বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুধবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
17 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

উচ্চ আয়ে পৌঁছানোর সিঁড়ি হতে পারে শক্তিশালী নৌপরিবহন

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার আকাঙ্খা। আর ভিত্তি অন্তর্ভুক্তিমূলক উচ্চ প্রবৃদ্ধি। এজন্য দরকার দক্ষতার সাথে সব খাতের কৃতকর্মের সফল সম্পাদন। নৌপরিবহন খাতের অবস্থান এই বৃত্তের প্রান্তে নয়, বরং কেন্দ্রেই। আর নিরাপদ নৌ চলাচল নিশ্চিত করার ভূমিকায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের রেগুলেটরি সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তর। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট থেকে সংস্থার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন, (সি), পিসিজিএম, এনডিসি, পিএসসি, বিএন। অধিদপ্তরের সার্বিক কর্মকাণ্ড, অর্জন, প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার কথা সম্প্রতি তুলে ধরেছেন নদীবাংলার কাছে।

নৌপরিবহন বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা পরিবহন খাতের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নৌ সংক্রান্ত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দক্ষ, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব নৌ চলাচল নিশ্চিত করতে কাজ করছে অধিদপ্তর। শুরুতেই সংস্থাটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চাই।

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : নৌ যোগাযোগের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে আমাদের। ঐতিহাসিক কাল থেকেই আমাদের শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন ছিল, একই সাথে ছিল আন্তর্জাতিক নৌ চলাচল কার্যক্রম। স্বাধীনতার আগে আন্তর্জাতিক নৌ চলাচল দেখভালের দায়িত্ব পালন করত ‘কন্ট্রোলার অব শিপিং’। ‘নেভিগেশন ডিরেক্টরেট’ পালন করত অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সম্পর্কিত দায়িত্ব।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে নৌপরিবহন খাতের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্য বিধানে এবং সুরক্ষিত ও নিরাপদ নৌ চলাচল নিশ্চিত করতে খাতটির কার্যক্রম আরও সহজ ও দক্ষ করে তোলা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই লক্ষ্য থেকেই তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বন্দর, জাহাজ চলাচল ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন বিভাগের অধীনে ‘ডিরেক্টরেট অব শিপিং’ গঠন করে সরকার। ১৯৭৬ সালে ‘ডিরেক্টরেট অব শিপিং’ ও ‘কন্ট্রোলার অব শিপিং’ একীভ‚ত হয়ে গঠিত হয় ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং বা নৌপরিবহন অধিদপ্তর।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কার্যপরিধি সম্পর্কে কিছু বলুন।

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : নৌপরিবহন অধিদপ্তর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি রেগুলেটরি সংস্থা। সংস্থাটি মেরিটাইম প্রশাসন হিসেবে নিরাপদ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমুদ্রগামী জাহাজের নিরাপত্তা ও পরিবেশদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। জাহাজে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ও সনদায়ন এবং নৌবাণিজ্যের উন্নয়নে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সম্পর্কিত ফোকাল পয়েন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স (আইএসও) ১৯৭৬, মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্স (এমএসও) ১৯৮৩ এবং ফ্ল্যাগ ভেসেলস (প্রটেকশন) অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩-এর আওতায় প্রণীত বিধিবিধান ও আন্তর্জাতিক মেরিটাইম কনভেনশনগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তর তার মূল কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

এসব কাজের মধ্যে আছে সমুদ্রগামী মাছ ধরা, উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ নৌযানের নিবন্ধন ও জরিপ এবং এসব জাহাজের কর্মকর্তা ও নাবিকদের যোগ্যতা সনদ, পরীক্ষা গ্রহণ ও সনদ প্রদান। নৌযানের নকশা ও ডিজাইন অনুমোদন, আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মেরিন কোর্টে বিচারকাজ পরিচালনা, অভ্যন্তরীণ নৌযানের বে-ক্রসিং অনুমতি, নৌ দুর্ঘটনা তদন্ত, ভ্রাম্যমাণ নৌ আদালত পরিচালনা, ক্লাসিফিকেশন সোসাইটিসমূহের কার্যক্রম মনিটরিং, আইন অমান্যকারী নৌযান, মালিক ও মাস্টারের বিরুদ্ধে মামলা, বাংলাদেশি বন্দরে আগত বিদেশি জাহাজ পোর্ট স্টেট কন্ট্রোলের আওতায় পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা, বাংলাদেশের বন্দরে আগত সব বিদেশি জাহাজের ফিটনেস যাচাইকরণের কাজও করে থাকে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। নিরাপদ নৌ চলাচলের স্বার্থে কুতুবদিয়া, কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন বাতিঘর থেকে নৌযানসমূহকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় এবং রাজস্বও আহরণ করা হয়। নৌ চলাচল-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিধিবিধান যেমন দ্য ইন্টারন্যাশনাল শিপ অ্যান্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি (আইএসপিএফএস) কোড ও বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনভেন বাস্তবায়ন; আইএলওর বিধান মোতাবেক বাংলাদেশি নাবিকদের বরাবর নাবিক পরিচয়পত্র জারি; এসটিসিডবিøউ কনভেনশন ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী কর্মকর্তা, ক্যাডেট ও রেটিংদের প্রশিক্ষণ মনিটরিং; আইএমও, আইএলও এবং শিপিং-সংক্রান্ত অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ রক্ষা এবং অন্যান্য মেরিটাইম দেশের সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্বও অধিদপ্তরের। এছাড়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জলসীমায় বিপদগ্রস্ত জাহাজ উদ্ধার ও অনুসন্ধান কার্যক্রম সমন্বয়, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বাণিজ্যিক জাহাজের বিরুদ্ধে জলদস্যুতা ও অবৈধ কার্যক্রম রোধ, মেরিটাইম বিধিবিধান তৈরি, ম্যানিং এজেন্টদের লাইসেন্স প্রদান, বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের স্বার্থ সংরক্ষণ, শিপিং বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ প্রদান, নৌ পরিবেশদূষণ প্রতিরোধ, সমুদ্রগামী জাহাজের নিয়োগ, নিষ্কৃতি ও বেতন-ভাতা পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশি নাবিকদের স্বার্থ রক্ষা, বাংলাদেশি নাবিকদের অনুকুলে সিডিসি জারি, রপ্তানি পণ্যের ওজন-সংক্রান্ত ভেরিফায়েড গ্রস মাসের অনুমতি প্রদান করা হয়। সেই সাথে সমুদ্রগামী, উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ নৌযানের মিনিমাম সেফ ম্যানিং ডকুমেন্ট জারি করে থাকে নৌপরিবহন অধিদপ্তর।

এসব কার্যক্রম সমন্বয় করেন কীভাবে?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : স্থানীয় বিভিন্ন কার্যালয়ের মাধ্যমে অধিদপ্তর তার কার্যক্রমগুলো সম্পাদন ও সমন্বয় করে থাকে। যেমন মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩-এর আওতায় সমুদ্রগামী ও উপকূলীয় জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে চট্টগ্রামে অবস্থিত অধিদপ্তরের নৌবাণিজ্য অফিস। মোংলা বন্দরের জাহাজকে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে খুলনায়ও এর একটি শাখা অফিস রয়েছে। মোটকথা, মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩০এর প্রয়োগ; সমুদ্রগামী ও উপকূলীয় জাহাজের নিবন্ধন, জরিপ ও পরিদর্শন; জাহাজের সেফটি ইকুইপমেন্ট সনদ, সিওয়ার্দি সনদ এবং চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে জাহাজের আগমন ও নির্গমনের অনাপত্তি প্রদান করে থাকে নৌবাণিজ্য অফিস। পাশাপাশি সমুদ্রে নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেগুলোও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন ও বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থেকে সিফেয়ারারদের কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট (সিডিসি) ইস্যু, সিফেয়ারারদের সাইন ইন ও সাইন অফ এবং দেশিয় ও বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে বাংলাদেশি নাবিকদের কর্মসংস্থান-সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করে সরকারি শিপিং অফিস। এর বাইরে জাহাজে সিফেয়ারারদের নিয়োগ-সংক্রান্ত কোনো সমস্যা বা বিরোধ তৈরি হলে তা নিষ্পত্তি এবং নাবিক তহবিল পরিচালনা ও দেখভালও সরকারি শিপিং অফিসের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬-এর আওতায় নৌ চলাচল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা, ভৈরব ও চট্টগ্রামে ছয়টি নিবন্ধন ও জরিপ (রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড সার্ভে) কার্যালয় এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, রাজশাহী ও ভোলায় ১০টি অভ্যন্তরীণ নৌযান পরিদর্শন (ইন্সপেক্টরেট অব ইনল্যান্ড শিপস) কার্যালয় রয়েছে। অধিদপ্তরের অধীন মাঠপর্যায়ের কার্যালয় হিসেবে কাজ করে। রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড সার্ভে অফিসের নিবন্ধক ও জরিপকারকরা নতুন নির্মিত জাহাজের নিবন্ধন দিয়ে থাকেন এবং বার্ষিক জরিপকাজ পরিচালনা করেন। অভ্যন্তরীণ নৌযানগুলোতে ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬-এ উল্লেখিত বিধিবিধান সঠিকভাবে পরিপালিত হচ্ছে কিনা ইন্সপেক্টরেট অফিসের পরিদর্শকরা সময় সময় তা পরীক্ষা করে দেখেন। কেউ আইন অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সব ধরনের ক্ষমতা তাদের দেওয়া আছে। আর সিফেয়ারারদের কল্যাণে কাজ করছে নাবিক ও প্রবাসী শ্রমিক কল্যাণ পরিদপ্তর বা ডিরেক্টরেট অব সিম্যান ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড ইমিগ্রেশন।

এছাড়া দক্ষ, যুগোপযোগী ও কার্যকর নৌপরিবহন খাত গড়ে তুলতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনায় উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কার্যক্রমও সম্পাদন করে থাকে নৌপরিবহন অধিদপ্তর।

নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি আত্মীকরণ এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন যেকোনো প্রতিষ্ঠানেরই দক্ষতা উন্নয়নের পূর্বশর্ত। নৌপরিবহন খাতের গুরুত্বপূর্ণ রেগুলেটরি সংস্থা হিসেবে নৌপরিবহন অধিদপ্তর সেটা কতটা সফলভাবে করতে পারছে?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতিকে অস্বীকার করে বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব নয়। নৌপরিবহন অধিদপ্তর কখনই এ থেকে বিচ্যুত ও বিস্মৃত হয়নি। সনদ, প্রশিক্ষণ ও ফি সংক্রান্ত অনেক কার্যক্রমে অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশি সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকদের কনটিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট (সিডিসি), সার্টিফিকেট অব কম্পিট্যান্সি (সিওসি) এবং সার্টিফিকেট অব প্রফিশিয়েন্সি (সিওপি) এখন অনলাইনে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এসব সনদ তৈরির কাজ সম্পাদনের তথ্য সেলফোন বার্তার মাধ্যমে সেবাগ্রহীতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ নৌযানের মাস্টার ড্রাইভারদের যোগ্যতা সনদ যাচাইয়েও অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকরা পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের আবেদন অনলাইনে করতে পারছেন এবং নন-ট্যাক্স রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন সেবার ফি অনলাইনে গ্রহণ করা হচ্ছে। নাবিকদের সাইন অন ও সাইন অফ কার্যক্রমও আংশিক অনলাইনে সম্পাদন হচ্ছে। বাংলাদেশি এসব নাবিক যাতে সহজে বিদেশি জাহাজে যোগদান ও বিভিন্ন বন্দরে নির্বিঘেœ গমনাগমন করতে পারেন সেজন্য তাদের জন্য মেশিন রিডেবল পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সমুদ্রগামী ও অভ্যন্তরীণ নৌযানের নাবিকদের পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের আবেদন এবং সেফ ম্যানিং সনদ, জাহাজ জরিপ সনদ, জাহাজ নির্মাণের ছাড়পত্র, ডিজাইন তৈরি ও অন্যান্য বিষয়ে অনাপত্তির জন্য নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সেবাগ্রহীতারা অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছেন। এসবই করা হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আকাঙ্খা বাস্তবায়নে, সেবাগ্রহীতাকে সহজে সেবাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান ও অধিদপ্তরের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে।

নাবিকদের সনদ জালিয়াতি একটি আলোচিত বিষয়। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্যও এটা হানিকর। এই জালিয়াতি বন্ধে নৌপরিবহন অধিদপ্তর কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : সনদ জালিয়াতির ঘটনা যে ঘটেনি তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এর বিরুদ্ধে আমরা বিলম্ব না করে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছি। সম্প্রতি জাল সনদ তৈরি ও অধিদপ্তরের নামে ভুয়া ওয়েবসাইটে তা আপলোড করার বিষয়টি জানতে পেরে আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তা অবগত করি এবং জাল সনদ তৈরিতে জড়িত চক্রটিকে তারা গ্রেপ্তারও করেছে। বিভিন্ন সময় শনাক্ত হওয়া জাল সনদের তালিকা আমরা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দিয়ে দিয়েছি।

সনদ জালিয়াতি যাতে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয় সে লক্ষ্যে নিরাপত্তা ছাপসংবলিত যুগোপযোগী যোগ্যতা সনদ প্রবর্তন করা হয়েছে। সিডিসি যাতে কেউ জাল করতে না পারে, সেজন্য বিশেষ নিরাপত্তা (আলট্রা ভায়োলেট, মাইক্রো সিকিউরিটি লাইন, অ্যান্টি ফটোকপি, কুইক রেসপন্স কোড) বৈশিষ্ট্যযুক্ত কাগজে পাশর্^বর্তী অন্যান্য দেশের সিডিসি বা সিম্যান বুকের মতো হাতে লেখার পরিবর্তে মেশিন প্রিন্টেড সিডিসি চালু করেছে অধিদপ্তর। আশা করি, অধিদপ্তরের এসব উদ্যোগের ফলে সনদ জালিয়াতি বন্ধ হবে এবং বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত থাকবে।

নৌ দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো কী বলে মনে করেন। নৌযানে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিশেষ কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : নানা কারণে নৌ দুর্ঘটনা ঘটে। তবে এককভাবে প্রধান কারণ অতিরিক্ত কার্গো ও যাত্রী পরিবহন। নৌপথে ৫৬ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটে এই কারণে। ১০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে যন্ত্রপাতি কাজ না করার কারণে। ৬ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে নৌ পাইলট না নেওয়ার জন্য। আর ৮ শতাংশ দুর্ঘটনার সাথে মানব ত্রæটি জড়িত। এখানে ক্রুদের দক্ষতার অভাব আছে। এক জাহাজের ক্রুরা হয়তো দক্ষ, কিন্তু আরেক জাহাজের ক্রুরা নন। চালকদের অনেকে আইন সম্পর্কেও অতটা ওয়াকিবহাল নন। সেই সাথে নৌ ব্যবস্থাপনারও সমস্যা আছে।
আমি বলব, আমাদের এখানে সামষ্টিকভাবে সেফটি কালচারের অভাব রয়েছে। যখন জাহাজ সার্ভে হয় তখন সব অ্যাপ্লায়েন্স থাকে। কিন্তু আস্তে আস্তে উদাসীনতা, অবহেলা ও প্রশিক্ষণের অভাবে তারা যে সকল অ্যাপ্লায়েন্স আছে, জরুরি পরিস্থিতে সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন না। তবে আমরা যেটা করেছি, তা হলো অগ্নিদুর্ঘটনার পর আমরা ‘ট্রেইন দ্য ট্রেইনার’ প্রোগ্রামের আওতায় প্রথমে আমাদের সার্ভেয়ারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা আবার বিভিন্ন নদীবন্দরে মাস্টার এবং ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মাস্টার এবং ড্রাইভাররা আবার অন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এসব প্রশিক্ষণে মালিকপক্ষকেও রাখা হয়েছিল। এছাড়া আমরা বিমানের মতো সেফটি ভিডিও তৈরি করে জাহাজে জাহাজে দিয়ে দিয়েছি, যাতে করে বসার আগে সবাই যেন সেফটি ভিডিওটা দেখেন। সব জাহাজে এটা দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

জাহাজের ড্রয়িং, ডিাজাইনের ক্ষেত্রেও ফায়ার সেফটি ফিচারগুলো আমরা যুক্ত করে দিয়েছি। বিদ্যমান জাহাজে কোন ধরনের সেফটি ফিচার যুক্ত করতে হবে, সে সংক্রান্ত নির্দেশনা আমরা জারি করেছি। আর নতুন জাহাজে ফায়ার পাম্প এবং ফায়ার হাইড্রেন্ট দিয়েছি, জাহাজের ইঞ্জিন কক্ষ, যেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়, সেখানে কার্বন ডাই-অক্সাইড বোতলের ব্যবস্থা করেছি। সারা পৃথিবীতেই এখন জাহাজের সব ইঞ্জিনকক্ষ বদ্ধ। কিন্তু আমাদের এখানে জাহাজের ইঞ্জিনকক্ষ এখানো উন্মুক্ত। তাই যেসব সেফটি ফিচারের কথা বললাম, এগুলো না থাকলে আগামীতে কোনো ডিজাইন আমরা অনুমোদন করব না। এগুলো সঠিকভাবে পরিপালন করলে নৌ দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে বলে আমি বিশ^াস করি।

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে ঠিক কত সংখ্যক নৌযান চলাচল করে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। অথচ সব নৌযানকে নিবন্ধনের আওতায় এনে ফিটনেস নিশ্চিত করতে এর সংখ্যা জানাটা জরুরি। নৌযানের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে নৌশুমারি বা এ জাতীয় কোনো উদ্যোগ গ্রহণের পরিকল্পনা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের আছে কি?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : নৌ দুর্ঘটনা কমাতে ও নৌপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে বাংলাদেশের জলসীমায় চলাচলকারী যন্ত্রচালিত সব নৌযানের একটি ডেটাবেজ তৈরি করতে চাইছি আমরা। এর অংশ হিসেবে ‘নৌযানের ডেটাবেজ তৈরি ও নৌযান ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বাড়ানো’ শিরোনামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে নৌযানের তথ্যভান্ডার তৈরির কাজ শুরু হবে। তথ্যভান্ডার তৈরি হয়ে গেলে নৌ দুর্ঘটনা কমে আসবে এবং নৌপথে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রকৃত সংখ্যা জানার পর সব নৌযানকে নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এতে করে সরকারের রাজস্বও বাড়বে।

নিবন্ধন ছাড়াই চলাচল করছে বিপুলসংখ্যক স্পিডবোট, যেগুলোর ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন আছে। নৌপথে অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন স্পিডবোট বন্ধে অধিদপ্তর কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : স্পিডবোটকে নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নিবন্ধনবিহীন কোনো স্পিডবোট যাতে চলাচল করতে না পারে, সে ব্যাপারে মাননীয় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীরও নির্দেশ রয়েছে। স্পিডবোটের নিবন্ধনের ব্যাপারে আমরা শক্ত অবস্থানে আছি। গত বছরের মে মাসে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটের সামনে একটি বাল্কহেডের সাথে স্পিডবোটের ধাক্কায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় নিবন্ধন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। আর ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ অনুযায়ী স্পিডবোট চালকদের লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক। গত বছরের দুর্ঘটনার পরপরই বিপুলসংখ্যক চালকের পরীক্ষা নিয়ে তাদের সনদ দেওয়া হয়েছে। এটি একটা ধারাবাহিক কার্যক্রম এবং আগামীতেও জারি থাকবে।

মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পর সুনীল অর্থনীতি ঘিরে বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারও এই সম্পদ আহরণের ওপর জোর দিচ্ছে। এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে সমুদ্রদূষণ। কারণ এর ফলে হুমকিতে পড়বে জীববৈচিত্র্য। তাই সমুদ্রদূষণ রোধে সরকারের উদ্যোগ কী?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : বাংলাদেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষের বাস উপকূলে এবং তাদের অনেকেরই জীবিকা প্রত্যক্ষভাবে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। তাই সমুদ্রদূষণ রোধ পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে যতটা না, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতি ও উন্নয়নের প্রশ্নে। দূষণের কারণে সামুদ্রিক পরিবেশ যে বিপন্ন হতে পারে-জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দূরদর্শিতা দিয়ে সেই সময়েই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই ১৯৭৪ সালে প্রণীত টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্টে এ-সংক্রান্ত ধারা সংযোজন করা হয়। আইনের অষ্টম অনুচ্ছেদে সমুদ্রদূষণ রোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং সমুদ্রের পরিবেশ ও প্রতিবেশগত মান ও ভারসাম্য ধরে রাখতে সরকার মনে করলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই আইনের নবম অনুচ্ছেদে সরকারকে এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

সমুদ্রদূষণ রোধে এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অনেকগুলো কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন অয়েল পলিউশন প্রিপেয়ার্ডনেস, রেসপন্স অ্যান্ড কো-অপারেশন ১৯৯০; বাসেল কনভেনশন অন দ্য কন্ট্রোল অব ট্রান্স বাউন্ডারি মুভমেন্ট অব হ্যাজার্ডাস ওয়েস্টস অ্যান্ড দেয়ার ডিসপোজাল ১৯৮৯; ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি ১৯৮২; ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন রিলেটিং টু ইন্টারভেনশন অন দ্য হাই সিস ইন কেসেস অব অয়েল পলিউশন ক্যাজুয়ালটিজ ১৯৬৯ এবং ১৯৭৮ সালের প্রটোকল দ্বারা পরিমার্জিত ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রিভেনশন অব পলিউশন অব দ্য সি বাই অয়েল ১৯৭৩ (মারপল) এর মধ্যে অন্যতম। জ্বালানি তেল, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, প্যাকেটজাত ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান ও বর্জ্যরে কারণে সমুদ্রদূষণ প্রতিরোধে মারপলের ছয়টি সংযোজনী (১ থেকে ৬) বাংলাদেশে কার্যকর আছে। এগুলো যাতে সঠিকভাবে পরিপালন হয়, সেই পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।

মারপলের সংযোজনী ১-এ জাহাজের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দূষণ রোধে কিছু উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। একই সাথে দূষণ রোধে আগে থেকেই চলে আসা কিছু চর্চার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের কথা বলা হয়েছে। সংযোজনী ২-এ নক্সাস লিকুইড সাবস্ট্যান্স (এনএলএস) পরিবহনের সময় উৎপন্ন বর্জ্যরে কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের বর্জ্য সংবেদনশীল সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য জ্বালানি তেলের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। এই সংযোজনীতে ২৫০টি উপাদানকে এনএলএস হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং দূষণ ব্যতিরেকে তা অপসারণের সুনির্দিষ্ট মানদÐ ও প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। নিকটবর্তী ১২ মাইল পর্যন্ত ভূমিতে এনএলএস অপসারণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। প্যাকেটজাত অবস্থায় ক্ষতিকর দ্রব্য থেকে দূষণ প্রতিরোধের কথা বলা হয়েছে মারপলের সংযোজনী ৩-এ। এসব দ্রব্যের প্যাকিং, মার্কিং, লেবেলিং, নথিকরণ, সংরক্ষণ এবং দূষণ প্রতিরোধের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে সংযোজনীটিতে। জাহাজের বর্জ্য থেকে দূষণ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত বলে দেওয়া আছে কনভেনশনের সংযোজনী ৪-এ। মারপলের সংযোজনী ৫-এ জাহাজ থেকে সমুদ্রে সব ধরনের প্লাস্টিক ফেলা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মারপল কনভেনশনের সংযোজনী ৬-এ জাহাজভিত্তিক বায়ুদূষণ প্রতিরোধের কথা বলা হয়েছে। ২০০৫ সালের ১৯ মে থেকে এটি কার্যকর হয়েছে।

বাণিজ্যিক জাহাজে বাংলাদেশি প্রশিক্ষিত নাবিকের সংখ্যা ১৫ হাজারের মতো। সম্ভাবনার তুলনায় এ সংখ্যাকে যথেষ্ট মনে করেন কি?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : আমাদের দেশে পেশাদার সিফেয়ারারের সংখ্যা ১২-১৫ হাজার হতে পারে। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় এবং তা হলো আমাদের অফিসারের সংখ্যা বেশি; নাবিকের সংখ্যা কম। আমি এটাকে উল্টো লেখচিত্র বলে মনে করি। কারণ বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল দেশ। সবচেয়ে বেশি সিফেয়ারার জোগান দিচ্ছে যেসব দেশ বিশেষ করে ভারত, ফিলিপাইনকে বাদ দিয়ে ইউক্রেন, রাশিয়া, চীনের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যাবে তারা কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলে না। সুতরাং ভাষা এখানে সে রকম কোনো প্রতিবন্ধক নয়।

সেদিক থেকে দেখলে আমাদের জন্য বাড়তি একটা সুবিধা ছিলই। কিন্তু যেসব প্রশিক্ষিত নাবিকের এখানে আসার কথা তারা আসেননি। অথচ এটা সম্ভাবনাময় একটা খাত এবং মাত্র ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে ৫০০-৬০০ ডলার প্রারম্ভিক বেতনে জাহাজে চাকরির সুযোগ রয়েছে। এছাড়া আমাদের বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা এখন ৮৭।

আমাদের অর্থনীতির জন্য নাবিকরাও গুরুত্বপূর্ণ। তারা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকেন। অর্থাৎ তাদের দ্বারা দেশের রাজস্ব বাড়বে। ব্লু ইকোনমিও যদি দেখেন তাহলে আমি মনে করি এটা খুবই সম্ভাবনায়ময় একটা খাত এবং আমাদের প্রশিক্ষিত নাবিক বাড়ানোর দরকার আছে। আমরা এখন খাতটিতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। সরকারি ও বেসরকারি নাবিক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে এবং প্রশিক্ষণও শুরু হয়েছে। মনে রাখতে হবে এগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি যেসব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে, সেগুলোর কাজ শুধু প্রশিক্ষণ দেওয়া নয়, চাকরিটাও নিশ্চিত করে দেওয়া।

পরিবহনের সবচেয়ে সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব মাধ্যম হওয়ার পর দেশের জিডিপিতে নৌপরিবহন খাতের হিস্যা ১ শতাংশেরও কম। এর কারণ কী বলে মনে করেন? জিডিপিতে নৌপরিবহন খাতের হিস্যা বাড়ানোরই বা উপায় কী?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : এর একটা কারণ হতে পারে যেভাবে দরকার ছিল, দীর্ঘদিন যাবৎ সেভাবে নজর দেওয়া হয়নি। আমাদের ২৪ হাজার কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ নৌ নেটওয়ার্ক থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণ বিশেষ করে ড্রেজিংয়ের অভাবে সারা বছর নাব্য নৌপথের দৈর্ঘ্য এক সময় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারে নেমে আসে। অথচ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের হাজারো অগ্রাধিকারের মধ্যেও নৌপরিবহন খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৪ সালের ৮ জুলাই থেকে ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত মন্ত্রণালয়টি নিজ হাতে রেখেছিলেন। নৌপথ খননের জন্য স্বাধীনতার পরপরই বিদেশ থেকে সাতটি ড্রেজার সংগ্রহেরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে বর্তমান সরকার নৌপরিবহন খাতের উন্নয়নে বিশেষ জোর দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং লক্ষ্য বাস্তবায়নে ড্রেজিং মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী কাজও চলছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে জিডিপিতে নৌপরিবহন খাতের ১ শতাংশ হিস্যার যে বৃত্ত, তা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে না। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধির দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্তও নৌপরিবহন খাতের প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের ঘরে আটকে থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়েরই আরেক সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডবিøউটিএ) কার্যক্রমকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তত্ত¡াবধানে অভ্যন্তরীণ নৌপথের জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে বিআইডবিøউটিএ। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নৌপথ যাতে নিরাপদ হয়, সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টাও করছে তারা। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত ২ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ এরই মধ্যে উদ্ধার করেছে তারা। নাব্য নৌপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ড্রেজিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। শক্তিশালী ও দক্ষ অভ্যন্তরীণ নৌ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা উন্নত দেশের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছানোর আরেকটি সিঁড়ি পাব।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের আগে আপনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখানে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : মানুষের শিক্ষা একটা ব্যাপার। কিন্তু প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ^বিদ্যালয়ে চার বছরের মতো সময় আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ মেরিটাইম সেক্টরের যারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাদের সাথে আমার এক ধরনের যোগাযোগ এখান থেকেই শুরু এবং আগামীতে যারা এ খাতে যাবে, তাদের সাথে থাকার সুযোগ হয়। আমি মনে করি, নৌপরিবহন অধিদপ্তরে কাজের ক্ষেত্রে এটা আমার জন্য সাঁকো হিসেবে কাজ করেছে। যদিও মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির কাজের ক্ষেত্রে শিক্ষা এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তর হচ্ছে মেরিটাইম প্রশিক্ষণ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা। দুই সংস্থার কাজের ক্ষেত্র আলাদা হলেও মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে থাকার কারণে নৌপরিবহন অধিদপ্তরে কাজ করাটা আমার জন্য সহজ হয়েছে।

ব্লু ইকোনমির যে অপার সম্ভাবনা কীভাবে তা কাজে লাগানো সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?

কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন : ব্লু ইকোনমির ধারণাটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রোথিত করে দেওয়া অনেক বড় অর্জন। এজন্য সরকার ধন্যবাদ পেতে পারে। উপযুক্ত সময়ে আমাদের জাতির মধ্যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এটাকে চারিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর সম্ভাবনা অপার। প্রসপেক্ট অব ব্লু ইকোনমি ইজ অ্যাজ ভাস্ট অ্যাজ ওশান, অ্যাজ ডিপ অ্যাজ ওশান। কিন্তু এটাকে কাজে লাগাতে হবে। কারণ, সম্পদ তখনই প্রকৃত সম্পদ, যখন তা কোনো কাজে লাগানো হয়। মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির প্রথম গ্র্যাজুয়েট ব্যাচ বের হয়েছে। তারা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। কিন্তু আমাদের দেশে শিল্পের সাথে অ্যাকাডেমিক কারিকুলামের একটা শূন্যতা থাকে। এই শূন্যতা পূরণ করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী গবেষণা হতে হবে বিষয়ভিত্তিক, তার প্রয়োগ আমাদের সমাজে যেন আমরা করতে পারি। মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় তা করছে কিনা সেটা একটা বিষয়। মেরিটাইম অংশীজনদের কাছ থেকে গবেষণার ধারণাপত্র নেওয়া যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজই হচ্ছে গবেষণা করা। সর্বোপরি ব্লু ইকোনমি আমরা কাজে লাগাতে চাই, এই মনোযোগটা আমাদের থাকতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here