বহু কাল আগে থেকেই অভ্যন্তরীণ নৌপথ এই অঞ্চলে যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম। তবে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তা ছিল বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে। নিয়ন্ত্রণকারী কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায় শৃঙ্খলার অভাব ছিল প্রকট। মুনাফাকে অতিমাত্রায় প্রাধান্য দিতে গিয়ে গৌণ হয়ে পড়ে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সেবার মানের বিষয়টি। বিভিন্ন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞের দীর্ঘ সুপারিশের পর ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (ইপিআইডব্লিউটিএ) গঠিত হয় বটে, তবে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও দক্ষ জনবলের অভাবে প্রতিষ্ঠার প্রথম কয়েক বছরে অর্থনীতিতে বাড়তি তেমন কিছু যোগ করতে পারেনি খাতটি। পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যমের মতো অতটা মনোযোগও পায়নি। স্বাধীনতার পর নতুন লক্ষ্যে, নতুন উদ্যোগে কাজ শুরু করে কর্তৃপক্ষ। এরপর পাঁচ দশকের পথ চলা। দীর্ঘ এই যাত্রায় কর্তৃপক্ষের কর্মে ও উদ্যোমে প্রচণ্ড গতি যেমন দেখা গেছে, সেই গতিতে ভাটাও পড়েছে কখনও-সখনও। তবে ২০০৯-পরবর্তী ছবিটা একেবারে ভিন্ন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ও বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মোদ্যোগে শুকিয়ে যাওয়া নৌপথ ফিরে পাচ্ছে নাব্যতা। পুরোনো নদীবন্দরের আধুনিকায়নের পাশাপাশি গড়ে উঠছে নতুন নতুন নদীবন্দর। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বিআইডব্লিউটিএ’র অর্জনের সেই খতিয়ানের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে “পাঁচ দশকে বিআইডব্লিউটিএ’র অর্জন” শীর্ষক বিশেষ রচনাটিতে।
উনিশ শতকেও পৌর প্রশাসনের নগর পরিকল্পনায় বুড়িগঙ্গার একটি স্থান ছিল। কারণ তখনো নদীর তীরকে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে পাকিস্তান আমল থেকে নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগর প্রশাসনের চিন্তায় বুড়িগঙ্গার আর স্থান হয়নি। তারপর বহু বছর কেটে গেছে। এর মধ্যেই বুড়িগঙ্গার গতিপ্রবাহে ভাটা পড়েছে। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। ফলে বুড়িগঙ্গায় পয়ঃবর্জ্য নির্গমনের পরিমাণও বেড়েছে হু-হু করে। পাশাপাশি বেড়েছে বুড়িগঙ্গা দূষণকারী শিল্পবর্জ্য নির্গমনও। দূষণের পাশাপাশি দখলেও একসময় শীর্ণকায় রূপ ধারণ করে ঢাকার এই প্রাণরেখা। আগ্রাসনের মুখে পড়তে হয় একদা স্বচ্ছ ও সুপেয় পানির নদী শীতলক্ষ্যাকে। মূলত নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর ঘিরেই চলে দখলের এই মচ্ছব। সময়ের পরিক্রমায় বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার মতো তুরাগ ও বালু নদকেও জোর করে বেঁধে ফেলতে থাকে মানুষ। পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহের অভাবে শুকিয়ে মরে যাওয়া নদীবক্ষে উঠতে থাকে বাড়িঘর, দোকান, কারখানা।
দখল-দূষণে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো মরে যেতে বসলেও সেগুলোর প্রাণ ফেরাতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সমন্বিত পরিকল্পনার অনুপস্থিতি দেখা গেছে দীর্ঘদিন। দূষণ ও দখলমুক্তির কিছু কিছু উদ্যোগ মাঝেমধ্যে নেওয়া হলেও সেগুলো খুব বেশি যে ফলদায়ক হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। তবে আশার কথা হলো বর্তমান সরকার ঢাকার চারপাশের নদীগুলোসহ দেশের সব নদী রক্ষায় অঙ্গীকারের কথা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে স্থান দিয়েছে। সে অনুযায়ী নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর প্রাণ ফেরাতে কাজ করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। নাব্যতা বৃদ্ধিসহ স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন, ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং ইকোপার্ক ও বনায়ন কর্মসূচির দৃশ্যমান অগ্রগতিও চোখে পড়ছে। দৃশ্যমান অগ্রগতি হলেই শুধু হবে না, একে টেকসই রূপও দিতে হবে। ‘নদীবাংলা’র এই সংখ্যায় বক্ষমাণ প্রধান রচনাটি সেটা নিয়েই।
অন্যসব খাতের মতো অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতেও এখন ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া। সেই আলোচনাও থাকছে এবারের সংখ্যায়। আছে নদী ও নৌপথ নিয়ে সরকারের আরও পরিকল্পনার সারকথা। নিয়মিত আয়োজন হিসেবে নাতিদীর্ঘ কলেবরে এবারও তুলে এনেছি আমাদের নদী ও আমাদের বন্দরের কথা। পরিভ্রণ করেছি দূর অতীতে, আমাদের ঐতিহ্যে। সেই সাথে থাকছে দেশ-বিদেশের নদী ও নৌ-খাত নিয়ে সবশেষ ঘটনাপ্রবাহের কথা ও ছবি।
প্রিয় পাঠক, আশা করি আমাদের এই প্রয়াস নদী ও নৌপথ নিয়ে আপনার জিজ্ঞাসার উত্তর দেবে। কিছুটা হলেও নতুন ভাবনার খোরাক জোগাবে। আপনার মূল্যবান মতামত, মন্তব্যসমৃদ্ধ কলেবরে ‘নদীবাংলা’র পথচলা এগিয়ে নেবে।