১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া নৌপথের পুনর্জাগরণ ঘটে ১৯৭২ সালের অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল ও বাণিজ্য প্রটোকল চুক্তির মধ্য দিয়ে। সেই প্রটোকলেই এখন রুট ও পোর্ট অব কল বেড়েছে। বেড়েছে পণ্য পরিবহনের ব্যস্ততাও ।
প্রাক-কথা
দেশের সীমা অতিক্রম করে দেশান্তরে বিস্তৃত নৌপথ। এই পথ বেয়েই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দেশান্তরের নগরে-বন্দরে, বাণিজ্যকেন্দ্রে মানুষের যাতায়াত। যাতায়াত পথই কেবল নয়, বাণিজ্য পথও। সুদীর্ঘ, সুপ্রশস্ত, বহুজনপদ পেরোনো এই পথ বেয়েই এক কালে পূর্ব বাংলায় বাণিজ্যতরীর গমনাগমন।
সড়ক যোগাযোগের সুবিধা যখন অপ্রশস্ত এবং রেল যোগাযোগের ধারণাটি বাষ্পীয়, তখনো অর্থাৎ মুঘল আমলে বাংলার পণ্য বাণিজ্যের প্রায় সবটাই হতো জলপথে। গঙ্গা ও তার অপরাপর শাখা নদীতে মুঘল রাজত্বকালে প্রচুর পরিমাণে পণ্য চলাচল করত।
মধ্যযুগে বাংলার বাণিজ্য যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় পর্যটক বারবোসার (১৫০৮) বয়ান থেকে। তার কথায়, বেঙ্গালা থেকে ভারতের উপকূলে ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে দেশীয় ও মুর বণিকেরা পণ্য রপ্তানি করত। চামড়ার থলিতে রপ্তানি হতো ময়দা। এই বাণিজ্য যে জলপথেই হতো সড়ক যোগাযোগের অনুপস্থিতিই তার প্রমাণ।
অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার বড় শহরগুলোর মধ্য দিয়ে প্রশস্ত সড়ক তৈরি হয়েছিল। একটি সড়ক ছিল কলকাতা থেকে যশোর ও ফরিদপুর হয়ে ঢাকা পর্যন্ত। বারাসাত থেকে যশোর পর্যন্ত যে সড়ক, তার অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না। জেমস রেনেলের ভাষায়, ‘বারাসাত ছাড়ার পর আমরা খুব কম ভালো রাস্তা পেয়েছি। রাস্তাগুলো সংকীর্ণ, অসমতল ও আঁকাবাঁকা। প্রায়ই ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে রাস্তা। যখন মাঠে চাষ শুরু, হয় তখন রাস্তার হদিস পাওয়া যায় না।’ কিন্তু পূর্ববঙ্গের নদীগুলো এমন সুন্দরভাবে ছড়িয়ে ছিল- পণ্য পরিবহন ও যাতায়াতে কোনো অসুবিধা হতো না। পূর্ববঙ্গের প্রধান প্রধান শহর ও শিল্পকেন্দ্রের সাথে নদীপথে পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার যোগাযোগ ছিল। ওলন্দাজ পর্যটক স্ট্যাভোরিনাস বাংলার নদীপথের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, নদীতীরে অসংখ্য শহর ও গঞ্জ। নয়ন-মনোহর ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে নদীগুলো প্রবাহিত। নদীগুলো দেখতে সুন্দর, নৌপরিবহনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। কোনো কোনো নদী এত চওড়া ও গভীর যে এগুলো দিয়ে বড় জাহাজও স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে।
কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে সেকালে যাতায়াত করতে হতো ইছামতী, পদ্মা ও ধলেশ্বরীর ৩৮২ দশমিক ২৫ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে। ঢাকায় আসতে প্রথমে জলঙ্গী হয়ে পদ্মায় পড়তে হতো। সেখান থেকে পাবনা হয়ে ইছামতীর মধ্য দিয়ে জাফরগঞ্জ। জাফরগঞ্জ থেকে ধলেশ্বরী হয়ে ঢাকা।
নদীতে অনেক সময় গুন টেনে যেতে হতো। রাতের বেলা নৌকা চলত না। এজন্য দীর্ঘ সময় লেগে যেত। ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে যাতায়াতে সময় লাগত সাড়ে ৩৬ দিন। কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে সময় লাগত ৬০ দিনের মতো। আর কলকাতা থেকে রংপুরে পাড়ি দিতে লাগত সাড়ে ৫২ দিন।
বিভিন্ন ধরনের যাত্রী ও মালবাহী নৌকার ভাড়ার তালিকা ১৭৮১ সালের ১০ মার্চ কলকাতা থেকে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করে পুলিশ। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, কলকাতায় বজরার ভাড়া ছিল দৈনিক দুই থেকে আট টাকা। নানা ধরনের মালবাহী নৌকার ভাড়া ছিল মাসে ২২ থেকে সাড়ে ৫০ টাকা। এসব নৌকা ভাড়া করে যাত্রীরা কলকাতা থেকে অনেক সময় চুচুড়া, হুগলি ছাড়িয়ে বহরমপুর, রাজমহল, পাটনা বা আরও দূরে অথবা পূর্ববঙ্গে আসতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এভাবেই চূর্ণী, মাথাভাঙ্গা হয়ে শিলাইদহে এসেছিলেন।
গঙ্গায় প্রথম স্টিমার নামে ১৮৩৪ সালে, যার মালিকানায় ছিল সরকার। এরপর ১৮৪৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাসে যাত্রা করে ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের (আইজিএনআর) স্টিমার। এর কয়েক বছর পর প্রতিষ্ঠা পায় রিভার স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি লিমিটেড (আরএসএন)। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত লন্ডনে নিবন্ধিত এই দুই কোম্পানিই বাংলা, আসাম ও বিহারের নৌপথে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। কার্গো ও যাত্রী পরিবহনের ৭০ শতাংশই হতো তাদের মাধ্যমে। যাত্রী পরিবহন প্রবৃদ্ধিও ছিল ঈর্ষণীয়। উনিশ শতকের শেষ প্রান্তিকেও সুন্দরবন দিয়ে কলকাতা ও খুলনার মধ্যে ৮৯৮টি নৌযান চলাচল করত। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় বার্ষিক ৪ হাজার ৮০৩টিতে।
বাণিজ্যের স্বার্থে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ইংরেজরা পথঘাট উন্নয়ন ও রেলপথ তৈরির দিকে মনোযোগ দেয়। ১৮৩৯-৪২-এর মধ্যে বিখ্যাত গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের আংশিক সংস্কার হয়। ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে কোম্পানি মুম্বাই থেকে ২১ মাইল রেলগাড়ি চালিয়ে আজব কলের প্রবর্তন করে। ১৮৬২ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে চালু হয়ে যায় এবং বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগে অন্য রকম পরিবর্তন আসে। রেলপথের প্রসারের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যের ব্যাপক শ্রীবৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব বলে মনে করে সরকারও। এডুকেশন গেজেটে সে সময় লেখা হয়, ‘রেলওয়ে কোম্পানি উত্তর-পশ্চিম বাংলার ভিতর দিয়া কর্ড লাইন নামক রেলের পথ খুলিয়াছে, এবং কুষ্টিয়া হইতে গোয়ালন্দ পর্য্যন্ত রেলগাড়ি চালাইয়াছে। ইহাতে আমাদের পূর্ব বাঙ্গালা ও আসাম প্রদেশের সুহৃদ্বর্গের বহুতর উপকার সাধিত হইয়াছে, এবং গতিবিধির সুবিধাহেতু ভবিষ্যতে তাহাদের সহিত আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ঘটিবে… পূর্ব বাঙ্গালার রেলরোড কোম্পানী গড়াই নদীর উপরে যে সেতু নির্ম্মাণ করিয়াছে তাহাতে ঐ অঞ্চলের যোগাযোগের সুবিধা হইয়াছে।’
নৌ পরিবহন কোম্পানি ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন (আইজিএন) এবং রিভার স্টিম নেভিগেশন (আরএসএন) পূর্ববঙ্গের মধ্য দিয়ে কলকাতা থেকে আসামে পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ছিল সেই ব্রিটিশ আমলেই। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনের এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশের সাথে ভারতের নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
নৌ প্রটোকলের পূর্বাপর
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারতের সাথে উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। এই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালকে তাই বলা হয় বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও স্বর্ণালি অধ্যায়। বাণিজ্য, অর্থনীতি, যোগাযোগ, পানি ব্যবস্থাপনাসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বঙ্গবন্ধুর সময়ই স্বাক্ষরিত হয়। এর অন্যতম হলো বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তি। সেই সময়ে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী এম আর সিদ্দিকী এবং ভারতের কেন্দ্রীয় বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী এলএন মিশ্র ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ নিজ নিজ পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিটির ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে উভয় সরকার পারস্পরিক স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে এবং এক দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পণ্য পরিবহনে নিজ নিজ দেশের নৌ, রেল ও সড়কপথ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়। অনুচ্ছেদটি অনুযায়ী ওই বছরের ১ নভেম্বর দুই দেশের সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড (পিআইডাব্লিউঅ্যান্ডটি) পাঁচ বছরের জন্য স্বাক্ষরিত চুক্তিতে চারটি রুটকে প্রটোকল রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রুটগুলো হলো:
১. কলকাতা-রায়মঙ্গল-খুলনা-বরিশাল-চাঁদপুর- গোয়ালন্দ-সিরাজগঞ্জ-বাহাদুরাবাদ-চিলমারী-ধুবরি
২. ধুবরি-চিলমারী-বাহাদুরাবাদ-সিরাজগঞ্জ- গোয়ালন্দ-চাঁদপুর-বরিশাল-খুলনা-রায়মঙ্গল-কলকাতা
৩. কলকাতা-রায়মঙ্গল-বরিশাল-চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ- ভৈরব বাজার-আজমিরিগঞ্জ-মারকুলি-শেরপুর- ফেঞ্চুগঞ্জ-জকিগঞ্জ-করিমগঞ্জ
৪. করিমগঞ্জ-জকিগঞ্জ-ফেঞ্চুগঞ্জ-শেরপুর-মারকুলি- আজমিরিগঞ্জ-ভৈরব বাজার-নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর- বরিশাল-রায়মঙ্গল-কলকাতা
জাতির পিতার নির্মিত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিতে চিড় ধরে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদানে অনীহা প্রকাশ করে। দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বঙ্গবন্ধু-উত্তর সরকারের কাছে একেবারে ব্রাত্য হয়ে পড়ে। ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বাধীন জনতা পার্টি সরকার গঠন করার পর বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয় ভারত। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালের ৪ অক্টোবর দুই দেশের মধ্যে নতুন বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটির অষ্টম অনুচ্ছেদে পারস্পরিক স্বার্থে পণ্য পরিবহনের জন্য উভয় পক্ষ নিজ নিজ দেশের নৌ, রেল ও সড়কপথ ব্যবহারের অনুমতি দানে রাজি হয়। এরপর ১৯৮৩ সালের ৮ নভেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নতুন করে প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড (পিআইডাব্লিউঅ্যান্ডটি) স্বাক্ষরিত হয়। এবারের চুক্তিতে আরও চারটি রুটকে প্রটোকল রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রুটগুলো হলো:
১. রাজশাহী-গোদাগাড়ী-ধুলিয়ান
২. ধুলিয়ান-গোদাগাড়ী-রাজশাহী
৩. ভৈরব বাজার-মিঠামইন-ইটনা-লালপুর- সুনামগঞ্জ-ছাতক
৪. ছাতক-সুনামগঞ্জ-লালপুর-ইটনা-মিঠামইন-ভৈরব বাজার
দুই বছরের জন্য স্বাক্ষরিত চুক্তির মেয়াদ পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪, ১৯৮৭, ১৯৮৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালে বর্ধিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন করে সংজ্ঞা পায়। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর আগল খুলতে থাকে। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে উভয় দেশ বিদ্যমান বাণিজ্য চুক্তির পাশাপাশি প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেডের মেয়াদ আরও দুই বছরের জন্য হালনাগাদ করা হয়। সেই সাথে প্রটোকলে আরও চারটি পোর্ট অব কল সংযোজন করা হয়। ভারতীয় অংশে সংযোজিত নতুন দুটি পোর্ট অব কল হলো হলদিয়া ও পানকোপাড়া এবং বাংলাদেশ অংশে খুলনা ও মোংলা। এর ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করে ভারতের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বাণিজ্যিকভাবে পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হয়। ১৯৯৬ সালে এ বাবদ ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার রাজস্ব আয় করে বাংলাদেশ। ১৯৯৫ সালের আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রটোকল রুট ব্যবহার করে বাংলাদেশি জাহাজে ৪৯ হাজার টন এবং ভারতীয় জাহাজে ৮৮ হাজার টন কার্গো পরিবাহিত হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের নৌ সচিব পর্যায়ে ঢাকায় আলোচনার পর বেশকিছু বিষয় সংযুক্ত করে ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ নৌ প্রটোকল চুক্তি হালনাগাদ করা হয়। এই দফায় চুক্তির মেয়াদ ধরা হয় ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০১১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত। তবে কিছু পরিবর্তন সাপেক্ষে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে চুক্তির মেয়াদ আরও বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়।
২০১০ সালের ৩১ মে প্রটোকল রুট সম্প্রসারণের ব্যাপারে একমত হয় উভয় দেশ। একই সঙ্গে আশুগঞ্জ ও শিলঘাটকে নতুন পোর্ট অব কল হিসেবে সংযুক্ত করার কথাও বলা হয় চুক্তিতে।
২০০৯ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এর মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে ভারতের গোয়াতে চুক্তি স্বাক্ষর করে উভয় দেশ। বাংলাদেশের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব মো. আবদুল মান্নান হাওলাদার এবং ভারতের পক্ষে দেশটির সেই সময়কার নৌ সচিব কে. মোহনদাস। ২০১১ সালের ১ এপ্রিল থেকে প্রটোকলটি কার্যকর ধরা হয় এবং এর মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০১২ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত।
প্রটোকল চুক্তিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয় ২০১৫ সালে। ওই বছরের ৬ জুন দুই দেশের নৌ সচিব স্বাক্ষরিত চুক্তিতে প্রটোকলের মেয়াদ ধরা হয় পাঁচ বছর। শুধু তা-ই নয়, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত ছয় মাস আগে কোনো দেশ চুক্তি বাতিলের আগ্রহ প্রকাশ করে লিখিত নোটিশ না দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রটোকলের মেয়াদ পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন হয়ে যাবে। এছাড়া পিআইডাব্লিউঅ্যান্ডটি পরিচালন অগ্রগতি মূল্যায়ন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে উভয় দেশের নৌ সচিব যাতে প্রতি দুই বছরে অন্তত একবার বৈঠক করেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হয় চুক্তিতে।
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্রটোকলে প্রথম সংযোজন আনা হয় ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর। এতে বাংলাদেশ অংশের পানগাঁও এবং ভারতীয় অংশের ধুবরিকে নতুন পোর্ট অব কল হিসেবে সংযোজিত করা হয়। এছাড়া নতুন একটি সাব আর্টিকেল ২.৩ এবং আর্টিকেল ২৯ নামে নতুন আরেকটি আর্টিকেলও সংযুক্ত করা হয় চুক্তিতে। সাব আর্টিকেলটি ভারত-বাংলাদেশ নৌ সীমান্তের শূন্য রেখায় জরুরি ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত। এ ধরনের কার্যক্রমের জটিলতা এড়াতে কর্মকর্তাদের কোনো দলকে দরকারি নৌযানসহ প্রয়োজনীয় কর্ম সম্পাদনের অনুমতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজন হলে তা স্থানীয় বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে তাৎক্ষণিক পতাকা বৈঠকের মাধ্যমেও করা যেতে পারে। ২৯ নম্বর আর্টিকেলটি জাহাজে কর্মরত অবস্থায় কোনো ক্রুর মৃত্যু হলে সে-সংক্রান্ত। আর্টিকেলটিতে জাহাজে কোনো ক্রুর মৃত্যু হলে জাহাজের মাস্টারকে মৃত্যুর তারিখ ও সম্ভাব্য কারণসহ অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। জাহাজ তার গন্তব্যে পৌঁছানো মাত্র এসব তথ্য তৎক্ষণাৎ উভয় পক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। কর্তৃপক্ষ এরপর প্রাপ্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা যেমন স্থানীয় থানা, বর্ডার কাস্টমস ও লোকাল কনসুলার (যদি থাকে) বিলম্ব না করেই জানিয়ে দেবে, যাতে করে দ্রুততম সময়ে মৃতদেহটি দেশে পাঠানো সম্ভব হয়। পাশাপাশি আরও কিছু সংশোধনীও আনা হয়। ধুবরি এবং পানগাঁওকে নতুন পোর্ট অব কল ঘোষণা এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া শেরপুর ও আশুগঞ্জে নৌযান থেকে বাংলাদেশি ট্রাক অথবা ট্রাক্টর ট্রেইলারের মাধ্যমে পণ্য ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছে দেওয়ার কথা চুক্তিতে উল্লেখ করা হলেও তাতে সংশোধনী আনা হয়। সংশোধনীতে ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য কেবল আগরতলা আইসিপিতে পৌঁছানোর কথা বলা হয়।
নৌ প্রটোকলে দ্বিতীয় সংযোজনী স্বাক্ষরিত হয় ২০২০ সালের ২০ মে। সংযোজনীতে বিদ্যমান আটটি প্রটোকল রুটের সঙ্গে আরও দুটি রুট সংযোজন করা হয়। রুট দুটি হলো সোনামুড়া থেকে দাউদকান্দি এবং দাউদকান্দি থেকে সোনামুড়া। পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশে পাঁচটি করে নতুন পোর্ট অব কল এবং দুটি করে সম্প্রসারিত পোর্টস অব কল ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ অংশের নতুন পাঁচটি পোর্ট অব কল হলো রাজশাহী, সুলতানগঞ্জ, চিলমারী, দাউদকান্দি ও বাহাদুরাবাদ। ভারতীয় অংশের পাঁচটি পোর্ট অব কল হচ্ছে- ধুলিয়ান, মায়া, কোলাঘাট, সোনামুড়া ও যোগীগোপা। এছাড়া বাংলাদেশ অংশের দুটি সম্প্রসারিত পোর্ট অব কল হচ্ছে ঘোড়াশাল ও মুক্তারপুর এবং ভারতীয় অংশে ত্রিবেণী (বান্ডেল) ও বদরপুর।
প্রটোকল রুট ও পরিচিতি
বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের মধ্যকার নৌ প্রটোকলকে সর্বোচ্চ কার্যকর করার প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত হচ্ছে প্রটোকল সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি এবং বাংলাদেশ-ভারত নৌ সচিব পর্যায়ের বৈঠক। এর আগে ২০১৮ সালের অক্টোবরে নয়াদিল্লিতে এবং ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহজ করতে প্রটোকল রুট সম্প্রসারণ, নতুন রুটের অন্তর্ভুক্তি এবং নতুন পোর্ট অব কলের ঘোষণা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০২০ সালের ২০ মে দ্বিতীয় সংযোজনী স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো পূর্ণতা পায়। সংযোজনীর ফলে নতুন দুটি প্রটোকল রুট সংযোজিত হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে প্রটোকল রুটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০টিতে। এছাড়া প্রটোকল রুটগুলো সম্প্রসারিতও হয়েছে।
দ্বিতীয় সংযোজনীতে গোমতী নদীর ওপর ৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ৯ ও ১০ নম্বর রুট হিসেবে পরিচিত সোনামুড়া-দাউদকান্দির প্রটোকল রুটে অন্তর্ভুক্তি ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর সাথে ত্রিপুরা ও এর পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর সংযুক্তি বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। রুটটি বিদ্যমান সবগুলো প্রটোকল রুটকেই সংযুক্ত করেছে। এছাড়া রাজশাহী-ধুলিয়ান-রাজশাহী রুট এবং আরিচা পর্যন্ত ২৭০ কিলোমিটার সম্প্রসারিত অংশ বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। কারণ প্রটোকল রুটটি দিয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে কম খরচে পাথর পরিবহন করা যাবে। পাশাপাশি সীমান্তের উভয় পাশে স্থল শুল্ক স্টেশনগুলোর ওপর থেকে চাপ কমাতেও সহায়তা করবে রুটটি।
দ্বিতীয় সংযোজনীতে ১ ও ২ নম্বর রুট অর্থাৎ কলকাতা-শিলঘাট-কলকাতা এবং ৩ ও ৪ নম্বর রুট কলকাতা-করিমগঞ্জ-কলকাতার সঙ্গে কোলাঘাটকে যুক্ত করা হয়। আর কলকাতা-করিমগঞ্জ-কলকাতা এবং ৭ ও ৮ নম্বর রুট করিমগঞ্জ-শিলঘাট-করিমগঞ্জ রুটকে ভারতের বদরপুর পর্যন্ত সংযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের ঘোড়াশালকেও এই রুটগুলোর সঙ্গে যুক্ত করা হয় দ্বিতীয় সংযোজনীতে।
বিদ্যমান ভারত-বাংলাদেশ প্রটোকল রুটের মোট দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৬৩৪ কিলোমিটার। এর প্রায় ৬৭ শতাংশই পড়েছে বাংলাদেশের মধ্যে, যার দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭৫৪ কিলোমিটার। বাকি ৩৩ শতাংশের মতো পড়েছে ভারতে, যার দৈর্ঘ্য ৮৮০ কিলোমিটার।
রুটভিত্তিক দূরত্ব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ত্রিবেণী থেকে শিলঘাট (রুট ১ ও ২) পর্যন্ত দূরত্ব ১ হাজার ৭৭০ কিলোমিটার এবং ত্রিবেণী থেকে বদরপুর (রুট ৩ ও ৪) পর্যন্ত ১ হাজার ৩৯৭ কিলোমিটার। এছাড়া আরিচা থেকে ধুলিয়ান (রুট ৫ ও ৬) পর্যন্ত দূরত্ব ২৩৬ কিলোমিটার, বদরপুর থেকে শিলঘাট (রুট ৭ ও ৮) পর্যন্ত ১ হাজার ৪৪৫ কিলোমিটার এবং দাউদকান্দি থেকে সোনামুড়া (রুট ৯ ও ১০) পর্যন্ত প্রটোকল রুটের দৈর্ঘ্য ৯২ কিলোমিটার।
প্রটোকল রুট ব্যবহার করে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কলকাতা থেকে বিভিন্ন স্থানের দূরত্বের দিকেও দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। ভাগীরথী হয়ে প্রটোকল রুটে কলকাতা থেকে স্বরূপগঞ্জের দূরত্ব ১২৮ কিলোমিটার, বহরমপুরের দূরত্ব ২৮১ কিলোমিটার, লালগোলা ঘাটের দূরত্ব ৩৮৯ কিলোমিটার, রাজশাহীর দূরত্ব ৪৩৬ কিলোমিটার, কুষ্টিয়ার দূরত্ব ৫৪৪ কিলোমিটার ও গোয়ালন্দের দূরত্ব ৬৪৮ কিলোমিটার।
প্রটোকল রুট ব্যবহার করে সুন্দরবন হয়ে কলকাতা থেকে খুলনায় যেতে পাড়ি দিতে হয় ৪৮৩ কিলোমিটার নৌপথ। এছাড়া সুন্দরবন হয়ে কলকাতা থেকে বরিশালে পৌঁছাতে দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় ৮৭৫ কিলোমিটার, চাঁদপুরে ৮১১ কিলোমিটার, ফরিদপুরে ৯২৩ কিলোমিটার, গোয়ালন্দে ৯৬৫ কিলোমিটার, কুষ্টিয়ায় ১ হাজার ৭০ কিলোমিটার, রাজশাহীতে ১ হাজার ১৬৫ কিলোমিটার ও লালগোলায় যেতে পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে ১ হাজার ২১২ কিলোমিটার নদীপথ।
প্রটোকল রুট ব্যবহার করে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে কলকাতা থেকে শিলচরে পৌঁছাতে ১ হাজার ৪০৪ কিলোমিটার নৌপথ অতিক্রমের প্রয়োজন পড়ে। কলকাতা থেকে চালনা (৪৫০ কিলোমিটার), নারায়ণগঞ্জ (৮৭০ কিলোমিটার), ঢাকা (৮৯৬ কিলোমিটার), ভৈরব বাজার (৯৯৬ কিলোমিটার), আশুগঞ্জ (৯৯৮ কিলোমিটার), শেরপুর (১১৬৬ কিলোমিটার), ফেঞ্চুগঞ্জ (১২৩৯ কিলোমিটার) ও করিমগঞ্জ (১৩১৮ কিলোমিটার) পাড়ি দিয়ে পণ্যবাহী নৌযানকে শিলচরে পৌঁছাতে হয়।
একইভাবে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রটোকল রুট ব্যবহার করে কলকাতা থেকে আসামের ডিব্রুগড় পৌঁছাতে পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে ২ হাজার ৪০ কিলোমিটার নৌপথ। ডিব্রুগড় পৌঁছানোর আগে নৌযানকে কলকাতা থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ১ হাজার ৭০, জগন্নাথগঞ্জ পর্যন্ত ১ হাজার ১১২, বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত ১ হাজার ১৯১ কিলোমিটার, ধুবরি পর্যন্ত ১ হাজার ৩১০ কিলোমিটার, যোগীগোপা পর্যন্ত ১ হাজার ৩৯২ কিলোমিটার, গোয়ালপাড়া পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার, গুয়াহাটি/পান্ডু পর্যন্ত ১ হাজার ৫৩৫, তেজপুর পর্যন্ত ১ হাজার ৬৯৩ কিলোমিটার ও নিয়ামতি পর্যন্ত ১ হাজার ৯১০ কিলোমিটার নৌপথ অতিক্রম করতে হয়।
পোর্ট অব কল
কোনো জাহাজের পূর্বনির্ধারিত যাত্রাপথে পণ্য নামানো-ওঠানো বা জ্বালানি ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য মধ্যবর্তী যাত্রাবিরতির যে স্থান, সেটিই পোর্ট অব কল। প্রটোকল চুক্তি অনুযায়ী, আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যে নিয়োজিত অন্য দেশের নৌযানকে কোনো দেশ পোর্ট অব কল সুবিধা দিয়ে থাকে। তবে পোর্ট অব কলের সংখ্যা উভয় দেশেই সমান হতে হবে। ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবরের প্রথম সংযোজনী স্বাক্ষরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত উভয় দেশে পোর্ট অব কলের সংখ্যা ছিল পাঁচটি করে। ওই সংযোজনীতে বাংলাদেশে পানগাঁও ও ভারতে ধুবরিকে পোর্ট অব কল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার পর এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ছয়টি করে।
২০২০ সালের ২০ মে স্বাক্ষরিত দ্বিতীয় সংযোজনীতে উভয় দেশে আরও পাঁচটি করে পোর্ট অব কল অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দুটি করে সম্প্রসারিত পোর্ট অব কলও সংযুক্ত করা হয় চুক্তিতে। এর ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রটোকল রুটে পোর্ট অব কলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১টি করে।
প্রটোকলের বিভিন্ন দিক
নৌ প্রটোকল হচ্ছে দুই দেশের সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি, যার উদ্দেশ্য পণ্য পরিবহন এবং প্রটোকল রুটভুক্ত নিজ নিজ দেশের নৌপথের নাব্যতা রক্ষা করা। একই সাথে নিশ্চিত করা অবকাঠামো সুবিধাও। বিদ্যমান প্রটোকলে ১০টি রুট, ১১টি পোর্ট অব কল ও দুইটি সম্প্রসারিত পোর্ট অব কল যেমন নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে একইভাবে সুনির্দিষ্ট আরও কিছু বিষয় আছ্যে, যেগুলো পরিপালন করা উভয়পক্ষের জন্যই জরুরি। এগুলোর মধ্যে আছে-
- নিজ নিজ দেশের অন্তর্গত প্রটোকল রুটের নাব্যতা উভয় পক্ষকেই নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে নৌ চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদিও দিতে হবে। সুযোগ থাকলে রাতে নৌযান চলাচলের অনুমতিও প্রদান করতে হবে।
- প্রটোকল রুটে চলাচলকারী নৌযানকে অবশ্যই নিজ নিজ দেশের সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় নিবন্ধিত হতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নৌযান নিবন্ধন হবে ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬ এর অধীনে। ভারতের নৌযানের নিবন্ধন নিতে হবে সেদেশে বিদ্যমান ইনল্যান্ড ভেসেল অ্যাক্ট, ১৯১৭ এর আওতায়।
- নৌ প্রটোকলের আওতায় পরিচালিত নৌযানকে নির্ধারিত প্রটোকল রুট দিয়েই চলাচল করতে হবে।
- এক দেশের নৌযান অন্য দেশের নৌপথ দিয়ে চলাচলের সময় প্রটোকলে উল্লেখিত স্থান থেকে বিনিময়যোগ্য মুদ্রায় জ্বালানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে পারবে। রাত্রিকালে নৌযান কোথায় অবস্থান করবে, তা-ও নির্ধারণ করে দেওয়া আছে প্রটোকলে। প্রটোকল রুটে চলাচলকারী নৌযান যেসব স্থান থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারবে, সেগুলো হলো:
- প্রটোকল রুটে নৌযান পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীও বিনিময়যোগ্য মুদ্রায় বাঙ্কারিং পয়েন্ট থেকে কিনতে পারবেন। এজন্য বাঙ্কারিং পয়েন্টে মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে বাঙ্কারিং পয়েন্টের বাইরে থেকেও এসব সামগ্রী কেনা যাবে।
- প্রটোকলের আওতায় এক দেশের নৌযান অন্য দেশের জলসীমায় যেতে চাইলে উভয় দেশের সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে যাত্রার অন্তত চারদিন আগে নির্ধারিত ফরমে যাত্রার তারিখ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করতে হবে। বাংলাদেশে অনুমতি দেওয়ার কর্তৃপক্ষ হচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং ভারতে ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটি অব ইন্ডিয়া (আইডব্লিউএআই)।
- আন্তঃদেশীয় পণ্য বাণিজ্য ও ট্রানজিটের ক্ষেত্রে উভয় দেশের নৌযান পরিচালনাকারীরা বাস্তবানুগ অভিন্ন ভাড়া নির্ধারণ করবেন।
- এক দেশের নৌযান অন্য দেশের জলসীমায় চলাচল করলে নিজ দেশের পতাকার পাশাপাশি অন্য দেশের পতাকাও প্রদর্শন করতে হবে।
- এক দেশের নৌযান অন্য দেশের জলসীমায় ডুবে গেলে বা অন্য কোনো বিপদে পড়লে সেই দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নৌযানটিকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা দেবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সহায়তা দেওয়ার দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর এবং ভারতে আইডব্লিউএআইএর।
- কোনো দেশের নৌযান অন্য দেশের নৌপথে চলাচলের সময় মেরামতের প্রয়োজন পড়লে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে উভয় দেশের সরকারি মালিকানাধীন বা স্বনামধন্য কোনো মেরিন ওয়ার্কশপে তা মেরামত করা যাবে। মেরামত বাবদ যে খরচ হবে তা ছাড়ের জন্য নৌযান পরিচালনাকারীরা সংশ্লিষ্ট ফরেন এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষকে জানাবেন।
- প্রটোকল রুটে চলাচলকারী সব নৌযানকেই রক্ষণাবেক্ষণ, বার্থিং, ল্যান্ডিং ও শিপিং এবং ক্যানেল চার্জ পরিশোধ করতে হবে। এই চার্জ হবে স্থানীয় নৌযানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য চার্জের মতোই।
- প্রটোকল রুটে চলাচলকারী অন্য দেশের নৌযান অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাইলটেজ সুবিধা পাবে।
- প্রটোকলের আওতায় চলাচলকারী নৌযানের ট্রানজিট অবস্থায় আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে পণ্য পরিবহন এবং দেশীয় পণ্য বা যাত্রী পরিবহনের কোনো সুযোগ নেই।
- সব নৌযানকে প্রয়োজনীয় নথিপত্র সাথে রাখতে হবে এবং উপযুক্ত কোনো কর্তৃপক্ষ দেখতে চাইলে বাধ্যতামূলকভাবে তা প্রদর্শন করতে হবে।
- উভয় দেশের ট্রানজিট পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত নৌযানে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ভ্রমণ কর্মকর্তারা নৌযানে যোগদানের জন্য অথবা অসুস্থতাজনিত বা অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে সড়ক, রেল ও আকাশপথে ভ্রমণের অনুমতি পাবেন। তবে উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা অবহিত করতে হবে।
- প্রযোজ্য ক্ষেত্রে উভয় দেশের নৌযান পোর্ট অব কল বা কাস্টমস স্টেশন থেকে সমপরিমাণ অর্থাৎ ৫০:৫০ হারে বাণিজিক ও ট্রানজিট কার্গো পরিবহন করবে।
- বাংলাদেশি ট্রাক বা ট্রাক্টর-ট্রেইলার শেরপুর ও আশুগঞ্জে নৌযান থেকে পণ্য নিয়ে তা ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছে দিতে পারবে।
- ভারত থেকে বেশি ড্রাফটের জাহাজে আনা পণ্য শেরপুর এবং আশুগঞ্জ অথবা বাংলাদেশি নৌপথের যেকোনো স্থান থেকে কম ড্রাফটের নৌযানে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধমে ভারতীয় গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া যাবে। আবার ট্রান্সশিপমেন্ট হতে পারে কম ড্রাফটের জাহাজ থেকে বড় ড্রাফটের জাহাজেও। তবে এই ট্র্রান্সপিশমেন্ট পরিচালিত হবে বিআইডব্লিউটিএ এবং বাংলাদেশের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে।
- কোনো দেশের নৌযান পরিচালনাকারীরা চাইলে অন্য দেশের মেজর নদীবন্দর অথবা সেকেন্ডারি নদীবন্দরে শাখা অফিস খুলতে বা এজেন্ট নিয়োগ দিতে পারবে। তবে দেশের নির্ধারিত নিয়ম-কানুন মেনেই শাখা অফিস খুলতে হবে।
- চুক্তি অনুযায়ী প্রটোকলের কার্যক্রম মূল্যায়ন ও পর্যালোচনায় এবং উভয় দেশের মধ্য দিয়ে নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি স্থায়ী কমিটি রয়েছে। কমিটিতে রয়েছে দুই দেশের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন করে, দুই দেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন করে, বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি এবং আইডাব্লিউএআই ও সিআইডাব্লিউটিসিএর একজন করে প্রতিনিধি। উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট কাস্টমস কর্মকর্তা এবং দুই দেশের নৌযান পরিচালনাকারীদের একজন করে প্রতিনিধিও রয়েছে স্থায়ী কমিটিতে। তবে কমিটি চাইলে অন্য প্রতিনিধিও অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। প্রতি ছয় মাসে একবার বৈঠক করবে স্থায়ী কমিটি এবং বৈঠকে উঠে আসা বিষয়গুলোর ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তা উভয় দেশের সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে।
- সব পোর্ট অব কল বা অন্যান্য সম্প্রসারিত স্থানে বিদ্যমান নিয়ম ও বিধি অনুযায়ী গ্রাহক সেবা পদান করতে হবে।
স্বার্থ উভয়েরই
বঙ্গীয় বদ্বীপে ৫৪টি নদী প্রবেশ করেছে ভারত থেকে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশে যার পরিচিতি পদ্মা ও যমুনা নামে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং পদ্মা, যমুনাসহ অন্যান্য নদীতে যে প্রটোকল রুট চিহ্নিত হয়েছে, তার সিংহভাগই পড়েছে বাংলাদেশে। স্বাভাবিকভাবেই প্রটোকল রুটের আধিপত্য তাই বাংলাদেশেরই বেশি। তাছাড়া ভারতের তুলনায় তুলনামূলক সাশ্রয়ী জ্বালানি, শ্রম ও মূলধনি ব্যয় প্রটোকল রুটে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশি নৌযানকে বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। সুযোগ তৈরি হয়েছে ভারতীয় নৌযানকে সেবা প্রদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর। সেই সাথে লজিস্টিক ব্যবসায় সক্ষমতা বৃদ্ধিরও।
সর্বোপরি বাংলাদেশের দৃষ্টি এখন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে রপ্তানি বাড়ানো। সেদিক থেকে দেখলেও নৌ প্রটোকল বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়ানোর দ্বার খুলে দিয়েছে, যার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য রাজস্ব বৃদ্ধি।
নৌ প্রটোকলে ভারতের আগ্রহ প্রধানত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর স্বার্থেই। প্রটোকল রুট ব্যবহার করে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে “চিকেন’স নেক”-এর তুলনায় দ্রুত ও কম খরচে পণ্য পরিবহন করতে পারছে। কারণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে ভারতের বাকি অংশের সংযোগ স্থাপনকারী চিকেন’স নেক নামে পরিচিত সরু এই সড়কপথে পণ্য পরিবহনে পাড়ি দিতে হয় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার পথ। এছাড়া নৌপথে পণ্য পরিবহনের খরচ সড়কপথের এক-পঞ্চমাংশ।
ব্রহ্মপুত্র নদীতে ব্যস্ততম এই প্রটোকল রুট দিয়ে বার্জগুলো আসাম থেকে চুনাপাথর, সিলিকন, পেট্রোলিয়াম ও চা নিয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে পৌঁছে দিচ্ছে। বিপরীত পথে ভারতের অন্য অংশ থেকে পণ্য নিয়ে বার্জগুলো তা পৌঁছে দিচ্ছে আসামেও। একইভাবে সেখানে নৌ চলাচলকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হয়েছে।
অর্থাৎ নৌ প্রটোকল বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্যই পণ্য পরিবহনের লাভজনক একটি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে উন্নত যোগাযোগের সুযোগ পাচ্ছে। আর পণ্য পরিবহন, বন্দর ফি, কার্গো হ্যান্ডলিং ও অন্যান্য সেবা প্রদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পাচ্ছে রাজস্ব। সেই সাথে রয়েছে স্বল্প খরচে সরাসরি আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাস্বার্থ।
স্থলপরিবেষ্টিত নেপাল ও ভুটানও বাংলাদেশ ও ভারতে সহজে প্রবেশের জন্য জলপথের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর আগ্রহ প্রকাশ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুটান সফরকালে ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল দুই দেশের মধ্যে নৌপথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও ট্রানজিট কার্গো পরিবহন সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। এরপর কলকাতা-শিলঘাট প্রটোকল রুট বরাবর ধুবরিকে পোর্ট অব কল ঘোষণার পর ভুটান থেকে বাংলাদেশে বোল্ডার রপ্তানিকারকদের পছন্দের মাধ্যম হয়ে ওঠে নৌপথ। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত নৌ সচিব পর্যায়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত চিলমারী-ধুবরি প্রটোকল রুট দিয়ে ৩০টি ট্রিপের মাধ্যমে বাংলাদেশে ভুটানের পাথর রপ্তানি হয়েছে।
প্রটোকল রুট ব্যবহার করে ভুটানের পাথর পরিবহনের ফলে একদিকে সময় যেমন বাঁচছে, একইভাবে অর্থেরও সাশ্রয় হচ্ছে। ধুবরিভিত্তিক পাথর ব্যবসায়ী আতোয়ার রহমানের ভাষায়, ‘নৌপথে আসামের ধুবরি ও বাংলাদেশের চিলমারীর মধ্যে বাণিজ্য রুট চালু হওয়ায় পণ্য পরিবহনে টনপ্রতি ৯ ডলার সাশ্রয় হচ্ছে।’ ধুবরির নিকটবর্তী গোলকগঞ্জ থেকে ২০১৪ সাল থেকে সড়কপথে বাংলাদেশে পাথর রপ্তানি করে আসছেন আতোয়ার। কিন্তু বর্ডার পোস্টের প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতা, অনুন্নত সড়ক, ওজনের বাধ্যবাধকতা এই রুটে পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
সম্ভাবনা অবারিত
ভারতের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের পঞ্চম বৃহত্তম সীমান্ত। বিস্তৃত এই সীমান্ত সুবিধার কারণে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের সম্ভাবনা বিপুল। কিন্তু বাস্তবতা হলো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এখনো সম্ভাবনার অনেক নিচে। এই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে অন্যতম প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে নৌপথ। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে ভারত-বাংলাদেশ প্রটোকল (আইবিপি) রুট। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প প্রটোকল রুট ব্যবহার করে ভারত থেকে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে কাঁচামাল বিশেষ করে তুলা আমদানি করতে পারে। সেই সাথে একই পথে বাংলাদেশি পণ্যেরও ভারতের সুবিশাল বাজারে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। গঙ্গার নৌপথ পাড়ি দিয়ে এলাহাবাদ ও বারাণসী পর্যন্তও তা নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
নৌপথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়লে স্বাভাবিক নিয়মেই নৌপথ ঘিরে টার্মিনাল, জেটি, কনটেইনার ডিপো ও পণ্যাগার গড়ে উঠবে। এতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ যেমন সৃষ্টি হবে, একইভাবে অ্যানসিলারি শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। সব মিলিয়ে সীমান্তের উভয় প্রান্তে সবুজ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার বাস্তবতায় অন্য রকম গতি সঞ্চার করবে। আর অভ্যন্তরীণ এই নৌপথকে উপকূলীয় নৌ চলাচলের সাথে সংযুক্ত করা গেলে আবির্ভূত হবে মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের সাথে নতুন বাণিজ্য করিডোর। ভারতের সাথে প্রটোকল রুট নতুন করে জাগিয়ে তোলা, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা ও নদীকেন্দ্রিক কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন অর্থনৈতিক করিডোর উন্নয়ন বাংলাদেশের এখন বড় অগ্রাধিকার।
বাংলাদেশের বস্ত্র কারখানাগুলোতে উৎপাদিত বর্জ্য ভারতের আসাম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ম্যাট্রেস ও কম্বল তৈরিতে ব্যবহার করে। বাংলাদেশ থেকে এই তুলা বর্জ্য সেখানে রপ্তানি হয় মেঘালয়ের মাহেন্দ্রগঞ্জ ও আসামের মানকাচর হয়ে সড়কপথে। এর ফলে একাধিক স্থানে পণ্য বোঝাই ও খালাস করার প্রয়োজন পড়ে। এতে পরিবহন ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়। তাই ধুবরি থেকে পাথর নিয়ে বাংলাদেশে আসা বার্জগুলো ফেরার পথে তুলা বর্জ্য পরিবহন করতে পারে কিনা সেই আলোচনা অনেকদিন ধরেই চলছে। এটি চালু হলে কম খরচে ও সহজেই কটন বর্জ্য আমদানি করতে পারবেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ব্যবসায়ীরা। একইভাবে লাভবান হবেন বাংলাদেশের ছোট ব্যবসায়ীরা। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে অধিক পরিমাণে তুলা বর্জ্য রপ্তানির সুযোগ পাবেন তারা।
প্রটোকলে প্রথম
নৌ প্রটোকলের আওতায় এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের বাণিজ্য ছিল মূলত কলকাতার সাথে। ২০২০ সালের ২০ মে নৌ প্রটোকলের দ্বিতীয় সংযোজনী স্বাক্ষরের ফলে সোনামুড়া-দাউদকান্দি এবং দাউদকান্দি-সেনামুড়া রুট দুটি প্রটোকলে অন্তর্ভুক্ত হয়। এর মধ্য দিয়ে সুযোগ তৈরি হয় গোমতী নদী দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় পণ্য পরিবহনের। এর পরপরই প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়। ২০২০ সালের ৪ আগস্ট ভারতের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (আইডব্লিউএআই) উদ্যোগে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেকের অংশগ্রহণে বৈঠকে সোনামুড়া-দাউদকান্দি নৌপথে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত, বাণিজ্যিক, নিয়ন্ত্রণ ও পদ্ধতিগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় উঠে আসা সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছায় উভয় পক্ষ। ওই বছরের ১১ আগস্ট বিআইডবিøউটিএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নৌপথটি পরিদর্শন করেন। স্পিডবোটে করে বিবিরবাজার থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত নৌপথ পরিদর্শন করেন তারা। বিবিরবাজার থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত নৌপথে নাব্যতা সংকট ছাড়াও গাছের গুঁড়ি ও পানিপ্রবাহ কম থাকার মতো কিছু সমস্যা পরিদর্শনে উঠে আসে। অগ্রাধিকারভিত্তিতে এগুলো সমাধানের সিদ্ধান্ত নেয় বিআইডব্লিউটিএ। তার আগেই প্রটোকল রুটটি দিয়ে পরীক্ষামূলক পণ্য রপ্তানির অনুমতি দেয় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। সে অনুযায়ী, বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং নদীপথে মার্কিং করা হয়। আলাদা একটি নৌযানে ভেকুর ব্যবস্থাও করা হয়।
সব প্রস্তুতি শেষে প্রিমিয়ার সিমেন্টের নৌযান এমভি প্রিমিয়ার-১ মুক্তারপুর থেকে ১ সেপ্টেম্বর সিমেন্ট বোঝাই করে। ওইদিনই নৌযানটি মুক্তারপুর থেকে দাউদকান্দির উদ্দেশে রওনা করে। আর সোনামুড়ার উদ্দেশে যাত্রা করে ২ সেপ্টেম্বর। পথে ৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা এবং ৪ সেপ্টেম্বর বিবিরবাজারে পৌঁছায় জাহাজটি। ত্রিপুরায় সোনামুড়ায় নোঙর করে পরদিন অর্থাৎ ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। এর মধ্য দিয়ে নৌপথে ত্রিপুরায় বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়।
এর পরের মাসেই ২৯ অক্টোবর প্রিমিয়ার সিমেন্টকে সিলেটের কুশিয়ারা নদী দিয়ে জকিগঞ্জ হয়ে আসামের করিমগঞ্জে পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয় বিআইডব্লিউটিএ। এরপর ১ নভেম্বর এমভি প্রিমিয়ার-৬ নামের একটি জাহাজ নারায়ণগঞ্জ থেকে ১২৫ টন সিমেন্ট নিয়ে করিমগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। প্রথমে চালানটি মেঘনা নদী দিয়ে আশুগঞ্জ পৌঁছায়। এরপর মেঘনা নদী থেকে সিলেটের কুশিয়ারা নদী দিয়ে সীমান্ত এলাকা জকিগঞ্জে যায়। সেখান থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসামের করিমগঞ্জ এলাকায় নোঙর করে। প্রটোকল রুট দিয়ে এর আগে বাংলাদেশ থেকে আসামে পণ্য রপ্তানি হয়নি।
প্রটোকল রুট দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে খাদ্যপণ্য রপ্তানি শুরু হয় এর পরের বছর ২০২১ সালে। ওই বছরের ১৬ মার্চ নরসিংদীর পলাশে প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের জেটি থেকে খাদ্যপণ্য নিয়ে একটি জাহাজ ভারতের উদ্দেশে রওনা করে। এর মধ্য দিয়ে নৌপথে খাদ্যপণ্য রপ্তানির নতুন যুগের সূচনা হয়।
প্রটোকল রুট ব্যবহার করে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে হলদিয়া থেকে পান্ডু পর্যন্ত ভারতের পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের সূচনা হয় ২০১৯ সালের নভেম্বরে। ‘এমভি মহেশ্বরী’ নামক পণ্যবাহী জাহাজের মাধ্যমে হলদিয়া বন্দর থেকে আসামের গুয়াহাটির পান্ডু পর্যন্ত পণ্য পরিবহন শুরু হয়। এর ফলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের নতুন দিক উন্মোচিত হয়।
আর নৌপথে বাংলাদেশ হয়ে বিহারের পাটনা থেকে আসামের পান্ডু পর্যন্ত পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে ২০২২ সালে। এমভি লালবাহাদুর শাস্ত্রী নামের কার্গো জাহাজের মাধ্যমে ৫ ফেব্রুয়ারি সার্ভিসটি চালু করা হয়। ওইদিন ২০০ টন খাদ্যশস্য নিয়ে পাটনা থেকে ভাগলপুর, মণিহারি, সাহিবগঞ্জ, ফারাক্কা, ত্রিবেণী, কলকাতা, হলদিয়া হেমনগর হয়ে পণ্যবাহী জাহাজটি পৌঁছায় বাংলাদেশের খুলনায়। সেখান থেকে নারায়ণগঞ্জ, চিলমারী হয়ে আসামের ধুবুরি, যোগীগোপা হয়ে মার্চের প্রথম দিকে আসামের রাজধানী গুয়াহাটির কাছে পান্ডু বন্দরে পৌঁছায়। পাটনা থেকে পান্ডু পৌঁছাতে জাহাজটিকে দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় মোট ২ হাজার ৩৫০ কিলোমিটার। এই পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ২৫ দিন।
বাড়ছে দ্বিপক্ষীয় পণ্য পরিবহন
২০২৬ সালেই জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে এসে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ঢুকে পড়বে বাংলাদেশ। স্বাভাবিকভাবেই স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা মিলছে তা সীমিত হয়ে আসবে। কিন্তু ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের অভীষ্টে পৌঁছাতে হলে রপ্তানি বাড়ানোর বিকল্প নেই। এই লক্ষ্য অর্জনে রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে সামনের দিনগুলোতে দৃষ্টি থাকবে প্রতিবেশী দেশের বাজারের দিকে।
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এই বাণিজ্যের সিংহভাগই সম্পাদিত হয় স্থলপথে। যদিও প্রটোকল রুট দিয়ে কম খরচে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। প্রটোকল রুট সম্প্রসারণ, নতুন রুট অন্তর্ভুক্তিকরণ ও পোর্ট অব কলের সংখ্যা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় সেই চেষ্টাই করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সেই সাথে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে উভয় দেশই নৌপথের নাব্যতা বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে। এসব উদ্যোগের সুফলও মিলতে শুরু করেছে। প্রটোকল রুট ব্যবহার করে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য পণ্য পরিবহন এক দশকের ব্যবধানে প্রায় ১৭৭ শতাংশ বেড়েছে। বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ও ভারতীয় নৌযানের মাধ্যমে প্রটোকল রুট ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন হয়েছিল ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৬৩৩ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ লাখ ৫৯ হাজার ৪২৯ মেট্রিক টন। মাঝের বছরগুলোতেও প্রটোকল রুট ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০২০-২১ অর্থবছরে, আগের বছরের তুলনায় যা প্রায় ৪৩ শতাংশ।
কর্তৃত্ব বাংলাদেশি নৌযানের
প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশি এবং ভারতীয় নৌযানের ৫০:৫০ অনুপাতে ট্রানজিট ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের সুযোগ রয়েছে। শুরুর দিকে এই নিয়মেই পণ্য পরিবহন হতো। ২০০১-০২ অর্থবছরে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতীয় নৌযানে বেশি পণ্য পরিবহনের নজিরও আছে। ওই অর্থবছরে বাংলাদেশি ও ভারতীয় নৌযানের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের অনুপাত ছিল ৪৫:৫৫। এর পরের বছরই পরিস্থিতি বদলে যায়। ২০০২-০৩ অর্থবছরে বাংলাদেশি ও ভারতীয় নৌযানে পণ্য পরিবহনের অনুপাত দাঁড়ায় ৫৮:৪২। এরপর থেকেই প্রটোকল রুটে ট্রানজিট ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশি নৌযানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। কোনো কোনো বছর সব পণ্যই বাংলাদেশি নৌযানে পরিবহনের উদাহরণও আছে। গত দুই দশকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রটোকলের আওতায় ২০০৫-০৬ এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ভারতীয় নৌযানে কোনো পণ্য পরিবহন হয়নি। ওই দুই অর্থবছরে ট্রানজিট ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক পণ্যের পুরোটাই পরিবাহিত হয়েছে বাংলাদেশি নৌযানে। আর ২০০৩-০৪ পরবর্তী সব অর্থবছরেই প্রটোকলের আওতায় মোট পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশি নৌযানের হিস্যা ৯০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরেও ৩৯ লাখ ৫৯ হাজার ৪২৯ মেট্রিক টন পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশি নৌযান পরিবহন করেছে ৩৬ লাখ ৫২ হাজার ৪৩২ মেট্রিক টন। বাকি ৩ লাখ ৭ হাজার ৪৫৩ টন পণ্য পরিবহন করেছে ভারতীয় নৌযান। অর্থাৎ অর্থবছরটিতে নৌ প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশি ও ভারতীয় নৌযানে পণ্য পরিবহনের অনুপাত ছিল ৯০.০২:৯.৯৮।
২০০১-০২ অর্থবছরের পর নৌ প্রটোকলের আওতায় ভারতীয় নৌযানের বার্ষিক ট্রিপ সংখ্যা এক সময় তিন অংক থেকে দুই অংক এবং দুই অংক থেকে এক অংকে নেমে আসে। কোনো কোনো বছর সব পণ্যই বাংলাদেশি নৌযানে পরিবহনের উদাহরণও আছে। গত দুই দশকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রটোকলের আওতায় ২০০৫-০৬ এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রটোকল রুটে ভারতীয় কোনো নৌযান চলাচলই করেনি। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ভারতীয় নৌযানের ট্রিপ সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি। আর সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ট্রানজিট ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনে ট্রিপ ছিল মোট ৪ হাজার ১৩৯টি। এর মধ্যে বাংলাদেশি জাহাজের ট্রিপ সংখ্যা ৩ হাজার ৯১৩ এবং ভারতীয় নৌযানের ২২৬টি। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশি নৌযানের ৩ হাজার ১৯২টি ট্রিপের বিপরীতে ভারতীয় নৌযানের ট্রিপ ছিল মাত্র ৭০টি।
নৌ প্রটোকলের আওতায় ট্রানজিট ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশি নৌযানের আধিপত্য অর্থাৎ ভারতীয় নৌযানের পিছিয়ে থাকার কারণ কী- তা নিয়ে ২০১৬ সালে একটি গবেষণা করে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন। বাংলাদেশি নৌযানের কর্তৃত্বের একাধিক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
- ফ্রেইট রেটে বাংলাদেশি পতাকাবাহী নৌযানের সাথে ভারতীয় নৌযানের পেরে না ওঠা। কারণ, জাহাজ নির্মাণের খরচ বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে বেশি। উচ্চ ব্যয়ের কারণে পশ্চিমবঙ্গে পুরনো নৌযান প্রতিস্থাপন অথবা নতুন নৌযান নির্মাণের হার অনেক কম।
- পশ্চিমবঙ্গে নৌযানের সংখ্যা খুবই সীমিত। অন্যদিকে বাংলাদেশে টনেজ ও সংখ্যার হিসাবে নৌযানের সংখ্যা পর্যাপ্ত।
- ট্রানজিট কার্গো পরিবহনের ক্ষেত্রে কলকাতা-পান্ডু রুটে নাব্যতা সংকটের ইস্যুটিও জড়িত।
তবে ২০১৫-১৬ সাল থেকে ট্রানজিট কার্গো পরিবহনে ভারতীয় নৌযানের ট্রিপের হিস্যা বেড়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রটোকলের আওতায় ট্রানজিট পণ্যের ১৮টি ট্রিপের মধ্যে ১২টিই ছিল ভারতীয় নৌযানের। ৬টি ছিল বাংলাদেশি নৌযানের। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ট্রানজিট পণ্যের ১৭টি ট্রিপের মধ্যে ভারতীয় নৌযানের ট্রিপ ছিল ১০টি ও বাংলাদেশের ৭টি। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ট্রানজিট পণ্যের মোট ৩০টি ট্রিপের মধ্যে ২৯টিই ছিল ভারতীয় নৌযানের। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩টি ট্রিপের মধ্যে ভারতীয় নৌযানের ছিল ১১টি এবং বাংলাদেশের ২টি। পরের দুই বছর ট্রানজিট কার্গোর পুরোটাই পরিবাহিত হয়েছে ভারতীয় নৌযানে। যদিও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ট্রানজিট কার্গোর ৮১টি ট্রিপের মধ্যে ৭২টিই ছিল বাংলাদেশি নৌযানের।
রুটওয়ারি ট্রানজিট কার্গো পরিবহনের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ট্রানজিট পণ্য পরিবহনের মোটামুটি নিয়মিত প্রটোকল রুট হচ্ছে কলকাতা-ধুবরি এবং কলকাতা-আশুগঞ্জ-আগরতলা। সর্বশেষ সাত অর্থবছরের মধ্যে চার অর্থবছরই রুট দুটি দিয়ে ট্রানজিট কার্গো পরিবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের নৌপথ ব্যবহার করে কলকাতা থেকে আসামের পান্ডুতে প্রায় নিয়মিত পণ্য গেলেও সেখান থেকে ফিরতি পথে পণ্য পরিবহনের নজির খুব একটা নেই। বাংলাদেশ হয়ে পান্ডু থেকে কলকাতায় গত সাত বছরের মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরেই কেবল ২ হাজার টন কার্গো পরিবাহিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে করিমগঞ্জ-কলকাতা এবং ধুবরি-পান্ডু-করিমগঞ্জে এখন পর্যন্ত ভারতীয় পণ্য পরিবহন হয়নি।
বেশি পরিবহন আমদানি পণ্য
ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য মূলত আমদানিনির্ভর। স্বাভাবিক কারণেই প্রটোকল রুট দিয়ে পরিবাহিত পণ্যেরও সিংহভাগ আমদানি পণ্য। বিআইডব্লিউটিএর পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রটোকল রুট দিয়ে আন্তঃদেশীয় যে ৩৯ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮৫ মেট্রিক টন পণ্য পরিবাহিত হয়েছে তার মধ্যে ৩৯ লাখ ৫৯ হাজার ২৯৪ মেট্রিক টনই আমদানি পণ্য। এর আগের বছরগুলোর চিত্রই প্রায় একই রকম। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পরিবাহিত আন্তঃদেশীয় ২৭ লাখ ৮০ হাজার ৪১৬ মেট্রিক টন পণ্যের মধ্যে আমদানি পণ্যই ছিল ২৭ লাখ ৬৯ হাজার ৩৩৪ মেট্রিক টন। তার আগে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি পণ্য পরিবাহিত হয় ২৩ লাখ ৯১ হাজার ২৫৫ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২৬ লাখ ৯৭ হাজার ৬৯৫ মেট্রিক টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ২৬ লাখ ১৮ হাজার ৩৮৪ মেট্রিক টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছর ২২ লাখ ৫২ হাজার ৭২৫ মেট্রিক টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ১৯ লাখ ১২ হাজার ৫৬৪ মেট্রিক টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ১৯ লাখ ২৯ হাজার ২০৭ মেট্রিক টন এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে পরিবাহিত আমদানি পণ্যের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৩৯ হাজার ২০৮ মেট্রিক টন।
তবে প্রটোকল রুট ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি পণ্য পরিবহনও শুরু হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে নৌপথে ভারতের ত্রিপুরায় ১৩৫ টন সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে নতুন সংযুক্ত দাউদকান্দি-সোনামুড়া প্রটোকল রুট ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় রপ্তানি করা হয়েছে ১০ মেট্রিক টন। সিলেটের কুশিয়ারা নদী দিয়ে আসামে রপ্তানি হয়েছে আরও ১২৫ টন সিমেন্ট। এছাড়া প্রটোকল রুট ব্যবহার করে প্রথমবারের মতো খাদ্যপণ্যও রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের ১৬ মার্চ ২৫ হাজার কার্টন খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে প্রাণ গ্রুপ।
ফ্লাই অ্যাশের প্রাধান্য
ভারত-বাংলাদেশ প্রটোকল রুট দিয়ে পরিবাহিত কার্গোর সিংহভাগই ফ্লাই অ্যাশ। বাংলাদেশের সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহারের জন্য ভারত থেকে আমদানি করা হয় এই ফ্লাই অ্যাশ। বিআইডব্লিউটিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছর ভারত থেকে আমদানি করা ৩৮ লাখ ১১ হাজার ৭০৯ মেট্রিক টন ফ্লাই অ্যাশ পরিবাহিত হয়েছে প্রটোকল রুট দিয়ে। আগের বছরগুলোতে অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রটোকল রুট দিয়ে ফ্লাই অ্যাশ পরিবাহিত হয় ২৭ লাখ ৩০ হাজার ৪১১ মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৩ লাখ ২৭ হাজার ১৪৭ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৬ লাখ ৪২ হাজার ২৯৮ মেট্রিক টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৫ লাখ ৯৮ হাজার ২৩ মেট্রিক টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২২ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৩ মেট্রিক টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৯ লাখ ৩ হাজার ৪৬৭ মেট্রিক টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৯ লাখ ১২ হাজার ৭৫১ মেট্রিক টন এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৫ হাজার ৭ হাজার ৩৫৭ মেট্রিক টন। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে প্রটোকল রুট দিয়ে সবচেয়ে বেশি পরিবাহিত হয়ে থাকে স্টোন চিপ, গম ও স্টিল কয়েল।
নৌ পর্যটনের সম্ভাবনা
ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল হয়ে কলকাতা রুটে যাত্রীবাহী স্টিমার চলত নিয়মিতই। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে যাত্রী পরিবহন সেবাটিও বন্ধ হয়ে যায়। নৌ পর্যটন ও মানুষে মানুষে সংযোগের কথা বিবেচনা করে মাঝখানে বেশ কয়েকবার এটি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দীর্ঘ সাত দশক পর নৌপথে যাত্রী পরিবহন সেবাটি চালুর লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ১৬ নভেম্বর উপকূলীয় এবং প্রটোকল রুটে যাত্রী ও ক্রুজ সেবা-সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও ভারত। এর তিন বছরের মাথায় ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) স্বাক্ষরিত হয়। এমওইউ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে যাত্রী ও ক্রুজসেবায় উৎসাহ প্রদান এবং দুই দেশের মানুষকে সর্বোচ্চ সুফল দিতে সেবাটি পরিচালনায় অপ্রয়োজনীয় প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় এসওপিতে।
স্বাক্ষরিত এসওপি ভারতের ইনল্যান্ড ভেসেল অ্যাক্ট ১৯১৭ ও মার্চেন্ট শিপিং অ্যাক্ট ১৯৫৮ এবং বাংলাদেশের ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬ ও মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩-এর অধীনে নিবন্ধিত যাত্রী পরিবহন ও ক্রুজসেবায় নিয়োজিত জাহাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে ধরা হয়েছে। উপকূলীয় ও প্রটোকল উভয় রুটেই এসব জাহাজ চলাচল করতে পারবে। যাত্রীবাহী নৌযান বলতে এমন জাহাজকে বোঝানো হয়েছে, যার যাত্রী বা পর্যটক ধারণক্ষমতা ১২ বা তার বেশি। চুক্তি অনুযায়ী, যাত্রী ও ক্রুজসেবা প্রদানকারী নৌযান চলাচলের জন্য নির্ধারিত রুটগুলোর নাব্যতা উভয় দেশ রক্ষা করবে। প্রয়োজনীয় পাইলটেজ সেবাও প্রদান করতে হবে। এক দেশের নৌযান অন্য দেশের বন্দর ব্যবহার করলে সংশ্লিষ্ট দেশের বন্দর কর্তৃপক্ষ এর বিনিময়ে মাশুল আদায় করবে। এক দেশের নৌযান অন্য দেশের পোর্ট অব কল ব্যবহার করলে সংশ্লিষ্ট নৌযানকে জেটি, হ্যান্ডলিং সুবিধাদি ব্যবহারের অনুমতি দেবে। যাত্রী ও ক্রুজসেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নির্ধারিত আটটি পোর্ট অব কল হলো চট্টগ্রাম, মোংলা, খুলনা, পায়রা, নারায়ণগঞ্জ, পানগাঁও, আশুগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ। সমসংখ্যক পোর্ট অব কল আছে ভারতীয় অংশেও। সেগুলো হলো চেন্নাই, ধুবরি, শিলঘাট, পান্ডু, পারাদ্বীপ, হলদিয়া, কলকাতা ও করিমগঞ্জ।
প্রটোকল ও উপকূলীয় রুটে চলাচলকারী কোনো নৌযানে যাত্রী ও ক্রুসহ ১০০ জনের বেশি মানুষ থাকলে সেখানে একজন মেডিকেল অফিসার থাকা বাধ্যতামূলক। তবে যাত্রী ও ক্রুর সংখ্যা এক হাজার অতিক্রম করে গেলে সেক্ষেত্রে মেডিকেল অফিসার থাকতে হবে দুজন। তাদের যোগ্যতা নির্ধারিত হবে যৌথ শিপিং কমিটির সুপারিশ মোতাবেক। মেডিকেল অফিসারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত প্রয়োজনীয় সংখ্যক নার্স ও অ্যাটেনডেন্টও রাখতে হবে নৌযানে। যাত্রীদের দেওয়া মেডিকেল অফিসার ও নার্সদের সেবা হবে বিনামূল্যের। সেবা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন মেডিকেল অফিসার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে দাখিল করবেন।
দুই দেশের মধ্যে বা অন্য দেশের মধ্য দিয়ে দেশের এক স্থান থেকে অন্য দেশে চলাচলকারী যাত্রীবাহী নৌযান নির্ধারিত স্থান থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারবে। বাংলাদেশে জ্বালানি সংগ্রহের স্থানগুলো হলো চট্টগ্রাম, মোংলা, খুলনা, পায়রা, নারায়ণগঞ্জ, পানগাঁও, আশুগঞ্জ, শেখবাড়িয়া, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, চিলমারী ও চাঁদপুর। একইভাবে ভারতের চেন্নাই, কৃষ্ণপত্তম, ভিশাখাপত্তম, কাকিনাড়া, পারাদ্বীপ, হলদিয়া, কলকাতা, বুজ বুজ, করিমগঞ্জ, নামখানা, পান্ডু ও ধুবরি থেকে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারবে প্রটোকল ও উপকূলীয় রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী ও ক্রুজ জাহাজ।
নৌ প্রটোকল রুট দিয়ে চলাচলকারী পণ্যবাহী নৌযানের মতো যাত্রীবাহী ও ক্রুজ জাহাজকেও নিজ দেশের পাশাপাশি অন্য দেশের জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করতে হবে। অন্য দেশের মধ্য দিয়ে চলাচলকারী যাত্রীবাহী জাহাজে ক্রু বদলের প্রয়োজন পড়লে বাঙ্কারিং বা পোর্ট অব কলে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যাবে। তবে তার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত অনুমোদনের প্রয়োজন আছে। দুই দেশের নির্ধারিত রুট দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী নৌযানকে যাত্রী, পর্যটক ও নৌযানের জন্য উভয় পক্ষের সম্মতিতে সীমিত দায়ের বিমা সনদ সাথে রাখতে হবে।
এগুলোসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ ভারতীয় জাহাজ আরভি বেঙ্গল গঙ্গা কলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে। একই দিনে ঢাকা থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওয়ানা করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) জাহাজ এমভি মধুমতী। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সাত দশক পর বাংলাদেশ-ভারত যাত্রী পরিবহন সেবা ফিরে আসে।
ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য পরিবহন
তৃতীয় কোনো দেশের বন্দর ও পরিবহন ব্যবহার করে একটি দেশ তার অন্য অংশে বা অন্য কোনো দেশে পণ্য পরিবহন করলে তা ট্রান্সশিপমেন্ট হিসেবে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় কোনো একটি দেশ তার পণ্য তৃতীয় একটি দেশের বন্দর, সড়ক বা রেল অর্থাৎ যানবাহন ব্যবহার করে নিজ দেশের আরেক অংশে বা অন্য কোনো দেশে পাঠিয়ে থাকে। এজন্য সব খরচ তাদেরকেই বহন করতে হয়। ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল চুক্তির আওতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নদীবন্দরে ২০১৬ সালের ১৬ জুন ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। কলকাতা থেকে এক হাজার ৪ মেট্রিক টন রড নিয়ে এমভি নিউটেক-৬ নামের জাহাজটি আগের দিন ১৫ জুন আশুগঞ্জ নদীবন্দরে পৌঁছায়। সেখান থেকে পণ্যগুলো বাংলাদেশি ট্রাকে করে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ত্রিপুরায় পৌঁছে দেওয়া হয়। এর ফলে প্রযোজ্য বিভিন্ন মাশুল পায় বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। বেসরকারি পরিবহন মালিক পান প্রয়োজনীয় ভাড়া।
আশুগঞ্জ নদীবন্দর দিয়ে ট্রান্সশিপমেন্ট পরবর্তী বছরগুলোতেও অব্যাহত থাকে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় আশুগঞ্জ নদীবন্দর দিয়ে পাঁচটি নৌযানের মাধ্যমে মোট ৬ হাজার ৫২৫ দশমিক ৩৪৫ মেট্রিক টন পণ্য পরিবাহিত হয়। প্রতি টন ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারে জমা হয় ১৯২ দশমিক ২২ টাকা রাজস্ব। নৌ প্রটোকল চুক্তির আওতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আশুগঞ্জ বন্দরে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পরিবাহিত হয় প্রায় ২ হাজার ২৭০ মেট্রিক টন পণ্য। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় ছয়টি ট্রিপে প্রায় প্রায় ৯ হাজার ২৭৭ মেট্রিক টন পণ্য পরিবাহিত হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও আশুগঞ্জ ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্ট দিয়ে ছয়টি ট্রিপে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন পণ্য পরিবাহিত হয়।
নৌ প্রটোকলকেন্দ্রিক উন্নয়ন কার্যক্রম
নৌ বাণিজ্যের স্বার্থেই নৌ প্রটোকলভুক্ত সব রুট সারা বছরব্যাপী সংরক্ষণ ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সচল রাখতে সম্মত হয়েছে উভয় পক্ষ। এ বাবদ মোট ব্যয়ের ৮০ শতাংশ ভারত সরকার ও ২০ শতাংশ বাংলাদেশ সরকার বহনের ব্যাপারে একমত হয়েছে। এ লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়েছে।
প্রটোকলের আওতায় জকিগঞ্জ ও চিলমারী এন্ট্রি/এক্সিট পয়েন্টে ভারতীয় জাহাজ যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে, সে লক্ষ্যে সংরক্ষণ চার্জ বাবদ সে দেশের সরকার বছরে ১০ কোটি টাকা দেয়। এই অর্থে নাবিকদের জাহাজে ওঠা-নামাসহ নানা সমস্যা সমাধানে জকিগঞ্জ ও চিলমারী এন্ট্রি/এক্সিট পয়েন্টে দুইটি পাইলটেজ হাউজ নির্মাণ করে বিআইডব্লিউটিএ। উদ্যোগ নেওয়া হয় আশুগঞ্জ-জকিগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ-দইখাওয়া রুট দুটি সংরক্ষণ ও সারা বছর ২ দশমিক ৫ মিটার এলএডি বজায় রাখার। এ বাবদ যে ব্যয় তার ৮০ শতাংশ বহন করতে রাজি হয় ভারত। বাকি ২০ শতাংশ বহন করবে বাংলাদেশ সরকার। এই উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য ২০১৮ সালের ৪ মার্চ আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। আশুগঞ্জ-জকিগঞ্জ নৌরুটে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু হয়। স্থগিত হয়ে যাওয়া প্রটোকল রুট ৫ ও ৬ এর অংশবিশেষ গোদাগাড়ী-ধুলিয়ান নৌপথটি পরিদর্শন শেষে এরই মধ্যে চালু করা হয়েছে।
শেষ কথা
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র আর আমাদের পদ্মা, যমুনার জল বেয়ে সীমানার এপার-ওপার গমনাগমন ও পরিবহনের চিরকালীন যে ব্যবস্থা, তাতে যতি টেনে দেয় ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে নতুন দেশে নতুন করে প্রাণ পায় আন্তঃসীমান্ত সংযোগকারী নৌপথগুলো। দুই দেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ও বাণিজ্য প্রটোকল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে। সেই প্রাণেই এখন অন্য বেগ। প্রটোকলে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন রুট। বেড়েছে পণ্য ওঠানো-নামানো ও নৌযানে জ্বালানি সংগ্রহের সুবিধা। নাব্যতার যে সংকট কাটছে তাও। প্রতিবছরই বাড়ছে প্রটোকল রুটে পণ্য পরিবহনের পরিমাণ। এই পণ্যের সিংহভাগই পরিবাহিত হচ্ছে বাংলাদেশের নৌযানে, যার সুফল পাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা। নৌ প্রটোকলের সম্ভাবনা তাই সীমিত নয়, অবারিত। সোনালি অতীতের গৌরব আর সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রত্যয় এই নৌ প্রটোকল।