্রচালিত নৌযানের ৭৫ শতাংশ বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত হলেও ১৯৮৪-৮৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ শতাংশে। ১৯৭৯-৮০ সালে বেসরকারি মালিকানায় দেড় লাখ দেশীয় নৌকা অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচল করত। ১৯৮৪-৮৫ সালে তা বেড়ে হয় ২ লাখ। যন্ত্রচালিত নৌযানে ব্যাপক পরিমাণে বিনিয়োগেও এগিয়ে আসেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। ১৯৭২ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ১১৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯১ কোটি টাকায়।

বেসরকারি খাতকে এগিয়ে নেওয়ার এই নীতির কারণে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) সম্প্রসারণ থেকে সরে আসে সরকার। ফলে ১৯৮০ সালের দিকেও করপোরেশনের মালিকানাধীন বিভিন্ন ধরনের ৬০০টি নৌযান থাকলেও ১৯৮৫ সালের দিকে তা ৫৩৩টিতে নেমে আসে। সংস্থাটির মালিকানাধীন নৌযানের মাধ্যমে ১৯৭৯-৮০ সালে ২০ লাখ টন কার্গো পরিবহন হলেও ১৯৮৪-৮৫ সালে তা ১৩ লাখ টনে নেমে আসে।

১৯৮৫-৯০: এই সময়কালে নৌযানের সংখ্যা ও পরিসর বাড়লেও নৌপথ সংকোচনের ধারা অব্যাহত থাকে। তারপরও অভ্যন্তরীণ নৌপথই ছিল যাত্রী পরিবহনের প্রধানতম মাধ্যম। অন্য যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে নৌপথেই সবচেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন হতো। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের তিন-চতুর্থাংশ প্লাবিত হলে পরিবহন মাধ্যম হিসেবে বিশেষ করে বন্যার সময় নৌপথের গুরুত্ব নতুন করে সামনে আসে।

চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষা ও নৌযান চলাচল নিরাপদ করতে ১৯৮৫-৯০ মেয়াদি তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিলকল্পনায় বিআইডব্লিউটিএ’র জন্য বেশকিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। নৌপথের হাইড্রোলিক পরিবর্তনের রেকর্ড সংরক্ষণ ও সে অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এর মধ্যে অন্যতম। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের ডেককর্মীদের প্রশিক্ষণও অব্যাহত রাখা হয়।

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার নৌপথের উন্নয়নে শুরুতে ১৯টি প্রকল্পের বিপরীতে বিআইডব্লিউটিএ’র অনুকূলে ৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। পরে আরও ১৩টি প্রকল্প যুক্ত করে প্রকল্পের সংখ্যা উন্নীত করা হয় ৩১টিতে। এর মধ্যে ১৯৯০ সালের মধ্যে সম্পাদনের জন্য ২৮টির কাজ শুরু হয় এবং ২০টি সম্পন্ন হয়। এতে ব্যয় হয় ৭১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, যা মূল বরাদ্দের ৮৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় বিআইডব্লিউটিএ’র জন্য যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • ১৭১ কিলোমিটার নৌপথ উন্নয়ন;
  • দিবা-রাত্রি নিরাপদে নৌযান চলাচলে সহায়তার লক্ষ্যে ৪৮০ কিলোমিটারে নেভিগেশনাল মার্কিং;
  • গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় দেড়শটি লঞ্চ ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ;
  • বিদ্যমান ফেরিঘাটগুলোর মানোন্নয়নের পাশাপাশি নতুন নতুন সুবিধা তৈরি;
  • তিনটি হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ জাহাজ ক্রয় ও
  • নদীবন্দরগুলোয় কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কারিগরি ক অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখা।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে ১৬৪ কিলোমিটার নৌপথের উন্নয়ন সম্পন্ন করে বিআইডব্লিউটিএ। ২৩ লাখ ঘনমিটার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে পলি খনন করা হয় ২১ লাখ ঘনমিটার। লঞ্চ ল্যান্ডিং স্টেশন পুনর্বাসন করা হয় ২২টি। যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৫টি ল্যান্ডিং স্টেশন পুনর্বাসনের। এই সময়কালে ৭৫টি লঞ্চ ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণের কথা থাকলেও সেগুলো নির্মিত হয়নি। এছাড়া তিনটি জরিপ জাহাজ ক্রয় প্রকল্পটিও সম্পন্ন হয়নি।

১৯৯০-৯৫: পরিবহন মাধ্যম পণ্যের উৎপাদন, বিতরণ ও পরিভোগকেই কেবল প্রভাবিত করে না, অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ লিংকেজ হিসেবেও কাজ করে। অর্থনীতির প্রসারের লক্ষ্যে খাতটির উন্নয়নে ১৯৯০-৯৫ মেয়াদি চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিভিন্ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এজন্য ১৯৮৯-৯০ সালে যমুনা বহুমুখী সেতু (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু) প্রকল্পের অর্থ বাদে পরিবহন খাতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় সাকল্যে ৮ হাজার ৭ কোটি টাকা। তবে পরিবহনের প্রধানতম মাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও নৌপরিবহন খাত পায় মোট বরাদ্দের ১০ শতাংশ। বরাদ্দের ৩৪ শতাংশই যায় সড়ক পরিবহন খাতে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বরাদ্দ পায় রেল খাতও।

চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আলোকে বরাদ্দ বিভাজনের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, সড়ক ও সড়ক পরিবহন খাত পেয়েছে ২ হাজার ৭৪৫ কোটি, রেলওয়ে ৮৩৫ কোটি ও নৌপরিবহন খাতে গেছে ৭৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ’র অনুকূলে বরাদ্দ ১৮২ কোটি টাকা, যা এই খাতে বরাদ্দের মাত্র ২৩ শতাংশ। এই বরাদ্দে ১৯৯০-৯৫ সময়কালে বিআইডব্লিউটিএ কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • সারা বছর নৌ চলাচলের উপযোগী সর্বনিম্ন গভীরতা ধরে রাখতে নির্বাচিত কিছু নদী/চ্যানেল খনন করা;
  • দিনে ও রাতে নৌ চলাচল নিরাপদ করতে ৩৭২ কিলোমিটারে নেভিগেশন মার্কিং;
  • নতুন ৪০টি লঞ্চ ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ এবং ৪৫টি পন্টুন ও গ্যাংওয়ের পুনর্বাসন;
  • দুটি হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ জাহাজ ক্রয়;
  • বুড়িগঙ্গার ডাউন স্ট্রিমে জেনারেল কার্গো পোর্ট ও কনটেইনার বার্থ নির্মাণ;
  • স্থলের সাথে নৌযানের বিদ্যমান টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও
  • ড্রেজার বহর ও জরিপ জাহাজকে সহায়তাকারী সাপোর্ট জলযান ও যন্ত্রপাতি ক্রয়।

চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় অর্থাৎ ১৯৯০-৯৫ মেয়াদে গৃহীত কর্মসূচিগুলোর মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ ২৪৬ কিলোমিটার নৌপথ খনন করে। ৯৯টি পন্টুন পুনর্বাসনের পাশাপাশি ৪টি হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ জাহাজও ক্রয় করে এই সময়ে। সেই সাথে উপকূলীয় প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকার ম্যাপিং সম্পন্ন করে কর্তৃপক্ষ।

১৯৯৬-২০০১: অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের উন্নয়নে বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৭ সালের জুন পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএ ৮টি প্রকল্প সম্পন্ন করে। এসব প্রকল্পের আওতায় ২০টি পন্টুন মেরামত ও প্রতিস্থাপনের পাশাপাশি যমুনা নদীর রেল ফেরি রুট খনন করা হয়। সেই সাথে পাঁচটি ওয়ার্ক বোট ও তিনটি অ্যাকোমোডেশন বার্জও ক্রয় করে কর্তৃপক্ষ। স্থল থেকে স্থল, স্থল থেকে নৌযান এবং নৌযান থেকে নৌযানের মধ্যে উন্নত যোগাযোগের জন্য ৬৩টি টেলিকমিউনিকেশন সেটও কেনা হয় এই সময়েই।

১৯৯৭-২০০২ মেয়াদি পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতে বিদ্যমান চ্যানেল ও বন্দরের চ্যানেলগুলোর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ জোর দেওয়া হয়। সেই সাথে নদীবন্দর, জেটি এবং ইনল্যান্ড কনটেইনার পোর্ট ও ডিপো উন্নয়নের কথাও সমান গুরুত্বের সাথে বলা হয়। বরাবরের মতো পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও গ্রামীণ অঞ্চলে লঞ্চ ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি নিরাপদ নৌ চলাচল বিশেষ গুরুত্ব পায়। বিদ্যমান প্রথাগত দেশীয় নৌকার যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যও ধরা হয় এই পরিকল্পনায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই সময়কালে গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোতে মোট ১ কোটি ঘনমিটার খননকাজ সম্পন্ন করা হয়। সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে এগুলো পুনর্বাসন করা হয় পুরনো পাঁচটি ড্রেজার। আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ কাজ এ সময় সম্পন্ন করে বিআইডব্লিউটিএ। ঢাকা ও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতে ফেরিরুট পারাপারে সময় ও খরচ বাঁচাতে আরিচার পরিবর্তে পাটুরিয়াতে ফেরি টার্মিনাল, পার্কিং ইয়ার্ডসহ আনুষঙ্গিক অন্য সুবিধাদি নির্মাণ এবং পন্টুন ও গ্যাংওয়ে স্থাপন করা হয়। উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রয়োজনে উপকূলীয় অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ ম্যাপও প্রস্তুত করা হয় এই সময়কালে।

২০০২-২০০৮: ১৯৯৬ সালে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরের দিকে তাতে ভাটা পড়ে। ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত খাতটি উন্নয়নের ধারা সেভাবে ধরে রাখতে পারেনি। এই সময়কালে প্রকল্প সম্পন্ন হয় মাত্র ১১টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৪ সালের জুনে যমুনা নদীতে চাঁদপুর ও শরীয়তপুরের মধ্যে ফেরি সার্ভিস চালু করে টার্মিনাল, ঘাট ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ; ২০০৫ সালে সদরঘাট থেকে আশুলিয়া ব্রিজ পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য নতুন একটি নৌরুট চালু এবং একই বছর মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিমে নতুন একটি নদীবন্দর নির্মাণ। গাবখান খালের নাব্যতা উন্নয়ন ও প্রশস্থতা বাড়াতে খালের ১৮ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার খনন করা হয়। পাশাপাশি চারটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ দিলালপুর-জকিগঞ্জের শান্তিপুর অংশ; মোহনপুর-দইখাওয়া রুটের দৌলতদিয়া, চর রক্ষা, মিনিদিয়া, মাওয়া; আরিচা-রাজশাহী-গোদাগাড়ি-ভোলাহাট রুটের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি চ্যানেল এবং মজুচৌধুরীর হাট লঞ্চঘাট-মেঘনা রুটের রহমত আলী খাল এলাকার মোট ৩৯ লাখ ৭২ হাজার ঘনমিটার খনন করা হয় এই সময়কালে।

২০০৯-২০২০: উন্নত অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থাপনার যাত্রা মূলত এই সময়ে। ২০১১-২০১৫ মেয়াদি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতে অভ্যন্তরীণ নৌপথকেন্দ্রিক বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় নদী খনন এবং শুকিয়ে যাওয়া ও মরে যাওয়া নৌরুটগুলো ফিরিয়ে আনার বিষয়টি। নদীবন্দর উন্নয়নের পাশাপাশি ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা ও প্রশস্থ করার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয় পরিকল্পনাতে। এর উদ্দেশ্য কেবল অবকাঠামো উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যদূরীকরণে সহায়তা করা।

এই লক্ষ্য সামনে রেখে আলোচ্য সময়কালে বিআইডব্লিউটিএ বরিশাল নদীবন্দরের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন; চট্টগ্রামের কুমিরায় আরসিসি জেটি নির্মাণ; বুড়িগঙ্গা নদী ও নদীতীরভূমি দখলমুক্ত রাখার লক্ষ্যে বন্দর ও অন্যান্য সুবিধাদি নির্মাণ; আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিসহ একটি ড্রেজার সংগ্রহ; উদ্ধারকারী জলযান সংগ্রহ; ঢাকা শহরের চারদিকে বৃত্তাকার নৌপথ চালুকরণ (২য় পর্যায়) এবং নওয়াপাড়া-ভৈরব-আশুগঞ্জ ও বরগুনায় নদীবন্দর স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

২০১৫-২০: গুরুত্বপূর্ণ নদীপথ খনন ও পুনর্খননের বিশাল কর্মযজ্ঞ জোরদার করার প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করা হয় আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে। ক্রমে ভরাট হয়ে যাওয়া নৌপথগুলো পুনরুদ্ধার ও খননের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি ও নৌ

চলাচলের উপযোগী করে তোলার কথা বলা হয় সেখানে। প্রধান নদী ও নৌপথগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধি ছাড়াও ভরাট ও পরিত্যক্ত নৌপথগুলো ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর পুনরুজ্জীবনের প্রকল্পগুলোর কাজ অব্যাহত রাখার ঘোষণাও দেওয়া হয় ওই ইশতেহারে। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করা হয় সরকারের এই মেয়াদেই প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের, যাতে করে আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরের সাথে অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলোর সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি সুগম হয়।

এসব প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন দেখা গেছে ২০১৫-২০ মেয়াদি সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতে। দেশের বিশাল অভ্যন্তরীণ নৌপথের ওপর ভিত্তি করে একটি নিরাপদ ও স্বল্পব্যয়ী অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে পরিকল্পনায়। এসব পরিকল্পনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথের নাব্যতা বৃদ্ধি এবং মৃত ও মৃতপ্রায় নদী খাতগুলোর পুনরুজ্জীবন;
  • নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নৌপথের নাব্যতা সংরক্ষণ;
  • অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর স্থাপনের মাধ্যমে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি এবং পণ্য ও যাত্রীবাহী নৌযানের সুষ্ঠু ও নিরাপদ চলাচলে সহায়তা দান;
  • ইনল্যান্ড কনটেইনার পোর্ট নির্মাণ;
  • ওয়েবভিত্তিক ডাটাবেজ অ্যাপ্লিকেশন চালু করে বিআইডব্লিউটিএ প্রদত্ত সকল সেবার ডিজিটাইজ করা;
  • ঢাকার চারপাশের নৌপথগুলো দূষণমুক্ত ও পুনরুদ্ধার করে নাব্যতা ও প্রশস্থতা বাড়ানো।

এই প্রাধিকার ও কৌশলগুলো বাস্তবায়নে বিআইডব্লিউটিএ একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, উল্লিখিত মেয়াদে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গী নদীবন্দরের আওতাধীন এলাকার উচ্ছেদকৃত তীরভূমিতে ভৌত সুবিধাদি নির্মাণ করেছে সংস্থাটি। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নৌপথের নাব্যতা রক্ষায় দুটি ড্রেজার, ক্রেনবোট, ক্রু-হাউস বোট এবং টাগবোটসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ; মাদারীপুর-চরমুগুরিয়া-টেকেরহাট-গোপালগঞ্জ নৌপথ খনন; সদরঘাট টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণ; দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন ল্যান্ডিং স্টেশনে বন্দরসুবিধাদি নির্মাণ (১ম সংশোধিত); ডিজিটাল গেজ সংগ্রহ ও স্থাপন এবং গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল (জিএসএম) নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহ; মাদারীপুর শিপ পার্সোনেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন (২য় সংশোধিত); সন্দ্বীপের গুপ্তছড়ায় আরসিসি জেটি পুনর্নির্মাণ (১ম সংশোধিত) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন ও ল্যান্ডিং সুবিধাদি প্রদানের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছে।

সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্তমোট ১৭০টি প্রকল্প সম্পন্ন করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এর মধ্যে স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে সম্পন্ন করেছে ১৩৭টি প্রকল্প।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here