জন্ম টুঙ্গিপাড়ায়; বাইগার নদী ছুঁয়ে যাওয়া ছবির মতো গ্রামে। শৈশবে নদীর বুকে পাল উড়ানো নৌকা দেখা, মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান শোনা। তাল, তমাল আর হিজল বনে পাখির ডাকে মুগ্ধ হওয়া। নদীর প্রবহমানতা ও বিশালতাকে ধারণ করে নদীর মতোই মহানুভব এক মানুষ হয়ে ওঠা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৭ মার্চ ছিল তার শততম জন্মবার্ষিকী।
গোপালগঞ্জ তখন ফরিদপুর জেলার একটি মহকুমা। টুঙ্গিপাড়া এই মহকুমারই ছবির মতো একটি গ্রাম। মধুমতীর শাখা বাইগার নদী এই টুঙ্গিপাড়াকে সে ছুঁয়ে গেছে পরম মমতায়। নদীতে তখন পাল উড়ানো অগুনতি নৌকার যাতায়াত। বৈঠা হাতে মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান। তাল, তমাল আর হিজলে বোনা ঘন অরণ্যে পাখির কলরব। গাছের ছায়ায়, নদীর কলতানে ভরা স্নিগ্ধ পরিবেশের এই টুঙ্গিপাড়াতেই আবির্ভাব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯২১ সালের ১৭ মার্চ।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে জন্মস্থানের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- আমার জন্ম হয় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। আমার ইউনিয়ন হলো ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ অঞ্চলের সর্বশেষ ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের পাশেই মধুমতী নদী। মধুমতী খুলনা ও ফরিদপুর জেলাকে ভাগ করে রেখেছে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: পৃষ্ঠা ১)।
শেখ বংশে জন্ম নেওয়া বঙ্গবন্ধুর শৈশব কেটেছে এই টুঙ্গিপাড়াতেই, নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে, বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ মধুমতীর তীরেই এই শেখ বংশের গোড়াপত্তন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সে সম্পর্কে লিখেছেন-‘শেখ বোরহানউদ্দিন কোথা থেকে কিভাবে এই মধুমতীর তীরে এসে বসবাস করেছিলেন কেউই তা বলতে পারে না। আমাদের বাড়ির দালানগুলোর বয়স দুইশ বছরের বেশি হবে। শেখ বোরহানউদ্দিনের পরে তিন-চার পুরুষের কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে শেখ বোরহানউদ্দিনের ছেলের ছেলে অথবা দুই/এক পুরুষ পরে দুই ভাইয়ের ইতিহাস পাওয়া যায়। এঁদের সম্পর্র্কে অনেক গল্প আজও শোনা যায়। এক ভাইয়ের নাম শেখ কুদরতউল্লাহ, আর এক ভাইয়ের নাম শেখ একরামউল্লাহ। আমরা এখন যারা আছি তারা এই দুই ভাইয়ের বংশধর। এই দুই ভাইয়ের সময়েও শেখ বংশ যথেষ্ট অর্থ ও সম্পদের অধিকারী ছিল। জমিদারির সাথে সাথে তাদের বিরাট ব্যবসাও ছিল।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: পৃষ্ঠা ৩)।
সেকালে শেখদের এই যে বিরাট ব্যবসা ও ঐশ্বর্য সেখানেও নদী-নৌকাই আশীর্বাদ। বঙ্গবন্ধুর বয়ানে-‘শেখদের নৌকার বহর ছিল। সেই সব নৌকা মাল নিয়ে কলকাতায় যেত।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: পৃষ্ঠা ৩)।
বাইগার-মধুমতীর জল-হাওয়ায় বড় হতে হতে নদীর যান নৌকার সাথে বঙ্গবন্ধুর নিবিড় এক সম্পর্কও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তার নিদর্শন আমরা দেখতে পাই ১৯৫২ সালে তাঁর চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতায়। সেখানে বঙ্গবন্ধু তাঁর নৌকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা বয়ান করেছেন এভাবে-‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নৌকায় উঠলাম। ছোট্ট ছোট্ট নৌকা, দু’জনে বৈঠা বায় দাঁড় টানার মতো করে। মেয়েরাই নৌকা চালায় এদেশে।’ ‘আমার দেখা নয়াচীন: পৃষ্ঠা ৮০)।
নৌকাগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘আমাদের জন্য চারখানা নৌকা ঠিক হলো। নৌকার ভিতরে চারজন করে বসতে পারে। মোটরগাড়ির মতো গদি দেওয়া বসবার জায়গা। আমাদের সাথে চা, ফল-ফলাদি কিছু নেওয়া হয়েছিল। নৌকা ছাড়া হলো। আমাদের মধ্যে অনেকে নৌকা বাইবার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। অনেকে চেষ্টা করলো দাঁড় টানতে, হাল ধরতে, কেউই ঠিকমতো নৌকা বাইতে পারে না। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, তোমরা বালুর দেশের লোক, নৌকা বাইবা কী করে? ঘোড়া দাবড়াতে পারো।” (আমার দেখা নয়াচীন: পৃষ্ঠা ৮০)।
পানির দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু এরপর নিজেই দাঁড়ে হাত লাগিয়েছিলেন-‘আমার নৌকায় সামনের যে দাঁড় ছিল, প্রথমে আমি দাঁড়টা টানতে শুরু করলাম। কার নৌকা আগে যায় দেখা যাবে! কেউই পারে না, কারণ আমি পাকা মাঝি, বড় বড় নৌকার হাল আমি ধরতে পারি। দাঁড় টানতে, লগি মারতে সবই পারি। পরে আবার হাল ধরলাম। পাকা হালিয়াÑযারা আমাদের নৌকার মাঝি তারা তো দেখে অবাক! এ আবার কোন দেশের লোক! এক মাঝি জিজ্ঞাসা করলো, আপনাদের বাড়ি কোন দেশে? দোভাষী সাথে ছিল, বললাম, পূর্ব পাকিস্তান। মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মনে হলো কোনোদিন নামও বোধ হয় শোনে নাই, তাকে বুঝাইয়া বললাম, তারপর সে বুঝলো। তাকে বললাম, আমাদের পানির দেশ, বৎসরে ৬ মাস আমরা পানির মধ্যে থাকি।’ (আমার দেখা নয়াচীন: পৃষ্ঠা ৮০)।
নদী নিজে সুন্দর, সুন্দরের নির্মাতা; তা সে এই বাংলার পদ্মা-মেঘনা হোক বা সুদুর চীন দেশের কোনো অঞ্চলকে ঋদ্ধ করে ছুটে চলা নদীই হোক। সব নদীর মধ্যেই ধ্বনি-ছন্দে, তালে-মাত্রায় কোথায় যেন একটা মিল আছে। তাই তো সাংহাই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটিও বঙ্গবন্ধুর চোখে ধরা দিয়েছে সমান সৌন্দর্য ও গুরুত্ব নিয়ে-‘এক ঘণ্টা পরে আবার বেরিয়ে পড়লাম সাংহাই শহরের পাশে যে নদী বয়ে গেছে তা দেখবার জন্য। আমাদের দেশের মতোই নৌকা, লঞ্চ চলছে এদিক ওদিক। নৌকা বাদাম দিয়ে চলে।’ (আমার দেখা নয়াচীন: পৃষ্ঠা ৭৬)।
আর এই বাংলার নদ-নদীর ঢেউয়ের ভাষাও যেন বুঝতে পারতেন জাতির পিতা। নদীর বুকে ভাটিয়ালি গানের সুর ঢেউয়ের সাথে মিলেমিশে যে অদ্ভুত এক অনুরণন তোলে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার কৃৃষ্ণনগরে নৌযাত্রার সময় তা খুব করে অনুভব করেছিলেন তিনি। সেই বর্ণনা ধরা আছে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতায়। কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের দ্বারোদ্ঘাটন অনুষ্ঠান শেষে নৌকায় করে ফিরছিলেন বঙ্গবন্ধু। সাথে ছিলেন বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহমেদ। জাতির পিতার বয়ানে-‘পরের দিন নৌকায় আমরা রওয়ানা করলাম, আশুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল নদীর ঢেউগুলোও যেন তার গান শুনছে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: পৃষ্ঠা ১১১)।
বঙ্গবন্ধুর মানস গঠনে নদীর ভূমিকা অপরিসীম। নদীর বহমানতা ও বিশালতা নিজের মধ্যে ধারণ করে তিনি নিজেও হয়েছিলেন মহানুভব এক মানুষ। বাংলার মানুষকে তিনি ভালোবেসেছিলেন নদীর মতোই। নদীপাড়ের মানুষগুলোও তাকের স্থান দিয়েছিলেন হৃদয়ের খুব গভীরে। নদীর বুকে ডাকাতি যার পেশা, তার কাছেও তিনি ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয়, পূজনীয়। সেই নিদর্শন আমরা দেখতে পাই কোনো এক রাতে তার মধুমতী পাড়ি দেওয়ার সময়।
‘আমরা দুইজন রাত দশটায় একটা এক মাঝির নৌকায় রওয়ানা করলাম। নৌকা ছোট্ট, একজন মাঝি। মধুমতী দিয়ে রওয়ানা করলাম। কারণ, তাঁর (মাওলানা শামসুল হক) বাড়ি মধুমতীর পাড়ে। মধুমতীর একদিকে ফরিদপুর, অন্যদিকে যশোর ও খুলনা জেলা। নদীটি এক জায়গায় খুব চওড়া। মাঝে মাঝে, সেই জায়গায় ডাকাতি হয়, আমাদের জানা ছিল। ঠিক যখন আমাদের নৌকা সেই জায়গায় এসে হাজির হয়েছিল, আমি তখন ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পানির দেশের মানুষ নৌকায় ঘুমাতে কোনো কষ্ট হয় না। কাজী সাহেব তখনও ঘুমান নাই। এই সময় একটা ছিপ নৌকা আমাদের নৌকার কাছে এসে হাজির হল। চারজন লোক নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করল, আগুন আছে কি না? আগুন চেয়েই এই ডাকাতরা নৌকার কাছে আসে, এই তাদের পন্থা। আমাদের নৌকার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “নৌকা যাবে কোথায়?” মাঝি বলল, টুঙ্গিপাড়া, আমার গ্রামের নাম। নৌকায় কে? মাঝি আমার নাম বলল। ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে ভীষণভাবে একটা আঘাত করে বলল, “শালা আগে বলতে পার নাই শেখ সাহেব নৌকায়।” এই কথা বলে নৌকা ছেড়ে দিয়ে তারা চলে গেল।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: পৃষ্ঠা ১২৫)।
নদী যেমন সৃষ্টি, একই সাথে সে স্রষ্টাও। এর গতিতে যেমন গড়ার মন্ত্র, তেমনি থাকে ধ্বংসের বীজও। তাকে জেনে-বুঝে বশে আনতে পারলেই সে হয়ে ওঠে সমৃদ্ধির আকর। চীন সফরে গিয়ে চীনের দুঃখ হোয়াংহো নদীকেও এই রূপেই দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঁধ দিয়ে হোয়াংহোকে কীভাবে চীনারা কৃষি উৎপাদনে কাজে লাগিয়েছিলেন গভীরভাবে তা উপলব্ধি করেছিলেন। প্রত্যক্ষ করেছিলেন নদী-খাল সংস্কারের সুফলও। সেই অভিজ্ঞতা জাতীর পিতা বিবৃত করেছেন তার চীন সফরের স্মৃতিকথায়।
‘সরকার জনগণের সাহায্য নিয়ে হাজামজা নদী, খাল কাটতে শুরু করেছে। প্রত্যেক বৎসর বন্যায় লক্ষ একর জমির ফসল পূর্বে নষ্ট হয়ে যেত; আজ আর সাধারণ বর্ষায় ফসল নষ্ট হতে পারে না। একমাত্র হোয়াংহো নদীতে বন্যায় বৎসরে লক্ষ লক্ষ একর ফসল নষ্ট হতো। সরকার হোয়াংহো নদীতে বাঁধ বাধবে বলে জনগণেকে ডাক দিলো। লক্ষ লক্ষ লোক পেটে খেয়ে সরকারকে সাহায্য করলো। হোয়াংহোকে বলা হয় চীনের দুঃখ। চীনারা আগে কোনোদিন এই বাঁধ বেধে রাখতে পারে নাই। কিন্তু বিপ্লবের পর দেশপ্রেম ও জতীয় সংহতির দৃঢ়তায় চীনারা অসাধ্য সাধন করেছে। এখন আর হোয়াংহো নদীতে বন্যা হতে পারে না। লোকের এখন আর চিন্তা করতে হয় না। আরামে বৎসরের পর তাদের পরিশ্রমের ফল তারা পায়।’ (আমার দেখা নয়াচীন: পৃষ্ঠা ৯১)।
এই সব অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুর নদীকেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। নদী নিয়ে তাঁর ভাবনা, পরিকল্পনা ও উদ্যোগের মধ্যে আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই। তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও উদ্যোগেই আমাদের নদী ও নৌপথ সমৃদ্ধ, বেগমান এবং পরিবেশবান্ধব হয়।
নদীর প্রবহমানতাকে সঙ্গী করে, নদীর বিশালত্বকে আধেয় করে জীবন কাটানো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের এবার শততম বর্ষ। একই সাথে স্বাধীনতারও সুবর্ণজয়ন্তী। বাঙালি জাতির এ মহান নেতার জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তাকে স্মরণে খামতি রাখা হয়নি। নদী ও নৌপথে বঙ্গবন্ধুর অবদান স্মরণ করে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশেষভাবে দিবসটি পালন করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষও (বিআইডব্লিউটিএ)।
বঙ্গবন্ধুকে স্মরণে মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিএ ভবনে জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন। পরে বিআইডব্লিউটিএ ভবনে ‘বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা, সাফল্য ও সাম্প্রতিক অর্জন’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের হৃদয়ে আছেন এবং থাকবেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধুকে আমরা হৃদয়ের মধ্যে ধারণ করেছি। বঙ্গবন্ধু আমাদের গর্বের এবং অহংকারের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন।’
তার কথায়, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছে বলেই বাংলাদেশ আজ আলোকবর্তিকা হিসেবে সমগ্র পৃথিবীতে জালজাল করে জালছে।’