নদীমাতৃক, খাড়িপ্রধান, বারিবহুল এবং বহুলাংশে নিম্ন ভূমির এই ব-দ্বীপের মানুষের যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নৌ-পরিবহনের গুরুত্ব চিরকালীন। সরকারের শতবর্ষী ব-দ্বীপ পরিকল্পনাতেও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে যোগাযোগের সবচেয়ে প্রাচীন এই মাধ্যমটি। ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় বিবৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে বিআইডব্লিউটিএ, যার চূড়ান্ত অভীষ্ট ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়া।
প্রাক-কথা
নদ-নদীর প্রবাহ এ অঞ্চলের ধমনিতে, শিরা-উপশিরায়। এসব নদ-নদীই বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য। অখ- বাংলার প্রায় সমগ্র অঞ্চলই গঠিত উচ্চতর ভূমি থেকে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ও তাদের শাখা-প্রশাখার বয়ে আনা পলি দিয়ে। ধারণা করা হয়, ব-দ্বীপ গঠনের এ প্রক্রিয়ায় সবার আগে অবয়ব যায় রাঢ়ভূমি এবং পরে বরিন্দ্র বা বরেন্দ্র ও দক্ষিণাঞ্চল। সমগ্র বঙ্গের দক্ষিণাংশ হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের পললপুষ্ট পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ, যার পলল-মৃত্তিকার স্তর ১.৯ কিলোমিটারের চেয়ে গভীরে নয়।
বলা হয়ে থাকে, বাংলায় পলি সঞ্চয়ের কাজটির সূত্রপাত ছয় কোটি বছর আগে। তবে ব-দ্বীপ গঠনের এ প্রক্রিয়া নতুন গতি পায় প্লাইস্টোসিন হিমযুগের শেষে অর্থাৎ ১১-১২ হাজার বছর আগে নদীতে বরফগলা পানি ও পলির পরিমাণ বেড়ে গেলে। পরবর্তী সময়ে নদীতে পানি-পলির পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে এলেও বঙ্গীয় ব-দ্বীপ গঠনের এ প্রক্রিয়া এখনো চলছে। ব-দ্বীপ বঙ্গের ভূমিও তাই কোমল, নরম ও কমনীয়।
ব-দ্বীপ গঠনের এই ধারাবাহিকতায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সঞ্চিত পলির স্তরে স্তরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য ইতিহাস। বিভিন্ন সময় প্রাপ্ত নানা উপাদান ও নিদর্শনই সেই ইতিহাসের সাক্ষী। কর্ণসুবর্ণ থেকে শুরু করে গৌড়, পাণ্ডয়া এবং টাণ্ডা , রাজমহল থেকে কলকাতা ও ঢাকা সব রাজধানী শহরই গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। বগুড়ার মহাস্থানগড়ও ছিল এমনই এক নগর, যার পত্তন করতোয়ার তীরে অপেক্ষাকৃত উঁচু বরেন্দ্রভূমির মাটিতে। কেউ কেউ বলেন, এই মহাস্থানগড় ছিল তখন ব্রহ্মপুত্রের তীরে। আর শক্তিশালী কুশীকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ও তাদের শাখা-প্রশাখার পলি সঞ্চিত এই ব-দ্বীপে সভ্যতার পত্তন হয়েছিল যাদের হাতে তাদের বসতি গড়ে উঠেছিল কমপক্ষে ১০ হাজার বছর আগে। তখন থেকেই সমগ্র গাঙ্গেয় সমভূমি ছিল সুফলা, উর্বরা। স্বর্ণশস্যের আকর এই ব-দ্বীপে তাই জনবসতিও ছিল ঘন। তাদের প্রয়োজনেই বাংলার নদ-নদীর তীরে তীরে কৃষির পত্তন। গ্রাম, নগর, বাজার, বন্দর, সম্পদ, সমৃদ্ধি সবকিছুর বিকাশ। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের ভাষায়, ‘বাঙলার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাঙলার ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী। এই নদীগুলিই বাঙলার প্রাণ; ইহারাই বাঙলাকে গড়িয়াছে, বাঙলার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে যুগে যুগে, এখনও করিতেছে। এই নদীগুলিই বাঙলার আশীর্বাদ।’
তবে প্রকৃতির তাড়নায়, মানুষের অবহেলায় এই নদ-নদীই কখনো কখনো হয়ে উঠতে পারে অভিশাপ। জলবায়ু পরিবর্তন প্রকৃতিতাড়িত তেমনই এক হুমকি। ভূমির অত্যধিক ব্যবহার, উজানের দেশগুলোতে নদীর ওপর ব্যারেজ ও বাঁধ নির্মাণ এবং পানিসম্পদের বাড়তি চাহিদাও নরম-কোমল-নমনীয় এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপের ওপর চাপ তৈরি করছে। এসব চাপ সামলে ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ও তাকে টেকসই রূপদানে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার চাহিদাও এখন সমান আকাঙ্ক্ষিত। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই সরকারের শতবর্ষী ব-দ্বীপ পরিকল্পনা, যার মর্মমূলে ভবিষ্যতের ভূমি ব্যবহার এবং পানি ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ পানি। সেই সাথে কৃষির প্রবৃদ্ধিতে গতি এনে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা কী
১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নবসৃষ্ট এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপের ভূমি যেমন কোমল-নরম-কমনীয়, একইভাবে উর্বরা-সুফলা। প্রচুর মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে এখানে পানির প্রাচুর্য বরাবরের। বিপুল জনঘনত্বের কারণে ব-দ্বীপ বঙ্গে শ্রমের মহার্ঘতা কখনই ছিল না। শ্রম-সম্পদের এ প্রাচুর্যে বাড়তি যোগ প্রাগ্রসর নেতৃত্বের সুসমন্বিত পরিকল্পনা। উন্নত জাত ও যান্ত্রিকীকরণের ম্যাজিকে বছরে ফলছে সাড়ে চার কোটি টন খাদ্যশস্য। অর্থনীতির সবচেয়ে বড় আয়ুধ শিল্পের বিকাশও হচ্ছে সমানতালে। প্রবৃদ্ধি ছুটছে দুরন্ত গতিতে। আকাঙ্ক্ষা এখন ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশের সোপানে পা রাখা।
উন্নত দেশে অভিগমনের পথযাত্রায় বাধাও আছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও নদীভাঙনপ্রবণ দেশ। অনিয়ন্ত্রিত আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রভাবটাও এই অগ্রযাত্রায় কম বাধা নয়। তীব্রতার গাম্ভীর্যে এসবকে ছাপিয়ে গেছে জলবায়ু পরিবর্তন। এগুলোই মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ উতরে টেকসই উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে জরুরি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, যার ভঙ্গি সমন্বিত ও সামগ্রিক। দীর্ঘমেয়াদি সেই পরিকল্পনাই হচ্ছে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০। শতবর্ষী এই পরিকল্পনার মর্মার্থ প্রাকৃতিক ঝুঁকি ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ হ্রাস করার পাশাপাশি পানি, ভূমি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘আগামী ১০০ বছরে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাই বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০। ২১০০ সালে বাংলাদেশকে যেভাবে গড়তে চাই সেভাবেই আমরা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি।’
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। পরিকল্পনা প্রণয়নে নেদারল্যান্ডসের ডেল্টা ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতার আলোকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উত্তম চর্চা অনুসরণ করে সে দেশের সরকারের সার্বিক সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতাও।
মহাপরিকল্পনাটি তৈরির আগে দেশি-বিদেশি গবেষকদের মাধ্যমে মোট ১৯টি বেজলাইন গবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে। গবেষণাগুলো পরিচালিত হয়েছে আটটি ক্লাস্টারের ওপর। এই গবেষণার ওপর দাঁড়িয়েই ভিত্তি পেয়েছে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০। প্রাথমিকভাবে মহাপরিকল্পনাটি ২০৫০ সাল পর্যন্ত মধ্যমেয়াদি ডেল্টা এজেন্ডাকে ঘিরে প্রণীত হলেও তাতে ২০৫০-পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি এজেন্ডার ওপরও আলোকপাত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিবর্তনগুলোকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে পরিকল্পনায়। এক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ কার্যক্রমের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি ‘নো রিগ্রেট’ কৌশলকে প্রাধান্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনাকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা কেন
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ হচ্ছে ২১ শতক শেষে এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপের বিবর্তন কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে তার ভিত্তিতে একটি সমন্বিত, ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি অভীষ্ট ঠিক করা। যাতে একটি নিরাপদ, জলবায়ুসহিষ্ণু ও সমৃদ্ধ ব-দ্বীপ নিশ্চিত করা যায়। দীর্ঘমেয়াদি অভীষ্ট বলতে এখানে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে বোঝানো হয়েছে।
মোটা দাগে এই মহাপরিকল্পনায় তিনটি উচ্চ পর্যায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১-এ যা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এছাড়া পানি, প্রতিবেশ ও ভূমির ব্যবহার সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে মহাপরিকল্পনায়। উচ্চ স্তরের তিনটি লক্ষ্যের মধ্যে প্রথমেই আছে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য নির্মূল করা। পরের দুটি লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া।
সুনির্দিষ্ট যে ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তার মধ্যে আছে বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা; পানি নিরাপত্তা ও এর দক্ষ ব্যবহার জোরদার করা; টেকসই ও সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা; জলাভূমি ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ এবং তার যৌক্তিক ব্যবহারকে উৎসাহিত করা; দেশীয় ও আন্তঃসীমান্ত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও ন্যায়ভিত্তিক সুশাসন গড়ে তোলা। ভূমি ও পানিসম্পদের সর্বোচ্চ ও সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টিও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আর শতবর্ষী এ পরিকল্পনার অভিলক্ষ্য হলো শক্তিশালী, অভিযোজনমূলক ও সমন্বিত কৌশল এবং ন্যায্য পানি ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকি কার্যকরভাবে কমিয়ে আনা। সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন ও ব-দ্বীপ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। যাতে দীর্ঘমেয়াদে পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত হয়।
মহাপরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ফলাফলকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা নিলে তার প্রভাব কী হতে পারে এবং না নেওয়ার প্রভাবটাই বা কেমন হতে পারে তার একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে এক্ষেত্রে। ফলাফল যা পাওয়া গেছে তা বিস্মিত হওয়ার মতো। পরিকল্পনা না নিলে অর্থাৎ স্থিতাবস্থায় (বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল) ২০৪১ সাল নাগাদ বার্ষিক ১ দশমিক ১ শতাংশ হারে জিডিপি হারাতে পারে বাংলাদেশ। এই হিসাবে ২০৪১ সাল নাগাদ জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়াতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে, সরকারের লক্ষ্য যেখানে ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন। তবে লক্ষণীয় যেটা তা হলো পরিকল্পনা না নিলে ২০৩১ সালের মধ্যে অতিদারিদ্র্যমুক্ত উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের লক্ষ্য অধরাই থেকে যাবে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে শহরমুখী অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে, নগরের ওপর যা বাড়তি চাপ তৈরি করবে। নিম্নমুখী হতে থাকবে কৃষি উৎপাদনের গ্রাফ। ভূমিক্ষয় ও নিম্নভূমির উৎপাদনশীলতা ও জমির প্রাপ্যতা হ্রাসের পাশাপাশি বাড়বে জমির মূল্য। নগরে পানির স্বল্পতার পাশাপাশি পানির মান ও স্যানিটেশন ঝুঁকিতে পড়বে। সর্বোপরি স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়ে যাবে এবং জীবনমান হ্রাস পাবে।
এর বিপরীতে পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষণীয় মাত্রায় কমানো সম্ভব হবে। এর মধ্য দিয়ে গড়ে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে দেশের অর্থনীতি। ২০৩০ সাল নাগাদ অনায়াসেই অতিদারিদ্র্য নির্মূল করে উচ্চ মধ্যম আয়ের বন্দরে পৌঁছতে সক্ষম হবে ব-দ্বীপ বঙ্গ।
কাঠামো বিন্যাস
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির কারণে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৪ সালের মার্চে। পরিকল্পনাটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশ সরকার, নেদারল্যান্ডস সরকার এবং বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এবং পানিসম্পদ গ্রুপের (ডব্লিউআরজি) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অবদান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে ডেল্টা ভিশন ও লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক ১৯টি সহায়ক গবেষণাপত্র তৈরি করে তার আলোকে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জ্ঞানভান্ডার। পানিসম্পদ খাতে গত ৬০ বছরে পৃথকভাবে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বিস্তারিত পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত জ্ঞান থেকে ঠিক করা হয়েছে ভবিষ্যৎ করণীয়। বঙ্গীয় ব-দ্বীপের জন্য আগামীতে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও নগরায়ণ বিবেচনা করে ভবিষ্যতের বিভিন্ন রূপকল্প প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এই পরিকল্পনার ফলে সম্ভাব্য পরিবর্তিত পটভূমিগুলো কী হতে পারে, তারও একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে বিশেষজ্ঞদের সন্নিবেশে।
মহাপরিকল্পনাটি প্রণয়নে পরিকল্পনামন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি, মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি এবং প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ২৫ সদস্যের একটি দেশীয় বিশেষজ্ঞ প্যানেল করেছে। পরিকল্পনার প্রতিটি বিষয় এই তিনটি কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) অনুমোদন পায় বহু কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পরিষদে অনুমোদিত এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবিক পক্ষে একটি অভিযোজনক্ষম টেকনো-ইকোনমিক (প্রকল্পের সম্ভাব্যতা ও সুফল বিশ্লেষণের মডিউল) পরিকল্পনা, যার সাথে জড়িত পানি, ভূমি ব্যবহার, প্রতিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের আন্তঃসম্পর্ক। স্বাভাবিকভাবেই পরিকল্পনার অঞ্চল চিহ্নিতকরণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে হাইড্রোলজি। পরিকল্পনা প্রণয়নে দেশের ৮টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলকে ভিত্তি হিসেবে ধরে প্রতিটি অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কতখানি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। যেসব জেলা ও অঞ্চল একই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে আছে সেগুলোকে অভিন্ন গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই গ্রুপগুলোকেই বলা হচ্ছে একেকটা হটস্পট। এই প্রক্রিয়ায় পুরো ব-দ্বীপকে মোট ছয়টি হটস্পটে বিভাজিত করা হয়েছে, যা বিস্তৃত পরিসরে সুনির্দিষ্ট আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্য ও ঝুঁকি চিহ্নিতকরণের সহজ উপায় বাতলে দিয়েছে। এভাবে চিহ্নিত ছয়টি হটস্পট হলো উপকূলীয় অঞ্চল (২৭,৭৩৮ বর্গকিলোমিটার); বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল (২২,৮৪৮ বর্গকিলোমিটার); হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল (১৬,৫৭৪ বর্গকিলোমিটার); পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল (১৩,২৯৫ বর্গকিলোমিটার); নদী ও মোহনা অঞ্চল (৩৫,২০৪ বর্গকিলোমিটার) এবং নগর অঞ্চল (১৯,৮২৩ বর্গকিলোমিটার)। তবে ভৌগোলিক কারণে কোনো কোনো জেলা একাধিক হটস্পটে এসে পড়েছে।
মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অংশীজন
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ মোটা দাগে পানিসম্পদকে কেন্দ্র করে। স্বাভাবিকভাবেই পরিকল্পনার আওতায় গৃহীত প্রকল্প ও তা বাস্তবায়নে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিশেষ করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) ভূমিকা সবার অগ্রভাবে। তাই বলে অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার ভূমিকাও কম নয়।
মহাপরিকল্পনায় খাতভিত্তিক পরিকল্পনাগুলো মূলত স্বল্পমেয়াদি এবং এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের। তবে এতে যে অভীষ্ট ও লক্ষ্যগুলো ধরা হয়েছে তা জাতীয় ভিত্তিক এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তা অর্জনে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও বহুখাতভিত্তিক সমন্বিত নীতি ব্যবস্থাপনা। উদাহরণ হিসেবে বর্ধিত জনসংখ্যা এবং কৃষিজমি হ্রাসের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্যনিরাপত্তা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এ চ্যালেঞ্জ উত্তরণে প্রয়োজন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যেমন কৃষি; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন; ভূমি; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ; পানিসম্পদ; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়; নৌ-পরিবহন; খাদ্য; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ; অর্থ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত নীতি ও তার বাস্তবায়ন। একইভাবে উন্নত জীবনমান অর্জনে পানির উচ্চ চাহিদার জোগান এবং আবাসন ও শিল্প খাতে স্মরণকালের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের সুরক্ষায় বাংলাদেশের প্রয়োজন সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে সম্পৃক্ত করে দীর্ঘমেয়াদি অভীষ্ট ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন। সুতরাং ঐতিহাসিক এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে আজকের বাংলাদেশকে উন্নত দেশের সোপানে পৌঁছে দেওয়া সরকারের একক কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থার দায়িত্ব নয়। এ দায়িত্ব সমন্বিতভাবে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার।
সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সমন্বয়ে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদানের দায়িত্বে রয়েছে ‘ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল’। কাউন্সিলের চেয়ারপারসন হিসেবে আছেন প্রধানমন্ত্রী ও ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে পরিকল্পনামন্ত্রী। সদস্য হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের কৃষি; অর্থ; খাদ্য; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূমিমন্ত্রী এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ; নৌ-পরিবহন; পানিসম্পদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীরা। কাউন্সিলের সদস্য সচিবের দায়িত্বে আছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য।
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ২০২০ সালের ১ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে কাউন্সিলের কার্যপরিধিও নির্ধারণ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়নে কাউন্সিল নীতিনির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কৌশলগত পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা হালনাগাদকরণ, বিনিয়োগ পরিকল্পনা প্রণয়নে নীতিনির্ধারণ এবং ডেল্টা তহবিল গঠনে দিকনির্দেশনাও প্রদান করবে এই কাউন্সিল। প্রতি বছর কাউন্সিল ন্যূনতম একটি সভা করবে এবং প্রয়োজনে নতুন সদস্যও অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।
বিনিয়োগ চাহিদা ও অর্থায়ন কৌশল
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা কার্যকর হবে নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়িত প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের মধ্য দিয়ে। সেই সাথে পুরনো প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বিপুল বিনিয়োগের, বার্ষিক হিসাবে যা জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি মূল্য ও জিডিপির বিদ্যমান যে আকার তার হিসাবে ২০৩১ সালে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ২ হাজার ৯৬০ কোটি ডলার। বর্তমানে ব্যয় হচ্ছে জিডিপির মাত্র দশমিক ৮ শতাংশ।
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জিডিপির যে ২ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থায়নের চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে তার মধ্যে দশমিক ৫ শতাংশ আসবে বেসরকারি খাত থেকে। অবশিষ্ট ২ শতাংশ অর্থ জোগান দিতে হবে সরকারি খাত থেকে। এই অর্থের দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় হবে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ। আর ১ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় হবে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বিনিয়োগ পরিকল্পনার আওতায় (বিডিপি ২১০০ আইপি)। পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে বিনিয়োগ খুবই সামান্য এবং জিডিপির জিডিপির দশমিক ১ শতাংশের বেশি নয়।
তবে সরকারিভাবে এই অর্থের সংস্থান করা অতটা সহজ নয়। এজন্য কিছু কৌশলের কথা বলা হয়েছে ব-দ্বীপ পরিকল্পনায়। কৌশল অনুযায়ী সরকারি এই অর্থের সংস্থান হতে পারে ট্যাক্স ফাইন্যান্সিং (কর আরোপ), বেনিফিশিয়ারি পে প্রিন্সিপলের (বিপিপি) ভিত্তিতে বিনিয়োগ তুলে আনা এবং গ্লোবাল গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) কাজে লাগিয়ে বিদেশি তহবিল জোগাড় করার কৌশল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। আন্তর্জাতিকভাবে ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনায় বিপিপি নীতির ভালো নজিরও আছে। উদাহরণ হিসেবে ডাচ ডেল্টার কথা বলা যেতে পারে। সেখানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করা সিংহভাগ অর্থায়ন নিশ্চিত করা হয় বিপিপির মাধ্যমে।
বাংলাদেশেও ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনায় বেনিফিশিয়ারি পে প্রিন্সিপল কাজে লাগানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। শহর অঞ্চলে পানি ও স্যানিটেশনে নীতিটি লক্ষণীয় মাত্রায় বিদ্যমান আছেও। তবে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল সংস্থানের ক্ষেত্রে পুরো মাত্রায় এই নীতির প্রয়োগ হচ্ছে না। আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তহবিল সংস্থানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে চালু এই নীতির প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচে মূলধনি ব্যয় বা পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ উভয় ক্ষেত্রেই এই নীতি পুরোপুরি অনুপস্থিত। এর কারণ মূলত স্থানীয় পানি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ না থাকা। এ ধরনের কর্তৃপক্ষ গঠন করা গেলে বেনিফিশিয়ারি পে প্রিন্সিপলও ধীরে ধীরে কার্যকর হতে শুরু করবে। এছাড়া নগর অঞ্চলে পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান ও নীতিগুলোকেও আরো বেশি কার্যকর করতে হবে। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রপার্টি ট্যাক্স ব্যবস্থা চালুর মধ্য দিয়ে বার্ষিক মাশুল আদায়ের মাধ্যমে বিনিয়োগের অর্থ তুলে আনার সুযোগ রয়েছে।
গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড কাজে লাগিয়ে ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। তবে এই তহবিলের আওতায় বিদেশি অনুদান আদায় করতে হলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দেশের বেসরকারি শিল্পের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সেটি তাদের স্মরণে রেখে ঠিকমতো পরিপালন করতে হবে। এটা করা গেলে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকেই বাংলাদেশ প্রতি বছর ২০০ কোটি ডলার সংস্থানে সমর্থ হবে। এখনই সেটি হচ্ছে বিষয়টি তেমন নয়। এজন্য সব পক্ষ গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের সাথে সম্পৃক্ত ও এটি পুরোপুরি কার্যকর হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ আরো ১০-১৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
দেশের বেসরকারি খাতকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা গেলে ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় অর্থায়নের জন্য তাদের কাছ থেকেও বড় আকারের তহবিল পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, যার বার্ষিক পরিমাণ জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিকভাবেও পানি শোধন, পানি সরবরাহ ও বর্জ্য পরিশোধনে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগের অসংখ্য নজির রয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণের আরেকটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হচ্ছে সেচ।
তবে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা যেখানে তা হলো ড্রেজিং। ড্রেজিং চুক্তির ব্যাপারে বেসরকারি খাতের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে উত্তোলিত বালি বিক্রি করে ড্রেজিংয়ের ব্যয়ও কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। এজন্য যথোপযুক্ত ড্রেজিং চুক্তি পদ্ধতি উন্নয়নে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। এছাড়া পিপিপির ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতের জন্য নদীবন্দর স্থাপনেরও সুযোগ রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে ৮০ প্রকল্পে ৩৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনা
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা সমগ্র বাংলাদেশের পানি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার একটি দীর্ঘমেয়াদি, সমন্বিত ও সামগ্রিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এটি প্রণীত হয়েছে অভিযোজনমূলক ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনার (এডিএম) ওপর দাঁড়িয়ে। এই অভিযোজনমূলক ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনা হচ্ছে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তাগুলোকে বিবেচনার মধ্যে নিয়ে বিকল্প অভিযোজনমূলক কৌশল, ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ও তার মূল্যায়ন। এই নীতির আলোকেই ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আওতায় বাস্তবায়নের জন্য প্রথমবারের মতো ৮০টি প্রকল্প নির্বাচন করা হয়েছে।
প্রকল্প নির্বাচনের আগে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) সংশ্লিষ্ট ২০টি সংস্থাকে তাদের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প জমা দেওয়ার আহ্বান জানায়। সব মিলিয়ে ১৩৩টি বিনিয়োগ প্রকল্প জমা পড়ে। অভিযোজনমূলক ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রকল্পগুলোকে এরপর যাচাই-বাছাই, শ্রেণিবদ্ধ এবং সবশেষে অনুক্রম তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে প্রস্তাবিত যেসব প্রকল্পের সুফল বিনিয়োগের চেয়ে বেশি, ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় উল্লেখিত ছয়টি অভীষ্টের যেকোনো একটি পূরণ করতে সক্ষম সর্বোপরি অভিযোজনমূলক ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। প্রস্তাবিত ১৩৩টি প্রকল্পের মধ্যে ৮০টি এই মানদ- পূরণ করায় সেগুলো বিনিয়োগ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ভৌত প্রকল্প রয়েছে ৬৫টি। বাকি ১৫টি জ্ঞানভিত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত। এসব প্রকল্পে মূলধনি বিনিয়োগ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। তবে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় যোগ নির্বাচিত ৮০ প্রকল্পে মোট সম্ভাব্য বিনিয়োগ দাঁড়াবে ৫ হাজার ২০০ কোটি ডলার বা ৪ লাখ ৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম ১০ বছরে বিনিয়োগ করতে হবে বার্ষিক ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। তবে ২০২৫ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে যাবে এবং সে নাগাদ প্রয়োজন হবে বছরে গড়ে ২৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
হটস্পটভিত্তিক প্রকল্প নির্বাচন ও সে অনুযায়ী বিনিয়োগ পরিকল্পনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য প্রকল্প নির্বাচন করা হয়েছে মোট ২৩টি, যেগুলো বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৮৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই হটস্পটে জ্ঞানভিত্তিক আটটি প্রকল্প আশু সম্পাদনের কথা বলা হয়েছে।
নদী ব্যবস্থাপনা উন্নত করার প্রয়াসে নদী অঞ্চলের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে সাতটি প্রকল্প। এর মধ্যে অবকাঠামো প্রকল্প রয়েছে পাঁচটি এবং দুটি জ্ঞানভিত্তিক প্রকল্প। এই হটস্পটের সবগুলো প্রকল্পই দ্রুত শুরু করার অগ্রাধিকারে রয়েছে। এজন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘ইন্টিগ্রেটেড যমুনা-পদ্মা রিভারস স্ট্যাবিলাইজেশন অ্যান্ড ল্যান্ড রিক্লেমেশন প্রজেক্ট’। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা।
নগর অঞ্চল হটস্পটে বাস্তবায়নের জন্য মোট ১২টি প্রকল্প নির্বাচন করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি প্রকল্প নির্বাচন করা হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিয়ে। এই হটস্পটের অবশিষ্ট প্রকল্পগুলোর মধ্যে চারটি পানি সরবরাহ এবং দুটি স্যানিটেশন ও প্রতিবেশ রক্ষা সম্পর্কিত। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৬৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করাই বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ হটস্পটের প্রধান অগ্রাধিকার। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই হটস্পটের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় ৯টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নে বিনিয়োগ করতে হবে ১৬ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম পার্বত্যাঞ্চল হটস্পটের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় নির্বাচিত করা হয়েছে মোট আটটি প্রকল্প। এগুলো বাস্তবায়নে সম্ভাব্য বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে ৬ হাজার কোটি টাকা। এই হটস্পটের নির্বাচিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি বাদে সবগুলোই আশু বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।
হাওর ও জলাভূমি হটস্পটের ছয়টি প্রকল্পকে বিনিয়োগ পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় হবে সাকুল্যে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
সবশেষে ক্রস-কাটিং অঞ্চলে বাস্তবায়নের জন্য ১৫টি প্রকল্প বিনিয়োগ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সম্ভাব্য ৬৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে। এর মধ্যে ১৪টি প্রকল্প রয়েছে দ্রুত বাস্তবায়নের তালিকায়।
প্রশ্ন হচ্ছে বিপুল বিনিয়োগের এই অর্থের সংস্থান হবে কীভাবে? বিশ^ব্যাংকের কারিগরি সহায়তায় এর একটা রূপরেখা তৈরি করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থায়ন প্রক্রিয়াটি হবে মিশ্র। অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি অর্থায়নের পাশাপাশি গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড বা বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল থেকেও অর্থের জোগান আসবে। তবে প্রাক্কলিত বিনিয়োগের ৯৯ শতাংশই আসবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। পরিকল্পনার প্রথম পাঁচ বছরে সরকারিভাবে বার্ষিক মূলধন ব্যয় ১২ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৫ সালে ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সরকারের বাজেট বরাদ্দ অর্থাৎ রাজস্ব ও ঋণ নিয়ে এ অর্থের সংস্থান করা হবে। বলা যায়, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারি অর্থায়ন বিদ্যমান জিডিপির দশমিক ৮ শতাংশ দিয়ে শুরু হলেও ২০২৫ সালের মধ্যে তা জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হবে। বর্তমানে দেশের জিডিপির যে প্রাক্কলন তাতে ২০২৫ সাল নাগাদ সরকারিভাবে ৪৫ হাজার কোটি টাকা জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। এছাড়া মোট ব্যয়ের ১২ শতাংশ অর্থাৎ ৩৭ হাজার কোটি টাকা জলবায়ু তহবিল থেকে সংগ্রহের প্রত্যাশা করছে সরকার।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের সাতটি প্রকল্পের মাধ্যমে বড় অংকের বেসরকারি অর্থায়ন আকর্ষণের পরিকল্পনাও রয়েছে। ২০২১ সালে বেসরকারি অর্থায়নের পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা বা জিডিপির দশমিক শূন্য ২ শতাংশ হলেও প্রকল্পগুলো সফল হলে ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে পরবর্তী বেসরকারি বিনিয়োগ আরো বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে এবং ২০২৫ সালে তা জিডিপির কাক্সিক্ষত দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে।
ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ব্যয় ও অর্থায়ন লক্ষ্যমাত্রা
ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতের গুরুত্ব
নদীমাতৃক, খাড়িপ্রধান, বারিবহুল এবং বহুলাংশে নিম্নভূমির এই ব-দ্বীপের সাধারণ মানুষের যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নৌ-পরিবহনের যে বিশেষ একটি স্থান ছিল তা সহজেই অনুমেয়। এর প্রমাণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে, প্রাচীন বাংলার শিলালিপিতে এমনকি সংস্কৃত সাহিত্যেও। কালিদাস রঘুবংশে রঘুর দিগিজয় প্রসঙ্গে বাঙালিকে ‘নৌসাধনোদ্যতান’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। পাল ও সেন বংশের লিপিমালাতেও নৌবাট, নৌবিতান প্রভৃতি শব্দের বহুল উল্লেখ রয়েছে। বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর লিপিতে (৫০৭-৮ খ্রিষ্টাব্দ) নৌযোগ অর্থাৎ নৌঘাট বা বন্দর বা পোতাশ্রয়ের উল্লেখ আছে। ধর্মাদিত্যের ২ নং শাসনে ভূমির সীমা সম্পর্কে নৌদ-ক কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। নৌদ-ক কথার অর্থও নৌকার আশ্রয়, নৌকা যেখানে বাঁধা হতো সেই স্থান অর্থাৎ বন্দর বা ঘাট। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের বয়ানে-‘এইসব উল্লেখ হইতে স্পষ্ট বুঝা যায়, নদনদীগামী ছোটবড় নৌকা, সমুদ্রগামী পোত ইত্যাদি নির্মাণ-সংক্রান্ত একটি সমৃদ্ধ শিল্প ও ব্যবসায় প্রাচীন বাঙলায় নিশ্চয় ছিল।’
প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় সমৃদ্ধ এই নৌ-পরিবহন খাতের ভিত্তি ছিল দীর্ঘ-বিস্তৃত নৌপথ। ১৮ শতক পর্যন্তও দীর্ঘ এই নৌপথে চলাচলকারী নৌযান ছিল অযান্ত্রিক। গঙ্গার বুকে ধোঁয়া উড়িয়ে বাষ্পচালিত প্রথম নৌযানের আবির্ভাব ১৮৩৪ সালে। স্টিমারটির মালিকানায় ছিল সরকার। তবে অভ্যন্তরীণ নৌপথে স্টিমার পরিচালনাকারী প্রথম কোম্পানিটির গঠন ১৮৪৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। নাম ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে কোম্পানি লিমিটেড (আইজিএনআর)। এর কয়েক বছর পর গঠিত হয় রিভার স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি লিমিটেড (আরএসএন)। উনিশ শতকজুড়েই বাংলা, আসাম ও বিহারের নৌ-পরিবহন খাতে লন্ডনে নিবন্ধিত এই দুই কোম্পানির আধিপত্য ছিল একচেটিয়া। নৌপথে মোট যাত্রী কার্গোর ৭০ শতাংশই পরিবহন করত তারা। ট্রাফিক প্রবৃদ্ধিও ছিল ঈর্ষণীয়। উনিশ শতকের শেষ প্রান্তিকে অর্থাৎ ১৮৮০-১৮৯৯ সময়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কলকাতা থেকে খুলনায় যাতায়াত করত বার্ষিক ৮৯৮টি জাহাজ। বিশ শতকের প্রথম প্রান্তিকেই চলাচলকারী জাহাজের সংখ্যা বার্ষিক ৪ হাজার ৮০৩-এ পৌঁছে যায়। ব্রিটিশ শাসনকালে নৌপথের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রমও পরিচালিত হতো আইজিএনআর এবং আরএসএনের মাধ্যমে। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতের উন্নয়ন ছিল পুরোপুরি মুনাফাকেন্দ্রিক। নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও জরিপের জন্য পাইলট তত্ত্বাবধায়কের নেতৃত্বে জেলাভিত্তিক দল থাকত। নৌকায় চড়ে নিয়মিত তারা নৌপথ পরিদর্শন করতেন এবং গভীরতা পরিমাপে ব্যবহার করতেন বাঁশ বা অন্য কিছু। এরপর বাঁশ দিয়ে গভীর ও অগভীর নৌপথ আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হতো।
স্বাভাবিক কারণেই বিশ শতকের গোড়ার দিকে মাদারীপুর বিল রুট বাদ দিলে নৌপথের নাব্যতায় কোনো উন্নতিই সেই অর্থে হয়নি। ১৯০৭ সালে সংগৃহীত ড্রেজার ‘ফয়ার’ দিয়ে কেবল মধুমতী নদী, মাদারীপুর বিল রুট ও কুমার নদের নিম্নাংশ এবং গোপালগঞ্জ লুপ খনন করা হয়েছিল। এরপর সংগ্রহ করা হয় আরেকটি ড্রেজার আলেক্সান্দ্রা এবং নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণে ড্রেজিং চালু করা হয়।
বাংলাদেশে দীঘ-বিস্তৃত অভ্যন্তরীণ নৌপথ বিদ্যমান ছিল ৬০-এর দশকেও। ১৯৬৩ সালে নেদারল্যান্ডসের প্রতিষ্ঠান নেডেকোর গবেষণা বলছে, ওই সময়ে বাংলাদেশে নাব্য নৌপথ ছিল ১২ হাজার কিলোমিটার। তবে পাকিস্তান ইকোনমিক সার্ভে, ১৯৬৯-৭০-এর ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে নাব্য নৌপথ উল্লেখ করা হয়েছে ৪ হাজার ৯৮৪ মাইল বা ৮ হাজার ৭৪ কিলোমিটার, ১৯৬৯ সালে যা ৪ হাজার ৯৯৫ মাইল বা ৮ হাজার ৯২ কিলোমিটারে উন্নীত হয়। অভ্যন্তরীণ নৌপথে নৌযান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৯৬৫ সালের ৪২৬টি থেকে বেড়ে হয় ৬২৩টিতে। চার বছরের ব্যবধানে কার্গো পরিবহন সক্ষমতা ২ লাখ ১২ হাজার টন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫৬ হাজার টনে। যাত্রী পরিবহন সক্ষমতাও ১ লাখ ৭ হাজার থেকে বেড়ে ১ লাখ ১৫ হাজারে উন্নীত হয়। এই প্রবৃদ্ধি মূলত ১৯৫৮ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়িত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির ফল।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৌপথ খননের গুরুত্ব অনুধাবন করে স্বাধীনতার পরপরই ড্রেজার সংগ্রহের উদ্যোগ নেন এবং সাতটি ড্রেজার কেনেন। সেই সাথে মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল খনন করে তা উন্মুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী এসব উদ্যোগের ফলে স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক বছর যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে নৌ-পরিবহন খাত তার অবস্থান ধরে রাখে। ২০০৭ সালে পরিচালিত বিশ^ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনও সেই কথাই বলছে। ‘রিভাইভাল অব ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট : অপশন অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিস’ শীর্ষক ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালেও যাত্রী ও কার্গো পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথের হিস্যা ছিল যথাক্রমে ১৬ ও ৩৭ শতাংশ। ক্রমান্বয়ে ক্ষয় পেতে পেতে ২০০৫ সালে তা নেমে আসে যথাক্রমে ৮ দশমিক ৯ ও ১৬ শতাংশে। নাব্য নৌপথের দৈর্ঘ্যও ক্রমে ছোট হয়ে আসতে থাকে। ১৯৮৯ সালে পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে নাব্য নৌপথের দৈর্ঘ্য থাকে ৬ হাজার কিলোমিটারের মতো। আর শুষ্ক মৌসুমে নাব্য থাকে ৩ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের মতো নৌপথ। ২০০৯ সালে সারা বছর নাব্য নৌপথের দৈর্ঘ্য আরো কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটারে। ব্যাপক ড্রেজিং কর্মসূচির মাধ্যমে বর্তমানে ৬ হাজার কিলোমিটার নৌপথ নাব্য করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ নৌপথ দিয়ে চলাচল করছে বছরে ৩০ কোটির মতো যাত্রী। কার্গো পরিবাহিত হচ্ছে বার্ষিক সাড়ে ৫ কোটি টনের বেশি। বিপুল পরিমাণ এই কার্গো ও যাত্রী পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচল করছে ১০ হাজারের বেশি জাহাজ। এছাড়া গ্রামীণ অঞ্চলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য রয়েছে সাড়ে ৭ লাখের মতো পাম্প ইঞ্জিনচালিত নৌকা। এছাড়া নৌ-পরিবহন খাতের কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ৬ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ আবার নারী, যারা ল্যান্ডিং স্টেশনগুলোতে কাজ করেন। অর্থাৎ কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাত। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ তেও তাই নৌ-পরিবহন খাতের গুরুত্বকে বড় করে দেখানো হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় যে ৮০টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেখানেও গুরুত্বর সাথে স্থান পেয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাত। প্রথম পর্যায়ে বিনিয়োগ পরিকল্পনায় স্থান পাওয়া দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
এর মধ্যে একটি প্রকল্প হচ্ছে জ্ঞান ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত। ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত উন্নয়ন : প্রস্তুতিমূলক জরিপ ও গবেষণা’ শীর্ষক প্রকল্পটির আওতায় ডাইক ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধ বাঁধের বিস্তারিত প্রকৌশলগত নকশা উন্নয়নের মডেলিং, গবেষণা ও জরিপ এবং প্রাক্কলিত ব্যয়সহ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করা হবে। সুউচ্চ (বহুমুখী) সি ডাইক ও নদী বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে বাংলাদেশকে নিরাপদ রাখাও প্রকল্পটির লক্ষ্য। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ১৫ বছর এবং উপকূলীয় ভাঙন থেকে রক্ষার যে ব-দ্বীপ কৌশল তার সাথে সম্পর্কিত।
উপকূলীয় লোকজনের জন্য গবেষণা প্রকল্পটি আর্থসামাজিক প্রত্যক্ষ সুফল বয়ে না আনলেও পরবর্তী পর্যায়ে ইনপুট সুবিধা দেবে। তাছাড়া প্রকল্পের ব্যয় ও তা থেকে প্রাপ্ত সুবিধার বিশ্লেষণ ভবিষ্যতে অবকাঠামো বিনিয়োগকে আরো বেশি কার্যকর ও দক্ষ করে তুলবে। ১০২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বিআইডব্লিটিএ’র পাশাপাশি ডব্লিউএআরপিও, বিডব্লিউডিবি ও নৌবাহিনী। শতভাগ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।
বিআইডব্লিউটিএ’র বাস্তবায়নের জন্য প্রথম পর্যায়ে নির্বাচিত দ্বিতীয় প্রকল্পটি ভৌত অবকাঠামো সংক্রান্ত। ‘প্রধান প্রধান নৌরুটে টেকসই যোগাযোগ পুনঃস্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটির অধীনে ২৪টি নৌপথ খনন করে ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার নৌপথ চালুর লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ’র মালিকানাধীন ড্রেজারের মাধ্যমে খনন করা হবে ২ কোটি ঘনমিটার ও বেসরকারি ড্রেজারের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ঘনমিটার। প্রকল্পটির সম্ভাব্য বাস্তবায়নকাল ৬ বছর এবং পরিচালন মেয়াদ ২৫ বছর। পরিবহন সক্ষমতা ও নদীর নাব্যতা উন্নয়ন এবং প্রধান নদীগুলোর স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে যে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা তার সাথে সম্পর্কিত এটি।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মূলধন ব্যয় হবে ২ হাজার ২৯৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও পরিচালন ব্যয় ৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। শতভাগ সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত প্রকল্পটির সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সুফল ও ব্যয়ের অনুপাত ১:১৭।
বিআইডব্লিউটিএ’র পরিকল্পনায় ৮০ প্রকল্প
যাত্রী বা পণ্যের উৎস থেকে উদ্দিষ্টে গমনাগমের যে মাধ্যম, এই অঞ্চলে তা শুরুই হয়েছিল নদীকে ব্যবহার করে, নৌপথকে কাজে লাগিয়ে। দেশের অগম্য ও কঠিনগম বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এখনো অভ্যন্তরীণ নৌপথই। একইভাবে কার্গো পরিবহনেরও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে সড়ক ও রেলপথের তুলনায় নৌপথ অনেক বেশি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হওয়ায় যোগাযোগের প্রয়োজনে বিপুলসংখ্যক মানুষ (যাদের বড় অংশ নি¤œ আয়ের) এ মাধ্যমের ওপরই নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংকের ২০০৭ সালের গবেষণার তথ্য আমলে নিয়েও বলা যায়, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ১২ দশমিক ৩ শতাংশ বা গ্রামের ৫০ শতাংশ খানা যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করে।
একইভাবে পরিবহনের অন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম রেল ও সড়কের তুলনায় অভ্যন্তরীণ নৌপথ পরিবেশবান্ধবও। সড়কের তুলনায় নৌপথে জ্বালানি খরচও আট ভাগ কম হয়। স্বাভাবিকভাবেই কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নির্গমন সহনীয় মাত্রায় থাকে। অর্থাৎ ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি পরিবেশের ওপরও ইতিবাচক একটা প্রভাব রেখে চলেছে অভ্যন্তরীণ নৌপথ। তাই বলা যায়, প্রাকৃতিকভাবেই অন্য দুই মাধ্যমের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় সরকারের প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের যে প্রয়াস তাতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখার পর্যায়ে রয়েছে পরিবহনের প্রাচীনতম মাধ্যমটি।
কিন্তু মরফোলজিক্যাল ও জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে খাতটির ওপর। অনিয়মিত প্রবাহের কারণে নদীবক্ষে অত্যধিক পলি জমে নৌপথের দৈর্ঘ্য কমছে। এবং নৌ চলাচলে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিতে পড়ছে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতের নানা অবকাঠামোও। এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় টেকসই, দক্ষ ও আধুনিক অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাত গড়ে তুলতে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে মহাপরিকল্পনার অধীনে বাস্তবায়নের জন্য ৮০টি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে বিআইডব্লিউটিএ’র এ-সংক্রান্ত কমিটি। তিনটি পর্যায়ে অর্থাৎ ১০, ২০ ও ৩০ বছর মেয়াদে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে জ্ঞানভিত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্পও। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা।
প্রথম পর্যায়ে ৪৫ প্রকল্প
মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর বাংলাদেশের সামনে আশু অভীষ্ট ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের সোপানে ওঠা। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ অনুযায়ী এই অভীষ্টে পৌঁছাতে অতিদারিদ্র্য নামিয়ে আনতে হবে ২ দশমিক ৩ শতাংশে এবং দারিদ্র্য ৭ শতাংশে। আর প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রয়োজন পড়বে ৯ শতাংশ। উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যের হার কাক্সিক্ষত মাত্রায় নামিয়ে আনতে সাশ্রয়ী ও দক্ষ যোগাযোগ অবকাঠামোর বিকল্প নেই। সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে এক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতের। প্রেক্ষিত পরিকল্পনার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৩১ সালে অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী পরিবহনের চাহিদা দাঁড়াবে ২৫২ বিলিয়ন প্যাসেঞ্জার কিলোমিটার। সে নাগাদ কার্গো পরিবহন করতে হবে ৭১ বিলিয়ন টন কিলোমিটার। এজন্য প্রয়োজন হবে বিস্তৃত পরিসরে নাব্য নৌপথের পাশাপাশি শক্তিশালী নৌ অবকাঠামো। সেই সাথে গড়ে তুলতে হবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম আধুনিক ও দক্ষ জনবল। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর আওতায় প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ৪৫টি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে অভ্যন্তরীণ নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএ। বিভিন্ন মেয়াদে ২০৩০ সালের মধ্যে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের এই ৪৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে সাকল্যে ৬৯ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা।
প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ১০ বছর মেয়াদি সম্ভাব্য যে ৪০টি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে তার মধ্যে ছয়টি বিআইডব্লিউটিএ’র প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি-সংক্রান্ত। ২০৩০ সালের উপযোগী দক্ষ ও কার্যকর কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের ডিজিটাইজেশন নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যাবে। ড্রেজিং কার্যক্রম থেকে শুরু করে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সবকিছুতেই স্বচ্ছতা ও দক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
একদিকে প্রাকৃতিক ও মরফোলজিক্যাল প্রক্রিয়া, অন্যদিকে নদীর উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে অভ্যন্তরীণ নৌপথের নাব্যতা এক সময় অস্বাভাবিক হ্রাস পায়। ১৯৭৫-পরবর্তী দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নৌপথকেন্দ্রিক সুদূরপ্রসারী কোনো লক্ষ্য না থাকায় নাব্যতা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। নৌপথের নাব্যতা ফেরাতে ১৯৮৮-২০০৫ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ২২ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৭০ লাখ ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন বলে প্রাক্কলন করে ডিএইচভি কনসালট্যান্ট। ২০০৯ সালে ইনল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যানে বার্ষিক ১ কোটি ৮০ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের কথা বলা হয়। বর্তমান সরকারের ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালুর লক্ষ্যে বার্ষিক সাড়ে ১৬ কোটি ঘনমিটারের বেশি ড্রেজিংয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রথম পর্যায়ে প্রস্তাবিত ১০ বছর মেয়াদি প্রকল্প প্রস্তাবের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টিতে বিশেষ জোর দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এই পর্যায়ে ১০ বছর মেয়াদি প্রস্তাবিত সম্ভাব্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৯টিই ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত। ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২৭ মেয়াদি ‘ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ঝিনাই (টাঙ্গাইল), ঘাঘট (নীলফামারী, রংপুর), বংশী (টাঙ্গাইল, গাজীপুর) এবং নগদা নদীর নাব্যতা ফেরানো এবং বন্যা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন’; ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২৬ মেয়াদি ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও রাঙ্গামাটি-থেগামুখ নৌপথের নাব্যতা ফিরিয়ে আনা এবং নৌ পর্যটনের উন্নয়ন’; সম্ভাব্য ৮৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২৯ মেয়াদি ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন নদীর নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার’; ৭৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২৪ মেয়াদি ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে গোমতী নদীর নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার’; সম্ভাব্য ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০৩০ মেয়াদি ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন নদীর নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার’; সম্ভাব্য ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০৩০ মেয়াদি ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বরিশাল বিভাগের নদ-নদীর নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার’ ও ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০৩০ মেয়াদি ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে দেশের ৫০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিকটবর্তী নদীর নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার’ শীর্ষক প্রকল্পগুলো এর মধ্যে অন্যতম। ‘ঢাকার চারপাশের নৌরুটকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীতকরণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্পও সম্ভাব্য প্রকল্পের তালিকায় রাখা হয়েছে। প্রাক্কলিত ৪ হাজার কোটি ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০২৭ সালের জুলাইয়ে সম্পন্ন করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
ঢাকার চারপাশের নদীগুলো স্থায়ীভাবে দখলমুক্ত করে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি ও নদীতীরের সৌন্দর্য বাড়ানো সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। এ লক্ষ্যে ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমির পিলার স্থাপন, তীর রক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের কাজ চলমান। ৮৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের কাজে ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। এ কার্যক্রমকে আরো বিস্তৃত করতে ‘ঢাকার চারপাশের নদীতীরে ওয়াকওয়ে ও আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্পও ব-দ্বীপ পরিকল্পনার অধীনে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০৩০ মেয়াদি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং সক্ষমতা ও উদ্ধারকারী জাহাজের বহর শক্তিশালী ও আধুনিকায়নেও একাধিক প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০ বছর মেয়াদি ২১ প্রকল্প : উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে অদম্য বাংলাদেশের চূড়ান্ত লক্ষ্য ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়া। সেই অভীষ্টে পৌঁছতে প্রবৃদ্ধির চাকায় আরো গতি আনতে হবে। ২০৪১ সাল নাগাদ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধির ওপর ভর দিয়ে অতিদারিদ্র্য নেমে আসবে ১ শতাংশের নিচে। আর দারিদ্র্য ৩ শতাংশ। পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যমের মতোই অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতেও সে পর্যন্ত ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১-এ ২০৪১ সালে অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮৪৩ বিলিয়ন প্যাসেঞ্জার কিলোমিটার। একই সময়ে নৌপথে কার্গো পরিবহনের চাহিদা তৈরি হবে ৭৪ বিলিয়ন টন কিলোমিটার। বিপুল এই চাহিদার চাপ সামাল দিতে নৌপথের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন পড়বে নৌপথের পরিসর ও নাব্যতা বৃদ্ধির। নদীবন্দরের সংখ্যা বাড়ানোর সাথে চাহিদা তৈরি হবে কার্গো হ্যান্ডলিং সুবিধারও। সর্বোপরি গড়ে তুলতে হবে ২০৫০ সালের চাহিদা পূরণে সক্ষম দক্ষ মানবসম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ২০ বছর মেয়াদি মোট ২১টি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে বিআইডব্লিউটিএ। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭১ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা।
এই পর্যায়ে প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে টাকার অংকে সর্ববৃহৎ ‘ড্রেজিং ও নেভিগেশনাল এইডের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথ ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার কিলোমিটারে উন্নীতকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি। ২০৩৫ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০৫০ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি সম্পন্ন করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। সম্ভাব্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। রুটের শ্রেণি উন্নয়নের কয়েকটি প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে এই মেয়াদে। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সামনে নৌ পর্যটনের যে বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে তাকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনাও করেছে বিআইডব্লিউটিএ। ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌ পর্যটন সুবিধাদি ও পরিবেশসম্মত বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি তেমনই একটি প্রকল্প। ২০৩২ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে ২০৪০ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি সম্পন্ন করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
আমদানি-রপ্তানির ওপর ভর করে নৌপথে পণ্য পরিবহনের বিপুল চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে কার্গো হ্যান্ডলিং সুবিধা প্রদানে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভ্যন্তরীণ নৌ টার্মিনাল নির্মাণের পাশাপাশি নদীবন্দরের সংখ্যা ৭৫টিতে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। ‘রাজশাহী, ঢালার চর, বিরা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কুড়িগ্রামের মতো দেশের বিভিন্ন স্থানে অভ্যন্তরীণ নৌ টার্মিনাল স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় দাঁড়াবে ৯ হাজার কোটি টাকা। সম্ভাব্য বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে জুলাই ২০৩৫ থেকে জুন ২০৫০। ৮ হাজার কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয়ে ‘নদীবন্দরের সংখ্যা ৫০ থেকে ৭৫টিতে উন্নীতকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরুর সময় ধরা হয়েছে ২০৩২ সালের জুলাইয়ে, ২০৪০ সালের জুনে যা সমাপ্ত হবে। এছাড়া ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আওতায় ৬ হাজার কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয়ে দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় ১০০টি ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাবও রেখেছে বিআইডব্লিউটিএ। ২০৩২ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে ২০৪০ সালের জুন নাগাদ শেষ হবে প্রকল্পটি। এর বাইরে বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজার, উদ্ধারকারী জাহাজ ও জরিপ জাহাজের বহর শক্তিশালী করার একাধিক প্রকল্পও প্রস্তাব করা হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য।
৩০ বছর মেয়াদি ১৪ প্রকল্প : ১৫ হাজার কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ নৌপথ চালুর পর বিশাল বিস্তৃত এই নৌপথের নাব্যতা ধরে রাখাই হবে বিআইডব্লিউটিএ’র প্রধান চ্যালেঞ্জ। সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের বিপুল কর্মযজ্ঞ ধারাবাহিকভাবে সম্পাদনে শক্তিশালী করতে হবে ড্রেজারের বহর। পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনার পর দ্রুততার সাথে দক্ষ হাতে কার্যকরভাবে উদ্ধার তৎপরতার প্রয়োজন পড়বে। আধুনিকায়ন করতে হবে সেবার মান। সেই প্রশিক্ষণেও জোর দিতে হবে। এসব অভীষ্টকে সামনে রেখেই তৃতীয় ও সর্বশেষ পর্যায়ে ৩০ বছর মেয়াদি ১৪টি প্রকল্প ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আওতায় বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছে বিআইডব্লিউটিএ। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।
তৃতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ‘১৫ হাজার কিলোমিটার নৌপথে সংরক্ষণ ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা’ শীর্ষক প্রকল্পটি। সম্ভাব্য ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির ২০৫১ সালের জুলাই মাসে শুরুর প্রস্তাব করা হয়েছে, যেটি শেষ হবে ২০৯০ সালের জুন মাসে। বিপুল এই কর্মকা- যাতে সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় সে লক্ষ্যে ‘৩টি ১২ ইঞ্চি, ৫টি ১৮ ইঞ্চি, ৪টি ২০ ইঞ্চি, ৫টি করে ২৪ ইঞ্চি, ২৬ ইঞ্চি ও ২৮ ইঞ্চির ড্রেজার, ২৮টি করে ক্রেন ও ক্রু হাউজ বোট, ১০টি করে অফিসার’স হাউজ বোট ও টাগবোট, ১৪টি পাইপ বহনকারী, ৬টি করে তেল ও পানিবাহী বার্জ, ৬টি জরিপ জাহাজ এবং ১৪টি সার্ভে ওয়ার্ক বোট সংগ্রহ’ শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাবও করা হয়েছে। জুলাই ২০৫০ থেকে জুন ২০৫৫ মেয়াদি প্রকল্পটিতে ব্যয় হতে পারে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এই পর্যায়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘জেলাভিত্তিক উদ্ধারকারী ইউনিট গঠনের লক্ষ্যে ডাইভিং ইকুইপমেন্ট ও সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম সংগ্রহ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আওতায় বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছে বিআইডব্লিউটিএ। দেশের সব নদীবন্দরে সুবিধাদি বাড়াতে প্রস্তাব করা হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরো একটি প্রকল্প। ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আওতায় সর্বশেষ যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছে বিআইডব্লিউটিএ, তার অধীনে কেনা হবে দুটি আধুনিক প্রশিক্ষণ জাহাজ। জুলাই ২০৯৫ থেকে জুন ২১০০ মেয়াদি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য খরচ দাঁড়াবে ৮০ কোটি টাকা।
শেষ কথা
বাংলাদেশের মানুষ নদীর ওপর নির্ভর করতে শিখেছে কেবল সুপেয় পানি, কৃষি, খাদ্য বা আশ্রয়ের প্রয়োজনে নয়। যাত্রী কিংবা পণ্য স্থানান্তরেরও সবচেয়ে সুগম, সাশ্রয়ী মাধ্যম হিসেবে প্রমাণিত এসব নদী। এই মাধ্যমই এখন জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুষ্ক মৌসুমের স্থায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় নৌপথের নাব্যতা হ্রাসের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সাইক্লোন ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন অবকাঠামোর বিপর্যয় ডেকে আনছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাব বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০। আর এ পরিকল্পনার আওতায়ই বিআইডব্লিউটিএ’র প্রস্তাবিত ৮০ প্রকল্প, যা বাস্তবায়নে প্রয়োজন বিপুল অর্থের। এই অর্থের বড় অংশ আনতে হবে জলবায়ু তহবিল থেকে, আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর কাছ থেকে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নিঃসন্দেহে সরকারের পরিকল্পিত মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন। জিডিপিতে হিস্যা বাড়বে। গতি আসবে প্রবৃদ্ধিতেও, যা আমাদের পৌঁছে দেবে উন্নত দেশের বন্দরে। ধরা দেবে দারিদ্র্যমুক্ত কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ।