দুরদুরিয়ার দুর্গের অবস্থান ছিল শীতলক্ষ্যা নদীর ২৪ ডিগ্রি ৭ মিনিট উত্তর এবং ৯০ ডিগ্রি ৩৪ মিনিট পূর্বে, কাপাসিয়া গ্রামের প্রায় বিপরীতে। অর্ধচন্দ্রাকৃতির দুর্গটির বাইরের প্রাচীরের চারপাশে দুই মাইল পরিধির একটি পরিখা ছিল। এর ভেতরে ছিল মাটির কাজ এবং তার ঠিক কেন্দ্রে যে ধ্বংসপ্রাপ্ত বুরুজ সেটি ইটনির্মিত।
দুর্গকে সাধারণত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা বলা হলেও বাংলা ভাষায় এর কতকগুলো প্রতিশব্দ আছে। দুয়ার, কোট, কেল্লা, বুরুজ, খিত্তা, দমদমা, চৌকি এর অন্যতম। তাই বাংলায় দুর্গ গড়ে উঠেছিল কেবল প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে নয়, বসবাসের তাগিদও ছিল। প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে নির্মিত দুর্গগুলোকে নদীদুর্গ বলা হলেও বসবাসের নিমিত্তে গড়ে ওঠা দুর্গগুলোর পরিচিতি ছিল প্রাসাদ দুর্গ নামে।
তবে দুর্গ নির্মাণের ক্ষেত্রে নদীকে উপজীব্য করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই ছিল প্রধান। এই কারণে নদীবহুল বাংলায় এসব দুর্গের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হতো সাধারণত নদীর সংযোগস্থল অথবা নদীর তীরকে। নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূ-অবস্থান তো বটেই বিবেচনায় নেওয়া হতো বাংলার মৌসুমি বায়ু এবং প্রকৃতির খেয়ালি খেলার সাথে ঋতুগুলোর চক্রাকার আবর্তনকেও। তবে বাংলার নদীই এক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছিল।
এমনই একটি দুর্গ হলো দুরদুরিয়ার দুর্গ। কখনো কখনো একে একডালা দুর্গও বলা হয়ে থাকে। নামটি এসেছে শীতলক্ষ্যার আট মাইল ভাটিতে নির্মিত একডালা দুর্গ থেকে। তবে ইস্টার্ন বেঙ্গল গেজেটিয়ারের তথ্য অনুযায়ী, দুরদুরিয়ার দুর্গের অবস্থান ছিল শীতলক্ষ্যা নদীর ২৪০৭ উত্তর এবং ৯০০৩৪ পূর্বে, কাপাসিয়া গ্রামের প্রায় বিপরীতে। অর্ধচন্দ্রাকৃতির দুর্গটির বাইরের প্রাচীরের চারপাশে দুই মাইল পরিধির একটি পরিখা ছিল। এর ভেতরে ছিল মাটির কাজ এবং তার ঠিক কেন্দ্রে যে ধ্বংসপ্রাপ্ত বুরুজ সেটি ছিল ইটনির্মিত। এর ঠিক বিপরীত পাড়ে ছড়িয়ে থাকা ঢিবি ও ইট এটাই নির্দেশ করে যে এখানে একসময় মোটামুটি আকৃতির একটি নগর ছিল।
তবে যতীন্দ্রমোহন রায় তার ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে দুরদুরিয়ার দুর্গের অবস্থান বানার নদীর তীরে বলে উল্লেখ করেছেন। বানার হচ্ছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র থেকে উৎপন্ন চারটি শাখা নদীর একটি এবং বানার, শ্রীকালী ও সাতিয়ার মিলিত ধারাই শীতলক্ষ্যা নামে প্রবাহিত হয়ে শ্রীপুরের পূর্ব পাশ দিয়ে দক্ষিণমুখী হয়ে কাপাসিয়ায় প্রবেশ করেছে। ডা. টেইলারের সময় নদীর যে স্থানে দুরদুরিয়ার দুর্গ অবস্থিত সেই স্থানে নদীর পরিসর ছিল প্রায় ৩০০ গজ এবং গভীরতা ৪০ ফুটেরও বেশি। তীরভূমি ছিল রক্তবর্ণ এবং নদীর ধার থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট।
যতীন্দ্রমোহন রায়ের বর্ণনায়-দুর্গটি নদীতীরে অর্ধচন্দ্রাকারে নির্মিত হয়েছিল। দুর্গের বাইরের প্রাচীর কর্দমাক্ত রক্তবর্ণ কঠিন মাটির সংমিশ্রণে নির্মিত। দুর্গের পরিধি ছিল ২ মাইলের উপরে এবং চারদিকের পরিখা ছিল প্রায় ৩০ ফুট প্রশস্ত। দুর্গের পাঁচটি ফটক ছিল। তবে ইটের তৈরি কোনো তোরণদ্বারের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। দুর্গের অভ্যন্তরে এই বাইরের প্রাচীরের কিছু দূরে আরেকটি পরিখার চিহ্ন দেখা যায়। এই পরিখা অতিক্রম করে দুর্গের অভ্যন্তরে কিছুদূর এগোলে ইটনির্মিত প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ দৃষ্টিগোচর হয়। দুর্গের বাইরের অংশের মতো এটাও অর্ধচন্দ্রাকারে নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমিত হয়। এর চারদিকের পরিখা বানার নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল। অভ্যন্তরীণ এই বেষ্টনটির মধ্যে প্রবেশ করার জন্য তিনটি ফটক নির্দিষ্ট আছে। বেষ্টনীর মধ্যে দুটি অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ বিদ্যমান আছে। অট্টালিকা দুটি উচ্চ স্থানে নদীর কাছাকাছি অবস্থিত। দক্ষিণ দিকের অট্টালিকাটি ইটনির্মিত উচ্চ চূড়া সমন্বিত ছিল। প্রাচীরবেষ্টিত চারটি বুরুজের ভিত্তির অংশগুলো এখনো বিদ্যমান আছে।
উত্তর দিকের অট্টালিকাটিতে দুটি সমচতুষ্কোণাকার উচ্চস্তূপ পরিলক্ষিত হয়। এই স্তূপের কিছু দূরে একটি পুকুর ছিল। এই পুকুর দুর্গের বাইরের দিকের পরিখার সাথে একটি পয়ঃপ্রণালি দ্বারা সংযোজিত ছিল। দুর্গের অভ্যন্তরে অনেকগুলো জলাশয় ছিল। অট্টালিকাগুলোর অধিকাংশ স্থান বানার নদীর কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে।
দুর্গটির নির্মাতা ও নির্মাণকাল নিয়ে বিতর্ক আছে। টেইলার তার ‘টপোগ্রাফি অব ডাক্কা’য় দুর্গটির নির্মাতা হিসেবে রানী ভবানীর নাম উল্লেখ করেছেন। তার তথ্য অনুযায়ী, রানী ভবানী দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন বলে কথিত আছে। ১২০৪ সালে মুসলমানদের আক্রমণের সময় রানী ভবানী ছিলেন ধামরাইয়ের যথোপাল রাজবংশীয় শেষ শাসক। ১৪ শতকের শেষ ভাগে দিল্লির সুলতান দুই দফা দুর্গটি আক্রমণ করেন। কিন্তু একবারও সফল হননি।
তবে দুর্গটি রাজা যশোপালের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করেন যতীন্দ্রমোহন রায়। রাজা যশোপাল নির্মাণ করলেও ‘রানীবাড়ি দুর্গ’ নামে এটি পরিচিত হয়ে পড়ে। ১৩১৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন, দুরদুরিয়া কাপাসিয়া থানার নিকটে এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ একডালার আট মাইল উত্তরে বানার নদীর তীরে অবস্থিত। দুরদুরিয়ার একটি প্রাচীন দুর্গের ভগ্নাবশেষ আজও দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে। এই স্থানের বিপরীত দিকে বানার নদীর অপর তীরে একটি সমৃদ্ধ নগরীর চিহ্ন বিদ্যমান। উভয় স্থানই বৌদ্ধ নৃপতিগণ নির্মাণ করেছিলেন বলে কেউ কেউ অনুমান করে থাকেন। স্থানীয় প্রবাদমতে তা বল্লাল রাজার বাড়ি। ‘রানীবাড়ি’ বলেও অভিহিত হয়ে থাকে। ধামরাইয়ের যশোপাল রাজবংশীয় রানী ভবানী মুসলমানদের আক্রমণকালে এই দুর্গের মধ্যে অবস্থান করায় স্থানটি রানীবাড়ি বলে পরিচিতি পায়। ধারণামতে, মহারাজ বল্লাল ভূপতি যে সময়ে বিক্রমপুরে রাজত্ব করতেন সম্ভবত সেই সময়ে এই স্থানেও তাঁর একটি সাময়িক রাজধানী প্রতিষ্ঠিত ছিল। কেশবসেন গৌড়নগর পরিত্যাগ করে দুরদুরিয়া দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। পরে রানী ভবানী এই স্থানে বাস করেছিলেন বলে এটা ‘রানীবাড়ি দুর্গ’ নামে পরিচিত হয়ে পড়ে।
সে যাই হোক, বৌদ্ধ নরপতিগণের সময়ে দুর্গ কতটা সুরক্ষিতভাবে নির্মিত হতো তা দুরদুরিয়ার দুর্গ থেকে কতক অনুধাবন করা যায়।