বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
17 C
Dhaka

বিআইডব্লিউটিএ নিয়মিত প্রকাশনা

রূপান্তরের ধারায় নেভিগেশন প্রযুক্তি

সমুদ্রেই হোক বা নদীতে- নৌযান চলাচলে নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা হয় সবার আগে। এজন্য সুস্পষ্ট দখল থাকতে হয় মৌলিক কিছু বিষয়ের ওপর। সব ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে নৌযান যাতে নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে গন্তব্যে নোঙর করতে পারে সেজন্য এর অবস্থান, অন্য নৌযানের তুলনায় গতি এবং সামনে কোনো প্রতিবন্ধক থাকলে সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকাটা জরুরি। মোদ্দা কথা, পজিশন, নেভিগেশন ও টাইমিং সংক্ষেপে পিএনটি হচ্ছে নিরাপদ ও দক্ষ নৌযান চলাচলের প্রধান শর্ত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পিএনটির উৎস কী? গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম (জিএনএসএস) বিশেষ করে জিপিএস এক্ষেত্রে প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। বোটমাস্টার অবস্থান-সম্পর্কিত একদম সুনির্দিষ্ট তথ্য কীভাবে পেতে পারেন তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। এসবই হচ্ছে রিভার ইনফরমেশন সার্ভিসেস (আরআইএস) ধারণাকে ভরকেন্দ্রে রেখে। নিরাপদ নেভিগেশনে প্রযুক্তিগত যেসব অর্জন তার প্রথমেই আছে ইলেকট্রনিক চার্ট ডিসপ্লে অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম (ইসিডিআইএস)। অভ্যন্তরীণ নৌপথে যদি যুতসই ভেসেল ট্র্যাকিং সিস্টেম উন্নয়ন করা যায়, তা হবে নৌযান ও শোর স্টেশনের মধ্যে ডেটা আদান-প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অস্ত্র। তবে নতুন ধরনের এই টেলিম্যাটিক অ্যাপ্লিকেশনের জন্য সবার আগে যেটা দরকার তা হলো ডিজিএনএসএস’র মতো যথাযথ রেডিও নেভিগেশন সিস্টেমের ব্যবহার। এর ফলে অবস্থানগত সর্বোচ্চ নির্ভুল তথ্য পাওয়া সম্ভব হবে, যা নিরাপদ নেভিগেশনের সুযোগ করে দেবে।

আরআইএস চালুর মধ্য দিয়ে গত কয়েক বছরে অভ্যন্তরীণ নৌপথ অনেক বেশি আধুনিক হয়েছে। উদ্ভাবনীমূলক তথ্য ও যোগাযোগ সেবা কাজে লাগিয়ে নৌপথ যেমন আগের চেয়ে নিরাপদ হয়েছে, একইভাবে দক্ষতাও অর্জন করেছে। আরআইএসের এই যে লক্ষ্য, তা বেশি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলো।

আরআইএস প্রযুক্তির প্রতিনিয়ত বিবর্তন হচ্ছে। বিবর্তনের এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী যে লক্ষ্য, তা হলো আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে অভ্যন্তরীণ নৌপথে দুর্ঘটনা ব্যাপক হারে কমিয়ে আনা। অভিজ্ঞতা বলে, নৌযানকে সবচেয়ে বিপদসংকুল করে তোলে নৌপথের সেই সব জায়গা যেখানে রিভার লক, সেতু, বার্থ ও বন্দরের মতো অবকাঠামো নির্মাণের ফলে ফেয়ারওয়ে সরু হয়ে এসেছে। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই মূলত বেশি কাজ হচ্ছে। দুর্ঘটনা এড়াতে কম দৃশ্যমানতার মধ্যেও বোটমাস্টার যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সেজন্য তাকে নেভিগেশন-সংক্রান্ত সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ করাই আগামী দিনের আরআইএসের উদ্দেশ্য।

বিদ্যমান প্রযুক্তি

নেভিগেশন প্রযুক্তিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অর্জন যে ইনল্যান্ড ইসিডিআইএস, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। দুটি মোডে কাজ করে সিস্টেমটি- ইনফরমেশন মোড ও নেভিগেশন মোড। ইসিডিআইএস নেভিগেশন মোডে যখন থাকে তখন তা জাহাজের নির্ভুল অবস্থান জানিয়ে দেয়। ইনফরমেশন মোডে রাডারের ছবি ছাড়াই চালক ইলেকট্র্রনিক চার্ট থেকে নৌপথ ও যাত্রা সম্পর্কিত তথ্য পেতে পারেন। বিদ্যমান পানির স্তরের তুলনায় গভীরতা, জাহাজের ড্রাফট এবং কী মাত্রায় সতর্কতা প্রয়োজন সে তথ্যও পাওয়া যায় ইলেকট্রনিক চার্ট থেকে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বোটমাস্টার সহজেই জানতে পারেন, কী পরিমাণ কার্গো জাহাজে তুলতে হবে।

আরেকটি অর্জনের কথা যদি বলতে হয় তাহলে অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস) আসবে সবার আগে। সি-বোর্ন রেডিও ডেটা সিস্টেমটি জাহাজের পরিচিতি, অবস্থান ও অন্যান্য ডেটা নিয়মিত বিরতিতে শোর স্টেশনের সাথে বিনিময় করে। এসব সুবিধার কথা বিবেচনা করে ইউরোপিয়ান আরআইএস প্লাটফরম, রিভা রাইন নেভিগেশন কমিশন ও দানিয়ুব কমিশন অভ্যন্তরীণ নৌপথের নেভিগেশনের জন্য এআইএসকে সবচেয়ে উপযোগী প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জার্মান ফেডারেল ওয়াটারওয়েজ অ্যান্ড শিপিং অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও (ডব্লিউএসভি) এআইএস নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে। এই নেটওয়ার্কের আওতায় আছে রাইন, মোসেলে, দানিয়ুব, মেইন এবং মেইন-দানিয়ুব চ্যানেল।

ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি

ইনল্যান্ড ইসিডিআইএস ও এআইএসের মতো প্রতিষ্ঠিত অ্যাপ্লিকেশনের পাশাপাশি নেভিগেশনকে আরো কীভাবে নিরাপদ করা যায়, সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প চলমান আছে। কন্ট্রোল অ্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্স সিস্টেমস টু এনহ্যান্স দ্য সেফটি অব নেভিগেশন ইন ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ বা লায়েসি এ রকমই একটি প্রকল্প। এর উদ্দেশ্য জাহাজ চালনায় মাস্টারকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি ইনল্যান্ড শিপিংকে আরো বেশি নিরাপদ ও দক্ষ করে তোলা। লক্ষ্যে পৌঁছতে লায়েসি সর্বশেষ জিএনএসএস ও ডেটা স্থানান্তর প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। প্রযুক্তিটি আবশ্যকীয় হয়ে ওঠে অভ্যন্তরীণ নৌপথে বড় কিছু দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

প্রকল্পটিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মূলত চারটি বিষয়ের ওপর-ব্রিজ অ্যাপ্রোচ ওয়ার্নিং সিস্টেম, গাইডেন্স অ্যাসিস্ট্যান্স, মুরিং অ্যাসিস্ট্যান্স ও কোনিং ডিসপ্লে। ব্রিজ অ্যাপ্রোচ ওয়ার্নিং সিস্টেম বোটমাস্টারের কাছে সময়মতো প্রয়োজনীয় সংকেত পাঠাবে। গাইডেন্স অ্যাসিস্ট্যান্স অবস্থানগত নির্ভুল তথ্য দিয়ে মাস্টারের ওপর চাপ কমাবে। ম্যানুভারিংয়ের সময় অন্য জাহাজ থেকে দূরত্বের সঠিক তথ্য জানাবে মুরিং অ্যাসিস্ট্যান্স। আর কোনিং ডিসপ্লে থেকে বোটমাস্টার গতি সম্পর্কে তথ্য পাবেন। জাহাজ চলাকালে গতির পরিবর্তন দরকার পড়লে কোনিং ডিসপ্লে থেকে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।

ভবিষ্যৎ নেভিগেশন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে নেভওয়াটও। ভেসেল হাল ও পার্শ্ববর্তী অবকাঠামোর মধ্যে দূরত্ব ঠিক কতখানি সেই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করতে চায় তারা। আদতে তা সত্যিকারের নেভিগেশন পরিস্থিতি সম্পর্কে বোটমাস্টারকে সম্যক ধারণা দেবে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ নৌপথের স্থাপনা যেমন রিভার লক, সেতু ও বার্থের সাথে যেকোনো ধরনের সংঘর্ষের ঝুঁকি কমিয়ে আনবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here