বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বুধবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
17 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

অনেকগুলো ফেরি ও পর্যাপ্ত লোকবল রয়েছে। অর্থনীতিতে নৌপথের অবদান বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে

নদীবাংলা ডেস্ক,

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৯১ সালে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার হিসেবে। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার পর্যন্ত মাঠ প্রশাসনের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দায়িত্ব পালন ছাড়াও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবেও কাজ করেন। ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি যোগদান করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে গত কয়েক মাসে তার কাজের অভিজ্ঞতা এবং নৌপরিবহন খাতের চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা ও অর্জন নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন নদীবাংলার সাথে।

আপনি নৌপরিবহন সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই মহামারির প্রকোপ। এক অস্বাভাবিক চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নৌপরিবহন খাতের ওপর চ্যালেঞ্জটা বেশি ছিল। একদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, অন্যদিকে পণ্য পরিবহন সচল রাখা। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় আনলেন কীভাবে?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সারা বিশে^র মতো আমাদেরকেও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সাধারণ ছুটির মধ্যেও পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক রাখতে নৌপথকে সচল রাখতে হয়েছে। তবে নৌপথ সচল রাখতে গিয়ে যাতে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত না হয়, সেদিকটাতেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়েছে। নৌ-শ্রমিকের জীবন যাতে কোনোমতেই ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নৌযান মালিক ও স্থানীয় প্রশাসন এর সাথে সমন্বয় করেছি। পরিপূরক ব্যবস্থা হিসাবে ট্রাকলরি সচল রেখে প্রান্তিক যোগাযোগ চালু রাখার ক্ষেত্রেও সমন্বয় করতে হয়েছে। নৌ-পরিবহনের দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন সংস্থাও এ ব্যাপারে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হয়। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষও অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সার্বক্ষণিক এ ব্যাপারে কাজ করেছে। স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে উদ্ভাবনীমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এসবের ফলে নৌপরিবহন খাতে কোভিড-১৯ এর বিস্তার আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। আবার অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহনও একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। বরং আরো বেশি গতি পেয়েছে।

দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আপনাকে সম্পাদন করতে হয়েছে। তা হলো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেডের (পিআইডব্লিউটিটি) দ্বিতীয় সংযোজনী স্বাক্ষর। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: পিআইডব্লিউটিটির দ্বিতীয় সংযোজনী স্বাক্ষর হওয়ার ফলে প্রটোকল রুটে দাউদকান্দি-সোনামুড়া এবং রাজশাহী-ধুলিয়ান- রাজশাহী রুট দুটি নতুন করে যুক্ত হয়েছে। পাঁচটি নতুন পোর্টস অব কলও যুক্ত হয়েছে প্রটোকলে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে যেসব জাহাজ চলাচল করে, তার ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশের মালিকানাধীন। নতুন রুটগুলো চালু হওয়ায় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের জন্য বাণিজ্য সম্প্রসারণে আরো অনুকূল ক্ষেত্র তৈরি হবে।
বাংলাদেশের বাহাদুরাবাদ ও ভারতের যোগিগোপা নতুন পোর্টস অব কল হিসেবে যুক্ত হওয়ায় নৌপথে আসাম, মেঘালয় এবং ভুটানের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। নতুন সবগুলো পোর্টস অব কল চালু হলে স্থলবন্দরগুলোয় যে পণ্যজট হয় তা অনেকটা কমে আসবে। প্রটোকলের আওতায় যন্ত্রচালিত নৌযানের মাধ্যমে ভারতের ধুবড়ি ও বাংলাদেশের চিলমারীর মধ্যে বাণিজ্য চালুর পরিকল্পনাও আমাদের আছে।

নতুন দুটি নৌরুটের মধ্যে দাউদকান্দি ও সোনামুড়ার মধ্যে পরীক্ষামূলক পণ্য পরিবহন এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। রাজশাহী-ধুলিয়ান-রাজশাহী রুটের বিষয়ে কী ভাবছেন?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: গোমতী নদীতে দাউদকান্দি-সোনামুড়া নৌরুটটি গত ৫ সেপ্টেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সিমেন্টবোঝাই একটি নৌযান গোমতী নদী দিয়ে মুরাদনগর, দেবীদ্বার, ব্রাহ্মণপাড়া, বুড়িচং, কুমিল্লা সদর, বিবির বাজার সীমান্ত হয়ে ত্রিপুরার সোনামুড়া জেটিতে নোঙর করে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব পণ্যের চালানটি গ্রহণ করেন। নৌরুটটি চালু হওয়ায় বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যেই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে আশাবাদ তৈরি হয়েছে।

এখন আমরা রাজশাহী-ধুলিয়ান-রাজশাহী নৌরুটটি পরীক্ষামূলকভাবে চালুর কথা ভাবছি। উভয় দেশ নৌপথটি চালুর বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা নৌরুটটির অবকাঠামো পর্যালোচনা করে দেখছেন। নৌরুটটি দিয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে পদ্মা নদী হয়ে মুর্শিদাবাদের মায়া নৌবন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া করা হবে। শিগগিরই এটি চালু করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। নৌরুটটি চালু হলে ভারতের সাথে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্য আরো সহজ হবে। এসব নৌরুট দিয়ে ভারতে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ পাওয়া যাবে। গোদাগাড়ীতে শুল্ক স্টেশন স্থাপনের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে আমরা অনুরোধ জানিয়েছি।

শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী রুটটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফেরি রুট হওয়া সত্ত্বেও মাঝে মধ্যেই ফেরি চলাচল বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এ সমস্যার সমাধান নিয়ে কী ভাবছেন?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: সেপ্টেম্বরে টানা আটদিন ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার পর বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে নৌরুটটি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এক রাতের মধ্যে চর ভেঙে চ্যানেলটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। এটি অক্ষত রেখেই কয়েকটি বিকল্প চ্যানেলের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। লৌহজং টার্নিং তেমন একটি বিকল্প। এছাড়া প্রায় এক কিলোমিটারের হাজরার চরও একটি বিকল্প চ্যানেল হিসেবে আছে। সেখানে ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। ড্রেজিং সম্পন্ন হলে এটিও চালু করতে পারব। তবে এজন্য সময় লাগবে।

দূরত্ব বেশি হওয়ায় পালের চরের চ্যানেলটি এতদিন আমরা চালু করিনি। এটা একটি ডাউনওয়ার্ড চ্যানেল এবং ২৮ কিলোমিটারের ভ্রমণ। বিশেষ পরিস্থিতিতে এটি চালু করতে হচ্ছে। চ্যানেলটি দিয়ে শুধু জরুরি যানবাহন চলবে। অ্যাম্বুলেন্সের মতো স্পর্শকাতর যানবাহনগুলোকে এই রুট ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হবে। তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, তারা যেন পাটুরিয়া নৌরুট ব্যবহার করে। কারণ পাটুরিয়ায় শিমুলিয়া ঘাটের ভাঙন ফেরি চলাচলের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সেপ্টেম্বরে শিমুলিয়ার তিন নম্বর ফেরিঘাটে ভাঙন দেখা দেয়। এর আগে জুলাই মাসেও এক দফা ভাঙনের মুখে পড়ে ঘাটটি। আর আগস্টে ভেঙে যায় চার নম্বর ঘাট। এর সমাধান কী হতে পারে বলে মনে করছেন?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: ঘাটের এই ভাঙনপ্রবণতা নিরবচ্ছিন্ন ফেরি চলাচলের ক্ষেত্রে সত্যিই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে বা মেরামতের পর আবারো ভাঙন দেখা দিচ্ছে। তবে পদ্মা সেতুর কাজ যেহেতু দ্রুতগতিতে চলছে, তাই নির্ধারিত সময়েই এটি খুলে দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছি। এই রুটে চলাচলকারী যানবাহন যেহেতু পদ্মা সেতু ব্যবহার করবে, তাই ঘাটের ব্যাপারে আমরা স্থায়ী কিছু করার কথা ভাবছি না, আমাদের কাজ হবে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে একে সচল রাখা। নদীভাঙন থেকে যাতে শিমুলিয়া ঘাট রক্ষা পায়, সেজন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

সরকারের চলতি মেয়াদেই ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের মহাপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। সে হিসেবে ২০২৪ সালের মধ্যে এই পরিমাণ নৌপথ খনন করতে হবে। কাজের যে অগ্রগতি তাতে করে ঘোষিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের বিষয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিকল্পনামাফিকই সবকিছু এগোচ্ছে। গত অর্থবছর আমরা ৩০০ কিলোমিটার নৌপথ উদ্ধার করেছি। বিআইডব্লিউটিএ’র নিজস্ব ড্রেজারের পাশাপাশি বেসরকারি ড্রেজারের মাধ্যমেও বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিত খননকাজ চলছে। আগামীতে খননকাজ যাতে আরো বেশি গতিশীল হয়, সেজন্য বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে ড্রেজারের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। আরো ৩৫টি ড্রেজার সংগ্রহের মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে ড্রেজারের সংখ্যা আমরা ৮০টিতে উন্নীত করতে চাই। এটি এখন প্রক্রিয়াধীন আছে। সেই সাথে বেসরকারি ড্রেজার তো আছেই। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালের মধ্যেই ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের যে লক্ষ্য তা আমরা অর্জন করতে পারব বলে আশাবাদী।

পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপথকে আগামীতে কীভাবে দেখতে চান?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: নৌপথ বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন পরিবহন মাধ্যম। রেলপথের ধারণা যখন তৈরি হয়নি, সড়ক যোগাযোগ ও অনুন্নত ছিল তখন নদী ছিল যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের দিকে যদি তাকাই, সেখানেও আগ্রা ও সাতগামের (চট্টগ্রাম) মধ্যে নৌ-বাণিজ্যের কথা বলা হয়েছে। রেলপথ চালুর পাশাপাশি সড়ক যোগাযোগ উন্নত হওয়ার পর অভ্যন্তরীণ নৌপথের কর্তৃত্ব কমতে থাকে। তবে ব্যয়, নিরাপত্তা ও পরিবেশের কথা চিন্তা করলে নৌপথই পরিবহনের সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম। আমরা চাই, নৌপথকে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে ফিরিয়ে আনতে। মাল্টিমোডাল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যও এটা দরকার। প্রধান নৌপথগুলোর নাব্যতা বাড়ানো, আধুনিক যাত্রী ও কার্গো টার্মিনাল তৈরির কাজ চলমান আছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে বাংলাদেশের জিডিপিতে পরিবহন খাতের অবদান ১১ শতাংশ হলেও নৌপথের হিস্যা ১ শতাংশেরও কম, দশমিক ৮৬ শতাংশ। এ খাতের প্রবৃদ্ধিও ৩ শতাংশে আটকে আছে। যদিও একে আরো বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে; কারণ রেলপথ বলুন বা সড়কপথ, অভ্যন্তরীণ নৌপথই এখন পর্যন্ত পরিবহনের সবচেয়ে সাশ্রয়ী মাধ্যম। এখন প্রয়োজন নাব্য ও নিরাপদ করে অভ্যন্তরীণ নৌপথকে ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলা। সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে সরকার।

নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বড় বাধা এর তীরভূমি বেদখল হয়ে যাওয়া। নদী দখল বন্ধে উচ্চ আদালতের একাধিক রুলিং আছে। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনও নদী দখলকারী ৪২ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা করেছে। বিপুল সংখ্যক এই দখলদার উচ্ছেদ কতটা সম্ভব?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলে সবই সম্ভব। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখলমুক্ত করার মধ্য দিয়ে সরকার সেটা দেখিয়েছেও। তবে দখলমুক্ত করার পর নদীর জমি আবার বেদখল হওয়ার একটা ঝুঁকি আছেই। একই সাথে এর সমাধানও আছে। দখলমুক্ত নদীতীর নতুন করে যাতে বেদখল না হয়, সেজন্য ঢাকার চারপাশের নদীর তীরে স্থায়ী ওয়াকওয়ে করে দেয়া হচ্ছে। এতে একদিকে নদীগুলো স্থায়ীভাবে দখলমুক্ত হবে, অন্যদিকে জনসাধারণের বিনোদনেরও একটা স্থান তৈরি হবে।

শিল্প ও বাণিজ্যের কথা যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলী। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের অবস্থানও এখানেই। এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরও দখলমুক্ত নয় নদীটি। কর্ণফুলীকে স্থায়ীভাবে দখলমুক্ত রাখতে পরিকল্পনা কী?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: কর্ণফুলী নদীর দখল ও দূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে তাদের প্রকল্প গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিতভাবে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শুধু কর্ণফুলী নয়, দেশের সব নদ-নদীর দূষণ রোধে, নাব্যতা বৃদ্ধি ও দখল রোধে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যান যথাসময়ে বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আরো বেশি উদ্যোগী হয়ে কাজ করতে হবে। সবাই উদ্যোগী হলে আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি, নদীর এক ইঞ্চি জায়গাও বেদখল থাকবে না। নদী অপদখলমুক্ত করতে নদীর নাব্যতা বাজায় রাখা খুবই প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে নিয়মিত ড্রেজিংকে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে বিবেচনা করছি।

অভ্যন্তরীণ নৌপথের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিআইডব্লিউটিএ’র কাজকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: নৌপথকে নিরাপদ করার যে দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএ’র ওপর অর্পিত, তারা তা আন্তরিকতার সাথে পালন করছে। পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন-সব ক্ষেত্রেই দক্ষতার ছাপ রেখে চলেছে সংস্থাটি। আশা করি, আগামীতেও কার্যক্রমের এই ধারা অব্যাহত রাখবে বিআইডব্লিউটিএ। তাদের আন্তরিকতা ও দক্ষতায় শতভাগ নিরাপদ নৌপথ আমরা পাব।

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) জ্বালানি, সার, খাদ্যশস্যসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সংস্থাটির বহরে জাহাজের সংখ্যা সেই অর্থে খুব বেশি নয়। বিএসসির জাহাজ বহর শক্তিশালী করতে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। দেশের দুই পুঁজিবাজারেই তালিকাভুক্ত বিএসসিকে সরকার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতৃস্থানীয় শিপিং কোম্পানিতে উন্নীত করতে চায়। সে লক্ষ্য সামনে রেখে বহরে জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। চীন সরকারের অর্থায়নে ছয়টি জাহাজ ইতিমধ্যেই বিএসসির বহরে যুক্ত হয়েছে এবং এগুলো সমুদ্রপথে পরিচালিতও হচ্ছে। সংগৃহীত জাহাজগুলোর মধ্যে তিনটি প্রডাক্ট ট্যাংকার ও তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ার। সংস্থাটির জাহাজের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প হলেও আইনের সহায়তায় বিএসসি দেশীয় সেবা খাতের পণ্য নিরাপদ পরিবহনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে।

বহর শক্তিশালী করতে আগামীতে জাহাজ ক্রয়ের আরো বেশকিছু প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ৮০ হাজার টনের দুটি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার ও ১০ থেকে ১৫ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন ১০টি বাল্ক ক্যারিয়ার ক্রয় প্রকল্প এর মধ্যে অন্যতম। এর বাইরে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ক্রুড অয়েল পরিবহনের জন্য প্রতিটি ১ লাখ টন থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি মাদার ট্যাংকার ক্রয়ের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের আমদানি করা ডিজেল ও জেট ফুয়েল যাতে পরিবহন করা যায় সেজন্য কেনা হচ্ছে ৮০ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি মাদার প্রডাক্ট অয়েল ট্যাংকার।

দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। আমদানি করা এই এলএনজি যাতে নিজস্ব জাহাজে পরিবহন করা যায় সেজন্য প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটারের দুটি, প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার ঘনমিটারের দুটি এবং প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার ঘনমিটারের আরো দুটি এলএনজি ভেসেল বিএসসির বহরে যুক্ত করার প্রাথমিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

শ্রীলংকাসহ বিমসটেকের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ফিডার সার্ভিস চালুর বিষয়ে আলোচনা চলছে। এটি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টিইইউ ধারণক্ষমতার চারটি নতুন সেলুলর কনটেইনার জাহাজ ক্রয়ের আরো একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেলুলর কনটেইনার জাহাজগুলো ডেনমার্ক সরকারের সহায়তায় নির্মিত হবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিতে উন্নীত হবে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম নৌপরিবহন অধিদপ্তর। নাবিকদের সার্টিফিকেট অব কম্পিট্যান্সি (সিওসি), সার্টিফিকেট অব প্রোফিসিয়েন্সি (সিওপি), কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট (সিডিসি) ও অভ্যন্তরীণ যোগ্যতার সনদসহ বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে অধিদপ্তর। প্রথাগত পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসব সেবা ডিজিটাল করা এখন সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ কী?

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সেবাসমূহ ডিজিটাল হওয়াটা খুবই জরুরি, যাতে তা সহজ ও কার্যকরী হয়। সে লক্ষ্যে আমরা অনেক দূর এগিয়েছিও। সমুদ্রগামী ও অভ্যন্তরীণ জাহাজের নাবিকদের সিওসি এবং সিওপির মতো সনদের আবেদন এখন অনলাইনেই গ্রহণ করা হচ্ছে। সেই সাথে সনদ প্রণয়ন ও সনদ প্রস্তুতের তথ্য মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে আবেদনকারীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নাবিকদের পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের আবেদন, সেফ ম্যানিং সনদ, শিপ সার্ভেয়ার সনদ ও অন্যান্য বিষয়ে এনওসির জন্য অনলাইনে আবেদন দাখিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নাবিকদের সাইন অন, সাইন অফ কার্যক্রমও অনলাইনে সম্পাদনের পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।
সিডিসি জালিয়াতি যাতে বন্ধ হয় সে পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। জালিয়াত রোধে বিশেষ নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য যেমন আল্ট্রা ভায়োলেট, মাইক্রো সিকিউরিটি লাইন, অ্যান্টি-ফটোকপি ও কুইক রেসপন্স কোডযুক্ত কাগজে হাতে লেখার পরিবর্তে মেশিন প্রিন্টেড সিডিসি প্রবর্তন করা হয়েছে।

দক্ষ নাবিক তৈরির মাধ্যমে বৈদেশিক আয় বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এজন্য প্রয়োজন মেরিটাইম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে আধুনিকায়নের পাশাপাশি এর পরিসর বাড়ানো। এ ব্যাপারে সরকার কী ভাবছে।

মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী: বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মেরিটাইম শিক্ষার প্রচলন হয় ১৯৫২ সালে ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। শিপ রেটিংদের জন্য প্রি-সি ট্রেইনিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। মেরিটাইম ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিফেয়ারাররা বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও করছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি প্রি-সি প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছে নটিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনে। মেরিটাইম সায়েন্সে চার বছরের গ্র্যাজুয়েশন কোর্স চালু করেছে মেরিটাইম একাডেমি, আরো বেশি সংখ্যক সিফেয়ারার যাতে তৈরি হয় সেজন্য নতুন চারটি মেরিন একাডেমির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর বাইরে দেড় ডজনের মতো বেসরকারি মেরিন একাডেমি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসবের উদ্দেশ্য অধিক সংখ্যক সিফেয়ারার তৈরি এবং কর্মসংস্থানের পাশাপাশি তাদের হাত ধরে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here