নৌপথে পণ্য পরিবহনের চল শুরু সভ্যতার গোড়ার দিকেই। তবে এটা নির্ভর করত নৌপথের গভীরতার ওপর। পলি জমে গভীরতা কমে গেলে নৌপথে পণ্য পরিবহন এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ত। কিন্তু যুৎসই যন্ত্রের দেখা না মেলায় তখন পর্যন্ত পলি অপসারণের কাজটি করা হতো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে।
১৫ শতকে নৌপথে বাণিজ্যের ব্যাপ্তি বেড়ে গেলে প্রয়োজনের তাগিদেই ১৫৭৫ সালে নৌপথ খননে উদ্ভাবন করা হয় এক ধরনের কাঠের যন্ত্র। প্রথমদিকে এটি ম্যানুয়ালি পরিচালনা করা হলেও পরের দিকে স্টিম ইঞ্জিন যুক্ত করা হয়। তবে ড্রেজিংয়ে প্রথমবারের মতো যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে ১৮৬৭ সালে। ফরাসি প্রকৌশলী হেনরি এমিলে বাজিন ওই বছর সাকশন ড্রেজার উদ্ভাবন করেন। এ ড্রেজার দিয়ে সফলভাবে সুয়েজ খাল খনন করেও দেখান। তারপর থেকেই সাকশন ড্রেজারের জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার দুই-ই বাড়তে থাকে।
এরপর উনিশ শতকে আবির্ভাব ঘটে কাটার সাকশন ড্রেজার ও ট্রেইলিং সাকশন হপার ড্রেজারের। এগুলোই সবচেয়ে আধুনিক ড্রেজার, যা খুবই দক্ষতার সাথে কাঙ্ক্ষিত খনন সম্পন্ন করতে পারে। নৌযান চলাচল নির্বিঘ্নে রেখেও এই ড্রেজার দিয়ে খননকাজ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব।
ড্রেজিং পদ্ধতিতে বিবর্তনের এই ধারা এখনও চলমান। তবে নতুন ড্রেজার উন্নয়নের চেয়ে এই সময়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে এর অপটিমাইজেশন। কন্ট্রোল ও মনিটরিং সিস্টেমের অগ্রসরতা ড্রেজারের খনন সক্ষমতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ড্রেজ অটোমেশনও এরই মধ্যে চলে এসেছে। ড্রেজিং তদারকি থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রণ সবই হচ্ছে অটোমেশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে। অর্থাৎ ড্রেজার হয়ে উঠছে ইন্টেলিজেন্ট বা বুদ্ধিমান মেশিন। আর এই খনন প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে ইন্টেলিজেন্ট ড্রেজিং বা আইডি।
পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ড্রেজার খননকাজ পরিচালনা করছে। অ্যান্টওয়ার্প বন্দরে নিয়োজিত ইকোড্রোনের কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। পলির মাত্রা জানতে ইকোড্রোন জরিপ চালিয়ে সেই তথ্য ক্লাউড সিস্টেমে পাঠিয়ে দেয়। কখনও কখনও ইঞ্জিনিয়ার কেবল চোখ বুলিয়ে নেন সবকিছু ঠিকঠাকমতো আছে কিনা তা পরখ করতে। এভাবেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে খননকাজে সহায়তা করছে ইকোড্রোন।
২০১৮ সালে কোভাম স্যাটকম চীনের সিসিসিসি ড্রেজিং কোম্পানির ১৬টি ড্রেজারে সেইলর ৯০০ ভিস্যাট স্থাপন করে দেয়। খনন কার্যক্রম ডিজিটালাইজ ও স্বয়ংক্রিয় করার যে প্রয়াস, নতুন ধরনের এই হাই-থ্রোপুট স্যাটকম তাতে বিশেষ মাত্রা এনে দিয়েছে। তিয়ান কুন হাও নামে নতুন একটি ড্রেজারের সরবরাহ সম্পন্ন হওয়ার পর সিডিসির সাথে অটোমেশন-সংক্রান্ত চুক্তিতে যায় কোভাম। ম্যাজিক আইল্যান্ড মেকার নামে পরিচিত ড্রেজারটি ক্রুর সাহায্য ছাড়াই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে খননকাজ করতে সক্ষম। প্রতি ঘণ্টায় ৬ হাজার ঘনমিটার পর্যন্ত খনন করতে পারে ড্রেজারটির।
নরওয়ের শিপ ডিজাইন ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সি-জব আর্কিটেক্টস বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অটোনোমাস মেইন্টেন্যান্স ড্রেজারের (এইউএমডি) নকশা তৈরি করেছে। সি-জব-এর গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের নকশাঁকৃত ড্রেজারটিতে জ্বালানির প্রয়োজন পড়বে প্রথাগত ড্রেজারের তুলনায় অনেক কম। এইউএমডিতে থাকছে ১৬ মিলিয়ন ওয়াটের ব্যাটারি, যা ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত মেইন্টেন্যান্স ড্রেজিং করার মতো বিদ্যুতের জোগান দিতে সক্ষম।
অনন্য এই ড্রেজারটির নকশা করতে বিস্তর গবেষণা করতে হয়েছে সি-জবের গবেষকদের। এজন্য প্রথাগত ট্রেইলিং সাকশন হপার ড্রেজারের সাথে তুলনামূলক গবেষণা চালাতে হয়েছে তাদের। এরপর ড্রেজারের যে নকশাঁটি তারা উন্নয়ন করেছেন সেটি পানির নিচে মেইন্টেন্যান্সে ৫৫ শতাংশ কম প্রোপালশন পাওয়ার ব্যবহার করবে। ড্রেজারের সাথে ডাটা কমিউনিকেশনের কাজটি হবে অনশোরের ৪জি/৫জি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।
ডেমে গ্রুপের ট্রেইলিং সাকশন হপার ড্রেজার ‘মিউজ রিভার’ সি ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে। রয়্যাল আইএইচসির নেদারল্যান্ডসে তৈরি ৭ হাজার ৯৫০ ঘনমিটারের মিউজ রিভারের নকশা অনেকটা ডেমের বিদ্যমান ড্রেজার শেল্ডট রিভারের মতোই। দুটি ড্রেজারেই ডেমে ও রয়্যাল আইএইচসি উদ্ভাবিত স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ড্রেজিং পদ্ধতি অটোমেশন করতে আইএইচএস উন্নয়ন করেছে আইএইচএস ইসিও অটোমেশন প্যাকেজ, যা বাড়িয়ে দেবে ড্রেজিংয়ের সক্ষমতা।
ভারতীয় জলসীমায় খননকাজে নিয়োজিত ড্রেজারে স্যাটকম প্রযুক্তি সরবরাহের লক্ষ্যে ২০২০ সালের মার্চে নেদারল্যান্ডসের ড্রেজিং কোম্পানি ফন উর্ডের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে মারলিঙ্ক। যদিও ভারতীয় আইনে স্থানীয় লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থার মাধ্যমে ক্রয় ব্যতীত দেশটির জলসীমায় স্যাটকম যোগাযোগের সুযোগ নেই, তারপরও ভারতের ইন-ফ্লাইট কানেক্টিভিটি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নেলকো ও মারলিঙ্কের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি ফন উর্ডকে সেবাটি সরবরাহের সুযোগ করে দেবে। অর্থাৎ ট্রেইলিং সাকশন হপার ড্রেজার ভলভক্স ভারতীয় জলসীমায় ভিস্যাট ব্যবস্থা চালাতে পারবে, আগে যা আইনে নিষিদ্ধ ছিল। মারলিঙ্কের সঙ্গে চুক্তির ফলে ভ্যান উর্ডও কোনো বাধা ছাড়াই ভারতীয় জলসীমায় কার্যক্রম চালাতে পারবে। সেই সাথে ডাটা স্থানান্তরও করতে পারবে বাধাহীনভাবে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে নেদারল্যান্ডসের থেকলা বোডওয়েজ শিপইয়ার্ড নির্মাণ করেছে স্টেট-অব-দ্য-আর্ট প্রযুক্তির ট্রেইলিং সাকশন হপার ড্রেজার অ্যাংকারেজ। কানেক্টিভিটি ও অটোমেশনের সর্বোত্তম ব্যবহারের আদর্শ উদাহরণ হচ্ছে এই অ্যাংকারেজ। ড্রেজারটিতে যে ইন্টেলিজেন্ট অটোমেশন সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাতে খুবই স্বল্পসংখ্যক অর্থাৎ মাত্র সাতজন ক্রু দিয়েও খননকাজ পরিচালনা করা সম্ভব।
তবে অটোমেশনের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত ডাটা, যা ভেসেল থেকে স্থলে প্রেরণ করা হয়। ডাটা বিনিময় যত নির্বিঘ্নে হবে ড্রেজারের কার্যক্রমও তত সাবলীল হবে। সেই সাথে জ্বালানি সাশ্রয়ও হবে। সব মিলিয়ে বলা যায় ৪জি ও ৫জি ইন্টারনেট সংযোগ খনন কার্যক্রমকে অনেক বেশি সহজ করে আনছে। এভাবেই বদলে যাচ্ছে ড্রেজ অটোমেশনের ভবিষ্যৎ।