তিনবারের সংসদ সদস্য। মন্ত্রিসভায় এবারই প্রথম। দায়িত্ব পালন করছেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রীর। তরুণ এই রাজনৈতিক নেতা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই কাজ করছেন নদী যেন তার গতিতে বইতে পারে সেই লক্ষ্যে। পাড়-তীর দখলমুক্ত করে দূষণমুক্ত নদীর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। ফিরিয়ে দিতে চাইছেন নৌপথকে তার ঐতিহ্যে। দায়িত্বের দেড় বছর হলো। এই সময়ে লক্ষ্যে কতটা এগোলেন তিনি। যেতে চানই বা কতদূর। এসব নিয়েই নদীবাংলার সাথে কথা বলেছেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী এমপি।
নৌপথের নাব্যতা ফিরিয়ে এনে নৌ-বাণিজ্য গতিশীল করতে বর্তমান সরকার বিস্তর পরিকল্পনা নিয়েছে। সে অনুযায়ী কার্যক্রমও চলছে। নৌপথের নাব্যতা ফেরাতে গৃহীত পরিকল্পনা ও এর অগ্রগতি সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: সবচেয়ে আরামদায়ক ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ মাধ্যম হলো নৌপথ। শুধু যাত্রী নয়, পণ্য পরিবহনেরও সবচেয়ে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মাধ্যম এটি। তবে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে যা প্রয়োজন তা হলো সুগম-নিরাপদ-নাব্য নৌপথ।
নৌপথের নাব্যতা বাড়াতে সরকার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এর আওতায় বর্তমান সরকারের মেয়াদেই আমরা ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করতে চাই। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের নদ-নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। এজন্য যা যা প্রয়োজন সব কিছুই করা হবে। ৩০০ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ আমরা এরই মধ্যে উদ্ধার করেছি। আগামীতে এর গতি-পরিধি আরও বাড়ানো হবে।
নদী খননে অর্থাৎ ড্রেজিংয়ে গতি আনতে পর্যাপ্ত সংখ্যক ড্রেজার থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে যতগুলো ড্রেজার আছে তাকে কি যথেষ্ট মনে করছেন? না করলে এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কী?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: নদী খননের জন্য ড্রেজার প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু সাতটি ড্রেজার সংগ্রহ করেছিলেন। পরবর্তী সরকারগুলো সেই বহরে আর কোনো ড্রেজার যুক্ত করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গত ১০ বছরে ৩৮টি ড্রেজার সংগ্রহ করেছে। বর্তমানে ৪৫টি ড্রেজার রয়েছে। সেগুলো অনেক বড় এবং উন্নত মানের। তবে এখানেই আমরা থেমে থাকছি না। নৌযান চলাচল নির্বিঘœ করতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ড্রেজারসহ অন্যান্য জলযান ক্রয় করতে যাচ্ছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এরই ধারাবাহিকতায় আরও ১১টি ড্রেজারসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ ক্রয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করেছে সংস্থাটি।
মোট চারটি প্যাকেজে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম প্যাকেজে অত্যাধুনিক দুটি ২৮ ইঞ্চি মাপের কাটার সাকশন ড্রেজার ক্রয় করা হবে। এতে ব্যয় হবে ২০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্যাকেজ চারটি করে ৮টির দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে ২৪ ইঞ্চি মাপের কাটার সাকশন ড্রেজারের জন্য। এজন্য ব্যয় হবে এক হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। তবে এখানে শুধু ড্রেজার নয়, যুক্ত রয়েছে অন্যান্য সহায়ক যন্ত্রাংশও। চতুর্থ প্যাকেজে নদীর তলদেশ থেকে পলিথিন এবং বর্জ্য উত্তোলনের জন্য দেশে প্রথমবারের মতো ক্রয় করা হচ্ছে গ্র্যাব ড্রেজার। এতে ব্যয় হবে ২০০ কোটি টাকা।
আশা করি, দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে ড্রেজারসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ আমরা হাতে পাব। অত্যাধুনিক এসব ড্রেজার ও যন্ত্রাংশ যোগ হলে নৌপথের নাব্যতা ফেরানোর কাজে আরও গতি আসবে।
নদীর তীর দখল বহুদিনের পুরনো সমস্যা। এর ফলে নদীগুলো স্বাভাবিক গতিতে প্রবাহিত হতে পারছে না। সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে আপনার উদ্যোগ কী?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: নদী সবাই ব্যবহার করবে। কিন্তু কেউ দখল করতে পারবে না। নদীকে আমরা এভাবেই দেখতে চাই। সে লক্ষ্যে দখলদাররা যত ক্ষমতাধরই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিনি। তাদের দখলদারিত্ব থেকে নদীকে মুক্ত করেছি। প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ নদীতীর দখলমুক্ত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
নদীতীরের প্রায় ৯০ ভাগ আমরা দখলমুক্ত করতে পেরেছি। দখলমুক্ত করেই দায়িত্ব শেষ করিনি। উদ্ধার করা নদীতীর আবার যাতে বেদখল না হয়, সেজন্য সীমানা পিলার, পাকা দেয়াল এবং ওয়াকওয়ের কাজ চলমান রয়েছে। ঢাকার চারদিকে নদীতীরের ভূমি দখলমুক্ত রাখতে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ব্যাংক প্রটেকশনসহ ২০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে এরই মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এ সংক্রান্ত প্রকল্পের কাজের কলেবর বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পনা কমিশনে সংশোধিত প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। সেটি অনুমোদিত হলে নদীতীরের কাজগুলো আরও বেশি টেকসই হবে। ২০২৩/২০২৪ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
একটা সময় নৌপথে দুর্ঘটনা বিশেষ করে যাত্রীবাহী লঞ্চডুবি প্রায় নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাম্প্র্রতিক কয়েক বছরে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমেছে। কিন্তু আপনার মন্ত্রণালয় এটাকে শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসতে চায়। এর জন্য কী কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: নদীমাতৃক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৌপথের গুরুত্ব অপরিসীম। এই নৌপথকে নিরাপদ করতে অর্থাৎ নৌ-দুর্ঘটনা হ্রাস ও নৌ-নিরাপত্তা জোরদারে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এসবের ফলও পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে নৌ-দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা একে শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনতে চাই।
দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজ জোরদার করতে ২৫০ টন উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন ‘নির্ভীক’ ও ‘প্রত্যয়’ নামে দু’টি উদ্ধারকারী জাহাজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফেরি যাতে ওভারলোডেড না হয়, সেজন্য ৫৫ বছর পর ট্রাকের মালামাল পরিমাপের জন্য এ পর্যন্ত ছয়টি ওয়ে ব্রিজ স্থাপন করা হয়েছে। ফেরি ও নৌযানের অবস্থান পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে ৪০টি নৌযানে ভেসেল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে।
নদীর মধ্যেই যত্রতত্র নৌযান রেখে মেরামতের কারণে নদীর চ্যানেল সরু হয়ে যাওয়াও দুর্ঘটনার একটি কারণ। তাই বুড়িগঙ্গা চ্যানেল মুক্ত করার বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযানের ফলে বুড়িগঙ্গা চওড়া হবে এবং নৌ-দুর্ঘটনা কমে আসবে।
নৌপথে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ফিটনেসবিহীন নৌযান বিশেষ করে লঞ্চ যাতে নদীতে না চলতে পারে বিআইডব্লিউটিএ সেটি কঠোরভাবে তদারক করছে। লঞ্চগুলো যাতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিতে না পারে, সে ব্যাপারেও নজরদারি করা হচ্ছে। সময়োপযোগী ও কার্যকর এসব উদ্যোগের ফলে নৌ-দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
শুধু দখল নয়, দূষণও নদী ও জলজপ্রাণির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন শিল্পকারখানা নদী দূষণে বড় ভূমিকা রাখছে। দূষণ রোধে কতটা কঠোর সরকার?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: নদীর পানি দূষণমুক্ত রাখার বিষয়টি সরকার গভীরভাবে অনুভব করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই দূষণমুক্ত নদীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি অনুভব করেন। আর এ কারণেই আমরা মনে করি, দখল ও দূষণমুক্ত করে নদীকে চিরচেনা স্রোতস্বিনী রূপে ফিরিয়ে আনতে পারব। নদীর পানি দূষণমুক্ত করতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। কীভাবে নদীকে দূষণমুক্ত করা যায় তা নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে রাতারাতি তা সম্ভব নয়। কারণ দীর্ঘদিনের একটা অন্ধকার আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে আছে।
নদীগুলো দূষণমুক্ত করতে মাস্টারপ্ল্যানের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং অধীনস্থ সিটি করপোরেশন, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে কাজ করছে। আমরা নদী দখলমুক্ত করে সীমানাও চিহ্নিত করতে পেরেছি, এখন মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পারলে নদীর পরিবেশও রক্ষা করতে পারব।
বাসযোগ্য রাজধানীর জন্য ঢাকার খালগুলোর গুরুত্বও কম নয়। কিন্তু এর অধিকাংশই হয় দখল, নয় দূষণ অথবা ভরাট হয়ে গেছে। খালগুলো পুনরুদ্ধারে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: ঢাকার ভেতরের খালগুলো যেহেতু নদীগুলোর সঙ্গে যুক্ত তাই সেগুলোও মাস্টারপ্ল্যানের মধ্যে চলে আসবে। গত দেড় বছরে ওয়াসা এবং সিটি করপোরেশনের সাথে আমাদের টাস্কফোর্সের সভা হয়েছে। কিন্তু সবসময় পূর্ণ সহযোগিতা আমরা পাইনি। তবে এখন নবনির্বাচিত মেয়র ফজলে নূর তাপস খাল উদ্ধারে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। এতে খাল উদ্ধারের ব্যাপারে আমরা আশাবা
দী। এই কাজে বিআইডব্লিউটিএ বা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যেকোনো ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন হলে আমরা তা দিতে রাজি। আমরা যদি এই অবস্থানগুলো ধরে রাখতে পারি, তাহলে আমি মনে করি ঢাকার চারপাশের খালগুলো আমরা দখলমুক্ত করতে পারব।
অতীতে বিভিন্ন সরকার ঢাকার খালগুলো বন্ধ করে কালভার্ট করে দিয়েছে। যেটা ঢাকার জন্য দুর্যোগের একটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি আমরা এই খালগুলোকে সংরক্ষণ করে এর প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারতাম, তাহলে ঢাকার ভিতর দিয়েও নৌযান চলা সম্ভব ছিল। এখনও যদি আমরা মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে শুধু ঢাকার চারপাশে নয়, ঢাকার ভিতর দিয়েও ছোট ছোট নৌযান চলার সুযোগ আছে। সেই লক্ষ্যেই আমরা সমন্বিত কাজ করব।
প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে নৌ-যোগাযোগ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। নৌপথকে এ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে কীভাবে আরও দক্ষতার সাথে কাজে লাগানো যায়?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে পিপলস টু পিপলস রিলেশনে নৌ-যোগাযোগ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ব্রিটিশ ভারতের সময় ছিলও তাই। সেই সময় আসামের উঁচু ও নিচু অংশ এবং ত্রিপুরা, মেঘালয়ের সাথে কলকাতা বন্দরের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল স্টিমার। ১৮৪০ সালের দিকে এই স্টিমার সার্ভিস চালু হয়। তখন আসাম থেকে গোয়ালন্দ ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পশ্চিম তীরে স্টিমারে এবং সেখান থেকে রেলে কলকাতা যেতে হতো। রণদাপ্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য বেঙ্গল রিভার সার্ভিস’ ১৯৩৩ সালের দি
কে নৌপথে সংযুক্ত হয়। তবে এখন পর্যটক ছাড়া আসাম থেকে দীর্ঘ সময় নিয়ে কেউ আর কলকাতা যাবেন না। তাই পর্যটক আকৃষ্ট করতে এবং পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতেই উভয় দেশের পক্ষ থেকে ২০১৯ সালে আসাম থেকে কলকাতা যাত্রীবাহী ক্রুজ ভেসেল চালু করা হয়। এতে উভয় দেশের পর্যটন খাত আরও সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং দু-দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় পণ্য বাণিজ্যেরও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হওয়ার সুযোগ রয়েছে নৌপথের। এতে খরচও সাশ্রয় হবে। পণ্য পরিবহন সাশ্রয়ী করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: পণ্য পরিবহনে নৌপথে খরচ হয় সবচেয়ে কম। সেটা বিবেচনা করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীনের পর পরই ১৯৭২ সালে দুই দেশ নৌ-প্রটোকল চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নতির শিখরে পৌঁছলেও, ৭৫ সালের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর তা ব্যাহত হয়। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সম্পর্ক উন্নয়নে উভয় দেশ কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত নৌ-প্রটোকলে আগের ছয়টি ‘পোর্টস অব কল’ এর সাথে আরও পাঁচটি করে নতুন ‘পোর্টস অব কল’, দু’টি করে এক্সটেন্ডেড ‘পোর্টস অব কল’ এবং আগের আটটি নৌ-প্রটোকল রুটের সাথে দাউদকান্দি-সোনামুড়া ও সোনামুড়া-দাউদকান্দি রুট দু’টি সংযোজিত হয়েছে।
অতিবৃষ্টির সময় বন্যার অন্যতম কারণ পলি জমে নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া। অভিন্ন নদ-নদীর ক্ষেত্রেও এটা সমানভাবে প্রযোজ্য। অভিন্ন নদ-নদী ড্রেজিং করে বন্যা সমস্যার সমাধান কতখানি সম্ভব?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদী প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু যেসব নদ-নদী দিয়ে একসময় স্টিমার চলাচল করতো পলি পড়ে এখন শুষ্ক মৌসুমে ছোট জাহাজও চলতে পারে না। বর্তমানে প্রটোকল চুক্তির আওতায় আমরা যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র এবং কুশিয়ারা নদীর ড্রেজিংয়ের কাজ করছি। ড্রেজিংয়ের খরচ ৮০ ভাগ ভারত এবং ২০ ভাগ বাংলাদেশ বহন করছে। এছাড়া আত্রাই নদী বাংলাদেশের দিনাজপুর থেকে ভারতের মধ্যে ৪০ কিলোমিটার ঘুরে আবার বাংলাদেশের নওগাঁয় এসে মিলিত হয়েছে। আমরা এ নদীটিতেও ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা করছি। শুধু জাহাজ চলাচলের জন্য নয়, উভয় দেশের মধ্যে বহমান নদ-নদী ড্রেজিং করতে পারলে অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যা ও নদীভাঙনের হাত থেকেও আমরা রক্ষা পাব। এজন্য উঁচু ও নিচু উভয় অংশের ড্রেজিং করতে হবে।
ভারত বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করছে। একইভাবে বাংলাদেশ কিভাবে ভারতের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে পারে?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: ভারত বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার বিনিময়ে আমাদেরকেও হলদিয়া ও মুম্বাই বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে আমরা সিঙ্গাপুরে মাদার ভেসেলে পণ্য এনে সেখান থেকে একটু ছোট জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরে আনি। যতদিন না আমাদের নির্মিতব্য মাতারবাড়ী বন্দর বা বে টার্মিনালে বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ছে, ততদিন পর্যন্ত, প্রয়োজনে আমরা ভারতের বন্দরও ব্যবহার করতে পারব। এতে পণ্য পরিবহনে খরচ আরও কমবে বলে আশা করি।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্বজুড়েই নৌ-পরিবহন সেবায় নতুন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। নৌপথে চলাচলের জন্য আমাদের দেশে আমরা কি এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছি?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: করোনাভাইরাস মহামারি সমগ্র বিশ্বকেই ভিন্ন এক বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এটা অস্বাভাবিক একটা সময়। মহামারির বিস্তার রোধে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও যাত্রী চলাচল সীমিত করে দিতে হয়। যাত্রী পরিবহন বন্ধ করা সম্ভব হলেও পণ্যের ক্ষেত্রে সে সুযোগটা নেই। তাই মহামারির শুরু থেকেই নৌপথে পণ্য পরিবহন আমরা শুরু থেকেই সচল রেখেছি। বলতে গেলে অন্য সময়ের চেয়ে বেড়েছে। তবে নৌপথ সচল রাখতে গিয়ে আমরা স্বাস্থ্যবিধিতে ছাড় দিইনি। এজন্য আমরা কার্গো ভেসেল মালিক সমিতির প্রতিনিধিদের সাথে সভা করেছি। শ্রমিকদের জীবন যাতে ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সে ব্যাপারে ভেসেল মালিকদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি। তারা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি দেখার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আমরাও মালিকদের বিষয়টি দেখব বলে জানিয়েছি।
কোভিড-১৯ যাতে ভয়াবহ মাত্রা না পায় সে লক্ষ্যে মহামারির শুরু থেকেই আমরা নৌপথে মানুষের যাতায়াত সীমিত করার অনুরোধ জানিয়েছি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণসহ সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে গেছে। পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাওয়ায় নৌপথে যাত্রী চলাচল পুরো মাত্রায় শুরু হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রে আমরা আগের অবস্থানেই আছি। যাত্রীরা যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নৌ ভ্রমণ করেন সে বিষয়টিতে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে।
নদী ব্যবহারে যতœবান হওয়ার দায়ভার তো জনগণেরও। তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আপনার কি কোনো পরিকল্পনা আছে?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: নদী সবার। সবাই তা ব্যবহার করতে পারবে। নদী রক্ষার দায়িত্বও তাই সবার। নদী ব্যবহারে সবাইকে যতœবান হতে হবে। তা না হলে সরকারের একার পক্ষে নদীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তারপরও নদীর দখল-দূষণ বন্ধে সরকার সম্ভাব্য সব কিছুই করছে ও আগামীতেও করবে। জনগণের সহযোগিতায় ঢাকার আশপাশের নদীগুলো দখলমুক্ত করা হয়েছে। এগুলো যাতে আবার বেদখল হয়ে না যায় সেজন্য জনগণকে সচেতন হতে হবে। নদী দূষণের অন্যতম কারণ শিল্পবর্জ্য। অর্থনীতির স্বার্থে শিল্পের প্রয়োজন। শিল্পের জন্য আবার নদীরও প্রয়োজন। তাই নদীকে বাঁচিয়ে রেখে কিভাবে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করা যায় শিল্পোদ্যোক্তাদেরও সেটি ভাবতে হবে। সব কিছুর জন্যই সচেতনতা ও দায়বদ্ধতা। সেটিই আমরা করছি। আগামীতেও করে যাব।
নৌপথে যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এবং পরিধি সম্প্রসারণে আপনারা কি নতুন কিছু ভাবছেন?
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: নৌপথে যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নাব্যতা সংকট একটি বড় বাধা। সেদিকটাতেই বেশি জোর দিচ্ছি আমরা। নৌপথের নাব্যতা ফেরাতে অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। পাইপলাইনেও আছে এ সংক্রান্ত একাধিক প্রকল্প। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে তৃতীয় শ্রেণির অনেক নৌরুট দ্বিতীয় শ্রেণিতে আবার চতুর্থ শ্রেণির অনেক নৌরুটকে তৃতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করতে চাই, যাতে নৌপথে যোগাযোগের পরিধি সম্প্রসারিত হয়। সবমিলিয়ে ২০২৪ সালের মধ্যে আমরা ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালু করতে পারব বলে আশাবাদী।
অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর কর্মপরিধি ব্যাপক। তাদের কার্যক্রম কতটা সন্তুষ্ট করতে পারছে আপনাকে।
খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী: দখলমুক্ত নদীতে নিরাপদ নৌ চলাচল নিশ্চিত করতে যা যা করণীয় তার সবই করছে বিআইডব্লিউটিএ। নৌপথের নাব্যতা ফেরানোর পাশাপাশি নদীতীরের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদেও বিআইডব্লিউটিএ’র কার্যক্রম প্রশংসনীয়। সংস্থাটির কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে, কার্যক্রমের এই ধারা যেন তারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখে। মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে এজন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা বিআইডব্লিউটিএ’র প্রতি থাকবে।