চার স্তরের প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রথম স্তরেই মুন্সিগঞ্জের ইছামতী ও নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার তীরে তিনটি জলদুর্গ নির্মাণ করেন মুঘল শাসকরা। এগুলোর অন্যতম হলো খিজিরপুর দুর্গ, বর্তমানে যা হাজীগঞ্জ দুর্গ নামেই বেশি পরিচিত। আকৃতিতে ছোট হলেও কৌশলগতভাবে দুর্গটির গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি।
ঢাকার শ্রী, সমৃদ্ধি সবই উৎকর্ষের চূড়ায় পৌঁছায় মুঘল আমলে। এই অঞ্চলের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে ওঠে ঢাকা। দক্ষিণ ভারতের ইউরোপীয় বণিকরাও ঢাকায় পাড়ি জমাতে থাকেন। ইংরেজদের পাশাপাশি জড়ো হতে থাকেন ডাচ, ফরাসি, আর্মেনিয়ান ও গ্রিক বণিকরাও। গড়ে তুলতে থাকেন নিজ নিজ বাণিজ্য কেন্দ্র।
সমৃদ্ধির খোঁজে ঢাকার ওপর ইউরোপীয় বণিকদের যেমন নজর ছিল, দৃষ্টি ছিল মগ ও পর্তুগিজ দস্যুদেরও। তারাও দস্যুতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে ঢাকাকে। এর একটি বর্ণনা পাওয়া যায় পর্তুগিজ মিশনারি ও পরিব্রাজক ফ্রে সেবাস্তিয়ান মানরিকের ১৬৪০ সালের ঢাকা ভ্রমণের স্মৃতিকথায়। যদিও সেটা ছিল তার ঢাকা আগমনেরও প্রায় এক যুগ আগে। আরাকানিজ-মগ রাজা জান্দ্রামাক্স (থ্রিরি থুধাম্মা) পর্তুগিজদের সহায়তায় মুঘল বাহিনীর কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ঢাকা আক্রমণ করেন। তিন দিন অবস্থান করে নগরীতে ব্যাপক লুটতরাজ চালানোর পাশাপাশি অগ্নিসংযোগ করেন। বিশাল মুঘল বাহিনীর ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়ে চতুর্থ দিন ঢাকা ছাড়েন মগ রাজা জান্দ্রমাক্স।
দস্যুদের এই আগ্রাসন থেকে ঢাকাকে রক্ষায় চারপাশে প্রাচীর নির্মাণের পথে হাঁটেননি মুঘলরা। যেমনটা দেখা যায় ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্যযুগীয় অন্যান্য নগরের বেলায়। কারণ, নদী ব্যবস্থা, খাল ও নিম্নভূমির মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবেই ঢাকা অনেকটা সুরক্ষিত ছিল। এই সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী রূপ দিতে মুঘলরা যে প্রতিরক্ষা কৌশল সাজিয়েছিলেন তাও ছিল এই নদী ব্যবস্থাকে ঘিরেই। চার স্তরের প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রথম স্তরেই মুন্সিগঞ্জের ইছামতী ও নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা পাড়ে তিনটি জলদুর্গ নির্মাণ করেন তারা। এগুলোর অন্যতম হলো খিজিরপুর দুর্গ, বর্তমানে যা হাজীগঞ্জ দুর্গ নামেই বেশি পরিচিত।
শীতলক্ষ্যার তীরে যে কারণে
প্রথম স্তরের নিরাপত্তা কৌশলের অংশ হিসেবে তিনটি জলদুর্গের মাধ্যমে একটি ত্রিভুজাকৃতির নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে মুঘলরা। এর কেন্দ্রে ছিল মুন্সিগঞ্জের ইদ্রাকপুর দুর্গ, যা কৌশলগতভাবে ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি নির্মাণ করা হয়েছিল পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুদের ঢাকায় আসার প্রধান রুট ইছামতীর পাড়ে। এছাড়া মুঘল নৌবাহিনীর প্রধান মীর-ই-বাহার আবুল হোসেনের অধীনে যে ২০০ জাহাজ ছিল তার সদর দপ্তরও ছিল এই দুর্গটি। ত্রিভুজাকৃতির নিরাপত্তা কৌশলের দ্বিতীয় জলদুর্গটি নির্মিত হয় জলদস্যুদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব প্রান্তে নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দায়।
মুঘলদের প্রথম স্তরের ত্রিভুজাকৃতির নিরাপত্তা কৌশলের সর্বশেষ স্থাপনাটি হচ্ছে হাজীগঞ্জ জলদুর্গ। আকৃতিতে ছোট হলেও কৌশলগতভাবে দুর্গটির গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। কারণ, এর অবস্থান ছিল শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার একেবারে সঙ্গমস্থলে। মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের প্রতিহত করতে তাই কৌশলগত বিবেচনায় হাজীগঞ্জ দুর্গের গুরুত্ব কম ছিল না।
নির্মাণকাল নিয়ে বিতর্ক
হাজীগঞ্জ জলদুর্গটি ঠিক কবে নির্মিত হয়েছে সে সম্পর্কিত কোনো তথ্য খোদাইকৃত আকারে পাওয়া যায়নি। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে তাই দুর্গটির নির্মাণকাল নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। খোদাইকৃত তথ্যপ্রমাণের অভাবে ঢাকা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিরক্ষা স্থাপনাটির নির্মাণকাল নিয়ে বিতর্কও তাই বহুদিনের।
হাসান, এম আর এ তায়েশ এবং এস ইউ আহমেদের মতো কতিপয় প্রত্নতাত্ত্বিক হাজিগঞ্জ জলদুর্গ নির্মাণের পুরো কৃতিত্ব দিয়েছেন মীর জুমলাকে। এক্ষেত্রে হাসানের মত হচ্ছে, মগ ও আরাকান দস্যুদের আগ্রাসন থেকে ঢাকাকে রক্ষার প্রয়োজনে মীর জুমলা দুর্গটি নির্মাণ করেন। একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন এস ইউ আহমেদ তার ঢাকার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গ্রন্থে। ঢাকার চারপাশে তিনটি জলদুর্গ নির্মাণের মধ্য দিয়ে দস্যুতা নির্মূলের ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়ায় বাংলার সুবেদার হিসেবে মীর জুমলার তিন বছর সময়কে (১৬৬০-১৬৬৩) তাই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে গ্রন্থটিতে।
তবে দুর্গটির নির্মাতা সম্পর্কে ঠিক এর বিপরীত মত দিয়েছেন এ এইচ দানী এবং এস এম তাইফুর। হাজীগঞ্জ দুর্গ নির্মাতার কৃতিত্ব মীর জুমলাকে দেওয়া ভুল বলে মন্তব্য করেছেন দুজনেই। দানীর মতে, দুর্গটি বরং নির্মিত হয় সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের ঠিক পরপরই। মির্জা নাথানের বাহরিস্তান-ই-গায়বিতেও এর খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। গ্রন্থটিতে মির্জা নাথান উল্লেখ করেছেন, খিজিরপুর সদর দপ্তরের বিশাল সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে তিনি শীতলক্ষ্যার তীরে ব্যাটেলমেন্টস গড়ে তুলেছিলেন। মুঘল শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা কতিপয় প্রভাবশালী বারো ভুঁইয়া ও স্থানীয় যোদ্ধারাও যে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা কেন্দ্র হিসেবে স্থানটি ব্যবহার করতেন সেটিও মির্জা নাথান তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে ধারণা করা যায়, ১৬১০ সালে রাজমহল থেকে বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরের আগে থেকেই খিজিরপুর কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাহরিস্তান-ই-গায়বিতে উল্লেখিত এই খিজিরপুরই আজকের হাজীগঞ্জ। এর অর্থ দাঁড়ায় হাজীগঞ্জ জলদুর্গের অবকাঠামো খিজিরপুরের মধ্যেই অবস্থিত এবং এসব অবকাঠামো নির্মিত হয় আরো খানিকটা পরের দিকে।
১৯২০-২১ সালে ডিপার্টমেন্ট অব আর্কিওলজি অ্যান্ড মিউজিয়াম নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ মৌজার যে সিএস ম্যাপ তৈরি করে সেখানেও হাজীগঞ্জ জলদুর্গ নির্মাণে মুঘলদের সম্পৃক্ততার একটা ধারণা পাওয়া যায়। ম্যাপে হাজীগঞ্জ দুর্গের জমির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২৫ একর। দুর্গের সীমানা প্রাচীরের যে আউটলাইন দেওয়া আছে তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সেখানে আরো বিস্তৃত জায়গা ছিল, যার মধ্যেই হাজীগঞ্জ দুর্গ পুনঃনির্মাণ করে মুঘলরা। তাইফুর একে উল্লেখ করেছেন খিজিরপুর বা খানপুর হিসেবে। এসব কিছুর পরও হাজীগঞ্জ জলদুর্গের নির্মাণকাল বা নির্মাতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা বেশ কঠিন। এজন্য আরো গবেষণার দাবি রাখে।