বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
16 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

ঢাকার চারপাশের নদী বিবর্ণ তীরের নান্দনিক রূপান্তর

এক দিকে অগুনতি শিল্প থেকে নির্গত বিষবর্জ্য। অন্যদিকে নদীর পাড় দখল করে অসংখ্য অবৈধ নির্মাণ। এসবের সম্মিলিত আঘাতেই শীর্ণ নদী আরও বিশীর্ণ। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর ছবিটা ছিল এমনই। সেই ছবিতেই এখন বদলের ধারা। সুসংহত পরিকল্পনায়, উদ্যমী কর্মে। নদী রক্ষায় দৃশ্যমান স্থায়ী সীমানা পিলার; পাড় ধরে ওয়াকওয়ে, পার্ক।

প্রাক-কথা

গঙ্গা পরিভ্রমণের পরিক্রমায় দূর ভবিষ্যতের নদীর রূপ দেখতে পেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। কণ্ঠ ভারী করে একদিন বলেছিলেন, ‘এই বেলা এই গঙ্গা-মার শোভা যা দেখবার দেখে নাও, আর বড় একটা কিছু থাকছে না। দৈত্য-দানবের হাতে পড়ে এসব যাবে। এই ঘাসের জায়গায় উঠবে ইটের পাঁজা, আর নামবে ইটখোলার গর্তকুল। যেখানে গঙ্গার ছোট ছোট ঢেউগুলো ঘাসের সাথে খেলা করছে, সেখানে দাঁড়াবে পাটবোঝাই ফ্ল্যাট, আর সেই গাধা-বোট, ওই তাল-তমাল আর নিলের রঙ। ওই নীলাকাশ, মেঘের ব্যবহার ওসব কি আর দেখতে পাবে? দেখবে পাথুরে কয়লার ধোঁয়া। তার মাঝে মাঝে ভূতের মতো অস্পষ্ট দাঁড়িয়ে আছে কলের চিমনি।’

স্বামীজীর এই নদী-ভাবনা, গঙ্গা ছাড়িয়ে প্রায় সব নদীর বেলায়ই সত্য। আমাদের এই ভূখণ্ডে আরও বেশি করে সত্য। বুড়িগঙ্গা থেকে তুরাগ বা ধলেশ্বরী, বালু থেকে শীতলক্ষ্যা সবখানেই দূষণের বিষবাষ্প আর দখলের ক্ষতচিহ্ন। তীর দখল করে গড়ে তোলা শিল্পের চিমনি বেয়ে কোথাও কালো ধোঁয়ার উদ্গিরণ তো কোথাও ইট-সিমেন্টের সুরম্য দালান। এসব দালানের কোনোটি আবাসিক, কোনোটি আবার বাণিজ্যিক। দখলের এই আগ্রাসনে জীবনদায়ী নদী তাই বিশীর্ণ-কৃষকায়।

শীর্ণশরীরী মৃতপ্রায় এসব নদীকে এবার প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। বর্তমান সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কয়েক বছর ধরে সেই কাজটিই করে চলেছে অভ্যন্তরীণ নৌপথের সংরক্ষক বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। দখলদারদের হাত থেকে তীরভূমি মুক্ত করে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে নদীর কাছে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো আবার যাতে বন্দি না হয়, চলছে সেই আয়োজনও। স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন করে নদীতীরে নির্মিত হচ্ছে ওয়াকওয়ে। চলছে ইকোপার্ক নির্মাণ, বনায়নসহ অন্যান্য কর্মযজ্ঞ।

ঢাকার চারপাশের নদী ভরাট দূষণ পরিক্রমা

স্বচ্ছ পানি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে এককালে শীতলক্ষ্যার সুনাম ছিল সুবিদিত। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ব্রিটিশদের আগমনের পর অনেক দিন পর্যন্ত সবাই এই নদীর পানির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। সেকালে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য অনেকেই শীতলক্ষ্যার বুকে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। শীতলক্ষ্যার পানি কতটা সুপেয় ছিল তৎকালীন ডেভিড কোম্পানিই তার প্রমাণ। এই পানি দিয়ে তারা সোডা ওয়াটার বানিয়ে বোতলের গায়ে লিখে দিত ‘মেড বাই শীতলক্ষ্যা ওয়াটার’।

তুরাগ নদ ছিল এককালে টঙ্গীবাসীর আশীর্বাদ। আর বুড়িগঙ্গার অতীত তো উজ্জ্বল বর্ণমালায় প্রদীপ্ত। ১৮৪০ সালে লেখা জেমস টেলরের ‘টপোগ্রাফি অব ঢাকা’ তার সাক্ষী। টেলর সাহেবের লেখায় বুড়িগঙ্গার মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে ঢাকা। সেই সময় তিনি লেখেন, ‘ধলেশ্বরীর সাথে বুড়িগঙ্গার সঙ্গমস্থলের উপরে বুড়িগঙ্গার উত্তর তীরে ঢাকার অবস্থান। এইখানে নদীটি বেশ গভীর ও নৌকা চলাচলের উপযোগী। বর্ষাকালে নদী বেশ প্রশস্ত হয়। মিনার ও বৃহৎ অট্টালিকা শোভিত ঢাকা শহরকে তখন পাশ্চাত্যের জলোত্থিত ভেনিস নগরী বলে মনে হয়।’

বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদকে আশ্রয় করেই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীর শিল্প-বাণিজ্যের পত্তন। এদের আশীর্বাদেই প্রসার। পত্র-পল্লবে বিকশিত মহীরুহ এই শিল্পের অনাচারে সেই নদীরই বিপন্নতা। নদীর তলদেশে নানা আবর্জনার ১০-১২ ফুট স্তর। বিপন্ন নদীর পরিবেশ, ব্যবহার অযোগ্য এর পানিও। শুধু শিল্পের বর্জ্য নয়, মানববর্জ্য, বিভিন্ন ধরনের কঠিন বর্জ্য এবং সিটি করপোরেশন, ওয়াসা ও পৌরসভার বর্জ্যও ভরাট করেছে নদীর তলদেশ। বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী দূষণের জন্য দায়ী ৬০ শতাংশই শিল্প বর্জ্য। এর মধ্যে ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশই ট্যানারি বর্জ্য। এছাড়া দূষণের জন্য দায়ী পলিথিন, গার্বেজ, নারকেলের ছোবড়া, কাদামাটি ও বালু, মেডিকেল বর্জ্যরে মতো কঠিন বর্জ্যরে হিস্যা ১৫ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ মানববর্জ্য। নদী এলাকায় বসবাসকারী মানুষ ও নৌপথে চলাচলকারী নৌযান দ্বারাও ১০ শতাংশ দূষিত হচ্ছে এসব নদী। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর এ দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫টি।

১. কঠিন বর্জ্য

বর্জ্যরে উৎপত্তি বহুদিন আগে থেকেই, মনুষ্য কর্মকাণ্ডের অঙ্গ হিসেবে। তবে তখনকার দিনের বর্জ্যগুলো ছিল বায়ো ডিগ্রেডেবল (ভঙ্গুর)। তাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই সেগুলো পুনরাবর্তিত হতো। শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী যুগে প্রাকৃতিক সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও জীবনযাপনকে আরও সহজ, ভোগ্য ও আধুনিক করার তাগিদে বেড়েছে প্রাণ-প্রকৃতির জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারী নন-বায়ো ডিগ্রেডেবল বা কঠিন বর্জ্যরে। পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য, হাটবাজারের বর্জ্য ও বালু ব্যবসার ফলে সৃষ্ট বর্জ্য এর মধ্যে অন্যতম।

১.১. পয়ঃবর্জ্য: পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধনের দায়িত্ব মূলত ঢাকা ওয়াসার। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীতে প্রতি বছর পয়ঃবর্জ্য উৎপন্ন হয় প্রায় ১৩ লাখ ঘনমিটার। এর মধ্যে পরিশোধনক্ষম ১ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার। পাগলা পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনাগারের মাধ্যমে মাত্র ৫০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন করা হচ্ছে। বাকি ১২ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে পড়ছে, যা নদীর পানির গুণগত মানের অবনতি ঘটাচ্ছে। ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে নদীর পানি।

১.২. গৃহস্থালি বর্জ্য: ঢাকার গৃহস্থালি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। পর্যাপ্ত ডাস্টবিন এবং ট্রান্সফার স্টেশন না থাকায় এই বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনাও সঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে পয়ঃবর্জ্যরে মতো গৃহস্থালি বর্জ্যও সরাসরি নদীতে গিয়ে মিশছে। এর একটি বড় অংশ নাগরিকরা সরাসরি নদীতে ফেলছে। সিটি করপোরেশনের মাধ্যমেও বিভিন্নভাবে এই বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ছে।

১.৩. হাটবাজারের বর্জ্য: নদীর তীরে হাঁটবাজারে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব বর্জ্যরে পাশাপাশি বিভিন্ন আড়ত, দোকান থেকে পচা ফল, মাছ, সবজি ও পলিথিন জাতীয় কঠিন পদার্থও সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে নদীর দূষণ তো হচ্ছেই, তলদেশও ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

১.৪. বালুর ব্যবসার ফলে সৃষ্ট বর্জ্য: ঢাকার চারপাশের নদীর পাড় ঘেঁষে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে বালুর ব্যবসা। এসব বালুও নদীতে পড়ে তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

২. শিল্প বর্জ্য

শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে বর্জ্য উৎপন্ন হয় তাই শিল্প বর্জ্য। এটা কঠিন হতে পারে আবার অর্ধকঠিন বা তরলও হতে পারে। শিল্পে উৎপন্ন এই বর্জ্যে নদী যেমন দূষিত হয়, একইভাবে দূষিত হতে পারে আশপাশের মাটি, লেক এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিও। শিল্প বর্জ্যে ঢাকার চারপাশের নদীদূষণের বড় উৎস ট্যানারি বর্জ্য এবং টেক্সটাইল ডায়িং, পোশাক শিল্প ও অন্যান্য কলকারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য।

২.১. ট্যানারি বর্জ্য: হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকে একসময় দৈনিক প্রায় ২১ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে নিক্ষিপ্ত হতো। ট্যানারি থেকে নিক্ষিপ্ত বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিসহ নদীর তলদেশ এবং উভয় পাড়ের মাটি ও বাতাসকে ভয়ংকরভাবে দূষিত করে তোলে। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। ১০০টির মতো ট্যানারি ইতোমধ্যেই সেখানে উৎপাদন শুরু করেছে। তবে সেগুলোর বর্জ্যও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি পরিশোধিত হচ্ছে না। ফলে বুড়িগঙ্গার পরিবর্তে এখন ধলেশ্বরীর পানি দূষিত হচ্ছে।

২.২. কল-কারখানার বর্জ্য: টেক্সটাইল, ডায়িং, পোশাক ও অন্যান্য কলকারখানার তরল বর্জ্যও ঢাকার চারপাশের নদীদূষণের অন্যতম উৎস। এসব কলকারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৯০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য সরাসরি নদীতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। অধিকাংশ শিল্প-কারখানাগুলোর ইটিপি না থাকায় এবং থাকলেও সেগুলো চালু না রাখার কারণে এসব শিল্প-কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি নদীতে গিয়ে মিশছে এবং নদীর পানি দূষিত করছে।

৩. অন্যান্য বর্জ্য

অন্যান্য বর্জ্যরে মধ্যে নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন হাসপাতালের মেডিকেল বর্জ্য অনেক সময় সরাসরি নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে নদীর পরিবেশ ও পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। এছাড়া নদীতে চলাচলকারী নৌযান থেকে তেল, পয়ঃ এবং কঠিন বর্জ্যও সরাসরি নদীতে পড়ছে। নদীর পাশে অবস্থিত ইটভাটার কারণেও নদীর দূষণ হচ্ছে। দূষণের আরেকটি বড় কারণ ব্যবহৃত পলিথিন নদীতে ফেলে দেওয়া। এর ফলে কেবল দূষণ নয়, নদীর তলদেশ ভরাটও হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি নদীর পাড়ে যত্রতত্র গড়ে ওঠা অসংখ্য ডকইয়ার্ডে সৃষ্ট বিভিন্ন ধরনের বর্জ্যও নদীদূষণের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জনগণের সচেতনতার অভাবও এজন্য দায়ী।

দখল পরিক্রমা

নদী দখলের ইতিহাস খুঁজতে চাইলে ঢাকার প্রাণরেখা বুড়িগঙ্গার কাছে যেতে হবে সবার আগে। বিআইডব্লিউটিএ’র সীমানা পিলারের তোয়াক্কা না করে বুড়িগঙ্গার বুকে দখলের রাজত্ব কায়েম হয়েছে বারবার। এটা গতি পায় মূলত দুই দশক আগে, বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর মিলনস্থল থেকে। যমুনা ও ধলেশ^রীর প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় একসময় বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলেও পানি কমতে শুরু করে। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় দখলদারেরা। বুড়িগঙ্গার আদি ধারাটি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করতে থাকে। সদরঘাট টার্মিনাল থেকে গাবতলী ব্রিজ পর্যন্ত নদীর দুই ধারে গড়ে ওঠে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। আইনের তোয়াক্কা না করে ডকইয়ার্ডগুলোও নদীতে রেখেই জাহাজ মেরামত করতে থাকে।

বুড়িগঙ্গার পর ভয়ংকর আগ্রাসনের মুখে পড়তে হয় একদা স্বচ্ছ ও সুপেয় পানির নদী শীতলক্ষ্যাকে। মূলত নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর ঘিরেই চলে দখলের এই মচ্ছব। নদীর তীর বেঁধে ফেলে নির্মাণ করা হয় ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য স্থাপনা। সময়ের পরিক্রমায় বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার মতো তুরাগ ও বালু নদকেও জোর করে বেঁধে ফেলতে থাকে মানুষ। পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহের অভাবে শুকিয়ে মরে যাওয়া নদীবক্ষে উঠতে থাকে বাড়িঘর, দোকান, কারখানা।

মুক্তির পথরেখা

জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদী ঘিরেই আমাদের জীবন। কৃষি, পরিবহন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সভ্যতা ও ইতিহাসের বিকাশও এই নদী ঘিরেই। আমরা নদীরই সন্তান, আমাদের জন্য নদীর সেবা তাই অবিশ্রান্ত। তবে নদীও যেন স্বস্তি পায়, সে বিষয়টিও এখন আলোচিত হচ্ছে জোরেশোরে। নদী যাতে মুক্ত ধারায় প্রবাহিত হতে পারে সেই উদ্যোগই চলছে; আইন করে এবং সেই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে।

২০১১ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সংবিধানে ১৮ক নামে যে ধারাটি সংযোজন করা হয়েছে, নদী রক্ষার বিষয়টি তার মধ্যেই নিহিত আছে। ধারাটিতে পরিষ্কার করে বলা আছে- ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ অর্থাৎ সব প্রাকৃতিক সম্পদের মতো নদীকেও যেকোনো আগ্রাসন, তা সে দখল হোক বা দূষণ, রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

নদী রক্ষায় উচ্চ আদালত থেকেও একাধিক রায় এসেছে। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রায়টি আসে ২০০৯ সালে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ, অবৈধ দখল ও নদীর ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের বৈধতা নিয়ে দায়ের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৯ দফা নির্দেশনাসহ রায় দেয় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। নির্দেশনায় সিএস ও আরএস ম্যাপ অনুসারে নদীগুলোর সীমানা জরিপ করা ও সীমানা পিলার স্থাপন করতে বলা হয়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠনেও সরকারকে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয় রায়ে।

সেই মোতাবেক ২০১৩ সালে নদী রক্ষা কমিশন আইন পাস হয়েছে। আইনটির বলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নামে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে-নদীর অবৈধ দখল, শিল্প-কারখানা কর্তৃক নদীদূষণ, নদীর উপর অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অপরাধ রোধ করা। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নদীকে নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করাও কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

২০১৯ সালে উচ্চ আদালতের আরেকটি রায়ে তুরাগকে আইনিসত্তা বা জীবন্তসত্তা ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি বলা হয়, বাংলাদেশের মধ্যে এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সব নদ-নদী একই মর্যাদা পাবে। এগুলো রক্ষা ও সংরক্ষণে নদী রক্ষা কমিশনকে ‘আইনগত অভিভাবক’ ঘোষণা করা হয়।

বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব নদ-নদীর নাব্যতা রক্ষা ও দখলমুক্ত করতে ২০১৪ সালে ৩৭ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে রাখা হয় শিল্প, স্থানীয় সরকার, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, পানিসম্পদ, পরিবেশ ও বন, আইন ও ভূমিমন্ত্রীকে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সচিব, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও টাস্কফোর্সে সদস্য করা হয়। ঢাকার আশপাশের চার নদীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদী রক্ষায় প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও পরামর্শ প্রদান এবং তা বাস্তবায়নে ৩৮টি সভা করে এ টাস্কফোর্স। আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্‌মুদ চৌধুরী এমপির নেতৃত্বে আরও একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।

বিআইডব্লিউটিএ’উদ্যোগ বাস্তবায়ন 

ঢাকার চারদিকের নদীগুলোর প্রবাহ বিঘিœত হওয়ার শুরু বহু আগে থেকেই। প্রায় দেড়শ বছর আগে থেকেই বুড়িগঙ্গার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বুড়িগঙ্গার মুখে চর পড়ার খবর উঠে এসেছে সেই ১৮৮৬ সালেই পত্রিকার পাতায়। পাকিস্তান আমলেও নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগর প্রশাসনের চিন্তায় বুড়িগঙ্গা তথা ঢাকার চারপাশের নদীগুলো তেমন স্থান পায়নি। তারপর কেটে গেছে বহু বছর। নদীগুলোর গতিপ্রবাহে ভাটা পড়েছে। শিল্প ও পয়ঃবর্জ্য নির্গমনের পরিমাণ বেড়েছে। জঞ্জালের চাপে পথ হারানো এসব নদীকেই এবার পথ দেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। উদ্যোগের দৃশ্যমান সাফল্যও ইতোমধ্যে এসেছে।

১. নৌপথ পুনরুদ্ধার ও সৃষ্টি

ঢাকা শহরের যানজট নিরসন ও পরিবেশ উন্নয়নের কথা বিবেচনায় নিয়ে আশপাশের নৌপথগুলো উন্নয়নের বিষয়টি আলোচনায় আসে ৯০-এর দশকে। ১৯৯৩ সালের ৩ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে গ্রেটার ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্ট স্টাডি (ডিআইটিএস) শীর্ষক স্টাডির ওপর অনুষ্ঠিত স্টিয়ারিং কমিটির সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিআইডব্লিউটিএ ঢাকা শহরের চারদিকে নৌপথ চালুকরণের নিমিত্তে একটি প্রাথমিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষার আলোকে ‘ঢাকা শহরের চারদিকে নৌপথ চালুকরণ (১ম পর্যায়): সদরঘাট থেকে আশুলিয়া ব্রিজ পর্যন্ত নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন ও ল্যান্ডিং সুবিধাদি প্রদান’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রায় ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০০০ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়ে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়। এর ফলে সদরঘাট থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত নতুন নৌরুটের সৃষ্টি হয়। সারা বছর পানির প্রবাহ থাকায় এই অংশে নৌযান চলাচলের পাশাপাশি পরিবেশেরও উন্নয়ন হয়েছে। মৎস্য চাষ ও সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি থাকছে। ছোট ছোট দেশীয় নৌকায় সারা বছরই পর্যটকেরা ভ্রমণ করছেন।

প্রকল্পটির সাফল্যে আশুলিয়া ব্রিজ থেকে টঙ্গী হয়ে কাঁচপুর পর্যন্ত নৌপথের নাব্যতা উন্নয়নে ‘ঢাকা শহরের চারদিকে বৃত্তাকার নৌপথ চালুকরণ (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করে বিআইডব্লিউটিএ। সাড়ে ৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালের জুলাইয়ে এবং ২০১২ সালের জুনে সমাপ্ত হয়। এর ফলে সোয়ারীঘাট থেকে আশুলিয়া-টঙ্গী হয়ে কাঁচপুর পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার খননের মাধ্যমে ঢাকা শহরের চারদিকে ১১০ কিলোমিটার নৌপথ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকার অভ্যন্তরের রামপুরা, বাড্ডা/শাহজাদপুর ও গোবিন্দপুর খাল তিনটি খননের মাধ্যমে ড্রেনেজ ব্যবস্থাও উন্নত হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সোয়ারীঘাট থেকে মিরপুর পর্যন্ত ২০০ ফুট প্রশস্ত ও ১৪ ফুট গভীর এবং মিরপুর থেকে আশুলিয়া-টঙ্গী হয়ে কাঁচপুর পর্যন্ত ১২০ ফুট প্রশস্ত ও ৮ ফুট গভীরতার নৌপথ সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকল্পগুলোর আওতায় মোট ১৪টি স্থানে ল্যান্ডিং স্টেশনও নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে নির্মাণ করা হয়েছে ১০টি স্টেশন। এগুলো হলো সোয়ারীঘাট, নবাববাগ, খোলামুড়া, রায়েরবাজার, বসিলা/ঝাউচর, গাবতলী, আমিনবাজার, সিন্নিরটেক, বিরুলিয়া ও আশুলিয়া। দ্বিতীয় পর্যায়ে টঙ্গী, ইছাপুরা, কায়েতপাড়া ও কাঁচপুরে আরও চারটি ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ল্যান্ডিং স্টেশনগুলো ইজারা দেওয়ার ফলে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্বও আসছে।

নাব্যতা বৃদ্ধি: একদা অবিরাম-অবিশ্রাম গতিতে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গা, ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেওয়া সুন্দরতম শীতলক্ষ্যা, টঙ্গীর আশীর্বাদের উপাধেয় তুরাগের জলতরঙ্গ আবার ফিরিয়ে আনতে তৎপর সরকার। ঢাকার চারপাশের এসব নদীসহ কর্ণফুলীর দখল, দূষণরোধ ও নাব্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি মাস্টারপ্ল্যান ইতোমধ্যেই প্রণয়ন করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানটি বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিপরিষদ কমিটিও গঠন করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানের সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধি এর মধ্যে অন্যতম। এর অংশ হিসেবে বালু নদ ও টঙ্গী খালের বেজলাইন ফিজিবিলিটি স্টাডির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদনের পর থেকে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় স্থানসমূহে সারা বছর ড্রেজিংও করছে সংস্থাটি। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর সাথে সংযুক্ত ২ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার হাইক্কার খাল, ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার চারারগোপ খাল এবং রামপুরা, বাড্ডা/শাহজাদপুর ও গোবিন্দপুরের তিনটি খালের প্রায় ১৩ কিলোমিটার খননের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।

ঢাকার চারপাশের নদীই কেবল নয়, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সারা দেশের নদীর নাব্যতা রক্ষায় বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে ড্রেজারের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। ‘৩৫টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযানসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় আরও ড্রেজ ম্যাটেরিয়াল ক্যারিং বার্জসহ একটি পন্টুন, মাউন্টেড গ্রাব ড্রেজার, ৫টি এম্ফিবিয়ান এক্সকাভেটর সংগ্রহের কাজও চলছে।

বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেই নদী রক্ষার অঙ্গীকারের কথা বলা আছে। তার আলোকে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর প্রশস্ততা ও গভীরতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে প্রায় ২১৬ লাখ ঘনমিটার মাটি খনন করলে শুস্ক মৌসুমেও প্রায় পুরো নদীতে ১০-১৩ ফুট গভীর ও ২০০-৩০০ ফুট প্রশস্ত নৌপথ সৃষ্টি হবে। সে লক্ষ্যেই কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ।

২. দূষণরোধ

শীতলক্ষ্যার মোহনায় মিলিত হয়েছে গাজীপুরের বেলাইবিল, টঙ্গীর তুরাগ ও বেরাইদ ডেমরা এলাকার বালু নদ। শিল্পনগরী টঙ্গীর কল-কারখানার বর্জ্য দীর্ঘদিন ধরে এই নদীতেই ফেলা হয়। এতে বালু নদের পানির রঙ বদলে কালচে ও সবুজ বর্ণ ধারণ করে। বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রিতি বালু নদের পানি শীতলক্ষ্যায় পৌঁছে দূষিত করছে তার পানিকেও। শিল্প ও কল-কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যে বুড়িগঙ্গার পানিও ঘোলা, বিষাক্ত ও আবর্জনাময়।

নদীগুলোর এই দূষণের জন্য দায়ী শিল্প-কারখানার বর্জ্য, পয়ঃবর্জ্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে ২২৬টি বর্জ্য উৎসমুখ এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গা তীরের সাতটি রেডিমিক্স কারখানার বর্জ্যনিক্ষেপণ মুখ ও শীতলক্ষ্যা তীরে ৪২টি পয়ঃবর্জ্য নিক্ষেপণ মুখ ইতোমধ্যেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

যাত্রীবাহী নৌযানের কঠিন বর্জ্যও নদীদূষণের অন্যতম কারণ। এসব বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করতে বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে নৌযান মালিক সমিতিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যাত্রীবাহী নৌযানে বিন স্থাপন করে তা থেকে কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এছাড়া ঢাকার চারপাশের নদীসহ সব নদীর ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল পরিবেশসম্মত উপায়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্যোগে স্থানীয় জনগণের সাথে আলোচনা ও তাদের উৎসাহিত করে সমন্বয়ের মাধ্যমে সরকারি/ব্যক্তিমালিকানাধীন নিচু জমিতে ডাইক নির্মাণ করে সেখানে ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ফেলা হচ্ছে।

পাইলট ভিত্তিতে বুড়িগঙ্গার ৩ কিলোমিটার ও তুরাগ নদের ১ কিলোমিটারে প্রায় ৮ দশমিক ৪৪ লাখ ঘনমিটার পলিথিনসহ বর্জ্য ইতোমধ্যেই অপসারণ করা হয়েছে। নদীতীরের বর্জ্য অপসারণের জন্য ৯টি লংবুম এক্সকাভেটার সংগ্রহের পর সেগুলো দিয়ে নিয়মিত উচ্ছেদ ও বর্জ্য অপসারণ অব্যাহত রয়েছে।

৩. হাজার ২০০ সীমানা পিলার স্থাপন

নদীর জমি যাতে কেউ আর দখল করতে না পারে সে লক্ষ্যে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতের এক আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন, গণপূর্ত বিভাগ ও জরিপ অধিদপ্তরের সাথে যৌথ জরিপের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীর ফোরশোর লাইন (তটরেখা) ও তীরভূমি চিহ্নিত করে বিআইডব্লিউটিএ। সিএস এবং আরএস মৌজা ম্যাপের ভিত্তিতে সীমানা চিহ্নিতের কাজটি করা হয়। পরবর্তীতে গণপূর্ত বিভাগ সীমানা চিহ্নিত এলাকায় পিলার স্থাপন করে। কিন্তু পিলারগুলো সঠিক স্থানে না হওয়ায় ২০১২ সালে আপত্তিসহ সীমানা পিলার বুঝে নেয় বিআইডব্লিউটিএ। আপত্তি নিষ্পত্তিতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন সিএস ম্যাপ, আরএস ম্যাপ, ফোরশোর ম্যাপ ও জিপিএস প্রয়োগে আপত্তিকৃত সীমানা পিলারের পুনঃপরীক্ষা শুরু করে, এখনো যা চলমান আছে। বিআইডব্লিউটিএ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের সীমানা নির্ধারণ করে ৭ হাজার ২০০টি পিলার স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৫ হাজার ২০০টি পিলার স্থাপনের কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে।

৪.  অবৈধ দখলমুক্তকরণ

উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে নদীকে দখলমুক্ত করতে অনেক দিন ধরেই অভিযান পরিচালনা করে আসছে বিআইডব্লিউটিএ। তবে দখলদারদের বিরুদ্ধে জোরেশোরে অভিযান শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। বুড়িগঙ্গার কামরাঙ্গীরচর থেকে শুরু হয় নদী উদ্ধার অভিযান। নদী দখলমুক্ত করার এ অভিযানে শুধু বুড়িগঙ্গার দুই পাড়ে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বিআইডব্লিউটিএ। উচ্ছেদকৃত স্থাপনার মধ্যে অবৈধ টিনের স্থাপনা যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে নদীর জায়গায় গড়ে তোলা অসংখ্য বহুতল ভবন ও স্থাপনা। এ থেকে বাদ পড়েনি স্থানীয় প্রভাবশালীদের অবৈধভাবে দখল করা কোটি টাকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও। উচ্ছেদ চলাকালে তুরাগের দুই পাড় টঙ্গী ও আশুলিয়া, বালু, ধলেশ^রী ও শীতলক্ষ্যা দখল করে গড়ে তোলা অসংখ্য অবৈধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দিয়েছে সংস্থাটি।

স্বাধীনতার পর সবচেয়ে জোরালো এই অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার মুখেও পড়তে হয় অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তাদের। কোথাও কোথাও নকল কাগজপত্র তৈরি করে ও নিজেদের ইচ্ছেমতো সীমানা পিলার বসিয়ে উচ্ছেদ ঠেকানোর চেষ্টা করতে দেখা যায় দখলদারদের। তবে এসব অপকৌশলের কোনোটিই উচ্ছেদ আটকাতে পারেনি।

সবমিলিয়ে ২৯ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৩৬ কার্যদিবসেই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের চারপাশের নদী দখল করে গড়ে তোলা ৪ হাজার ১৫টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। নদীর জায়গা অবমুক্ত হয়েছে প্রায় ১১৩ একর। তবে গত এক দশকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ৭১৬ একর তীরভূমি।

ঢাকা নদীবন্দরে উদ্ধার ৪৯৩ একর তীরভূমি:

গত এক দশকে উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি জমি অবমুক্ত করা হয়েছে ঢাকা নদীবন্দরের। ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ঢাকা নদীবন্দর এলাকার ১৬ হাজার ৫২৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এসব অভিযানের মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়েছে ঢাকা নদীবন্দর এলাকার ৪৯৩ দশমিক ১৪ একর তীরভূমি। এই সময় উচ্ছেদকৃত সম্পদ নিলামে তুলে ও অবৈধ দখলের দায়ে জরিমানাসহ আদায় হয়েছে মোট ১৬ কোটি ৯০ লাখ ১৪ হাজার ৯৬০ টাকা।

নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে উদ্ধার ২২৩ একর জমি:

দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালিয়ে গত এক দশকে ২২২ দশমিক ৭৫ একর তীরভূমি উদ্ধার করেছে বিআইডব্লিউটিএ। ২০১০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা তীরের মোট ৪ হাজার ৭৬৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে এই পরিমাণ জমি উদ্ধার করা হয়েছে। উচ্ছেদকৃত এই সম্পদ নিলামে তুলে ও জরিমানা আদায়ের মাধ্যমে আয় হয়েছে মোট ২ কোটি ৮৫ লাখ ৩৬ হাজার ৬০০ টাকা।

এছাড়া ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর এলাকায় অবৈধ দখলের অভিযোগে মামলা হয়েছে দুটি। ১২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে জেল হয়েছে। পাশাপাশি দুই নদীবন্দর এলাকা থেকে ৫০০ টন বর্জ্য অপসারণ ও এক লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হয়েছে।

৫. পুনর্দখল রোধে পদক্ষেপ

উনিশ শতকে নগর পরিকল্পনায় ঢাকার চারপাশের নদী বিশেষ করে বুড়িগঙ্গার একটা স্থান ছিল। কারণ নদীর তীরকে তখন ব্যবহার করা হতো বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে। এবার শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদরে তীরকেও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। নদীর তীরভূমি দখলমুক্ত করার পর আবার তা বেদখল হওয়ার রেওয়াজ ভাঙাও এর আরও একটি উদ্দেশ্য। আর পুনর্দখল রোধে নদীর তীরে আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল/গাইড ওয়াল নির্মাণ করা এবং ওয়ালের কাছে ওয়াকওয়ে, স্টেপ্স/স্টেয়ারস নির্মাণ, জেটি নির্মাণ, বসার বেঞ্চ, বৃক্ষরোপণ সবচেয়ে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকৃত। সে আলোকে উচ্ছেদের পাশাপাশি দখলরোধে নদীর তীর বরাবর ওয়াকওয়ে নির্মাণ করছে বিআইডব্লিউটিএ। ঢাকার চারদিকে নদীর তীরসমূহের মধ্যে গাবতলী/আমিনবাজার, টঙ্গী এলাকা, কাঁচপুর, টানবাজার এলাকা ও শ্যামপুর থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত এলাকা অবৈধ দখলমুক্ত রাখতে প্রায় ২০ কিলোমিটার নদীর তীররক্ষাসহ ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। বুড়িগঙ্গার তীরে শ্যামপুরের কদমতলী ও নারায়ণগঞ্জের খানপুরের তীরভূমি থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়ে এবং বিভিন্ন রাইডস প্রদান করে দুটি দৃষ্টিনন্দন ইকোপার্কও ইতোমধ্যেই নির্মাণ করা হয়েছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫২ কিলোমিটারের তীররক্ষাসহ ওয়াকওয়ে কাজ চলমান আছে। তৃতীয় পর্যায়ে আরও ১৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এ লক্ষ্যে ‘ঢাকা শহরের চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ^রী, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের তীরভূমিতে তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) (জুলাই ২০২১-জুন ২০২৪)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়নের পর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের অগ্রগতি: ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের তীরভূমির পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ২ জুলাই অনুমোদিত হয়েছে। প্রকল্পটির আওতায় ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে ছাড়াও ১০ হাজার ৮২০টি সীমানা পিলার, বনায়ন, তিনটি ইকোপার্ক, ছয়টি পন্টুন, ৪০ কিলোমিটার কি-ওয়াল, ১৯টি আরসিসি জেটি, ৪০টি স্পার্ড ও ৪০৯টি বসার বেঞ্চ নির্মাণ করা হবে। ৮৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়সংবলিত প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

ক্রয় পরিকল্পনা অনুযায়ী মোট ১৮টি প্যাকেজে প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গের কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতিও হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পর ৬টি লংবুম এক্সকাভেটর আগেই সংগ্রহ করা হয়েছে। এক্সকাভেটর পরিচালনার জন্য ছয়টি পন্টুন নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। পূর্ত কাজের মধ্যে প্যাকেজ-১ এর অগ্রগতি হয়েছে ৮০ শতাংশ। এই প্যাকেজের অধীনে রামচন্দ্রপুর থেকে বসিলা ও রায়েরবাজার খাল থেকে কামরাঙ্গীরচর পর্যন্ত সাড়ে ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, কিওয়াল, ওয়াকওয়ে অন পাইল স্থাপন/নির্মাণের কাজ চলছে। ৩ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়েছে।

প্যাকেজ-১৩ এর অধীনে টঙ্গী নদীবন্দর এলাকায় নির্মিত হচ্ছে ইকোপার্ক। এখন পর্যন্ত এই কাজের অগ্রগতি ৩৮ শতাংশ। প্যাকেজ-১৪ এর আওতায় চলছে ঢাকা ও টঙ্গী নদীবন্দরের অধীনে ছয়টি ভারী জেটি নির্মাণের কাজ। এসব জেটির দুটি হচ্ছে পাগলা বাজার এলাকায়। এছাড়া মুন্সিখোলা, মিরপুর সন্নিরিটক, গাবতলী ও আমিনবাজার এলাকায় নির্মিত হচ্ছে একটি করে জেটি। সাবস্ট্রাকচারের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং সুপারস্ট্রাকচারের কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত এর বাস্তব অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ।

প্যাকেজ-১৬ এর আওতায় রয়েছে ঢাকা নদীবন্দর এলাকায় ৩ হাজার ৮৩টি সীমানা পিলার নির্মাণ। এর মধ্যে ২ হাজার ১৬৮টি পিলার ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়েছে। অবশিষ্ট ৯১৫টি পিলারের কাজও ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের এই অংশের বাস্তব অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ।

টঙ্গী নদীবন্দর এলাকায় ২ হাজার ৬টি সীমানা পিলার নির্মাণ কাজ চলছে প্যাকেজ-১৭ এর আওতায়। এর মধ্যে ৫৬০টি পিলার ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়েছে এবং ৫৬৬টির কাজ ৪০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এই অংশের কাজের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৪৫ শতাংশ।

প্যাকেজ-১৮ এর আওতায় রয়েছে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের অধীনে ২ হাজার ৪০০টি সীমানা পিলার নির্মাণ। এর মধ্যে ৪৮৩টি সীমানা পিলার দৃশ্যমান হয়েছে এবং ৯১৩টির পাইলিং শেষ হয়েছে। এ কাজের বাস্তব অগ্রগতি ৪০ শতাংশ।

পাশাপাশি রামচন্দ্রপুর থেকে বসিলা পর্যন্ত নদীর অভ্যন্তরের অননুমোদিত মাটি খননের কাজও চলমান রয়েছে। এখন পর্যন্ত এই কাজের ৬০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।

এছাড়া প্রকল্পটির অধীনে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রামচন্দ্রপুর থেকে বসিলা ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় এক হাজার বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে তুরাগ নদীর বিরুলিয়া মৌজা থেকে রানাভোলা মৌজা পর্যন্ত প্রায় ৩০০টি, বালু নদের বড়কাউ মৌজাস্থ হরদি বাজার থেকে ভোলানাথপুর পর্যন্ত ৫৫০টি, গাবতলী দীপনগর থেকে দিয়াবাড়ী ও ঝাউচর এলাকায় বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর তীরে ৪০০টি এবং সদরঘাট থেকে খোলামুড়া পর্যন্ত নদীর উভয় পাড়ে রোপণ করা হয়েছে আরও ৩০০টি বৃক্ষ।

৫.১. প্রকল্পের কলেবর বৃদ্ধির প্রস্তাব: চলমান প্রকল্পটিতে আরও কিছু অঙ্গ সংযুক্ত করে এর কলেবর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বিআইডব্লিউটিএ। সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) প্রণয়নের পর ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে তা জমাও দেওয়া হয়েছে। আরডিপিপিতে প্রকল্পের নতুন ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ১৮১ কোটি ১০ লাখ ৩১ হাজার টাকা। প্রকল্প সম্পন্নের মেয়াদও ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে নদীর অভ্যন্তরে অননুমোদিতভাবে ভরাটকৃত ১৮ লাখ ২১ হাজার ঘনমিটার মাটি খননের পাশাপাশি তীরভূমিতে ৩৩ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার ও তীরভূমিতে কলামের ওপর ১৭ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। অন্যান্য কাজের মধ্যে আছে ২৪ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার তীররক্ষা কাজ, ৮০টি আরসিসি সিঁড়ি নির্মাণ, ১০ দশমিক শূন্য ৪ কিলোমিটার কি-ওয়াল নির্মাণ, ওয়াকওয়ে সংলগ্ন ৩৫ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, ৩৯৫ মিটার দীর্ঘ হাঁটার সেতু নির্মাণ, ১০২ দশমিক ৫২ কিলোমিটার রেলিং নির্মাণ, ২৯১টি বসার বেঞ্চ নির্মাণ ও ৮০৫ মিটার সীমানা প্রাচীর নির্মাণ। এর বাইরে ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, ভারী যানবাহনের জন্য ১৪টি জেটি, জেটির জন্য ৯ হাজার বর্গকিলোমিটার রাস্তা, ২৩ হাজার বর্গমিটার আরসিসি পার্কিং ইয়ার্ড, উঁচু ভূমিতে ৩ হাজার ৭১২টি ও নিচু ভূমিতে ৩ হাজার ৮৫০টি সীমানা পিলার, নদীর তীরভূমিতে ৯ হাজার ৪২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের তিনটি ইকোপার্ক, সদরঘাট ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় যাত্রীসেবায় ৪টি ঘাট নির্মাণের প্রস্তাবও করা হয়েছে আরডিপিপিতে।

জনসচেতনতায় জোর

নদী দখল ও দূষণ রোধ একক কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন ব্যাপক পরিসরে জনসচেতনতা। এর অংশ হিসেবে হাটবাজারের কঠিন বর্জ্য, গৃহস্থালির আবর্জনা এবং হাসপাতাল ও কল-কারখানার বর্জ্য নদীতে না ফেলতে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করছে বিআইডব্লিউটিএ। পাশাপাশি সার্কুলার ওয়াটার ওয়েজের বিভিন্ন স্থানে অংশীজনদের সাথে আলোচনা সভার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যেও কাজ করছে সংস্থাটি।

দখল ও দূষণরোধকল্পে বিআইডব্লিউটিএ জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে এবং অব্যাহতভাবে সেগুলো চলছে। জনসচেতনতামূলক এসব কার্যক্রমের মধ্যে আছে, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মানববন্ধন; বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগপাড়ে বাউল ও জারি গান এবং গণসংগীতের আয়োজন; নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে দখল-দূষণের বিরুদ্ধে র‌্যালি; দর্শনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার টাঙানো; নদী দখল ও দূষণ রোধ সম্পর্কিত লিফলেট ও স্টিকার বিলি; জনসচেতনতামূলক পথনাটিকা প্রদর্শন; দখল-দূষণের বিরুদ্ধে টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এসএমএস প্রেরণ; বহুল প্রচারিত ১০টি জাতীয় দৈনিকে নদী দখল ও দূষণ রোধ-সংক্রান্ত গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং গণবিজ্ঞপ্তি বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদের তীরে বসবাসরত জনসাধারণের মধ্যে লিফলেট আকারে বিলি করা।

শেষ কথা

নদী সুন্দর, সুন্দরের নির্মাতা, জীবনদায়ী। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো আমাদের শিল্প ও অর্থনীতির শক্তি, পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও নদী ঘিরে ও নদীরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তবে নদীকে বাঁচিয়ে রাখার কাজ সরকারের একার নয়; এ দায়িত্ব সকলের। এজন্য সবার আগে নদীর পাশ্ববর্তী শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিশোধন করতে হবে। তারপর নদীতে ফেলতে হবে। নদীর তীরবর্তী হাটবাজার ও গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলাও বন্ধ করতে হবে। এ লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে জোনভিত্তিক ইটিপি স্থাপন করে শিল্প বর্জ্য ও ড্রেনেজ খালের বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এসব হলে ধনপতির মতো আমরাও বলতে পারবÑযেদিকে চোখ যায় যেন জেগে থাকে নদীকূল, নদীগর্ভ, নদীকান্ত, নদীতট, নদীপথ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here