বৈশ্বিক উৎপাদন দৃশ্যপট এখন বদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যার পোশাকি নাম চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। মূল যেসব প্রযুক্তি এই মঞ্চে অনুঘটকের কাজ করছে মোটা দাগে সেগুলো হলো ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং, রোবোটিকস, আননেমড এরিয়াল ভেহিকল (ইউএভি), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), ব্লকচেইন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ প্রযুক্তির প্রধান আলোচনা উৎপাদন শিল্পকে ঘিরে আবর্তিত হলেও এখন পরিবহন ও লজিস্টিকস খাতও উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে এর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে।
আর সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন। কারণ, পরিবহনের অপরাপর মাধ্যমের তুলনায় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অনেক বেশি জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। সেই সাথে অনেক বেশি পণ্য পরিবহনের সুযোগ থাকায় ব্যয়সাশ্রয়ীও। এমন সব সুবিধা সত্ত্বেও সড়ক ও রেলপথের তুলনায় অভ্যন্তরীণ নৌপথ কম উন্নত। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটা আরও বাস্তব এবং এর পেছনে নানা কারণও আছে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের উপযোগী অবকাঠামো ঘাটতি, বিনিয়োগ স্বল্পতা, কঠোর নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং বিভিন্ন ইনস্টিটিউশনের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সম্মিলিতভাবে এগুলো অভ্যন্তরীণ নৌপথে কার্গো পরিবহনের নানা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে ট্রাফিক প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। ট্রাফিক মনিটরিং ও স্মার্ট নেভিগেশন তাই আশু প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবহনের মাধ্যমটিকে অধিক পরিবেশবান্ধব ও সুরক্ষিত করতে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ প্রযুক্তির সঠিক ও দক্ষ প্রয়োগ কাঙ্ক্ষিত ফল এনে দিতে পারে।
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের এসব সমস্যার সমাধানে প্রাথমিকভাবে চারটি ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ প্রযুক্তি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। মোটা দাগে এগুলো হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্কস (এএনএন), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), বিগ ডেটা ও গ্রুপিং অ্যালগরিদম। কিছু ক্ষেত্রে এসব প্রযুক্তি ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ প্রযুক্তির অংশ যেমন কম্পিউটার ভিশন ও আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল (ইউএভি) এবং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে প্রচলিত প্রথাগত প্রযুক্তি এআইএস, জিআইএস ও রেডারের সাথে সমন্বিতভাবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। এটা যে কেবল অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনেই প্রয়োগযোগ্য তেমন নয়, ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে উৎপাদনসহ অন্যান্য খাতেও।
ট্রাফিক মনিটরিংয়ে দুই ধরনের কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম বা এআইএস থেকে উপাত্ত ব্যবহার করা। দ্বিতীয় কৌশলটি হচ্ছে বেশি করে ডিপ লার্নিং টেকনিকের প্রয়োগ। যদিও ধ্রুপদি কম্পিউটার ভিশন টেকনিকের ব্যবহার এখনো চালু রয়েছে।
উপাত্ত সংগ্রহকে শক্তিশালী করতে পারে ইন্টারনেট অব থিংস। চূড়ান্তভাবে এর সুফল পেতে পারে এআইএস সিস্টেম, যা এর ব্যবহার বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে কার্যকর। সেই হিসেবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনে ইন্টারনেট অব থিংস ব্যবহারের সম্ভাবনা বিপুল। এছাড়া উপাত্ত সংগ্রহে এর ব্যবহারই এখন সবচেয়ে বেশি হচ্ছে এবং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মঞ্চে এর প্রতি আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।
নিরাপদ নৌ চলাচলের জন্য জরুরি হচ্ছে নৌপথের প্রতিবন্ধকতা ও অন্য নৌযানের অবস্থান চিহ্নিত করা, যাতে করে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। এক্ষেত্রেও দুই ধরনের কৌশল অবলম্বনের সুযোগ রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে নৌযানের ভেতরে স্থাপিত বিভিন্ন প্রযুক্তির সহায়তায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে দুর্ঘটনার ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে পারা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বন্দর থেকে ঝুঁকি চিহ্নিত করে নৌযানগুলোকে তা সরবরাহ করা। ডিপ লার্নিং এবং এআইএস প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে এক্ষেত্রে।
অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম বা এআইএস, রেডার, লিডার অথবা ভিডেস, রিমোট সেন্সিং ও ইন্টারনেট অব থিংসের মাধ্যমে সংগৃহীত নৌখাতের বিপুল-বিচিত্র উপাত্ত বিগ ডেটার মাধ্যমে বিশ্লেষণের বিকল্প নেই। পদ্ধতিটি নতুন মেট্রিকের ধারণা দিয়ে থাকে, যা নৌপরিবহনের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি নৌপথে চলাচলকারী নৌযানের সিমুলেশন পদ্ধতিও সহজ করে বিপুল ও বিচিত্র এসব উপাত্ত। এছাড়া বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত এসব উপাত্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং নৌ চলাচল সংক্রান্ত গবেষণার জন্যও জরুরি, যা খাতটি সম্পর্কে আমাদের আরও বিস্তৃত ও স্পষ্ট ধারণা পেতে সহায়তা করবে। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের সামর্থ্য প্রথাগত বিশ্লেষণ পদ্ধতির নেই। এ কারণেই বিগ ডেটা সংশ্লিষ্ট টেকনিকের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
সারা বিশ্বের বর্ধিত কার্বন নিঃসরণ উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্প তো বটেই পরিবহন ব্যবস্থাও কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধির জন্য কম দায়ী নয়। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনকেও এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের কার্বন নিঃসরণই সহনীয় মাত্রায় রাখা সম্ভব। বৈদ্যুতিক শক্তি ও বিকল্প জ্বালানিও এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্রমাণিত সমাধান। তবে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধানেরও সুযোগ রয়েছে।
ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি এর সুরক্ষাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সাইবার হামলা ধরন বদলে আরও শক্তিশালী ও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। তাই সমন্বিত ও বহু স্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা কেবল প্রযুক্তির সুরক্ষাই দেবে না, এগুলোর সুষ্ঠ কনফিগারেশনে ভূমিকা রাখবে।