বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুধবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
17 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

লক্ষ্যে অবিচল থেকে কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতে এখন পুনর্জাগরণের পর্ব। নৌখাতের গৌরব ফিরিয়ে আনতে চলছে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালুর বড় কর্মযজ্ঞ। সেই সাথে নিরাপদ, টেকসই, সাশ্রয়ী এবং আধুনিক ও যুগোপযোগী অভ্যন্তরীণ নৌপথ গড়ে তোলার বিপুল-বিশাল আয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নির্দেশনায় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তত্ত¡াবধানে এ কর্মযজ্ঞের নেতৃত্বে আছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কমডোর গোলাম সাদেক এনজিপি, এনডিসি, এনসিসি, পিএসসি। ৪৭তম চেয়ারম্যান হিসেবে ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। নদীবাংলার সাথে তাঁর আলাপচারিতায় উঠে এসেছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাত ঘিরে বিআইডব্লিউটিএর পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও অর্জনের সবিস্তার।

নদীমাতৃক বাংলায় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ভূমিকা চিরকালীন। কিন্তু এ খাতে শৃঙ্খলা আনয়নে সংবিধিবদ্ধ একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ সময় লেগে গেছে। বিআইডব্লিউটিএর প্রতিষ্ঠা এবং বর্তমানের এই গৌরবজনক অবস্থানে পৌঁছানোর পরিক্রমাটি সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।

কমডোর গোলাম সাদেক: অভ্যন্তরীণ নৌপথই একসময় বাংলার সড়কপথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই নৌপথের বাহন ছিল নানা আকৃতির-প্রকৃতির ও নানা নামের নৌকা। পরের দিকে অঞ্চলের নদীপথে যন্ত্রচালিত+ নৌযানের আবির্ভাব ঘটে। তাও প্রায় দুইশ বছর আগে, ১৮৩৪ সালে। পরের দিকে ১৮৪৪ সালে গঠিত হয় দ্য ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে কোম্পানি লিমিটেড (আইজিএনআর)। এর কয়েক বছর পর আসে আরও একটি কোম্পানি রিভার স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি লিমিটেড (আরএসএন)। উনিশ শতক পর্যন্ত বাঙলা, আসাম ও বিহারে নৌপথে বাণিজ্য এই দুই কোম্পানিই নিয়ন্ত্রণ করত। মোট যাত্রী ও কার্গো পরিবহনের ৭০ শতাংশই করত তারা। তখনো নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণে বা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো ভূমিকা ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে নৌপথের যে উন্নতি ও উন্নয়ন তা ছিল তাদের মুনাফাকেন্দ্রিক।

এই অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ নৌপথের জন্য আলাদা একটি বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া অবশ্য শুরু হয় ৩০-এর দশকেই। সেই লক্ষ্যে ১৯৩৪ সালে বেঙ্গল আইনসভা ‘দ্য ইনল্যান্ড ওয়াটরওয়েজ বিল’ও পাস করে। কিন্তু সেটি আর কাজে আসেনি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরপরই অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও উন্নয়নে বিভিন্ন সংস্থা, কমিটি ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে উপযুক্ত একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দাবি উঠতে থাকে।

এই অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের জন্য সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রথম সুপারিশ আমরা দেখতে পাই ১৯৪৮ সালের ইউনাইটেড স্টেটস সার্ভে মিশনে। ১৯৫১ সালে জাতিসংঘের আইডব্লিউটিএ স্টাডি গ্রুপেও একই প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। ১৯৫৩ সালে জে.জি. সুরি ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের ওপর জাতিসংঘের জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। ওই প্রতিবেদনেও আলাদা কর্তৃপক্ষের বিষয়টি উঠে আসে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন নিয়ে ১৯৫২ ও ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে দুই দফা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে খাতটির ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও উন্নয়নে পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবি আবারো উচ্চারিত হয়। ১৯৫৫-৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করে। একই বছর পূর্ব পাকিস্তানের পানিসম্পদ নিয়ে জাতিসংঘের জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন জে.জে ক্রুগ। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের জন্য কর্তৃপক্ষের বিষয়টি উঠে আসে সেখানেও। একই সুপারিশ করা হয় ১৯৫৭ সালে বিশ^ব্যাংকের সার্ভে মিশন, আইসিএ সার্ভে মিশন ও পাকিস্তান সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। সর্বশেষ ১৯৫৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের যে আইডবিøউটি ইকুইটি কমিটি সেখানেও কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়টি জোরেশোরেই আলোচিত হয়। এরপর ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌযান চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে ও সুনির্দিষ্ট কিছু নাব্য নৌপথের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দ্য ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৫৮ (ইস্ট পাকিস্তান) জারি করে। ওই বছরের ৪ নভেম্বর চেয়ারম্যান হিসেবে মাসুদ হোসেন ও সদস্য (প্রকৌশল) হিসেবে বিএম আব্বাসকে নিয়োগদানের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (ইপিডব্লিউটিএ)।

স্বাধীনতার পর ইপিডব্লিউটিএর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বিআইডব্লিউটিএ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালেই সংস্থাটিতে সংস্কারের উদ্যোগ নেন। নৌপথের নাব্যতা ধরে রাখতে বিদেশ থেকে সংগ্রহ করেন সাতটি ড্রেজার, যা আজও বিআইডব্লিউটিএর বহরে সচল আছে। মোট কথা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর আজকের যে ব্যাপ্তি ও পরিসর তা জাতির পিতার দেখানো পথ ধরেই। নিরাপদ ও সাশ্রয়ী নৌপথের প্রতিশ্রুতিতে আমরা দেশব্যাপী নিয়মিত নৌপথ খনন, নৌসহায়ক সরঞ্জাম এবং টার্মিনাল, ঘাট, পন্টুন, জেটি ও বন্দরের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বিআইডব্লিউটিএর সক্ষমতা ও দক্ষতা বহুগুণে বেড়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর কার্যপরিধি কী? প্রতিষ্ঠার ছয় দশকে এবং স্বাধীনতার পাঁচ দশকে এর ব্যাপ্তি ও পরিসর কতটা বেড়েছে?

কর্তৃপক্ষের কার্যপরিধি কী হবে ‘দ্য ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৫৮ (ইস্ট পাকিস্তান)’-এ তা বলে দেওয়া আছে। তবে সময়ের সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ নৌপথকেন্দ্রিক কাজের ধরন ও কৌশল বদলেছে। সংশোধনী আনা হয়েছে অধ্যাদেশে। প্রথম সংশোধনীটি আনা হয় ১৯৭৭ সালে। এরপর ১৯৯৭ সালে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (সংশোধনী) আইন নামে আরেকটি সংশোধনী আনা হয়। এসব সংশোধনীর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কার্যপরিধি আরও সুনির্দিষ্ট ও বিস্তৃত হয়েছে। নিরাপদ, দক্ষ, সাশ্রয়ী ও নাব্য অভ্যন্তরীণ নৌপথ নিশ্চিত করতে বর্তমানে কর্তৃপক্ষকে যেসব কাজ করতে হয় তার মধ্যে আছে নদী শাসন ও নদী সংরক্ষণ এবং নৌ সহায়ক সরঞ্জাম যেমন মার্কা, বয়া, লাইট ও সেমাফোর সিগন্যালের ব্যবস্থাপনা; নাব্যতা ও আবহাওয়া-সংক্রান্ত তথ্য এবং রিভার চার্ট প্রকাশ করা; পাইলটেজ ও হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ পরিচালনা করা; ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হলে সে সম্পর্কিত কর্মসূচি তৈরি ও বিদ্যমান নাব্য নৌপথগুলো দক্ষতার সাথে সংরক্ষণ করা। নৌ চলাচলের জন্য নতুন চ্যানেল ও ক্যানেল উন্নয়নের পাশাপাশি মরে যাওয়া বা শুকিয়ে যাওয়া নদী, চ্যানেল ও ক্যানেল পুনরুজ্জীবিত করা; নদীবন্দর, ঘাট এবং এসব নদীবন্দর ও ঘাটের টার্মিনাল সুবিধাদির উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও পরিচালনা করা; নাব্য নৌপথে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা অপসারণ করা; যাত্রী এবং কার্গো পরিবহন নির্বিঘ্নে করতে ট্রাফিক জরিপ পরিচালনা করা; সরকারের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও কার্গো পরিবহনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা; যাত্রীবাহী নৌযানের টাইম-টেবিল অনুমোদন করা; দেশীয় জলযানগুলোর আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীরণের কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামীণ পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করা; অন্যান্য পরিবহন মাধ্যম ও সমুদ্র বন্দরের সাথে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের সমন্বয় আনা; জলযানের নকশা, টাওয়েজ কৌশল, ল্যান্ডিং ও টার্মিনাল সুবিধাদি ও বন্দর স্থাপনার উন্নয়নসহ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা; দেশের ভেতরে ও বাইরে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য কর্মসূচির ব্যবস্থা করা; অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন বহরে থাকা জলযান মেরামত ও নতুন জলযান নির্মাণের লক্ষ্যে শিপইয়ার্ড ও জাহাজ মেরামত শিল্পের সাথে লিয়াজোঁ রক্ষা করা এবং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন শিল্পের জন্য মেরামত সরঞ্জাম আমদানিকে সহজীকরণ করা। তবে এর বাইরে সময় সময় সরকার নির্দেশিত নৌপরিবহন খাত-সংশ্লিষ্ট যেকোনো কার্যক্রম বাস্তবায়ন করাও বিআইডবিøউটিএর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর কাজের পরিসর সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত এ কাজ সম্পন্নের জন্য প্রয়োজন বর্ধিত জনবল। কর্তৃপক্ষের সেই জনবল আছে কি?

ঠিকই বলেছেন। বিআইডব্লিউটিএর কাজের পরিসর বাড়ছে। নৌপথের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নৌ অবকাঠামোর সংখ্যা বাড়ছে। গেজেটভুক্ত নদীবন্দরের সংখ্যা ৩৬টিতে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া ড্রেজার বেজ হচ্ছে ১১টি। কিন্তু জনবলস্বল্পতায় সব জায়গায় লোকবল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

বর্তমানে কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত পদ আছে ৪ হাজার ৬৭০টি। এর মধ্যে পূরণকৃত পদ ৪ হাজার ৮৫টি। বাকি ৫৮৫টি পদ শূন্য আছে। কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করতে ও সংশ্লিষ্ট কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে জরুরি ভিত্তিতে শূন্য পদ পূরণ করা জরুরি। আমরা সরকারের কাছে আমাদের জনবলের চাহিদা পাঠিয়েছি। আশা করি নতুন নিয়োগের মাধ্যমে জনবলের স্বল্পতা কেটে যাবে।

কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করতে কেবল পর্যাপ্ত জনবলই যথেষ্ট নয়। জনবলের দক্ষতা থাকাটাও জরুরি। দক্ষতা উন্নয়নে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন?

স্ব স্ব ক্ষেত্রে জনবলের দক্ষতা থাকাটা খুব বেশি জরুরি। এ বিষয়ে বলব, দক্ষ জনবল নিয়োগের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে। নিয়োগের সময় সেগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। মেধা ও বুদ্ধিমত্তা কঠোরভারে যাচাইয়ের পর কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয় এখানে। নিয়োগের পর প্রত্যেক কর্মীকে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও আছে আমাদের। কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য নিয়মিতই তাদেরকে ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এনএপিডি), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (বিআইএম), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইএএম) এবং এ ধরনের অন্যান্য ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়ে থাকে। দক্ষ জনবল তৈরিতে নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল ও মাদারীপুরে আমাদের তিনটি ডেক অ্যান্ড পারসোনেল ট্রেইনিং সেন্টারও রয়েছে।

তাছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও কৃতকর্ম মূল্যায়নেরও নিজস্ব পদ্ধতি আছে কর্তৃপক্ষের। সব মিলিয়ে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, জনবলের ঘাটতি থাকলেও তাদের দক্ষতার কোনো ঘাটতি নেই।

সরকারের এই মেয়াদে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালুর লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ব্যাপক ভিত্তিতে ড্রেজিং কার্যক্রম চলছে। এখন পর্যন্ত সেই লক্ষ্যের অগ্রগতি এবং নির্ধারিত সময়ে তা অর্জনের ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী?

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের নাব্যতা রক্ষায় এরই মধ্যে খসড়া ড্রেজিং মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। মহাপরিকল্পনায় মোট ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালুর লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিআইডবিøউটিএর পাশাপাশি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া খালসমূহ খননের দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। বিআইডব্লিউটিএর ওপর ১৭৮টি নদী খননের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় খনন করবে ৩১৩টি নদী।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তত্ত¡াবধানে খসড়া ড্রেজিং মহাপরিকল্পনায় ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ। এরই মধ্যে অতিরিক্ত ২ হাজার ৭০০ কিলোমিটার নৌপথ চালু করা সম্ভব হয়েছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই নৌ চলাচলের উপযোগী অভ্যন্তরীণ নৌপথ ১০ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত হবে বলে আমরা আশাবাদী।

ড্রেজিং মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিআইডব্লিউটিএর শক্তিশালী ড্রেজার বহর। বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব বহরে বর্তমানে যত সংখ্যক ড্রেজার আছে তাকে কি যথেষ্ট মনে করেন?

শক্তিশালী ড্রেজার বহর ছাড়া যে দেশের বিস্তৃত নৌপথের নাব্যতা সংরক্ষণ সম্ভব নয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা স্বাধীনতার পরপরই উপলব্ধি করেছিলেন। সে কারণেই তিনি খুব কম সময়ের মধ্যেই বিদেশ থেকে সাতটি ড্রেজার সংগ্রহ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সময়ে বিষয়টি আর সেভাবে অগ্রাধিকার পায়নি। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারে এসে নৌপথ সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দেন। তারই অংশ হিসেবে বিআইডবিøউটিএর ড্রেজার বহর শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে বিআইডবিøউটিএর বহরে ড্রেজার রয়েছে ৪৫টি, যা দিয়ে বছরে ৩৪৬ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করা সম্ভব। এর বাইরে বেসরকারি খাতে ১০০টির মতো ড্রেজার রয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশের মোট ড্রেজিং সক্ষমতা প্রায় ৮০০ লাখ ঘনমিটার। এর বিপরীতে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং চাহিদা বছরে ১৬০০ লাখ ঘনমিটার। সুতরাং বুঝতেই পারছেন চাহিদার বিপরীতে আমাদের ড্রেজিং সক্ষমতায় এখনো প্রায় ৮০০ লাখ ঘনমিটার ঘাটতি রয়েছে।

তবে বিআইডব্লিউটিএর চলমান ৩৫ ড্রেজার প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সালের মধ্যেই বহরে আরও ১০টি ড্রেজার যোগ হওয়ার কথা রয়েছে। তখন বিআইডবিøউটিএর বহরে ড্রেজারের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৫টি। আর ৩৫টি ড্রেজারের সবগুলো সংগৃহীত হলে বহরে ড্রেজারের সংখ্যা ৮০টিতে উন্নীত হবে। তখন বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব ড্রেজিং সক্ষমতা দাঁড়াবে বার্ষিক ৬৭২ লাখ ঘনমিটার। তার পরও চাহিদার বিপরীতে কিছু ঘাটতি থাকবে। এ ঘাটতি পূরণে সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বিআইডব্লিউটিএর কাছ থেকে রুট পারমিট ও সময়সূচি নিয়ে আট শতাধিক নৌযান সারা দেশে যাত্রী পরিবহনের কাজ করছে। এসব নৌযানে যাত্রী পরিবহন সহজ করতে বিআইডব্লিউটিএ কী পদক্ষেপ নিয়েছে?

অভ্যন্তরীণ নৌপথে নিরাপদ যাত্রী পরিবহন নিশ্চিত করতে নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক (নৌনিট্রা) ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে কর্তৃপক্ষের পৃথক বিভাগ রয়েছে। নৌযানে যাত্রী পরিবহন যাতে নির্বিঘ্নে হয় সেজন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে তারা। খেয়াল করে দেখে থাকবেন, যাত্রী সাধারণের নিরাপদ যাতায়াতের সুবিধার্থে ২০২০ সাল থেকে আমরা ঢাকা-ইলিশা (বিশ্বরোড), ঢাকা-মুলাদী রুটে দিনের বেলায় লঞ্চ সেবা বাড়িয়েছি। পাশাপাশি ঢাকা-মজুচৌধুরীরহাট (লক্ষীপুর) রুটে নতুন করে দিনের বেলা লঞ্চ সেবা চালু করেছি।

পর্যটনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে খাতটিতে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন নৌপথে পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে যাত্রীবাহী নৌযানের অনুকূলে রুট পারমিট ও সময়সূচি প্রদান করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, পর্যটকরা যাতে নৌযানে স্বচ্ছন্দে ওঠানামা করতে পারেন সেজন্য ল্যান্ডিং সুবিধাও দেওয়া হয়েছে।

যাত্রী সাধারণ যাতে ঝামেলামুক্তভাবে বাড়িতে বসেই লঞ্চের টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন সেজন্য ঢাকা নদীবন্দর থেকে চলাচলকারী কিছু লঞ্চের ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তবে সব লঞ্চের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালুর একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং সময়মতো তা কার্যকর করা সম্ভব হবে বলে আমরা আশাবাদী। সেই সাথে যাত্রীদের লঞ্চে ওঠানামা ও বার্দিং সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সদরঘাটে ঘাট বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। সদরঘাট টার্মিনালে আগে ১৩টি পন্টুনের মাধ্যমে পরিচালন কার্যক্রম চলে আসছিল। এখন সেখানে নতুন করে আরও ১২টি পন্টুন সংযোজন করা হয়েছে। এতে লঞ্চ ছাড়া ও ভেড়া এবং আগমন-নির্গমন অনেক সহজ হয়েছে।

পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যম বিশেষ করে সড়কপথের তুলনায় নৌপথে দুর্ঘটনা অনেক কম। দুর্ঘটনা আরও কমিয়ে আনতে আপনাদের উদ্যোগ কী?

১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গত ২৯ বছরে চার শতাধিক যাত্রীবাহী নৌদুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণহানি ঘটেছে প্রায় ৩ হাজার ৬৫৪ জন যাত্রীর। নৌ-দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কালবৈশাখী বা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, চালকের অদক্ষতা, গাফিলতি, জাহাজের নির্মাণ ও যান্ত্রিক ত্রুটি এসব দুর্ঘটনার কারণ। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন। এছাড়া কালবৈশাখী ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ২৫ এবং অন্যান্য কারণে ৪৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে এবং তা হলো, নৌযান পরিচালনাকারী অধিকাংশ শ্রমিক ও মালিক প্রচলিত আইনকানুন, নিরাপদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যথেষ্ট মাত্রায় সচেতন নন।

তবে বিআইডব্লিউটিএ বেশকিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নৌদুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। পদক্ষেপের অংশ হিসেবে নৌযানের সাথে নদীবন্দরের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও মনিটরিংয়ের জন্য ভেরি হাইফ্রিকোয়েন্স (ভিএইচএফ) যোগাযোগ চালু করা হয়েছে। গত অর্থবছরই আমরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী নদীবন্দরে এ ধরনের যোগাযোগ চালু করেছি। যাত্রীবাহী লঞ্চ যাতে মাত্রাতিরিক্ত গতিতে চলাচল না করে সেজন্য ঢাকা নদীবন্দর থেকে চলাচলকারী লঞ্চগুলোর জন্য ঢাকা থেকে মোক্তারপুর পর্যন্ত গতিসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকা নদীবন্দরের লঞ্চগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন টার্মিনাল ভবনের ছাদে একটি ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী সাধারণের চলাচল যাতে নিরাপদ হয় সেজন্য সব নদীবন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ লঞ্চঘাটগুলোতে পরিবহন পরিদর্শক, বার্দিং সারেং, ট্রাফিক সুপারভাইজার পদায়নের মাধ্যমে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি নদীবন্দরে স্থানীয় প্রশাসন ও নৌপুলিশের মাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উপকূলীয় নৌপথ সাধারণত অশান্ত থাকে। তাই প্রতি বছর ১৫ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে উপকূলীয় নৌপথ সি-সার্ভে (আংশিক উপকূলীয় চলাচল) ব্যতীত সব ধরনের উপকূলীয় নৌযানের রুট পারমিট ও সময়সূচি জারি বন্ধ রাখা হয়। এ সময় অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধে সংশ্লিষ্ট নৌপুলিশ ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়ে থাকে। এতে করে নৌপথে অবৈধ নৌযানের চলাচল অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।

কালবৈশাখী মৌসুমে নৌদুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকায় বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে এই সময়ে সব নদীবন্দরে বিশেষ মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরসমূহে আবহাওয়া বার্তা প্রচার করা হচ্ছে। পাশাপাশি যাত্রী সাধারণকে সচেতন করার লক্ষ্যে নৌ-হুঁশিয়ারি সম্বলিত বিভিন্ন স্লোগান বিলবোর্ড ও লিফলেট আকারে প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও জনসচেতনতামূলক বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হচ্ছে। এছাড়া দুর্ঘটনা এড়াতে রাতের বেলায় বালুবাহী ও মালবাহী নৌযান চলাচল সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভিজিল্যান্স টিমও গঠন করা হয়েছে এজন্য।

দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হলো নৌযানে বিশেষ করে লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন। দুই ঈদের সময় ঢাকা নদীবন্দরসহ দেশের সব নদীবন্দরে যাত্রী সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এসব নদীবন্দরে ঈদ যাত্রী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা অনুযায়ী সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ। কঠোর নজরদারিতে রাখা হচ্ছে নৌযানের ফিটনেসের দিকেও। এসবের ফল হিসেবে নৌযান দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছে।

দুর্ঘটনা এড়াতে নৌযান কর্মীদের দক্ষতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এজন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। নৌযান কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিআইডব্লিউটিএ কী করছে?

নিরাপদ নৌযোগাযোগ নিশ্চিত করতে নৌযান পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। নৌযানের ডেক ও ইঞ্জিন কর্মীদের দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে বিআইডবিøউটিএর নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনাকান্দায় এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষিত জনবল এরইমধ্যে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছেন। অভ্যন্তরীণ নৌপথে পর্যাপ্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরিতে বরিশাল ও মাদারীপুরে ডিপিটিসির আরও দুটি শাখা খোলা হয়েছে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুবিধা থাকায় আগ্রহী যে কেউ এসব কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।

মালিক সমিতিকে অনুরোধ করব তারা যেন নৌযান কর্মীদের প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্য আরও এগিয়ে আসেন। নিজ উদ্যোগে নৌযান শ্রমিকদের পক্ষে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা সম্ভব না হলে নৌযান মালিকগণ তাদের কর্মচারীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারেন। এ বিষয়ে মালিকপক্ষ আগ্রহী হলে বিআইডব্লিউটিএ নৌযান কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। প্রশিক্ষিত এই জনবল একসময় নৌযান মালিকদের সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। মনে রাখতে হবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও অভিজ্ঞ নৌযান কর্মী গড়ে তুলতে পারলে আমরা অবশ্যই নিরাপদ নৌপথ নিশ্চিত করতে পারব।

নৌদুর্ঘটনা প্রতিরোধে নৌযানের চালক, মালিক ও যাত্রীদের উদ্দেশে কী বলবেন?

নৌদুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য নৌযানের চালক/মাস্টার, যাত্রী ও মালিক সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। চালকদের প্রতি নির্দেশনা থাকবে যাত্রীদের বসার স্থানে মালামাল ওঠাবেন না এবং ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন করবেন না। বৈধ কাগজপত্র, জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামাদি লঞ্চে রাখবেন। যাত্রার পূর্বে ইঞ্জিন পরীক্ষা করুন এবং আবহাওয়া সংকেত মেনে চলুন। পথিমধ্যে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে লঞ্চটি দ্রæত নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিন, ঘাটে ভিড়ান এবং ছাড়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করুন। যাত্রীদের জীবনরক্ষায় অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করুন এবং যাত্রাপথে অন্য নৌযানের সাথে অহেতুক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবেন না। যাত্রা শুরু করার আগে হ্যাচ কভার পানিরোধক করে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করুন। লঞ্চের ছাদে কোনোভাবেই যাত্রী ওঠাবেন না এবং ধারণক্ষমতা অনুযায়ী যাত্রী বোঝাই হওয়ার সাথে সাথে ঘাট ত্যাগ করবেন।

নৌপথে নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে যাত্রী জনসচেতনতার বিকল্প নেই। ঈদ, পূজা-পার্বণ অথবা দীর্ঘ ছুটির সময় লঞ্চে যাত্রীর চাপ বেড়ে যায়। হঠাৎ যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রীতোলা হয়। তাই যাত্রীদের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবেÑকোনো লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে উঠবেন না এবং লঞ্চের ছাদে ভ্রমণ করবেন না। সেই সাথে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় লঞ্চযাত্রা থেকে বিরত থাকুন।

নৌযান মালিকদের প্রতি আমাদের অনুরোধÑরাডার, জিপিএস, ইকোসাউন্ডার ইত্যাদি আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করে নৌযানকে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সক্ষম করে তুলুন। সনদধারী, দক্ষ ও অভিজ্ঞ উপযুক্ত মাস্টার/সারেং ও চালকের মাধ্যমে লঞ্চ পরিচালনা করুন এবং ধারণক্ষমতা অনুযায়ী যাত্রী বোঝাই হওয়ার সাথে সাথে ঘাট ত্যাগ করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে মাস্টারকে নির্দেশ দিন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো দুর্ঘটনায় যদি একটি প্রাণহানিও ঘটে তাহলেও তা অপূরণীয় ক্ষতি। সরকারের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় বটে, তবে তা নিহতের পরিবারবর্গের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। যাত্রী সাধারণকে নিজের মধ্যে এই উপলব্ধি তৈরি করতে হবে যে জীবন সুরক্ষিত থাকলেই কেবল নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, দেশের জন্য কিছু করতে পারবেন। নৌযান চালকদের মধ্যে এই চেতনাবোধ তৈরি করতে হবে যে তিনি যে নৌযানটি পরিচালনা করছেন তার প্রতিটি যাত্রীকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তার। মালিকদেরও এটা মনে রাখতে হবে যে তিনি একটি সেবামূলক কাজে নিয়োজিত থেকে ব্যবসা করছেন। নৌযানকর্মীদের জন্য আমরা নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকি। মালিকরা চাইলে প্রশিক্ষকও আমরা দেব।

দুর্ঘটনার পর উদ্ধার তৎপরতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজগুলোর সক্ষমতা তুলনামূলক কম। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজ সংগ্রহের পরিকল্পনা আপনাদের আছে কিনা?

নৌযানের আকার এখন আগের চেয়ে বেড়েছে। সেগুলো দুর্ঘটনায় পড়লে উদ্ধারের জন্য অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজের প্রয়োজন পড়বে এটাই স্বাভাবিক। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা ২০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজ সংগ্রহের পরিকল্পনা নিয়েছি। তাছাড়া উদ্ধারকাজে বেসরকারি সহযোগিতায়ও অনেক সময় আমরা নিয়ে থাকি। সম্প্রতি পাটুরিয়ায় ডুবে যাওয়া ফেরি শাহ আমানত উদ্ধারেও আমরা বেসরকারি মাধ্যমের সহযোগিতা নিয়েছিলাম। উদ্ধারকাজে নৌবাহিনীর সালভেজ টিমও আমাদের বিভিন্ন সময় সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এছাড়া আমাদের যে ডুবুরি আছে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী? পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যমের সাথে তুলনা করলে মাধ্যমটিকে কোথায় কোথায় এগিয়ে রাখবেন?

পরিবহন মাধ্যম হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। প্রথমত এটি তুলনামূলক নিরাপদ। বিগত কয়েক বছরের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে চোখ রাখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আরেকটি কারণ হলো অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যয়সাশ্রয়ী। বিশ্বব্যাংকের ২০০৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক, রেল ও অভ্যন্তরীণ নৌপথের মধ্যে রেলের ট্যারিফ হার সবচেয়ে কম হওয়া সত্তেও গন্তব্যে পৌঁছাতে যে দূরত্ব পাড়ি দিতে হয় তার দৈর্ঘ্য নৌপথেই সবচেয়ে কম। এ কারণে অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রা করলে চূড়ান্ত ব্যয় অন্য মাধ্যমগুলোর চেয়ে কম হয়।

আর পণ্য পরিবহনে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ট্যারিফ হার অন্য সব মাধ্যমের তুলনায় কম। অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয় এক টাকারও কম। একই পরিমাণ পণ্য একই দূরত্বে পরিবহনে সড়কপথে খরচ পড়ে যেখানে সাড়ে ৪ টাকা এবং রেলপথে ২ টাকা ৫০ পয়সা। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক হিসাব করে দেখায় যে ১২ টন ধারণক্ষমতার ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে প্রতিটি কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া সড়কপথে ১২ হাজার টাকা ও রেলপথে ৬ হাজার টাকা। একই পণ্য অভ্যন্তরীণ নৌপথে পরিবহন করলে ভাড়া দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০০ টাকা।

আরেকটি কারণ হলো জ্বালানি দক্ষতা। ইউএনএসকাপের হিসাবে, প্রতি টন জ্বালানিতে নৌপথে যেখানে ২১৭ টন-কিলোমিটার পণ্য পরিবহন করা যায় সেখানে রেলপথে পরিবাহিত হয় ৮৫ টন-কিলোমিটার এবং সড়কপথে বড় ডিজেল ট্রাকে ২৫ টন-কিলোমিটার। জ্বালানি দক্ষতার অর্থ হলো কার্বন নিঃসরণ সীমিত রাখা। সেই সাথে পরিচালন ব্যয়ও কম হওয়া। বিশ্বব্যাংকের ২০০৭ সালের হিসাবে, সড়কের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করলে বছরে ৫ কোটি ৮৫ লাখ লিটার ডিজেল সাশ্রয় করা সম্ভব। এর ফলে বছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার টন কম কার্বনডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হবে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে পরিবেশের ওপর। জ্বালানি দক্ষতার পাশাপাশি মূলধনি বিনিয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে তুলনামূলক কম।

দারিদ্র্য দূরীকরণে অভ্যন্তরীণ নৌপথ কী ধরনের ভমিকা রাখতে পারে?

দারিদ্র্য হ্রাসের যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে যোগাযোগের সহজগম্যতা। সেদিক থেকে বললে বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ভূমিকা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রায় ১২ শতাংশের কেবল নৌপথের মাধ্যমেই যোগাযোগের সুযোগ রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগের প্রাপ্যতার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে তাদের জীবনযাত্রার ওপর। গ্রামীণ অঞ্চলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য রয়েছে সাড়ে ৭ লাখের মতো পাম্প ইঞ্জিনচালিত নৌকা। এছাড়া নৌ-পরিবহন খাতের কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ৬ লাখের বেশি। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ আবার নারী, যারা ল্যান্ডিং স্টেশনগুলোতে কাজ করেন। এছাড়া উপজাত হিসেবে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন সহজতর হচ্ছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বিবিএসের হিসাবে বাংলাদেশের জিডিপিতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের অবদান ১১ শতাংশের বেশি হলেও এতে নৌপথের হিস্যা ১ শতাংশেরও কম। তাছাড়া এ খাতের প্রবৃদ্ধিও দীর্ঘদিন ধরে স্থবির হয়ে আছে। এ ব্যাপারে কী বলবেন?

এ কথা ঠিক যে অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগের বিপুল সম্ভাবনা সত্তে¡ও বাংলাদেশের অর্থনীতি এ সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় অভ্যন্তরীণ নৌপথের অবদান সম্ভাবনার তুলনায় পিছিয়ে আছে। এর কারণ, পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ সময় পর্যন্ত খাতটির প্রতি সেইভাবে মনোযোগ না দেওয়া। বিবিএসের হিসাবে, স্থির মূল্যে বাংলাদেশের জিডিপিতে নৌপথের হিস্যা এখনো দশমিক ৬৬ শতাংশ। সার্বিকভাবে জিডিপিতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের হিস্যা ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এছাড়া সার্বিকভাবে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত প্রতি বছর ৫-৭ শতাংশ হারে বাড়লেও ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্তও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের ঘরে আটকে ছিল। তবে সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে নৌপরিবহন খাতে।

এক্ষেত্রে বিনিয়োগ স্বল্পতা আছে কি?

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতে বিনিয়োগের চাহিদা যে বাড়ছে সে কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়নে সরকার বিশেষ জোর দেওয়ায় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্য রকম গতি এসেছে। ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সাথে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগের বিদ্যমান অবকাঠামোর আধুনিকায়ন ও নতুন অবকাঠামো নির্মাণের দিকে। এছাড়া নতুন নৌপথ চালু ও বিদ্যমান নৌপথের নাব্যতা উন্নয়নে প্রতি বছরই ক্যাপিটাল ও মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং বৃদ্ধি বিনিয়োগের চাহিদা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই সরকারের আমলে নৌপথে উন্নয়ন বরাদ্দ বেড়েছেও। তবে তা যোগাযোগ অবকাঠামোয় মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ২ শতাংশের কম। যোগাযোগ অবকাঠামোয় বাজেট বরাদ্দের ৪৫ শতাংশের বেশি যাচ্ছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে। ২০ শতাংশের বেশি যাচ্ছে রেলওয়েতে। এর ফলাফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি। যাত্রী ও কার্গো পরিবহনের ৮০ শতাংশের বেশিই হচ্ছে সড়কপথে।

সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভমিকা রাখতে পারে অভ্যন্তরীণ নৌপথ। কীভাবে সেটা সম্ভব বলে মনে করেন?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে দেওয়া। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১-এ সেই পথরেখা বলে দেওয়া আছে। উন্নত দেশ হওয়ার পথযাত্রায় নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করবে আমদানি-রপ্তানি তথা পণ্য বাণিজ্য, যার সিংহভাগই পরিচালিত হবে সমুদ্রবন্দরগুলোর মাধ্যমে। রপ্তানি পণ্য সমুদ্রবন্দরে পৌঁছে দেওয়া ও আমদানি পণ্য গন্তব্যে নেওয়ার কাজে অভ্যন্তরীণ নৌপথের ব্যবহার বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এবং এটি দরকারও। সেটা হলে ব্যবসায়ীরা অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ে পণ্য পরিবহন যেমন করতে পারবেন, একই সাথে সড়কের ওপর বিদ্যমান চাপও অনেকটা লাঘব হবে। চূড়ান্ত বিচারে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার জট কমে আসবে, যা সমুদ্রবন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে।

কনটেইনার হ্যান্ডলিং উপযোগী নদীবন্দর এক্ষেত্রে বড় ভমিকা রাখতে পারে। আরও বেশি সংখ্যক কনটেইনার নদীবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের আছে কিনা?

কনটেইনার পরিবহনের লক্ষ্য থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে পানগাঁওয়ে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করেছে এবং ২০১৩ সাল থেকে এখানে কনটেইনার পরিবহন শুরুও হয়েছে। প্রথম দিকে পানগাঁও নৌ-টার্মিনালে কনটেইনার পরিবহনে ধীরগতি দেখা গেলেও ট্যারিফ কমানোর ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এটি ব্যবহারের আগ্রহ বাড়ছে। এছাড়া আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নদীবন্দর নির্মাণের কাজও পুরোদমে চলছে। নারায়ণগঞ্জের খানপুরেও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ও বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে চট্টগ্রাম, মোংলা এবং অন্যান্য বন্দর থেকে নদীপথে সহজেই কনটেইনার পরিবহন করা সম্ভব হবে। পানগাঁও, খানপুর ও আশুগঞ্জের পাশাপাশি মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়ায় ফেরিঘাটের আশেপাশেও এ ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ চলছে। রাজশাহী, ঢালার চর, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কুড়িগ্রামের মতো দেশের অন্যান্য স্থানেও অভ্যন্তরীণ নৌ-টার্মিনাল স্থাপনের সুযোগ রয়েছে। দেশের সব অর্থনৈতিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করেও অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা যেতে পারে। এগুলো করা গেলে কনটেইনার পরিবহনে সড়কপথের ওপর চাপ অনেক কমে আসবে এবং অভ্যন্তরীণ নৌপথে তুলনামূলক কম খরচে ও নিরাপদে কনটেইনার পরিবহনের তৈরি হবে। নিশ্চয় বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিবেচনায় রয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে তার বাস্তবায়নও আমরা দেখতে পাব।

২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ে এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্নযাত্রায় চ্যালেঞ্জও আছে। জলবায়ু পরিবর্তন এর মধ্যে অন্যতম। এই চ্যালেঞ্জ উতরে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছানোর পরিকল্পনাই হচ্ছে শতবর্ষী বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে অন্যতম অংশীজন বিআইডব্লিউটিএ। এ ব্যাপারে আপনাদের প্রস্তুতি কী?

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ মোটা দাগে পানিসম্পদকে কেন্দ্র করে হলেও তা বাস্তবায়নে অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার ভূমিকাও কম নয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ, মরফোলজিক্যাল ও জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে খাতটির ওপর। অনিয়মিত প্রবাহের কারণে নদীবক্ষে অত্যধিক পলি জমে নৌ-চলাচলে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিতে পড়ছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের নানা অবকাঠামোও। এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় টেকসই, দক্ষ ও আধুনিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাত গড়ে তুলতে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে মহাপরিকল্পনার অধীনে বাস্তবায়নের জন্য ৮০টি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে বিআইডবিøউটিএ। তিনটি পর্যায়ে অর্থাৎ ১০, ২০ ও ৩০ বছর মেয়াদে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প যেমন রয়েছে, একইভাবে আছে জ্ঞানভিত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্পও।

এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় অংকের বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। তবে আশার কথা হলো এসব বিনিয়োগ করতে হবে ধাপে ধাপে, যা সংস্থানযোগ্য।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের আপনার দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে কর্তৃপক্ষের তাৎপর্যপূর্ণ সব অর্জনও আছে। সেগুলো সম্পর্কে যদি কিছু বলেন। 

বিআইডব্লিউটিএ যে সাফল্যগুলো অর্জন করেছে তার দাবিদার কর্তৃপক্ষের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী। এটা কারও একার সাফল্য নয়। তার চেয়েও বড় কথা সাফল্যগুলো এসেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী দিকনির্দেশনা ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঠিক তত্ত্বাবধানের মধ্য দিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ এই সময়ে আমাদের করতে হয়েছেÑনদীতীরের অবৈধ দখল উচ্ছেদ। কারও প্রতি কোনো ধরনের আনুকূল্য না দেখিয়ে কাজটি আমরা করে যাচ্ছি। ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ এই দুই অর্থবছরে আমরা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন নদীর সীমানা পিলারের অভ্যন্তরে ৪ হাজার ৭০৬টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদপূর্বক ১২৯ দশমিক ৭৫ একর তীরভূমি অবমুক্ত করেছি। অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী যাত্রীরা ময়লা-আবর্জনা নদীতে না ফেলে যাতে ডাস্টবিনে ফেলেন সেই ব্যবস্থা করেছি। যাত্রীদের বিনোদনের জন্য যাত্রীবাহী বড় লঞ্চে পাঠাগার স্থাপন, পত্রিকা সরবরাহ ও ইন্টারনেট সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর বহরে গত অর্থবছর ২০টি কাটার সাকশন ড্রেজার, ৮৩টি ড্রেজার সহায়ক জলযান, একটি প্রশিক্ষণ জাহাজ ‘টিএস ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী’ (দাদা ভাই), একটি বিশেষ পরিদর্শন জাহাজ ‘পরিদর্শী’ জাহাজ সংযোজিত হয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের ৬ মে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে যেগুলো উদ্বোধন করেছেন। নারায়ণগঞ্জের খানপুরে নির্মিত ড্রেজার বেজও এদিন উদ্বোধন করেন তিনি। মাননীয় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী জনাব খালিদ মাহ্‌মুদ চৌধুরী এমপির আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য ‘রিয়েল টাইম ড্রেজ মনিটরিং সিস্টেম’ ২০২০ সালের ২০ জুলাই পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে। ফলে ড্রেজিংয়ে স্বচ্ছতা যেমন আসবে একইভাবে ড্রেজারের বিলিং সিস্টেমও আরও সহজ হবে।

করোনা মহামারির কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও অস্বাভাবিক সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এর মধ্যেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঐকান্তিক চেষ্টায় নৌপথে পণ্য পরিবহন আমরা অব্যাহত রেখেছি। কোভিডের মধ্যে ৫০ হাজার নৌযান শ্রমিককে আমরা খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। এছাড়া ২ হাজার ৫০০ টাকা করে অর্থ সহায়তা পেয়েছেন ৩ হাজার নৌযান শ্রমিক।

বিআইডব্লিউটিএর আওতায় গত বছর প্রথমবারের মতো নৌপথে বাংলাদেশ থেকে খাদ্যসামগ্রী ভারতে রপ্তানি করা গেছে। এটাও বড় একটা অর্জন। তার আগে ২০২০ সালে নবঘোষিত প্রটোকল রুট ৯ ও ১০ ব্যবহার করে ট্রায়াল রান হিসেবে বাংলাদেশি নৌযানের মাধ্যমে ১০ টন সিমেন্ট ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে রপ্তানি করা হয়।

১৯৬৭ সালে যে ভাসমান ডকটি সংগ্রহ করা হয়েছিল পুনর্বাসনের লক্ষ্যে জাহাজটি প্রথমবারের মতো ডকিং করা হয়। সেই সাথে সংস্কারের মাধ্যমে এর কার্যক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার চারপাশের নদীতীরে সীমানা পিলার স্থাপন, উচ্ছেদকৃত স্থানে ওয়াকওয়ে ও ইকোপার্ক নির্মাণের কাজও কাক্সিক্ষত গতিতে হচ্ছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমরা করেছি এবং তা হলো মানিকগঞ্জের আরিচা ও পাবনার কাজিরহাট রুটে ফেরি সার্ভিস চালু। ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মাননীয় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী জনাব খালিদ মাহ্‌মুদ, এমপি রুটটিতে ফেরি চলাচল উদ্বোধন করেন। এছাড়া বালাসী-বাহাদুরাবাদ রুটে পরীক্ষামূলক লঞ্চ সার্ভিস আমরা চালু করেছি।

সততা ও নৈতিকতার স্বীকৃতি হিসেবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের মধ্য থেকে আপনাকে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে যদি কিছু বলেন।

২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়নে বিআইডব্লিউটিএর তার কাজ লক্ষ্যে অবিচল থেকে পালন করে যাচ্ছে। এই পুরস্কার হয়তো নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তারই স্বীকৃতি। এই অর্জন আমার একার নয়, বরং কর্তৃপক্ষের প্রত্যেক কর্মীর। আমি শুধু দিকনির্দেশনা দিয়েছি, তারা কাজ করেছেন। মাঠে থেকে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ বাস্তবায়ন করেছেন। আমরা উচ্ছেদ অভিযানে গিয়েছি, সততার পরিচয় দিয়েছি, কোথাও নত হইনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব পাশে ছিলেন বলেই আমরা ভালো করতে পেরেছি এবং শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছি। একতাবদ্ধভাবে একই লক্ষ্যে অবিচল থেকে যার যে কাজ সে কাজটুকু সঠিকভাবে করলে বিআইডব্লিউটিএ সামনের দিনগুলোতে আরো ভালো করবে এবং দেশ এগিয়ে যাবে।

নদী রক্ষায় আপনার পরামর্শ কী? 

নদী আমাদের দিনযাপনের জীবনরেখা। নদী শুধু বেঁচে থাকার রসদই জোগায় না, আমাদের যে আবেগ, সংস্কার তাকেও ঘিরে আছে এই নদী। নদী আমাদের মায়ের মতো। মানবসভ্যতার বিকাশে নদীর ভূমিকা অপরিসীম। হোয়াংহো এবং ইয়াংসিকিয়াং নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল চীন সভ্যতা, নীল নদের তীরে মিসরীয় সভ্যতা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেসোপটেমীয় সভ্যতা এবং সিন্ধু নদের তীরে সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা। আমাদের এই প্রাণের শহর ঢাকারও পত্তন হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। তাই নদীকে রক্ষা করা আমাদের অস্তিত্বের জন্যই জরুরি।

নদী আমাদের জন্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটা মানুষেরই তা উপলব্ধি করা উচিত। বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থায় নদী নিয়ে প্রচুর বিষয় থাকা প্রয়োজন।

শিল্প বর্জ্য আমাদের নদীর জন্য খুবই ক্ষতিকর। নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে এই শিল্প বর্জ্য বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। দূষণের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অভিযান চালানো হয় বটে। তবে অভিযান বন্ধ হলেই নদীতে আবার শিল্প বর্জ্য ফেলা হয়। তবে আমাদেরকে আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এই চেষ্টায় সাধারণ মানুষকে আমাদের পাশে পাওয়াটা খুব দরকার। শুধু পাশে থাকলেই হবে না। একইভাবে তাদের সচেতনও হতে হবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলে গেছেন, ‘হোয়াংহো নদীর প্লাবন, টেনেসিভ্যালির তাণ্ডব ও দানিয়ুবের দুর্দমতাকে বশে আনিয়া যদি মানুষ জীবনের সুখ সমৃদ্ধির পথ রচনা করিতে পারে তবে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মত শান্ত নদীকে আয়ত্ত করিয়া আমরা কেন বন্যার অভিশাপ হইতে মুক্ত হইব না?’ এই বিষয়টিতে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। সোনার বাংলা গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর এই শ্লোগানকে ধারণ করে আমরা যেন সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here