সরকারের এই মেয়াদেই ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ পুনরুদ্ধার করতে চায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিক-নির্দেশনা ও অভিভাবকত্বে সেই লক্ষ্য অর্জনের পথেই আছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাসমূহ। এজন্য প্রণয়ন করা হয়েছে ড্রেজিং মহাপরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার আওতায় ১৭৮টি নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সে লক্ষ্যে কাজও চলছে। বহরে বাড়ানো হচ্ছে ড্রেজারের সংখ্যা। জোর দেওয়া হচ্ছে ড্রেজিংয়ে স্বচ্ছতা আনয়নের উপর। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ১৯টি নদীর ২১টি এলাকা খনন করে ৩০০ কিলোমিটার নৌপথ পুনরুদ্ধার করেছে বিআইডব্লিউটিএ। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আগামীতে আরও অনেক প্রকল্প পরিকল্পনার মধ্যে রেখেছে সংস্থাটি।
বাংলার ভূ-প্রকৃতি গঠনে নদ-নদীর ভূমিকা বরাবরই অগ্রণী। এ নদীকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে লোকালয়, শহর ও নগর। আবার এই নদীই ধ্বংস করেছে বহু জনপদ। নদীর এই ভাঙা-গড়া শাশ্বত। এর মধ্যেই ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়াতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে নদী ও নৌপথ।
স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত জাতীয় মহাসড়ক যখন খুব একটা ছিল না, তখন এই নৌপথই ছিল যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম। আর এখনও শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সবচেয়ে সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব মাধ্যম অভ্যন্তরীণ নৌপথ। এই নদী ও নৌপথের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা এমনকি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
নৌপথের শ্রেণি বিভাজন
বাংলাদেশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য অগ্রাধিকারে রয়েছে ৬৫টি নৌরুট। গভীরতা অনুযায়ী বাংলাদেশের নৌরুটগুলোকে চারটি পৃথক শ্রেণিতে বিভাজিত করা হয়েছে। ৩ দশমিক ৬৬ থেকে ৩ দশমিক ৯৬ মিটার গভীরতা থাকলে সেই নৌরুটকে ক্লাস-১ বা প্রথম শ্রেণির হিসেবে গণ্য করা হয়। ক্লাস-২ বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে রাখা হয় ২ দশমিক ১৩ থেকে ২ দশমিক ৪৪ এবং ৩ দশমিক ৬৬ মিটারের কম গভীর নৌপথকে। ২ দশমিক ১৩ মিটারের কম অর্থাৎ ১ দশমিক ৫২ থেকে ১ দশমিক ৮৩ মিটারের মধ্যে থাকলে সেই নৌপথকে ধরা হয় ক্লাস-৩ বা তৃতীয় শ্রেণির নৌরুট। গভীরতা ১ দশমিক ৫২ মিটারের কম হলে সেটি ক্লাস-৪ বা চতুর্থ শ্রেণির নৌরুট। বর্ষা মৌসুমে যে ছয় হাজার কিলোমিটার নৌপথ নৌযান চলাচলের উপযোগী থাকে তার ৪০ শতাংশ অর্থাৎ দুই হাজার ৪০০ কিলোমিটার চতুর্থ শ্রেণির। এছাড়া এক হাজার ৮৮৫ কিলোমিটার বা ৩২ শতাংশ তৃতীয় শ্রেণির, এক হাজার কিলোমিটার বা ১৭ শতাংশ দ্বিতীয় শ্রেণির এবং অবশিষ্ট ৬৮৩ কিলোমিটার বা ১১ শতাংশ প্রথম শ্রেণির নৌপথ।
নাব্যতা সংকট
স্বাধীনতার পাঁচ দশকে যোগাযোগের ধরনে লক্ষণীয় বদল এসেছে। পরিবহন চাহিদাও বেড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি হারে। তবে এই বর্ধিত চাহিদায় নিজেদের হিস্যা সে হারে বাড়াতে পারেনি অভ্যন্তরীণ নৌপথ। পণ্য পরিবহনের প্রধানতম মাধ্যম হওয়ার পরও ২০০৫ সালে এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নৌপথের হিস্যা ১৬ শতাংশে নেমে আসে। ১৯৯৬ সালে যেখানে এ হিস্যা ছিল ৩০ ও ১৯৭৪ সালে ৩৭ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ নৌপথের সম্ভাবনার অনেকাংশ অব্যবহৃত থাকার প্রধানতম কারণ নাব্যতা সংকট।
ডিসেম্বর-মে পর্যন্ত সময়ে অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে দেশে নৌপথ ব্যাপকভাবে নাব্যতা ফিরে পায়। এর ঠিক বিপরীত অবস্থা তৈরি হয় শুষ্ক মৌসুমে। আমাদের নৌপথ আছে ২৪ হাজার কিলোমিটারের মতো। এর মধ্যে বর্ষা মৌসুমে নৌযান চলাচলের উপযোগী অর্থাৎ নাব্য থাকে সর্বোচ্চ ছয় হাজার কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে নাব্য নৌপথের দৈর্ঘ্য নেমে আসে তিন হাজার ৮৬৫ কিলোমিটারে। তবে বর্তমান সরকার মাল্টিমোডাল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংক্রান্ত বলিষ্ঠ নীতি প্রণয়ন করেছে। এর লক্ষ্য যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সহজ করতে নৌপথের নাব্যতা ফিরিয়ে আনা। অভ্যন্তরীণ নৌপথের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে এর মূল দায়িত্বে আছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
নাব্যতা রক্ষার প্রয়োজন যে কারণে
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী ব্যবস্থার দ্বারা গঠিত বাংলাদেশ বিশে^র বৃহত্তম বদ্বীপ। বাংলাদেশের নদীগুলো ব্রেইডেড প্রকৃতির হওয়ায় নাব্যতা সংকট জটিল আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে প্রতি বছর পানি প্রবাহিত হয় ৫০ লাখ কিউসেক। কিন্তু পলি প্রবাহিত হয় প্রায় ২৪০ কোটি টন। অত্যধিক পলি পরিবহন নৌপথের নাব্যতা হারানোর অন্যতম কারণ। শুষ্ক মৌসুমে নৌপথের নাব্যতা এতোটাই কমে যায় যে, অনেক নদীতে ফেরি পর্যন্ত চলাচল করতে পারে না।
অভ্যন্তরীণ নৌপথে জাহাজের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে এবং বর্তমানে নিবন্ধিত জাহাজ রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার। এর ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত। এর বাইরে সাড়ে ৭ লাখের মতো প্রথাগত দেশীয় নৌকা রয়েছে, যার একটি বড় অংশকে যন্ত্রচালিত ট্রলারে রূপান্তরিত করা হয়েছে। নৌকাগুলোর ৬৫ শতাংশের মতো যাত্রীবাহী, যা প্রধানত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর যোগাযোগের চাহিদা পূরণ করে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের প্রয়োজনে সব ধরনের নৌযান যাতে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে সে জন্য দরকার নৌপথের নাব্যতা।
নাব্যতা ফেরাতে মহাপরিকল্পনা
সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রেই অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন (আইডব্লিউটি) ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর বিশেষ জোরারোপ করা হয়েছে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন বিদ্যমান নৌপথগুলো ব্যাপক পরিসরে ক্যাপিটাল ড্রেজিং বা খনন করা। এ লক্ষ্যে নৌপথ পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত একটি মহাপরিকল্পনা এরই মধ্যে প্রণয়ন করেছে সরকার। মহাপরিকল্পনায় সরকারের চলতি মেয়াদেই ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এজন্য ড্রেজিং করা হবে ১৭৮টি নদী। নাব্যতা ফেরাতে ড্রেজিংয়ের মূল দায়িত্বে আছে বিআইডব্লিউটিএ। সরকারের পাশাপাশি এতে অর্থায়ন করছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা।
বহরে ড্রেজারের সংখ্যা বাড়ছে
স্বাধীনতার পরপরই নৌপথের নাব্যতা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। সদ্য স্বাধীন দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাতটি ড্রেজার ক্রয় করেন। দীর্ঘদিন যাবৎ এই সাতটি ড্রেজার দিয়েই নৌপথের খননকাজ চলছিল। পরবর্তীতে আরও কিছু ড্রেজার বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে যোগ হয়। বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে ড্রেজার আছে ৪৫টি, যা দিয়ে বছরে প্রায় ৩৪৬ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করা সম্ভব।
বিআইডব্লিউটিএ’র দ্বিগুণের বেশি ড্রেজার রয়েছে বেসরকারি মালিকানায়। ব্যক্তিমালিকানায় এই মুহূর্তে ১০০টির বেশি ড্রেজার রয়েছে, যা দিয়ে বছরে প্রায় সাড়ে ৪০০ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করা যায়। যদিও বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং চাহিদা আরও অনেক বেশি, বছরে প্রায় ১৬০০ লাখ ঘনমিটার। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ড্রেজিং করতে তাই ড্রেজারের বহর শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি আরও ৩৫টি ড্রেজার ক্রয়ের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ১০টি ড্রেজার ২০২২ সালের মধ্যেই বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে যুক্ত হওয়ার কথা। তখন সংস্থাটির নিজস্ব ড্রেজারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৫৫টিতে। আর প্রকল্পটির আওতায় সবগুলো ড্রেজার কেনা হলে বিআইডব্লিউটিএ’র নিজস্ব ড্রেজারের সংখ্যা ৮০তে উন্নীত হবে। সেই সাথে দ্বিগুণের বেশি হবে সংস্থাটির নিজস্ব ড্রেজিং সক্ষমতা। বহরে ৮০টি ড্রেজার নিয়ে বার্ষিক ৬৭২ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং সক্ষমতা তৈরি হবে। সরকারি-বেসরকারি মিলে তখন বার্ষিক ড্রেজিং চাহিদার ৭০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হবে।
চলমান খনন প্রকল্প
যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সিংহভাগ বর্তমানে সড়কপথে হলেও নৌপথই সবচেয়ে নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী। এক হিসাবমতে, বাংলাদেশে সড়কের পরিবর্তে নৌপথে কার্গো পরিবহন করলে প্রতি বছর সাশ্রয় হয় প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। তবে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন নির্বিঘ্নে করতে নৌপথের নাব্যতা প্রধানতম শর্ত। সে কারণেই নৌপথের নাব্যতা ফেরাতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিআইডব্লিউটিএ’র মাধ্যমে ১৭৮টি নৌপথ খননের এই উদ্যোগ। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের খননের লক্ষ্য রয়েছে ৩১৩টি নদী। এছাড়া খাল খননের দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। তবে সব নদীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএ’র ওপর।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-আশুগঞ্জ নৌ করিডোর
যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-আশুগঞ্জ নৌ করিডোর এবং নারায়ণগঞ্জ ও বরিশালের বর্ধিতাংশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ নৌযান এই পথেই চলাচল করে এবং করিডোরটি দিয়ে গন্তব্যে আসা-যাওয়া করেন দৈনিক দুই লাখের বেশি যাত্রী। দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যই শুধু নয়, ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের জন্যও সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত নৌ করিডোর এটি।
গুরুত্ব বিবেচনায় নৌ করিডোরটির উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন প্রকল্প-১ (চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ ও সংযুক্ত নৌপথ খনন এবং টার্মিনালসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে ড্রেজিং বা খনন অন্যতম। প্রকল্পটির আওতায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম করিডোরের আশুগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও বরিশালে মূল নদী পারফরম্যান্স বেজড কন্ট্রাক্ট (পিবিসি) ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও নাব্য করা হবে। চাঁদপুর-শরীয়তপুর, লক্ষীপুর-ভোলা এবং ভেদুরিয়া-লাহারহাট নৌরুটের তিনটি ফেরি ক্রসিং এলাকার সংরক্ষণ ড্রেজিংও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। বিআইডব্লিউটিএ’র চলমান প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর।
৫৩টি নৌরুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং (প্রথম পর্যায়)
নাব্যতা ফেরাতে ৫৩টি নৌরুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের একটি প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালের জুলাইয়ে। এর আওতায় প্রথম পর্যায়ে ২৪টি নদীর নৌপথ ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার কথা। প্রথম পর্যায়ে নির্বাচিত নদীগুলো হলো মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল, খোগদন, লাউকাঠি, ভোলা নালা, কীর্তনখোলা, তিতাস, সুরমা, বাউলাই, নতুন নদী, রক্তি, রক্ষা নালা, মোগরা, কংস, ভোগাই-কংস, বুড়ি, ইছামতি, কর্ণতলী, পালরদি, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা, মধুমতি, ভৈরব, আত্রাই, দুধকুমার, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও আড়িয়াল খাঁ। প্রকল্পের আওতায় খননের মাধ্যমে ৫৭০ লাখ ঘনমিটারের বেশি পলি এরই মধ্যে অপসারণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এর মধ্যে ৭০ লাখ ঘনমিটারের বেশি পলি অপসারণ করা হয়েছে সংস্থার নিজস্ব ড্রেজারের মাধ্যমে। অবশিষ্ট খননকাজ সম্পন্ন হয়েছে বেসরকারি ড্রেজারের সাহায্যে। কিছু পরিমান খননে এক্সকাভেটরের সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে গত আট বছরে শুধু এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১২০০ কিলোমিটার নৌপথের নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য রয়েছে।
মোংলা-পাকশি নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন
মোংলা থেকে পাকশি ভায়া চাঁদপুর-মাওয়া-গোয়ালন্দ নৌপথ খননের আরেকটি প্রকল্প ২০১৭ সালে হাতে নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে ভারী যন্ত্রাংশ অভ্যন্তরীণ নৌপথ দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। এজন্য ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌরুটটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি সম্পন্নের দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবার নাব্যতা ফেরানো
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবার নাব্যতা পুনরুদ্ধারে ৪ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলনে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ। এর আওতায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ২২৭ কিলোমিটার খনন করে কমপক্ষে তিন মিটার গভীর ও ১০০ মিটার প্রশস্ত করা হচ্ছে, যাতে করে এটি দ্বিতীয় শ্রেণির নৌরুটে উন্নীত হয়। সেই সাথে কম খরচে ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন নিশ্চিত হয়।
এছাড়া ধরলার ৬০ কিলোমিটার খননের মাধ্যমে দুই মিটার গভীর ও ৩৮ মিটার প্রশস্ত করা হচ্ছে। এর মধ্য তৃতীয় শ্রেণির নৌরুটের কাতারে উঠে আসবে এটি। একই প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনীয় খননের মাধ্যমে পুনর্ভবাকে তৃতীয় ও তুলাই নদীকে চতুর্থ শ্রেণির নৌরুটে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পুরো প্রকল্পটির আওতায় রয়েছে রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও দিনাজপুর জেলা; ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর, শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলা।
এক বছরে ৩০০ কিলোমিটার নৌপথ পুনরুদ্ধার
নৌপথ পুনরুদ্ধারের যে বিপুল কর্মযজ্ঞ তার অংশ হিসেবে বিআইডব্লিউটিএ গত এক বছরে (১ জুলাই ২০১৯ থেকে ২৮ জুন ২০২০) প্রায় ৩০০ কিলোমিটার নৌপথ খননের মাধ্যমে উদ্ধার করেছে। অর্থাৎ এক বছরে অতিরিক্ত ৩০০ কিলোমিটারের মতো নৌপথ নৌযান চলাচলের উপযোগী হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ২২৫ দশমিক ৪৫ লাখ ঘনমিটার সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল বিআইডব্লিউটিএর। এর বিপরীতে সম্পন্ন হয়েছে ১৫২ দশমিক ৯৬ লাখ ঘনমিটার বা প্রায় ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ নিজস্ব ড্রেজারের মাধ্যমে সংরক্ষণ ড্রেজিং করেছে ৭৪ দশমিক ৬০ লাখ ঘনমিটার। বাকি ৭৮ দশমিক ৪২ লাখ ঘনমিটার সংরক্ষণ ড্রেজিং সম্পন্ন হয়েছে বেসরকারি ড্রেজারের মাধ্যমে।
সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের চেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে উন্নয়ন ড্রেজিংয়ে। গেল অর্থবছর বিআইডব্লিউটিএ উন্নয়ন ড্রেজিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৩২৭ দশমিক ৪৫ লাখ ঘনমিটার। এর বিপরীতে সম্পন্ন হয়েছে ৩০৬ দশমিক ৭৫ লাখ ঘনমিটার। অর্থাৎ উন্নয়ন ড্রেজিংয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা তার প্রায় ৯৪ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটি। শুধু তা-ই নয়, নিজস্ব ড্রেজার দিয়ে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উন্নয়ন ড্রেজিং সম্পন্ন করেছে বিআইডব্লিউটিএ। ৩৫ দশমিক ৭০ লাখ ঘনমিটার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব ড্রেজার দিয়ে খনন হয়েছে ৫২ দশমিক ৭০ ঘনমিটার। আর বেসরকারি ড্রেজারের মাধ্যমে উন্নয়ন ড্রেজিং করা হয়েছে ২৫৪ ঘনমিটার।
২০১৯-২০ অর্থবছরে খননকৃত নদী ও নাব্য নৌপথের দৈর্ঘ্য
বিআইডব্লিউটিএ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ৩০০ কিলোমিটারের মতো নৌপথ পুনরুদ্ধার করেছে ১৯টি নদীর ২১টি এলাকা খনন করে। এর মধ্যে আড়িয়াল খাঁর মাদারীপুর-কবিরাজপুর- চৌধুরীহাট নৌপথের জাজিরা-মাদারীপুর অংশ খননের মাধ্যমে ২০ কিলোমিটারে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। একই নৌপথের ময়নাকাটায় মাদারীপুর-কবিরাজপুর-পিয়াজখালী এলাকা খনন করে নাব্যতা ফেরানো হয়েছে ১১ কিলোমিটার। নারায়ণগঞ্জ-দাউদকান্দি এলাকায় মেঘনা ও গোমতি নদীর ৭ কিলোমিটার খনন করেছে বিআইডব্লিউটিএ। খনন করা হয়েছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ডেমড়া-ঘোড়াশাল-পলাশ টোক-কটিয়াদি নৌপথের ৩ কিলোমিটার এবং আনোয়ারপুর-তাহেরপুর-বিশম্বপুর নৌপথের বাউলাই, রক্তি ও রকশা নদীর ৮ কিলোমিটারও। এছাড়া কুমার নদের সিনধিয়া ঘাট-ভাঙ্গা নৌপথের ৭ কিলোমিটার; তিতাস নদীর নরসিংদী-সলিমগঞ্জ-বাঞ্ছারামপুর নৌরুটের ৫ কিলোমিটার; একই নদীর দাউদকান্দি-হোমনা- রামকৃষ্ণপুর রুটে ৪ কিলোমিটার; পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের কটিয়াদী-ভৈরব নৌপথের ৫ কিলোমিটার; কংস নদীর পাগলাজোড়-মোহনগঞ্জ নৌপথের ১০ কিলোমিটার; বাউলাই ও মগরা নদীর দিলালপুর-চামড়াঘাট-নিকলি-নেত্রকোনা রুটের ১৪ কিলোমিটার; মেঘনা, পাগলা ও বুড়ি নদীর চিত্রি-নবীনগর-গোকর্নঘাট-কুটিবাড়ি রুটের ৬ কিলোমিটার; নতুন নদীর ছাতক-ভোলাগঞ্জ রুটের ৭ কিলোমিটার ও ভৈরব নদীর খুলনা-নোয়াপাড়া নৌপথের ১১ কিলোমিটার ২০১৯-২০ অর্থবছরে খনন করা হয়েছে। এর বাইরে পালরদি নদীর টরকী-হোসনাবাদ-ফাঁসিয়াতলা নৌপথের ৭ কিলোমিটার; বোগাই, কংস নদীর মোহনগঞ্জ থেকে নালিতাবাড়ি নৌপথের ৭০ কিলোমিটার; পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ৫৮ কিলোমিটার; ব্রহ্মপুত্রের মেঘনা-লাঙ্গলবন্ধ নৌপথের ১১ কিলোমিটার; ঝালুখালি নদীর ডলুরা-সুনামগঞ্জ নৌপথের ৬ কিলোমিটার; ধলেশ্বরী নদীর হাজরাপুর-জাবরা নৌপথের ৮ কিলোমিটার; আত্রাই নদীর পাবনা-নাটোর-দিনাজপুর নৌপথের ১৮ কিলোমিটার এবং দুধকুমার নদীর ৪ কিলোমিটার নৌপথ খননের পর গত অর্থবছর উদ্ধার করা হয়েছে।
স্বচ্ছতা আনতে রিয়েল টাইম ড্রেজ মনিটরিং সিস্টেম
ড্রেজিং কোম্পানি ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে কার্যাদেশ অনুযায়ী খননকাজ না করেই বিল তুলে নেওয়ার অভিযোগ অনেক দিনের। এটা বন্ধ করে ড্রেজিংয়ে স্বচ্ছতা আনতে খননকাজ ডিজিটালি তদারকির উদ্যোগ নিয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। এটি করা হবে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে, যা ‘রিয়েল টাইম ড্রেজ মনিটরিং সিস্টেম’ নামে পরিচিত।
খননকাজে নিয়োজিত ড্রেজার সফটওয়্যারটির মাধ্যমে মনিটরিং সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত থাকবে। সফটওয়্যারের সঙ্গে সংযুক্ত রেখে প্রত্যেক ড্রেজারে একটি করে ট্র্যাকিং সরঞ্জাম স্থাপন করা হবে। এর ফলে কোন ড্রেজার কতটুকু খননকাজ সম্পন্ন করেছে ও কী পরিমান খননকাজের এখনও প্রয়োজন আছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা তদারক করতে পারবে। ঘণ্টা, দিন, প্রশস্ততা, গভীরতা ও অ্যালাইনমেন্ট অনুযায়ী ড্রেজিং হচ্ছে কিনা তা সহজে জানা যাবে। ড্রেজারের বিলিং সিস্টেমও আরও সহজ হবে। এর ফলে খনন ব্যয় অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সাশ্রয়ী ও জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আরও অনেক দূর যেতে হবে অংশীজনদের। নাব্যতা ফেরাতে খনন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পাশাপাশি একে গতিশীল করতে হবে। সে লক্ষ্য সামনে রেখে আগামীতে আরও অনেক প্রকল্প গ্রহণের বিষয়টি পরিকল্পনার মধ্যে রেখেছে বিআইডব্লিউটিএ।
ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তাবিত বিআইডব্লিউটিএ’র এমন একটি প্রকল্প হচ্ছে বুরিশ্বর-পায়রা, সোয়া, সুতিয়া এবং কাচামাটিয়া নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নৌপথের নাব্যতা উন্নয়ন ও বন্যা ব্যবস্থাপনা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এসব নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। পাশাপাশি জিনাই, ঘাঘট, বংশী, লোয়ার বানর এবং নাগদা নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধার ও নৌপথের নাব্যতা উন্নয়নের পরিকল্পনা আছে সংস্থাটির। পরিকল্পনা আছে মিঠামইন উপজেলার ঘোড়াউতরা, বৌলাই-শ্রীগাং নদীর অংশবিশেষ ও ইটনা উপজেলার ধনু নদীর এবং অষ্টগ্রাম উপজেলার ধলেশ্বরী নদীর অংশবিশেষের নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধারেরও। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে সাংগু, মাতামুহুরী ও রাঙ্গামাটির থেগামুখ নৌপথ খননের মাধ্যমে নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার করতে চায় বিআইডব্লিউটিএ। এছাড়া ঢাকা-লক্ষীপুর নৌপথের লক্ষীপুর প্রান্তে মেঘনা নদী ও গোমতী নদী খনন করে পুনরুদ্ধার ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছে সংস্থাটি।
ইতোমধ্যে সমাপ্ত, চলমান ও আগামী দিনের এসব প্রকল্প, পরিকল্পনা ও উদ্যোগে চোখ রেখে আশা করাই যায়, আবার নদী বইবে নদীর রূপে। নৌপথ ফিরবে ফেলে আসা ঐতিহ্যে। বর্ষা মৌসুমেই কেবল নয়, শুষ্ক মৌসুমেও তিস্তা, করতোয়া, আত্রাই, কর্ণফুলী, বাঙ্গালী, নাফ, শীতলক্ষ্যাসহ প্রায় সব নদীর জল বেয়ে নৌযান চলবে। নাব্য হবে অনাব্য সব নৌপথ।