বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার ওপর ভর করে, নগরায়ণের হাত ধরে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর ক্রমেই বড় হচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে স্থান থেকে স্থানে মানুষের গমনাগমন। ফলে জটিল হচ্ছে যানজট পরিস্থিতি, যা এড়িয়ে চলতে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ফেরি। উন্নয়নশীল হোক বা উন্নত- সব দেশের জলপথেই ফেরি খাত উল্লম্ফনের অপেক্ষায় আছে। সেই সাথে নকশা, ধরনে বদলেরও সময় এখন। বদল আসছেও। সামনের বছরগুলোতে যেসব ফেরি নির্মিত হবে সন্দেহাতীতভাবে তাতে গুরুত্ব পাবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, যার লক্ষ্য একটাই; যাত্রী কল্যাণ ও নিরাপত্তা। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে উন্নত প্রযুক্তির আশ্রয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে সর্বাধুনিক ফেরি নির্মাণের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একদল শিক্ষার্থীও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির নিরাপদ ফেরির নকশা তৈরির অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিইইয়র্কভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফেরি সেফটি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউএফএসএ) আয়োজিত ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ডিজাইন কম্পিটিশন ফর আ সেফ অ্যান্ড অ্যাফোর্ডেবল ফেরি, ২০২১’ শীর্ষক প্রতিযোগিতার জন্য নকশাটি করেন তারা।
প্রশ্ন হলো ঠিক কোন কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে নকশাটি করা হয়েছে? নকশার জন্য বেশ কিছু বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হয়েছে। প্রথমেই যে বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে তা হলো রোপ্যাক্স ফেরিটি অ্যামাজন নদীর মানাউস থেকে টেফে পর্যন্ত ২০ ঘণ্টা চলার উপযোগী হওয়ার শর্ত ছিল। এর যাত্রী ধারণক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল ৩০০ জন। শুধু যাত্রী বহন করলেই হবে না। বাধ্যবাধকতা ছিল ছোট যানবাহন, বাইসাইকেল ও কৃষিপণ্যও পরিবহনের সক্ষমতা থাকারও। সেই সাথে আউটডোরে ৩৫ শতাংশের মতো যাত্রীর জন্য হ্যামক জোনের বন্দোবস্ত রাখতে বলা হয়েছিল নকশায়।
২০২০ সালের প্রথম ভাগ থেকে শুরু হয়েছে কোভিড-১৯ মহামারি এবং ব্রাজিল সবচেয়ে বেশি মাত্রায় সংক্রমণের শিকার দেশগুলোর অন্যতম। নিরাপদ ফেরির নকশা তৈরির ক্ষেত্রে এ বিষয়কেও বিবেচনায় রাখার শর্ত দেওয়া হয়েছিল প্রতিযোগীদের। অর্থাৎ নকশায় এমন কোনো ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়েছিল, যাতে করে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হয়। আবশ্যিক হিসেবে ফেরির নকশায় সোলার প্যানেল, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা, হাইব্রিড প্রোপালশন ব্যবস্থা ও হাইড্রোফয়েল ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখার শর্ত তো ছিলই। সবশেষে কম জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনার শর্ত ছিল।
এসব মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে অ্যামাজন নদীতে চলার উপযোগী নিরাপদ নৌযানের নকশাটি করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির (বিএসএমআরএমইউ) শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত চার সদস্যের এই প্রতিযোগী দল। এটি একটি অ্যারো-ডাইনামিক নকশা এবং হাল ব্যবহার করা হয়েছে ইস্পাতের। উপরিকাঠামো হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম, যাতে করে ওজন কম হয়। নৌপথ অনাব্য কিনা এবং কোনো ধ্বংসাবশেষ থাকলে তা শনাক্তের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে মেরিন লিডার (লাইট ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং) প্রযুক্তি। কারণ, অ্যামাজন নদীতে নৌ চলাচলের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা স্বাভাবিক। আরও যেসব বিষয় নকশায় সন্নিবেশিত করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো সোলার প্যানেল স্থাপন, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা ও ইলেকট্র্রিক মসকিটো রিপিলেন্টের ব্যবস্থা। সেই সাথে রয়েছে অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস)।
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো ব্রাজিলেও নৌযানে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন নৈমিত্তিক ঘটনা। এতে নৌযানের দুর্ঘটনাও ঘটে নিয়মিত। ১৯৮১ সালে সংঘটিত সোবরাল সান্তোস টু ট্রাজেডির কথা এখনো জ¦লজ¦ল করছে। ওই দুর্ঘটনায় ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। বিষয়টি মাথায় রেখে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন বন্ধে নকশায় রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশনভিত্তিক (আরএফআইডি) প্রবেশদ্বারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। স্মরণকালের আরেকটি বড় নৌ দুর্ঘটনা হলো হেরাল্ড অব ফ্রি এন্টারপ্রাইজের ডুবে যাওয়া। ১৯৮৭ সালের ৬ মার্চ বেলজিয়ামের পোর্ট অব জিবরুগ ছেড়ে যাওয়ার পরপরই রোরো ফেরিটি ডুবে যায়। এতে প্রাণ হারান ১৯৩ জন যাত্রী ও ক্রু। এ বিষয়টিও নকশা তৈরির ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিয়েছেন প্রতিযোগীরা, যাতে বাও র্যাম্পটি পুরোপুরি লকড হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রধান ইঞ্জিন চালু না হয়। দক্ষভাবে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ফ্ল্যাট র্যাক, রেইল ও ট্রলির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দৈবাৎ নৌযানটি যদি দুর্ঘটনায় পড়ে তাহলে দ্রুত উদ্ধারকাজ নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক লাইফ বোট ও বহির্গমন পথ রয়েছে নকশায়। রয়েছে হট ওয়াটার ক্যানন, অ্যালার্ম ব্যবস্থা, দস্যুরা যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য সিঁড়িতে তালার ব্যবস্থা। এছাড়া রয়েছে চাইল্ড কেয়ার ও ইমার্জেন্সি মেডিকেল কক্ষ, হুইলচেয়ার ও শিশুবান্ধব ডেক এরিয়া। বসার স্থান ও হ্যামকগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যাতে নদীর দৃশ্য ভালোমতো উপভোগ করা যায়। সর্বোপরি কোভিডের কথা বিবেচনায় নিয়ে নৌযানে প্রবেশের আগে হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ ডিজইনফেকশন টানেলের পাশাপাশি সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে দুই আসনের মাঝখানে স্বচ্ছ পিভিসির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ঝুঁকিমুক্ত নৌযানের এই নকশা তৈরির স্বীকৃতি হিসেবে প্রতিযোগিতায় তৃতীয় পুরস্কার লাভ করেছে বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধিত্বকারী শিক্ষার্থীদের দলটি। এটা ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফেরি সেফটি অ্যাসোসিয়েশনের এ ধরনের প্রতিযোগিতার অষ্টম আসর। বাংলাদেশি প্রতিযোগী দলটির নেতৃত্ব দেন বুয়েটের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী রওনক সাহা নিলয়। দলের বাকি তিন সদস্য হলেন বুয়েটের পরমা রায় চৌধুরি ও মোহাম্মদ আবরার উদ্দিন এবং বিএসএমআরএমইউর শরিফুল ইসলাম। ফ্যাকাল্টি অ্যাডভাইজর হিসেবে ছিলেন বুয়েটের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবায়ের ইবনে আউয়াল এবং সিঙ্গাপুরের নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির মেরিন টেকনোলজির সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল হান্নান।